||দোলা সেন||
১২ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৮ সাল। ক্যালিফোর্নিয়ার এল সেগুন্ডোতে
ম্যাককেন্ডলস পরিবারে একটি ছেলে জন্মায়। ক্রিস্টোফার জনসন ম্যাককেন্ডলস। পরিবারটি
নিশ্চয়ই খুশি হয়েছিল। কিন্তু একটু বড়ো হয়ে ক্রিস সেই আনন্দ আর নিজের মধ্যে খুঁজে
পায় নি। পরিবার ছেড়ে বন্য প্রকৃতির মধ্যে চলে যাবার, তার মধ্যে নিজেকে হারাবার
প্রবল ইচ্ছেতে সে ছটফট করতো। ১৯৭৬ সালে তারা যখন বাস উঠিয়ে ভার্জিনিয়ায় চলে গেল
তখনও এ অবস্থার বদল হলো না।
তা এজন্য ক্রিসকে খুব একটা দোষও দেওয়া যায় না। কেনই বা তার হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করবে না? বিশেষতঃ সন্ধ্যায় যখন দেখত তার মদ্যপ বাবার হাতে বেদম ঠ্যাঙানি খাচ্ছে তার মা – তখন তার মনে হতো যেদিকে দুচোখ চায়, পালিয়ে যাই। অথবা রাতের বন্ধ দরজার ওপার থেকে মায়ের গোঙানি, সকালে মায়ের গায়ে মুখে কালশিটে, ওয়ালটারের – বাবা বলতে ইচ্ছে করে না ক্রিসের – মুখে এক পৈশাচিক পরিতৃপ্তি – তখন বয়ঃসন্ধির জালে আটকানো কিশোরটি বার বার মনে হতো হেথা নয়, অন্য কোনোখানে। সবচেয়ে অসহ্য লাগত যখন মা কলার দেওয়া পুরোহাতা জামা পরে পরদিন সেই বাবার জন্যই ডিনার তৈরি করতে বসত। বিলি, মনে মিসেস উইহেলমিনা ম্যাকক্যান্ডেলসের মুখের হাসিটা দেখলে ক্রিসের তখন..., যাকগে, সেসব কথা। হয়তো চলেই যেত ক্রিস, যদি না...
এই একটা যদিতেই ক্রিস ভীষণভাবে আটকে আছে। সেই যদির নাম
ক্যারিন – তার ছোট বোন। ওকে একলা এই জঙ্গলে ফেলে যেতে মন চায় না। জঙ্গল? জঙ্গল কেন
বলল ক্রিস? জঙ্গলের জীবন তো এতো কুশ্রী নয়? জান্তব জীবনের একটা ছন্দ আছে, সেখানে
এমন অনিয়মের কথা কেউ ভাবতেই পারে না। ঠিক কথা। একদিন সে বনেই চলে যাবে। কিন্তু এই
ক্যারিনটা? বাবা যখন মাতাল হয়ে চেঁচাতে থাকে, হাতের কাছে যাকে পায় তাকেই মারতে যায়
– তখন, তখন তো এই দাদাকে জড়িয়ে ধরেই থরথর করে কাঁপতে থাকে বেচারি। তাকে এই অসহায়
অবস্থায় ফেলে চলে যাবে, ক্রিস এতো নির্মম নয়।
অথচ বাইরে থেকে দেখতে গেলে ম্যাককেন্ডলসদের জীবনযাত্রা
অনেকেরই ঈর্ষণীয় হতে পারে। ক্রিসের বাবা ওয়ালটার নাসার একজন অ্যান্টেনা
স্পেশালিস্ট। মা উইহেলমিনা হিউ এয়ারক্র্যাফ্ট কোম্পানির সেক্রেটারি। এ ছাড়া
নিজেদের কনসালটেন্সি ফার্ম, ক্রিস আর ক্যারিনের মতো ঝকঝকে ছেলেমেয়ে, তকতকে
ঘরবাড়ি....
তাই আর চারটে বাচ্চার মতো সেও স্কুলে যায়। স্কুল শেষে
বাড়ি ফেরে। স্কুলের ক্রশ কান্ট্রি দৌড়ের
সেই অধিনায়ক। সে দৌড়ায়। দৌড়োতেই থাকে। জীবনের সব ক্ষুদ্রতা, হিংস্রতা, নোংরামিকে
পিছনে ফেলে সে ছুটতেই থাকে।
হযতো এভাবেই কেটে যেত দিন, যেভাবে আর সবার যায়। কিন্তু ওর স্কুল শেষ হতেই ১৯৮৬ সালে
ভার্জিনিয়া থেকে বাস গুটিয়ে তার বাবা যখন তাদের নিয়ে দক্ষিণ ক্যালিফোর্ণিয়ায় এসে
ঘাঁটি গাড়ল – তার কিছুদিন পরেই তার থুতু
দিয়ে ঠাসা বুড়ির বাড়িটাও ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ল।
অথচ প্রথমদিকে বেশ খুশিই ছিল ক্রিস। এতদিন পরে কিছু
আত্মীয়বন্ধুর কাছাকাছি এসে তার ভালোই লাগছিল। অতীতের দমবন্ধ পরিবেশ থেকে একটু যেন
মুক্তির স্বাদ পাচ্ছিল। বাবার আচরণটাও
আগের চেয়ে ভালো মনে হচ্ছিল। মায়ের মুখের হাসিটা আরও একটু বেশি চওড়া লাগছিল। একদিন
সন্ধ্যায় বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেবার ফাঁকে জন বলছিল – কাল শহরে গেসলাম,
বুঝলি? কুইনের সাথে দেখা হলো।
-
দেখা করতেই গেসলি, তাই না? – রবিনের মুচকি হাসিতেই
স্পষ্ট, এটা কোনো সাধারণ দেখা নয়।
-
আরে, সে সব কিছু নয়... জন উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছিল।
ক্রিস মজার গলায় শুধোলো – আরে, কমসে কম এটা তো বল যে, এই কুইন মেয়েটা কে?
এবার অবাক হবার পালা জন, রবিন,
স্টুয়ার্টদের।
-
সে কি তুই কুইনদের চিনিস না?
-
তোর ফিঁয়াসেকে আমি কি করে চিনব? আমি তো এখানে নতুন রে
বাবা!
বিল এদের মধ্যে একটু বড়। সে বোধহয় ব্যাপারটা বুঝছিল। তাড়াতাড়ি
কথা ঘোরাতে চায় – ছাড় না ওসব কথা। তোদের যত বাজে কথা।
ক্রিসের মনে হলো, বিল ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চাইছে। জনের
মুখের অস্বস্তিও খুব স্পষ্ট। কিন্তু পুরো
ব্যাপারটার মধ্যে যেন একটা কিছু আছে, যেটা তার জানা উচিত, অথচ সে জানে না। সে চেপে
ধরল – কুইনদের আমার চেনার কথা কি করে? তোরা কি চেপে যাচ্ছিস আমার কাছ থেকে?
-
ছাড় না এসব কথা। সবকিছু না জানাই ভালো।
রুখে উঠলো ক্রিস – আমি বাচ্চা ছেলে নই জন। আমার ব্যাপারটা
আমায় বুঝতে দে। কে এই কুইন?
-
সম্পর্কে তোর সৎ বোন। তোর বাবার প্রথম পক্ষের মেয়ে।
-
ওহ্। আমি জানতাম না যে এই নামে আমার এক সৎ বোন আছে।
কিন্তু সে তো জনের কাকিমার বয়েসী হবার কথা! তুই সমবয়েসী কাউকে পেলি না?
জন রুখে উঠলো – মোটেই কাকিমার বয়েসী নয়। বরং আমার চেয়ে বছর
কয়েকের ছোটই।
ক্রিসের চোখের সামনে চাপ চাপ অন্ধকার। মাটি দুলছে, আকাশ
ফাটছে। রক্তলাল চোখে জনের দিকে তাকালো – তু-তুই সত্যি কথা বলছিস?
-
মিথ্যে বলতে যাব কেন? – জন একটু অবাক হলো। বিল হাল ধরলো
এবার।
-
এই জন্যই আমি কথা ঘোরাতে চেয়েছিলাম রে ক্রিস। এখানে
বোধহয় তুই আর তোর বোন ছাড়া সবাই কথাটা জানে। ওয়ালটার কোনোদিনই তার বউকে ডিভোর্স
দেয়নি! সে মাঝে মাঝেই ওদের বাড়ি যায়। আরে বাবা, এই কুইনই তো ক্যারিনের চেয়ে মাস
কয়েকের ছোট!
কিছু কি টুকরো টুকরো হয়ে ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়লো? আশ্চর্য! ওর
বন্ধুরা কেউ একটুও আওয়াজ পেল না কিন্তু! মাথার ভিতরে এতোদিনের পরিবার, ঘরবাড়ি সব –
সব গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ছে। টলতে টলতে সেই ভেঙে পড়া বাড়ির দিকেই এগোলো ক্রিস।
-
সত্যি বলো মা, তুমি সব জানতে, তাই না?
-
জানি। কিন্তু ওয়ালটার আর আমি পরস্পরকে ভালোবাসি ক্রিস।
তার জন্য আমি সব মেনে নিয়েছি।
-
তুমি জানো বাবার ডিভোর্স হয়নি?
-
জানি।
-
তবু কেন?
-
উত্তর তো আগেই দিয়েছি।
-
কিরকম ভালোবাসা মা? যার জন্য নিজের গায়ের কালশিটে,
সন্তানদের অবৈধ তকমা – সব মেনে নেওয়া যায়?
-
এর উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই ক্রিস। আমার জীবন আমি আমার মতো
করেই বাঁচবো।
ছিটকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল ক্রিস। চার্চের বাগানের এক
নির্জন কোণে বসে রইল। সে এইসব থেকে দূরে চলে যাবে। এ তার জায়গা নয়। অনেক দূরে সেই
যেখানে মাঠ গিয়ে আকাশে মেশে, যেখানে গেলে চলার পায়ে পায়ে জীবনের ভেরী বাজে – সে
চলেই যাবে সেই অজানার খোঁজে। এইসবই ভাবছিল আর এই নির্জনে, শেষবারের মতো সে
তার সমস্ত লোনা জলকে মুক্তি দিচ্ছিল। অনেকক্ষণ পরে পিঠের ওপর একটা
কোমল হাত এসে পড়ল – বাড়ি চল ক্রিস।
উঠল ক্রিস। লোনা জলের ভাণ্ডার শেষ হয়েছে।
-
বাড়ি কোথায় রে ক্যারিন?
-
বোকামি করিস না ভাই। কয়েকমাস পরেই তোর কলেজের শেষ
পরীক্ষা। তোর মতো মেধাবী ছাত্রের জন্য দুনিয়ার সব দরজা খোলা। এই পড়াটা শেষ কর। তারপর
তুই চলে
যাস। তোর মতো করে জীবনকে চিনে নিস।
-
আর তুই?
-
আমিও আমার মতো করে জীবন খুঁজে নেব। এখন আর আমিও ছোট নেই
রে! তাই ধীরেসুস্থে ঠিক নিজের বাঁচার রসদ খুঁজে নেব।
ক্রিস বুঝল। ক্যারিন ঠিক কথাই বলেছে। অজানা পথের যাত্রী
হতে হলে অনেক কিছু শিখতে হবে। নিজেকে তৈরি করতে হবে। বোনের হাত ধরে সে ঘরে ফিরল।
ইতিহাস আর নৃতত্ব – দু দুটো বিষয়ে মেজর নিয়ে পাসও করল। বছর বাইশের
তরুণটির হাতে তখন তার কলেজের স্কলারশিপ আর হাতখরচ বাবদ কড়কড়ে চব্বিশ হাজার ডলার! সালটা
১৯৯০! পুরো টাকাটাই সে দান করে দিল OXFAM এর তহবিলে।
বিশ্বজোড়া দুস্থ গরীব শিশুদের জন্য এ তার উপহার। নিজের জন্য বেছে নিল এক বাউণ্ডুলে
ভবঘুরের জীবন।
এরপরে সে ঘুরে বেড়াবে আক্ষরিক অর্থে যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকপানেই। পয়সার
দরকার হলে হবে রেস্তোরাঁর রাঁধিয়ে থেকে ক্ষেতের দিনমজুর – মানে যখন যা পাওয়া যায়।
এই ভাবে সে বছর দুয়েকের মধ্যে প্রিয়সঙ্গী ড্যাটসান গাড়ি নিয়ে চষে ফেলল ক্যালিফোর্ণিয়া,
আ্যারিজোনার বিস্তৃত বনাঞ্চল। সুদীর্ঘ হাইকিং তাকে মুক্তির পথ দেখায়। ভিতরের এক
অদম্য তাড়ায় সে কেবলই ছুটে বেড়ায়। নতুন নতুন পথের রোমাঞ্চ তা ধমনীতে প্রাণের জোয়ার
আনে। এরপরে চলে গেল দক্ষিণ ডাকোটায়। কার্থেজে থাকল কিছুদিন। সেইখানের এক বনপথে,
নদী পার হবার সময়, হড়কা বানে তার গাড়িটা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক চেষ্টা করল
ক্রিস। অবশেষে বিদায় জানাতেই হলো তার এতোদিনের সঙ্গীটিকে। অগত্যা যতটুকু পারল
ব্যাগে ভরে নিল। বোধকরি স্মৃতিচিহ্ন হিসেবেই ব্যাগে পুরে নিল লাইসেন্স প্লেটটি।
তারপর সর্ব বন্ধনমুক্ত হয়ে পথের সঙ্গেই পায়ে হেঁটে চলে গেল একসময়।
এবার শুরু হল হিচ হাইকিং। কতো সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিল ক্রিস। পার হয়ে গেল কতো
মাঠ, বন...। ক্যানো নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো কলোরাডো নদীর বুকে। তীব্রস্রোতের
উথাল পাথাল নদী তাকে ডোবাল, ভাসালো – তারপর অকূল দরিয়ায় না ভাসিয়ে একসময় তীরেও
পৌঁছে দিল।
হিচ হাইকিং করতে করতেই দক্ষিণ ডাকোটা থেকে প্রায় হাজার তিনেক মাইল পাড়ি
দিয়ে এক সময় সে এসে পৌঁছালো আলাস্কার ফেয়ারব্যাঙ্কস শহরে। এপ্রিল মাসের শহরটি তখন বরফে মোড়া। কিন্তু ক্রিসের
মাথায় তখন এক আরো লম্বা পথের ভাবনা। স্ট্যাম্পেড ট্রেইল। সেই পথ ধরে ধরে সে চলে
যাবে, চলতেই থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না বেরিং প্রণালীতে গিয়ে ধাক্কা খায়। পথ বরফ আর
বনে ভরা? তাতে কি? এপ্রিল শেষ হয়ে মে আসছে। বরফ গলতে শুরু করবে। বনের ফল, খরগোস,
নদী থাকতে খাওয়া দাওয়ার চিন্তা করে কে? মানে আর যেই করুক, ক্রিস অন্ততঃ করে
না। অতএব সে রওয়া দিল স্ট্যাম্পেড
ট্রেইলের দিকে। প্রায় ১৩৪ মাইলের পথ পাড়ি দিয়ে সে একসময় একসময় স্ট্যাম্পেড
ট্রেইলের দোরগোড়ায় পৌঁছেও গেল। এই পথটায় তাকে লিফ্ট দিয়েছিল জিম গ্যালিয়েন। সে
ফেয়ারব্যাঙ্কস থেকে হিলি যাচ্ছিল। আর স্ট্যাম্পেড ট্রেইলের শুরু তো সেখানেই। কেন
কে জানে, ক্রিস তাকে বলেছিল তার নাম অ্যালেক্স!
তা এই অ্যালেক্সের সঙ্গে জিমের বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আর হবে নাই বা কেন?
অ্যালেক্সের সরস কথাবার্তা, তার জমিয়ে গল্প করার ক্ষমতা তাকে মুগ্ধ করে দেয়। এই ঝাঁকড়াচুলো বিবাগী ছেলেটার প্রতি সে সত্যিকারের
অন্তরের টান অনুভব করতে শুরু করেছিল। তাই যখন সে শুনল অ্যালেক্স স্ট্যাম্পেড
ট্রেইল ধরে বেরিং পাস যাবার তালে আছে, তখন সে বিস্মিত হবার সঙ্গে সঙ্গে শঙ্কিতও
হয়ে উঠল। তখন এপ্রিল মাস। ছমাস দিন রাতের দেশে তখনও দিনের আলো খুব বেশি সময় থাকে
না। তার উপর অ্যলেক্সের জিনিসপত্রের জোগাড় দেখে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল। সঙ্গে শুধু
একটা হালকা ব্যাগ, প্রয়োজনীয় রেশন ও যাত্রার উপকরণের চূড়ান্ত অভাব.... এ ছেলের তো
মরণ ঘনিয়েছে! সে প্রাণপণ ক্রিসকে বোঝায় – দোস্ত, এই নিয়ে আর যাই হোক আলাস্কায় হাইক
করা যায় না। আলাস্কার ক্ষুদে গাছের জঙ্গল বড় নির্মম হে। সামান্য ভুলচুকও সে ক্ষমা
করে না। আর তোমাকে যেতে হবে তার ভিতর দিয়েই।
-
আমি যাবোই বন্ধু। ভয় পেয়ো না।
কিচ্ছু হবে না আমার। কিন্তু যেতে আমাকে হবেই।
-
বেশ তো যেও। কিন্তু এখন নয়। আগে বরফ গলুক। তুমি কছুদিন
এখানে থাকো। যাবার পাথেয় জোগাড় করো। রেশন... তোমার তো একখানা ঠিকঠাক জুতো অবধি
নেই।
-
ওসব নিয়ে ভেবো না বন্ধু। বন থেকে আমার রসদ জোগাড় করে
নেব। অনেক বন ঘুরেছি হে।
-
অনেক বন আর
আলাস্কায় অনেক তফাত আছে দোস্ত। তোমার অভিজ্ঞতা নেই, তাই একথা বলছ। - দুঃখিত মুখে
জিম মাথা নাড়ে।
-
আমি ঠিক চলে
যেতে পারব। - অ্যালেক্সের এক গোঁ।
-
তাহলে চলো
প্রথমে অ্যাঙ্করেজ যাই। সেখান থেকে দরকারি ম্যাপ, কম্পাস, জুতো, ক্যাম্পিংয়ের
জিনিসপত্র কিনি। তার পরে নাহয় তুমি যেও। এটা এই পথে যাওয়ার সময়ও নয়। বিপদ ঘটবে।
-
আমার জন্য এতো
কেউ ভাবে না জিম। তুমিও ভেবো না। যাবার আগে তোমার মতো একজন বন্ধু পেলাম, তাই কি
কম, বলো?
অবশেষ হার মানল জিম গ্যালিয়েন। অনেক
পীড়াপীড়ি করে সে অ্যালেক্সকে একজোড়া জুতো, দুখানা স্যান্ডুইচ আর কর্ন চিপসের একটা
প্যাকেট দিতে পেরেছিল। নিজের ব্যাগের মধ্যে সেটা ভরে জিমকে বিদায় জানিয়ে বরফে ঢাকা
প্রায় অস্পষ্ট স্ট্যাম্পেড ট্রেইলের পথ ধরে চলে গেল। ২৮শে এপ্রিল, ১৯৯২ – জিম তাকে ট্রেইলহেডে
নামিয়ে দিয়ে মনে মনে হেসেছিল। ভেবেছিল খিদের জ্বালায় অ্যালেক্স কিছুদিনের মধ্যেই
ফেরত আসবে। হয়তো লজ্জায় তার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না, কিন্তু ফিরতে তাকে হবেই।
জিম তখনও জানতো না যে, সে এই তারিখটা জীবনেও ভুলতে পারবে না।
এরপরের গল্প খুব সংক্ষিপ্ত। ক্রিস প্রায়
পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার মতো হেঁটে দেনালি ন্যাশানাল পার্কের কাছে এসে ঘন ঝোপের সামনে
এসে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই শক্ত ঘন ঝোপ ভেঙে যাওয়া সম্ভব নয়। হয়ত সেই সময় সে জিমের
কথার মানে বুঝতে পেরেছিল। গরমে ঝোপ একটু না শুকালে এগোবার পথ নেই। অন্য কেউ হলে
হয়তো ফিরে আসত। ক্রিস তো ফিরতে শেখেনি। টেকনালিকা নামে একটা নদী পেরিয়ে সে একটা
পরিত্যক্ত বাসের সন্ধান পেল। মহানন্দে সেখানেই ঘাঁটি গাড়লো। তখন তার কাছে ছিল সাড়ে চার কেজি চাল, একটা সেমি অটোম্যাটিক রাইফেল, কিছু গুলি এবং কয়েকটি বই!
বোধহয় সে ভেবেছিল বরফ গললেই সে ঠিক রাস্তা খুঁজে পাবে। বুনো ফল, শজারু এইসব খেয়ে
সে দিন কাটাচ্ছিল। আর রোজ লিখত তার দিনপঞ্জী – যে কোনো অভিযাত্রীর যা অবশ্য করণীয়।
একদিন বরফ গলল, কিন্তু রাস্তা পাওয়া গেল না। অগত্যা সে ফিরবার চেষ্টা করল।
কিন্তু হায়!
যে শীর্ণ নদীটিকে হেঁটে পার হয়ে সে এপারে এসেছিল, বরফ গলা জল পেয়ে সেই টেকনালিকা
এখন তীব্র স্রোতস্বিনী। কিছুতেই পার হতে না পেরে সের ফিরে এলো বাসের আশ্রয়েই।
এইবার শুরু হলো তার সত্যিকারের কৃচ্ছসাধন। এই সময় সে খাবার জন্য কি না করেছে।
বে-আইনী জেনেও মুজ মেরেছে। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে অতবড়ো হরিণ জাতীয় প্রাণীটির
অধিকাংশ মাংসই পচে নষ্ট হলো। আসপাশের অনেকগুলো কেবিন সে ভেঙে ঢুকেছে খাবার খোঁজে।
আলাস্কার জঙ্গলের পর্যাপ্ত বেরি এখন তার মূল খাদ্য।
রসদ ফুরিয়ে
আসছিল। খিদের জ্বালায় সে নানারকম কন্দ, বীজ খাচ্ছিল। সেগুলো তার মাংসপেশিকে অবশ ও
দুর্বল করে দিচ্ছিল। তার চলতে ফিরতে কষ্ট হচ্ছিল। অবশেষে সে বাসটির গায়ে গোটা গোটা অক্ষরে লিখে
রাখল –
“Attention Possible Visitors. S.O.S. I need your help. I am
injured, near death, and too weak to hike out. I am all alone, this is no joke.
In the name of God, please remain to save me. I am out collecting berries close
by and shall return this evening. Thank you, Chris McCandless. August.”
এতো কিছুর মধ্যেও
সে তার জার্নাল নিয়মিত লেখা চালিয়ে গেছে। ছবি তুলেছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা
হলো, এই জার্নালের কোথাও ভয় নেই, হতাশা নেই, যন্ত্রণা নেই! যা আছে, তা এক নির্মোহ
বিবরণ। একদম শেষের দিকে সে লিখেছে –
“I HAVE HAD A
HAPPY LIFE AND THANK THE LORD. GOODBYE AND MAY GOD BLESS ALL!”
ধীরে ধীরে শক্তি ফুরিয়ে আসে। এখন তার বাইরে যেতেও
কষ্ট হয়। লেখা ক্রমশঃ সংক্ষিপ্ত হতে থাকে। ২৮শে এপ্রিল তার যাত্রা শুরু হয়েছিল।
তারপর ১০৭ তম দিনে, বারো বা তেরোই আগস্টে সে শেষ লেখা লিখল –
"BEAUTIFUL BLUE BERRIES."
পাঠক,
আমাকে ক্ষমা করো, এই লাইনগুলো আমি অনুবাদ করতে পারিনি। বোতাম আঁটা জামার নীচে
শান্তিতে শয়ান এই হাতে এর অনুবাদ হয় না।
কিন্তু
সেদিন কি সে এই বেরি খেতে পেরেছিল? নাকি খিদের জ্বালায় অশক্ত শরীর ও মনের ভাবনায়
এটাই এসেছিল? জানিনা। সত্যিই কেউ জানে না। কারণ, এরপরে ১০৮ থেকে ১১২ তম দিন
পর্যন্ত সে শুধু একটা দাগ কেটে গেছে। ১১৩ তম দিন থেকে আর কোনো এন্ট্রি নেই। সম্ভবতঃ
আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে সে মারা যায়।
ভাগ্যের
পরিহাস আর কাকে বলে? ক্রিসের কাছে যদি একটা ঠিকঠাক টপোগ্রাফিকাল ম্যাপ থাকত, তাহলে
সে দেখতে পেত, সে যে জায়গা দিয়ে এই নদী
পার হয়েছিল, সেখান থেকে যদি স্রোতের অভিমুখে আর মাত্র ৮০০ মিটার এগিয়ে যেত, তাহলেই
– হ্যাঁ তাহলেই সে পেয়ে যেত একটা অব্যবহৃত হাতে চালানো কেবল কার। সে নদীটা পেরিয়ে
জীবনের অভিমুখে চলে যেতে পারত।
সেপ্টেম্বরের ছয় তারিখে একদল শিকারি এদিকে মাথা
গোঁজার জন্য বাসটা দেখতে পায়। বাসের মধ্যে স্লিপিং ব্যাগের ভিতর পচা গলা দেহাবশেষ
দেখতে পেয়ে পুলিসকে রেডিওতে খবর দেয়। ক্রিস ম্যাককেন্ডলসের দেহ আবিস্কৃত হলো।
ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ লেখা হলো অনাহার।
এরপর?
হ্যাঁ এরও পর! এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই ১৯৯২ সালের আমেরিকা উত্তাল হলো, চব্বিশ বছরের এই
পাগলা ছেলেটার জন্য। কেউ বলল – বোকা, গোঁয়ার, অপরিণামদর্শী। আবার কেউ কেউ বলল -
এমন রোম্যান্টিক অভিযাত্রী আর হয় না। তাকে বললো দি আল্টিমেট অ্যাডভেঞ্চারার! তার
আদরের ডাকনাম হলো আলেকজান্ডার সুপারট্র্যাম্প!
দেখা
গেল, ক্রিসের মতন পাগল আরো অনেক আছে। তারা কখনো দলবেঁধে, কখনো একা একা এই বাসটির
উদ্দেশ্যে রওনা দিল। তারা এর নাম দিল ম্যাজিক বাস। এটা দুঃসাহসী দামাল মানুষদের
তীর্থস্থান হয়ে উঠল। তার একবার সুপারট্র্যাম্পের শেষ আশ্রয়কে ছুঁয়ে দেখতে চাইল।
বাসটায় একটা রাত কাটাতে চাইল। এই যাত্রায় নদী পার হতে গিয়ে কমপক্ষে দুজন মারা যায়,
পনেরোজনকে সরকার উদ্ধার করে। এরপর জনগণের নিরাপত্তার খাতিরে অবশেষে ১৮ই জুন, ২০২০
সালে হেলিকপ্টারে করে বাসটিকে তুলে হিলিতে নিয়ে আসা হয়। তারপর এক ট্রাকে চড়িয়ে সেটি
এক গোপন স্থানে রেখে দেওয়া হলো।
ক্রিস কিন্তু হারিয়ে গেল না। আলেকজান্ডার সুপারট্র্যাম্প সমস্ত অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়
মানুষের মনের মণিকোঠায় হীরের মতো উজ্জ্বল উপস্থিতি নিয়ে রয়ে গেল।
দোলা
সেন||
তথ্যসূত্র
– দেনালি ভিজিটরস সেন্টার, গুগল, ইউ টিউব, নেটফ্লিক্স।
No comments:
Post a Comment