Wednesday, February 1, 2023

তোমারো অসীমে

 


||দোলা সেন||

 

তমারে হাবে জরুরি না থী –

সেই দুপুর থেকে শব্দগুলো মাথায় হাতুড়ির ঘা মেরে যাচ্ছে, মেরেই যাচ্ছে। ঘরের দাওয়ায় বসে রতন সকালবেলার দৃশ্যপট আর মালিকের ভাবলেশহীন মুখে উচ্চারিত শব্দগুলোকে নানান পারমুটেশন কম্বিনেশনে সাজিয়ে দেখে যাচ্ছে। বিকেল গড়িয়ে গেল, কিন্তু তার অর্থ কেমন যেন কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না। এমন নয় যে, সে গুজরাটি জানে না। নয় নয় করে তার দশ বছর কাটানো হয়ে গেল এই দেশে। আর আজ কিনা মালিক নির্বিকারভাবে উপদেশ দিল – ঘর পাছা যাও। 

 ঘরে ফিরে যাও? ঘর থাকলে কি আর.....

সেই পনেরো বছর বয়েসে ভবেশকাকার হাত ধরে সে এদেশে এসেছিল। ফেরা হয়নি। ফিরতই বা কার কাছে? কোনো এক সময়ে, এক গ্রামে, ছোট্ট দাওয়া সমেত একখানা মাটির ঘর ছিল। সেটাতে বহুদিন ছাদ ছাওয়া হয়নি, দেয়ালে পড়েনি মাটির প্রলেপ। বর্ষায় দেয়াল বেয়ে জল গড়িয়ে মেঝে দিয়ে বয়ে যায়। চাল থেকে হেথায় হোথায় টুপ টাপ জল পড়ে। মা-ব্যাটায় দুটো পিঁড়িতে বসে আধোঘুমে ঢোলে। বাবা তো সেই কবে মরে বেঁচেছে। বাবার মুখটা ভালো করে মনে পড়ে না রতনের। কিন্তু বাদলা রাতে হাওয়া দিলে, দেয়ালের থির থির কাঁপুনিটা সে বেশ মনে করতে পারে।

 

তবু দিন কেটে যাচ্ছিলমা এর বাড়ি ঢেঁকি ছেঁটে, ওর বাড়ির গোয়াল নিকিয়ে কোচড়ে করে মুড়ি বা দুমুঠো চাল নিয়ে আসত। পুকুরের ধারের শাক বা মেটে আলু সেদ্ধ করলে রাতের খাওয়াটা একরকম করে ঠিকই জুটে যেত। রতন এর ওর ক্ষেতে মজুর খাটত, অবসর সময়ে পুতুল গড়ে মাথায় করে বেচতে বেরোত। হাতের কাজ ভালো ছিল। তাই, মেলা লাগলে ভাতের সাথে তরকারিও মিলতো কখনো কখনো।

 

এই পুতুল ফেরি করতে গিয়েই তার ভবেশকাকার সঙ্গে আলাপভবেশ কাজ করত গুজরাটের ভারুচে এক সোনার দোকানে। ছুটিতে বাড়ি এসে মেয়েকে তামার তারের গয়না বানিয়ে দিচ্ছিল। মাথার বোঝা নামিয়ে মুগ্ধ  দৃষ্টিতে তাই দেখছিল রতন – আমারে শিখায়ে দিবে কাকা?

 

মজা পেয়েছিল ভবেশ। এ ছোকরা কি এটা খুব সহজ কাজ ভাবছে নাকি? হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল কায়দাটা। রতন একটু তার নিয়ে বাড়ি গিয়েছিল। দুদিন বাদে সঙ্কুচিতভাবে নমুনা পেশ করছিল গুরুর পায়ের কাছে। ভবেশ চমকে গিয়েছিল। খুঁত আছে, অজস্র খুঁত। কিন্তু দুবার দেখেই যে এতোটা পারে, শেখালে সে যে একজন বড় কারিগর হবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। জিজ্ঞাসা করেছিল – যাবি আমার সঙ্গে? কাজ শিখবি?

 বিমর্ষমুখে রতন মাথা নেড়েছিল – মাকে দেখবে কে? আমার কোত্থাও যাওয়া হবেনিকো।

 

অথচ, পরের বছরেই ভবেশের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল একটা ন্যাড়ামাথা ছেলে। সব পিছুটান তার শেষ হয়ে গেছে।একটা ছোট্ট পুটুলি ছাড়া সঙ্গে নেবার মতো কিছু নেই তার। ঘর বহু আগেই মহাজনের কাছে বাঁধা পড়েছিল। মা মারা যেতে শেষকাজের পয়সা ও উচ্ছেদের নোটিস একসাথেই পেল। আরও আগেই পেত হয়তো, নেহাত লোকটা সম্পর্কে পিসে, তাই এতোদিন থাকতে পেরেছে।

 

তার মানে মোদ্দা কথাটা হলো এই যে, ফিরে যাবার মতো কোনো ঘরদুয়ার রতনের নেই। সোনার বাজারে মন্দা চলার খবর কিছুদিন ধরেই বাজারে ভাসছিল। তা বলে এই হারে কর্মী ছাঁটাই হবে, সেটা রতন ভাবতে পারেনি। অবশ্য ভেবেও যে খুব লাভ হতো এমনটা নয়। তবে হলো যখন, তখন একটা অন্য উপায় ভাবতেই হবে। মাথা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো রতন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে। সকালের পর আর খাওয়া হয়নি। খিদেটা এখন জানান দিচ্ছে। দোকানে যেতে ইচ্ছে করল না। বরং পা চালিয়ে চলল নদীর বাড়ি। খবরটা দেওয়া দরকার। নদীর বাবার অনেক চেনাশোনা। হয়তো কিছু সাহায্যও করতে পারবে। নদীর সঙ্গে ওর সম্পর্কটা ওদের বাড়ির সবাই জানে। বাড়ি যেতেই ছুটে এলো নদী – চারদিকে কি সব শুনছি? তোমার খবর কি?

ম্লান হাসল রতন – সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি, এককাপ চা খাওয়াও।

নড়ল না নদী – তার মানে তোমারও চাকরি নেই?

মাথা নাড়ল রতননদীর মা এসে দাঁড়িয়েছে – চিন্তা করো না। তোমাকে হয়তো ওরা আবার ডাকবে।

আবারও হাসলো ছেলেটা। সকালে মালিকও বলেছে - জো জরুরি হোয়ি তো, আমে পাছা বোলাবিসু। দরকার হলে আবার ডাকব।

তার কানে দুজনের গলা একই রকম সুরে বাজল। রতন খিদেটা আর টের পাচ্ছে না। তবু বলল – কাকা আছে? নদীর গলায় আফশোষের ছোঁয়া –

-       পপ্পা বাড়ি নেই। আমি তোমার খবরটা পেয়েই পপ্পাকে জানিয়েছিলাম। এই মন্দার বাজারে তারও কিছু করার নেই বলল।

-       আমি কাল নদীকে নিয়ে বাপের বাড়ি যাব। দু’ একমাস পরে ফিরব। ততদিনে কিছু জোগাড় হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।

নদীর মা লেখাপড়া জানা মহিলা। কিছু না বলেও খুব স্পষ্টভাবে পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিতে পারেন। আর নদী? কাজ চলে গেলে এক কাপ চাও যে দেয় না, তার মন বুঝতে মানেবই লাগে না। রতন উঠে পড়ল।

 

বেরিয়ে এসে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে কখন যে নদীর ধারে এসে পড়েছে তা সে নিজেই জানেনা। অনেক দিনের পরিশ্রমে, যত্নে একটা পরিচয়, একটা সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। এক ধাক্কায় সে আবার সেই পনেরো বছরের ন্যাড়া মাথা ছেলেটার জায়গায় নিজেকে দেখতে পেল। এভাবেই কি বৃত্তপথে বার বার ফিরে যেতে হবে যেখান থেকে শুরু করেছিল, সেখানেই? শিকড়বিহীন এই জীবনের বোঝা আর কতোদিন টানবে রতন? তার একটা আশ্রয় চাই। সেটা কি রেবা মাঈয়ের কোলে পাওয়া যাবে? অন্ধকারে নর্মদার কালো জল কি তাকে সেই কথাই বলতে চায়? কেমন এক ঘোরে সে এগিয়ে যায়  বহতা নদীর দিকে। ঘাটের সিঁড়িতে পা রাখতেই পিছন থেকে কাঁধে একটা শক্ত হাত এসে পড়ল – রেবা মায়ের কোল খুঁজছিস নাকি? গম্ভীর, সকৌতুক হিন্দিতে উচ্চারিত কথা শুনে, রতন চমকে প্রায় জলেই পড়ে যাচ্ছিল। সাধুজী তাকে ধরে না রাখলে কি হতো বলা যায় না। আবারও হাসলেন সন্ন্যাসী। শীর্ণ ঋজু চেহারায় হাসিটা খুব উজ্জ্বল। রতনের চোখ আপনা থেকেই নত হয়ে গেল। সন্ন্যাসী কোমল গলায় বললেন – দাগা পেয়েছিস না রে? কিন্তু এভাবে মায়ের কোল পাওয়া যায় না যে।

-       তাহলে কিভাবে? - অনিচ্ছাসত্তেও প্রশ্নটা ছিটকে বেরিয়ে এল।

-       আমার সাথে যাবি? রেবা মাঈ তোর সব দুঃখ নিয়ে নেবে।

-       কোথায় যাবেন? আর আপনার সাথে যাবোই বা কেন?

-       যাব রেবা মায়ের পথ ধরে। গেলে আনন্দ পাবি, তাই যাবি। বিশ্বাস করার, কষ্ট করার, সাহস থাকলে চল।

কষ্ট? রতন নিজের মনেই একটা তিক্ত হাসি হাসে। কষ্টের ভয় তাকে আর কি দেখায় এই সন্ন্যাসী? কিন্তু তাঁর উপস্থিতিতে একটা শান্তির ছোঁয়া পাচ্ছে ও। তার তো কোনো পিছুটান নেই। তবু বলল – আপনি নর্মদা পরিক্রমার কথা বলছেন?

দুষ্টু শিশুর মতো হাসিতে ভরে গেল সন্ন্যাসীর মুখ – ঠিক বুঝেছিস। তোর বুদ্ধি আছে। যেতে পারবি সব ছেড়ে? তাহলে দুটো কাপড়, দুটো কম্বল, একটা ঘটি, থালা আর গেলাস, আর একটা ছাতা ঝোলায় ভরে কাল সকালেই চলে আয়। এখানে হরদাস বাবাজীর আশ্রম বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে। ভালো করে ভেবে সংকল্প করিস।

 

গুজরাটে থাকবে অথচ নর্মদা পরিক্রমার কথা শুনবে না, এমন হয় না। বড়ো কঠিন এই পরিক্রমার নিয়ম। সঞ্চয় করা যায় না। পথে যা মেলে তার উপরেই জীবন ধারণ।  রেবা  বা নর্মদা  যাই বলো না কেন, তাকে ডানদিকে রেখে উৎস অবধি গিয়ে সেখানে  মায়ের আরাধনা করে আবার ঘুরে অপর তট ধরে ফিরে আসতে হবে যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলে সেখানেই। সাধারণতঃ এই যাত্রা নর্মদার উৎস থেকে শুরু হয়। হরদাস শুরু করছেন মোহনা থেকে। উৎস থেকে সঙ্গমযাত্রা নাকি আগেই করেছেন। এবার তাই বিপরীতমুখী পথ। মোটামুটিভাবে বছর দেড়েকের ধাক্কা। আগে নাকি তিন বছর তিন মাস তেরোদিন লাগত। কে জানে, এনার কি পরিকল্পনা! তবে সে যাই হোক না কেন, তাতে তার কিই বা আসে যায়। এখানে তো তাকে প্রয়োজন নেই কারো। - তমারে হাবে জরুরি না থী –

*

পরদিন সকালে একটা পিঠের ব্যাগে জিনিস ভরে সে আশ্রমে হাজির হয়ে গেল। হরদাস বাবাজীর মুখ হাসিতে ভরে উঠল – আয় বেটা, আয়। আমারা কালই রওনা দেব। পরদিন সকালে যথাবিহিত পূজা সেরে ছ’জনের একটা ছোট দল ‘জয় রেবা মাঈয়া’ ধ্বনি দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু করল। এই পথে রেবা মাই তাদের আরাধ্যা। প্রথম কিছুদিন জনপদের ভিতর দিয়ে যাওয়া। অনেকেই দিয়ে যাচ্ছে ফল, দুধ আর কিছু খাবার। পরিক্রমাকারীদের খাওয়ালে পুণ্য সঞ্চয় হয়। রতনের বিশ্বাসের ভিত সাধারণ আর পাঁচটা মানুষের মতোই নড়বড়ে। কিন্তু জনমানসের এই বিশ্বাসভরা ভাবনাটা না থাকলে, পরিক্রমা করা নিতান্ত দুঃসাধ্য হতো সেটা সে স্বীকার করতে বাধ্য হলো। জনপদ পার হয়ে বনপথ। নর্মদার তীর ধরে চলা। কোথাও কোথাও দুর্গমতার জন্য নদী ছেড়ে একটু দূরে যেতে হচ্ছে। তবে দিনশেষে আবার রেবার তীরে ফিরে আসতেই হয়। পথের প্রান্তে অসংখ্য শিবমন্দির। তাতেই রাত্রিযাপন। সকালে স্নান,পুজো সেরে আবার পথচলা। পথ বড়ো কম নয়। রতন লক্ষ্য করল, সাধুদের পৌঁছানোর তাড়া নেই। পথের দুধারে সমস্ত দেবালয়ে পুজো দিতে দিতে তাঁরা ধীরে ধীরে চলেছেন। নর্মদা নদীতীরে শিবের আবাস। নর্মদার জলের নুড়িতে শিবলিঙ্গ। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা চলাটাই মুখ্য। পথে যখন গ্রাম মিলছে, জুটে যাচ্ছে খাবার আর আশ্রয়। আবার যেদিন লোকালয় থেকে দূরে, সেদিন বনের মধ্যে কোনো জীর্ণ শিবমন্দিরে ফলমূল খেয়ে রাত্রিবাস। কোথাও আবার ঘন বনে শ্বাপদের ভয়, দুর্গম রাস্তা। রতন দেখল সাধুদের কোনো উদ্বেগ নেই। সকল অবস্থায় তাঁরা প্রসন্ন। দিনে চলা। সন্ধ্যায় চলে শিবমাহাত্ম্য, নামগান, আলোচনা। এই চলার পথে, ধীরে ধীরে রতনও নিজের ভাবনা রেবা মায়ের উপর ছাড়তে শিখছে। আস্তে আস্তে সেও অভ্যস্ত হয়ে উঠছে এই জীবনযাপনে।

 চলতে চলতে, থামতে থামতে ভাঙছিল রতন, নতুন করে গড়েও উঠছিল বুঝি। পথের মাঝে, একবার যখন সে জ্বরে বেহুঁশ, তখন তার দায়িত্ব নেয় অচেনা এক পুরোহিত। তার কাছে, নাকি রেবা মায়ের কাছে তাকে রেখে এগিয়ে যায় হরদাসের দল। পাঁচদিন পরে জ্বর ছাড়ল যখন, তখন এই প্রথম একা হবার জন্য রতনের কোনো কষ্ট হলো না। একটু সবল হতেই নতুন দলের সঙ্গে এগিয়ে চলল। এমন সঙ্গী বদল এ পথে স্বাভাবিক ঘটনা। কতোদিন ধরে সে চলছে, রতন সে হিসেব করা ছেড়ে দিয়েছে কবেই। চলার পথের মাঝে  একসময় গ্রীষ্ম এলো, তারপর বর্ষাএই দুই সময়ে যাত্রা নিষেধ। রতনের দিন কাটে মন্দিরে, অথবা কোনো সাধুর আশ্রমে। মানুষের জন্য মানুষের এতো মায়া! অথচ কেমন এক নির্মোহও কাজ করে ভিতরে ভিতরে। যত দিন যাচ্ছে জীবনের নতুন নতুন দিক তার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হচ্ছে। রতন জানে না এই পরিক্রমার অর্থ জীবন পরিক্রমা। কিন্তু না জেনেও তার মধ্যে চারিয়ে যাচ্ছে এক নতুন বোধ। পথের সৌন্দর্য, পথের নেশা, পূজার্চনা, তার অন্তরের শক্তিকে বিকশিত করছিল। এই ভাবে চলতে চলতে এক সময় সে পৌঁছে যায় নর্মদাকুণ্ডে। নর্মদার উৎসমুখে।

 

রতন জানে না, তার মনে এতো আনন্দ হচ্ছে কেন? কোন আলোয় তার প্রাণের প্রদীপ এভাবে জ্বলে উঠল! সে সবার সঙ্গে মিশে, গলা খুলে, হর হর মহাদেও, জয় রেওয়া মাইয়া, বলে যতই ধ্বনি দিল, ততই তার মন এক অনস্বাদিত আনন্দে ভরে উঠল। সে পুজো করল, কাঁদলো, হাসলো – মনের ভার নিঃশেষে নামিয়ে দিয়ে এক আনন্দিত মন নিয়ে বার বার নর্মদাস্নানে শুদ্ধ হলো, পবিত্র হলো।

 

সে দিনের বেলায় দলের সঙ্গে, কখনো নতুন সঙ্গীর সঙ্গে, আসেপাশের মন্দির দেখে, পুজো করে।  সন্ধ্যায় ফিরে আসে নর্মদাকুণ্ডের কাছে। এখনে জলের তলায় থাকেন নর্মদেশ্বর শিব। সে শুধু ভাবে আর রোমাঞ্চিত হয়। এক অমোঘ আকর্ষণে সে যেন বাঁধা পড়েছে ওই জলবাসী দেবাদিদেবের সঙ্গে। তার মনে অখণ্ড শান্তি।  তবু একদিন সাথীদের ডাক আসে। পরিক্রমা শেষ হয়নি যে! এবার অন্য তট ধরে ফিরে যেতে হবে। ছেড়ে যেতে মন চায় না। তবু, রতন এখন জানে ভালোবাসার ধনকে আকাশ দিতে হয়। ভালোবাসা মানে শুধুই আঁকড়ে ধরা নয়।

*

সে আবার চলতে শুরু করে। আসার সময় যাওয়া হয়নি। এবার ফেরার পথে সে নর্মদার বুকের মধ্যে গজিয়ে ওঠা দ্বীপের মধ্যে ওমকারেশ্বর শিবমন্দির দর্শন এবং আরাধনা করবেই করবে। আবার চলা শুরু হয়, আবার সাথীবদল। অনেকেই শীতের জন্য যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব সমতলে নামতে চাইছে। রতন তাদের সঙ্গ ছেড়ে দেয়।  এখন সে অনেক স্বচ্ছন্দ, অনেক পরিণত। সে আপন তালে চলে। সঙ্গী ঠিক জুটে যায়।  এই পথ চলাতেই তার আনন্দ। চলার পথে অশক্ত কাউকে দেখলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। নির্জন মন্দিরে একা একা রাত কাটাতেও আজকাল তার ভয় করে না। সে যে একা নয়, আর একা হবে না কোনোদিন, কেমন করে যেন এই বোধের জন্ম হয়েছে তার মনে। তাই চলতে চলতে আবার যখন ভারুচে এসে যাত্রা সমাপ্ত করলো, তখন  রতন সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ। এখন তার নতুন নাম। কমল। পথচলতি এক সাধুর দেওয়া নাম। তিনি বলেছিলেন নর্মদা পরিক্রমণে নতুন মানুষের জন্ম হয়। তুই এখন রেবা মাঈয়ের পায়ের কমল।

*

সেই নতুন মানুষটি এখন জীবনযাপনের জন্য যে কোনো কাজ করতে পারে। উদ্বৃত্ত অংশ হাসিমুখে বিলিয়ে দিতে পারে, তার চেয়েও অসহায় মানুষজনের মাঝে। নিজেকে সে ছড়িয়ে দিয়েছে সবার মাঝে। এর মধ্যে সোনার বাজারের মন্দা কেটে গেছে। কমলের কাজের তাই অভাব নেই।

 

আর নদী? সেও এসেছিল বইকি! রতনের প্রতিষ্ঠার কথা শুনে সে আসবে না, তাও কি হয়! কিন্তু শত মানুষের মধ্যে প্রতিফলিত হওয়া কোন কমল যে তার সম্পূর্ণ একান্ত রতন – তা সে খুঁজে পায়নি। তাই সে ফিরে গেছে। কমল ভালোই আছে ।

দোলা সেন ||

No comments: