[১]
চৈত্রমাসের প্রথমেই পরপর দু-তিনদিন বৃষ্টি হয়ে গেল ঝমঝমিয়ে। শিলও পড়ল টুপটাপিয়ে। ভোররাতে বৃষ্টিভেজা হাওয়ায় শিরশিরে আমেজ ফিরে এলে, ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমকে চাদরে জড়িয়ে নিয়ে বউটি পাশ ফিরে শোয়। আজ নাহয় একটু দেরিতেই উনোনের আঁচ পড়বে। ডানা গোটানো পায়রা গিন্নির হালকা বকবকমে কর্তার ঘুম ভাঙাবার চেষ্টা। কর্তার আধখোলা চোখে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছেন। তিনি জানেন, কুয়াশার পর্দা কেটে রোদ উঠলে তবেই উঠোনে গম ছড়াবে আদুল গায়ের কিশোর।
মোরগ একাই ঝুঁটি আর রঙবাহারী লেজ ছড়িয়ে – কোঁকর কোওওওও...। মা
মুরগির পেটের তলার ওম থেকে ছানারা বেরোয় না। প্রায় শুনশান রাস্তায় গাড়ি চলে যায়।
এই গাড়ির ড্রাইভারসাহেবের আজ ভারি আনন্দ। লং ড্রাইভে তাঁর সিগারেট খাবার পারমিশন আছে।
সহযাত্রিনীর চোখে তখনও হালকা ঘুমের আমেজ। সদ্যস্নাত চুলগুলো আদুরে শিশুর মতো ঘাড়ের
সঙ্গে লেপটে থাকে।
ক’দিন ধরেই কথা হচ্ছিল কোথাও গেলে হয়। গতকাল সোমার সঙ্গে
ফোনে কথা হচ্ছিল। সে বলল, ‘ঘাটশিলায় কাল বৃষ্টি হয়ে বেশ আবহাওয়া ঠাণ্ডা’।
কর্তাগিন্নিতে এইসব সময়ে খুব ভাব। ফটাফট ব্যাগ গোছানো, লাঞ্চপ্যাক
তৈরি – সব হয়ে গেল। এখন শুধু সকালের অপেক্ষা। সোমাই বলে দিল – হাইওয়ের ওপরেই আছে
ছিমছাম পরিচ্ছন্ন হোটেল জে এন প্যালেস। আর কি চাই? আসলে চলাটাই তো মুখ্য। স্থান তো
উপলক্ষ্য মাত্র।
মেঘলা আলসে সকালে রাস্তায় ভিড় জমে না। চলার আনন্দে
আসানসোল পেরিয়ে ছুট, ছুট ছুট। একে একে দামোদর,দ্বারকেশ্বর, কংসাবতী, কুমারী নদীদের
পার করে, গাড়ি চলেছে তো চলেইছে। আজ বিকেলের আলোয় সুবর্রণরেখার সঙ্গে সময় কাটাবার
কথা আছে।
ঝড়বৃষ্টিতে পলাশের দল ভিজে ঝুমঝুমে। গাছের চেয়ে মাটির সাথেই
এখন তাদের মিতালি বেশি। গরবিনী লাল লেলিহান শিখা এখন মলিন কমলা। তাদের এমন দীনহীন রূপ
দেখা যায় না কখনও। ফোন তাক করতেই রাগী মাথা ঝাঁকিয়ে সে আরো দু-চারটে ফুল ঝরিয়ে
দিল।
-
‘আরে আরে করো কী? ন্যাড়া হয়ে যাবে নাকি?’
-
‘হলেই বা কি? এমন দুখী ছবি তুললে ভালো লাগে নাকি?’
লজ্জা পেয়ে ক্যামেরা নামায় মেয়েটি। খুঁজে দেখে এমন জলঝড়েও
উদ্ধত লালের আগুন জ্বালানো পলাশ আছে দু চারটি। কিছুতেই হার না মানা মানুষের মতন।
তবে সেইসব মানুষের মতো তাদের সংখ্যাও ভারি কম। খুশিমনেই ক্যামেরায় ধরা দিল তারা।
বান্দোয়ান পার হয়ে দুয়ারসিনির জঙ্গল। কাঁটাঝোপ ঝাঁপিয়ে পড়া
সরু পিচরাস্তা এখন ঝকঝকে দুই লেন। ঝুপসি গাছের ছায়ায় পাহাড়, বনের সঙ্গে মিলিজুলি
আবহে তিনখানি কটেজ। মাটি থেকে আধতলা উচ্চতায়, দেয়ালে কাজ চোখ টানে। বনবিভাগের অবদান। অনলাইন বুকিং হয়। মমতাভরে
প্রিয় জায়গার চারপাশ ঘুরে দেখা।
তারপর আবার চলা।
আকাশমণি তাদের পছন্দের গাছ নয়। যতই কেন না তাকে সোনাঝুরি
নামে ডাকা হোক। পাখিদের না দেয় বাসা বাঁধার জায়গা, না দেয় খিদের ফল। মাঝখান থেকে
জলস্তর নামিয়ে একাকার করে। কিন্তু আজ বৃষ্টিশেষের রোদে তাদের পাতাগুলি য়খন
ঝিলমিলিয়ে উঠল – তখন বোঝা গেল সুন্দরকে দেখারও এক মহেন্দ্রক্ষণ থাকে। তখন রাস্তার
অপর পারে, কচি ধানের ক্ষেতে বকের দল পোকা শিকারে ব্যস্ত। দূরে তিনজন বউ ধান রুইছে,
পরণে তাদের লাল, হলুদ, গোলাপী শাড়ি। দিগন্তে নীল পাহাড়ি টিলার সারি।
[২]
দুয়ারসিনি থেকে ঘাটশিলা আধঘণ্টার পথ। সোমবার বলে উইকএন্ডের
ভিড় এড়িয়ে আরাম করে ঘোরা যাবে। ভিড় ওদের দুজনেরই না-পসন্দ। হোটেলে বসেই ঘরের
বানানো রুটি চিকেন কষা। আরামে চোখ বুজে আসে। সকাল থেকে চলার পরে দুটিতে বিছানায়
এলিয়ে খানিক বিশ্রাম নেয়। হোটেল থেকে একটা কাগজ দিয়েছিল। তাতে দ্রষ্টব্য ও হোটেল
তেকে দূরত্ব দেওয়া ছিল। খুব জরুরি কাগজ! ফুলডুংরি পাহাড় এক বা সওয়া কিলোমিটার
মোটে। “হেঁটেই চলে যান” – আশ্বাস পেয়ে সাড়ে চারটেয় পায়ে জুতো, মাথায় টুপি। ফুলডুংরিরি
সামনে এসে দুজনারই চক্ষু চড়কগাছ। রাস্তার ওপারে তার গেট দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু
মাঝে হাইওয়ে – এন এইচ ১৮! তার দুধারে প্রায় কোমর সমান উঁচু রেলিং। তার দুপাশে দু লেনের চওড়া রাস্তা – যার পোষাকি নাম এক্সিট!।
স্পষ্টতঃ হেঁটে পারাপার বন্ধ করাই উদ্দেশ্য। কিন্তু ফুট ব্রিজ নেই বলে সবাই পটাপট
রেলিং টপকে ওপারে চলে যাচ্ছে। অগত্যা হাসতে হাসতেই পারাপার।
বিভূতিভূষণ আদর করে পাহাড় বললেও ফুলডুংরি আদতে গাছপালা ভরা
একটা ছোট্ট মাটির টিলা। টুক করে ওপরে পৌঁছে যাওয়া যায়। ওপরে একটা চাতাল। তার মাঝে
খোড়ো ছাউনির তলায় মাটির হাতি, পুতুল, ছোট ছোট হাঁড়িকুড়ি। এক বিঘৎ পাঁচিল দিয়ে গোল
করে ঘেরা পুজোর থান। ওপর থেকে ঘাটশিলা শহর দেখা যায়। বিভূতিভুষণের সময় নিশ্চয়ই খুব
মনোরম দৃশ্য চিল, এখন ক্রমবর্ধমান জনজীবনের চাপে গাছপালার দল কমে এসেছে। শীতে
বোধহয় সুয্যিমামা গাছপালা ঘেরা উপত্যকার পিছনে ডুব দেন। কিন্তু এই চৈত্রে তিনি
ডুববেন ঘরবাড়িদের পিছনে। তার চেয়ে বরং সুবর্ণরেখার কাছে যাওয়া ভালো।
নেমে আবার রেলিং টপকানো। অটোওয়ালার সঙ্গে সঙ্গীর দরদাম, আপাত
নির্লিপ্ত উদাসীনতায় দেখে সঙ্গিনী। পাঁচশোর ভাড়া তিনশোয় ঠিক হতেই নির্লিপ্ততার
মুখোশ খসে খুশির হাসি ঝিলিক দেয়। চলার পথের পাশে হিন্দুস্থান কপার লিমিটেডের
কমপ্লেক্স।
আঁকাবাঁকা পথ ধরে রাতমোহনার চরে সুবর্ণরেখার সঙ্গে দেখা। এখন
সে কিছুটা ক্ষীণাঙ্গী। টলটলে জলে সবুজ দাম ভেসে যায়। জলের তলায় লাল, সবুজ পাথরেরা
শান্ত হয়ে শুয়ে। আগে এখানেই ব্রিজ ছিল। নদীর ভালো লাগেনি। সেই ভাঙা ব্রিজের ওপর
বসে নদীর সাথে আলাপ। অটোওয়ালা বলল - বর্ষায় দামাল হয়ে, ব্রিজ আর দুকূল ছাপিয়ে, নদী
- পাঁচ ছ ফুট উঁচু জমিতে গাছতলার শিবঠাকুরের পা ধুইয়ে দেয়।
নদীর জল ছুঁয়ে তীর্থে যেতে হয়। এ গলি, সে গলি পার হয়ে এবার
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসতবাটি। এ পথে অটোই ভালো। দু কামরা, বারান্দা আর এক
চিলতে রান্নাঘর নিয়ে সাধাসিধে বাড়ি। তাঁর লেখার মতোই সহজ, অনাড়ম্বর মনছোঁয়া।
হেরিটেজের মর্যাদা পায়নি আজও। ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংস্কার করা হয়েছে। মূলতঃ
দর্শকদের অনুদান আর কিছু সামান্য পয়সার জোগাড় আছে বোধহয়। নিরলঙ্কার, নিরভিমান
ঘরখানি। নানান পাণ্ডুলিপি, কিছু পুরোনো ছবি – এমনই যেন হবার কথা ছিল। সংরক্ষক
বলছিলেন কতো চেষ্টা করা হচ্ছে হেরিটেজ আখ্যা পাবার জন্য। একটা জাবদা খাতা দর্শনার্থীদের
সইসহ অনুরোধে প্রায় ভরে এসেছে। কিনত্ু সে পথ তো সহজ নয়! মেয়েটি জানতে চায় -
“এখান থেকে সুবর্ণরেখা খুব কাছে না? উনি রোজ যেতেন যে?”
“কাছেই তো। তবে এখন তো এখন অনেক বাড়ি, সরু গলি। গাড়ি যাবে
না। হেঁটে যেতে হবে। যাবেন?”
ঠিকই তো। মেয়েটি ঘোর ভেঙে বাস্তবের মাটিতে নেমে আসে। এতগুলো
বছর! বদলে তো যাবেই। আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে – “যাবো না। ফিরে যাব এখান থেকেই”।
বিকেলের চায়ের তেষ্টা যিনি খুব সুন্দর বিস্কুট সহযোগে
মেটালেন, তাঁর দোকানের চটের আবরণ আকাশের রোদ আটকালেও, তাঁর মনের খোলা হাওয়াকে
একটুও আটকায়নি। চায়ের চেয়ে গল্প হলো বেশি। গুটি গুটি আরও দু একজন জুটলেন। ঘাটশিলার
গল্প বলায় তাঁদের ভারি উৎসাহ। সগর্বে জানালেন – ঘাটশিলা এখনো নিরুপদ্রব, অপরারাধ
প্রবণতাহীন এলাকা। পয়সা বেশি না থাক, আন্তরিকতার অভাব নেই। একজনের কথায় - এখানকার
তামার খনিতে চাকরির সুবাদে ইংরেজ আমলে প্রচুর বাঙালি জড়ো হয়েছিলেন। তাই ঘাটশিলায়
হিন্দির সঙ্গে সমানতালে বাংলাও চলে।
ছেলেটি চমকে বলে – তাইতো! আমাদের তো একবারও হিন্দি বলতে
হয়নি। আসানসোলেই বরং...।
সদুঃখে মাথা নাড়ে - যে রাজ্যের যে ঐতিহ্য!
সন্ধ্যার আকাশ কালো, বিদ্যুতের ঝলকানি। মোটে একজোড়া জুতো
সম্বল করে ভেজার কোনো মানে হয় না। অতএব, চাওয়ালার সুপারিশ করা ধাবা বাতিল করে
হোটেলেই ডিনার। আহা, শুধু মিক্সড ভেজ পদটার জন্যেই এই শেফকে কিডন্যাপ করা চলে!
[৩]
সকালে স্নান প্রাতরাশ সেরে রঙ্কিনী দেবীর মন্দির। স্থান –
জাদুগোড়া, ঘাটশিলা থেকে কিলোমিটার বিশেক। ভক্ত মানুষেরা উপবাস করে যেতে পারেন।
পুজো শেষে পাতায় করে প্রসাদ বিক্রি হয়। এই পথে পড়বে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে ঢাকা
ইউরেনিয়ামের খনির অফিস। আজ অলিগলি নেই। তাই আজ গাড়ি এবং জি পি এস সঙ্গী । ছোট ছোট
বাড়ি, খেতখামার, সুবর্ণরেখা পার হয়ে যেতেই দুপাশে প্রায় বনাঞ্চল।
এক ফুটফুটে কিশোরী এই পাহাড়িয়া বনভূমিতে মনের আনন্দে ঘুরে
বেড়াত। সে প্রায় কয়েকশো বছর আগের
কথা। এক রাখাল মেয়েটিকে দেখে তার পরিচয় জানতে চায়! মেয়েটি জবাব না দিয়ে পালাবার
চেষ্টা করলে ছেলেটি ধাওয়া করে। উপায়ান্তর না দেখে সে, নদীর ধারে রাখা ধোপার কাপড়ের
ভিতর লুকিয়ে পড়ে। ছেলেটি তাকে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যায়। এই মেয়েই রঙ্কিনী
দেবী। দেবীস্পর্শে সেই নিঙরানো কাপড়ের গাদা ও দেবী নিজে শিলারূপে পরিবর্তিত হন। সেই
ঘাটের নাম হয় কাপড়াগাদির ঘাট।
বহুদিন সেখানকার ভূমীজ উপজাতি তাঁর পুজো করত। দেবী খুব
জাগ্রত। নিয়মিত বলি হতো। কথিত আছে বলি না দিলে রুষ্টা দেবী তাঁর বলি নিজেই জোগাড়
করে নিতেন। নরবলিও চালু ছিল। পরে ১৮৬৫ সালে বৃটিশ হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়ে যায়। দেবীর
কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করলে তা নাকি বিফলে যায় না।
যেহেতু দেবীস্থানে ভক্তসমাগম বাড়তে থাকে সেহেতু, একদিন এক
উচ্চবর্ণীয় ব্যক্তি স্বপ্নাদেশ পান। তদনুসারে মূল রাস্তার ওপর ১৯৫০ সালে একটি
সুন্দর মন্দির তৈরি করা হয় এবং দেবীর শিলীভূত রূপকে লাল কাপড়ে মুড়ে সেখানে স্থাপনা
করা হয়। রঙ্কিনী দেবী এখন কালীমায়ের এক রূপভেদ। তবে মূল পুরোহিত অবশ্য এখনো ভূমীজ
সম্প্রদায়ের মানুষ। দেবী জাগ্রত বলে, দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে পুজো দিতে
আসেন।
সুন্দর কারুকাজ করা মন্দির। তবু মেয়েটির একটু মনখারাপ। সে
তো এক বনবালার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তাকে এই বৈভবের মধ্যে, পুরোহিতদের ভিড়ে
খুঁজে পেল না কিছুতেই। এক অকারণ অনির্দেশ্য অভিমানে সে সরে গিয়ে রাস্তার অপর পারে
রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়ায়। কাউকে জিজ্ঞাসাও করাতেও তার অনীহা।
এক সদ্যবিবাহিত দম্পতি - হাতে তাদের ধূপ, নারকেল – রেলিংয়ের
গা ঘেঁষে একটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে একটা মাটির পাহাড়ের আড়ালে কোথায় যেন চলে গেল। কি আছে ওদিকে? হাতে অজস্র সময়। তাই দুটিতে গুটি
গুটি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। সিঁড়ির শেষে পাথুরে এবড়ো খেবড়ো পথ। পথের শেষে এক
অদ্ভুতদর্শন গাছ। তার শিকড় জড়িয়ে নিংড়ানো কাপড়ের স্তুপের মতো বিশাল এক পাথর। আলো
আঁধারি স্যাঁতসেতে ছায়াময় জায়গাটি এক বিঘৎ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। নিজের অজান্তেই মুখ
দিয়ে বেরিয়ে এলো – কাপড়াগাদি!
ছেলে আর বউটি পুজো দেবে বলে হাত ধুচ্ছিল। ওরাই বলল - এখানে
সবাই আসে না। পুরোহিত সকালে পুজো করে চলে যান। এরপর কেউ এলে নারকেল ফাটিয়ে, ধূপ
জ্বেলে প্রণাম করে যায়। শনি মঙ্গলবার জীববলি হয়। হাঁড়িকাঠের দিকে ইশারা করল। আজ
মঙ্গলবার। সেখানকার লাল তরল তখনো জমে যায়নি।
মেয়ের হাতে কোনো পুজোর সরঞ্জাম নেই। সে ওদের পুজো দেখল
প্রাণভরে। তৃপ্তমনে প্রণাম করে ফিসফিসিয়ে শুধোয় – পাথর হতে গেলে কেন?
হালকা হাওয়ায় মেয়ের চুল এলোমেলো হয়ে যায়। একটু হেসে সে
ফেরার পথা ধরে।
ফেরার পথে ‘হঠাৎ বেঁকে ডাইনে মোচড় মেরে, ফিরবে আবার বাঁয়ের
দিকে’ – এই যাঃ, কটা গলি তো গোনা হয়নি! তবে মোড়টার নাম মনে আছে। সুদড়া মোড়। সেখান
থেকে গুগলবাবুর কথামতো জামসেদপুর-মুসাবনি রোড ধরে এগিয়ে গেলে, এই পথের ধারেই আছে -
ভারতে সর্বপ্রথম তামার খনি। আর বনে আছে অনেক পলাশ। সবুজে লালে নেশা ধরানো ভারি
সুন্দর এক পথ দিয়ে, গাড়ি গুড়গুড়িয়ে চলে। চলতে চলতে বাসস্ট্যান্ড। বাস, দোকান,
লোকজন – সেরেছে রে! ঘোরাও, ঘোরাও, গাড়ি ঘোরাও!
এবার বেঁকেচুরে পৌঁছে যায় বুরুডি ড্যামে।
বেশ সুন্দর ছোট ড্যাম। তীরে মাটি পাথরের বৈচিত্র্যে চোখের
আরাম। ড্যামের ওপর চালার হোটেল। ভাত তরকারির স্বাদের চেয়েও আন্তরিকতার স্বাদটি বেশি
মিঠে। হালকা টিপটপ বৃষ্টি। সাড়ে সাত কিলোমিটার দূরে ধারাগিরি ফলস। তবে সে ‘চোত
বোশেখে শুকিয়ে ওঠে’ বলে, হোটেলে ফিরে হাত পা টান টান ।
বিকেলে বেরিয়ে একটু হাঁটাহাটি। চারপাশ টহল দেওয়া। স্টেশনের
ঠেলাওয়ালা অল্প তেলে কী ভালো ওমলেট ভাজে! ওরা চেটেপুটে খায়। ঠেলাওয়ালা বলে, শীতের শনি রবিতে স্টেশনে ভ্রমণপিপাসুদের ঢল নামে। লাইন
পেরিয়ে নাকি এক রাজবাড়ি আছে। ওদের তাতে কোনো আগ্রহ নেই বলে, উলটোপথে চলে যায় বাজার
এলাকায়। ছোট ছোট ছিমছাম দোকান। এতো কিছুর পরে আইসক্রিম খেতে হয়।
[৩]
পরদিন যাবার পালা। সকালে গাড়িতে বসে সহযাত্রিণী গুনগুন করে –
‘দুয়ারসিনি বাংলোর সামনের রাস্তাটা ধরে হাঁটব, হ্যাঁ?’
-
‘যতসব পাগলের প্রলাপ। ওসব হবে টবে না’।
ড্রাইভার সাহেব সপাট
জবাব দিয়ে, গাড়ি ছেড়ে দেয়। মেয়ে নির্বিকার সুবোধ বালিকার মতো ঘাড় নেড়ে রাস্তা
দেখতে থাকে। লজেন্স ভাগ করে খায়। বাংলোর সামনে গাড়ি ঘচাৎ করে থামে। দুজনে নেমে পড়ে
হাঁটতে থাকে। দুজনের মুখেই ঝিকিমিকি হাসি খেলা করে। একপাশে পাহাড় আর একপাশে খেত
চিরে কংক্রিটের সরু পথ চলে গেছে। সকালের নরম রোদে চলতে মজা। মনোহারি দোকানের
যাবতীয় জিনিস নিয়ে মটর সাইকেল গুড়গুড়িয়ে চলে যায়। ভুট ভুটের সঙ্গে চুড়ি দুলের
ঝাঁকার ঠিন ঠিন মিলে মিশে যায়। আর যায় দ্রুত সাইকেল চালানো কিশোরী। তার বোধহয়
ইস্কুলের সময় হয়ে গেছে। দু একটা পলাশ ইতিউতি উঁকি দেয়। চলতে চলতে দ্বিতীয় টিলার
তলায় পৌঁছে যাওয়ার পরে ছেলেটি হাসে – ‘আরও যাবে?”
“নাঃ, ফিরতেও তো হবে অনেকটা পথ। এখন গ্রামে ঢুকে গল্প
জমাবার সময় নেই। তার চেয়ে রানিবাঁধ খাতরা হয়ে ফিরলে শালবনের জঙ্গল চিরে যাওয়া যাবে”।
খাতরা ঢোকার আধঘণ্টা আগে বন্ধুর ফোন – ‘রানিবাঁধ হয়ে ফিরছিস
নাকি?’
-
‘হুঁ’।
-
‘জানতাম। ওটা তোদের ফেভারিট পথ। তাহলে আমাদের
বাড়ি হয়ে যা’।
খাতরায় বন্ধুর বাড়ি। মাসিমার কাছে দই মিষ্টি খেয়ে, গল্প করে
আবার গাড়ি। খানিক বাদে আরেক বন্ধুর ফোন – ‘বাঁকুড়া হয়ে ফিরবি?’
-
হ্যাঁ, তবে কটায় ঢুকব ঠিক নেই’।
-
‘চলে আয়’।
অতএব বাঁকুড়ায় রুটি মাংস আর ভরপুর আড্ডা। তার বরের বাগানের
শখ। সেখানে ফটোশুট। হা হা, হি হি। ‘সব ঠাঁই মোর ঘর আছে’ – বলে গেছেন না সেই
সত্যদ্রষ্টা কবি? শুধু চোখ তাকিয়ে দেখতে হয়। একটু জিরোতে হয়। ঘোরার আসল মজা তো পথে
পথেই।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে লম্বা শ্বাস – কিছুদিন পরে আবার একবার...।
অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে।
||দোলা সেন||
No comments:
Post a Comment