Thursday, September 16, 2021

অপ্সরার মন

 

 অপ্সরার মন

||দোলা সেন||

[১]

অপ্সরা, তার আবার মন?

 

হাসির হররা উঠলো ইন্দ্রের সভায়। বরুণের হাত থেকে খানিকটা সোমরস ছিটকে পড়ল পবনদেবের গায়ে। বিরক্ত হয়ে সরে বসলেন অগ্নিদেব।

 

-       কি যে করো না, একটু বিবেচনা রাখতে হয়। অ্যালকোহলটা যদি আমার গায়ে পড়ত, বরুণের বারুণী পানের শখ মিটে যেত একেবারে!

 

-       রীতিমতো অগ্নিকাণ্ড ঘটে যেত, কি বলো? -  হাসছিলেন অরুণ।

 

-       মুখখানা পোড়া হনুমানের মতো হয়ে গেলে ... এইই যাঃ! ব্রহ্মা একটা জিভ কাটলেন।

 

বিষ্ণু একটু বিরক্ত হয়ে বললেন – ত্রিকালজ্ঞ লোকের ভীমরতি ধরলে খুব মুসকিল। টাইম, স্পেস, প্লেস সব গুলিয়ে ফেলছে।

 

শিবের নেশার সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল। তিনি তাড়াতাড়ি বিষয়টার নিষ্পত্তি চাইছিলেন। ডমরুটা করকরিয়ে বাজালেন তিনি।

 

-       উঃ, বাজে না বকে আসল কথাটায় এলে হয় না? মেনকা কোথায়? কেসটা কি নিয়ে?

 

ইন্দ্র তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন -  আমি বলছি। সে ছুটি চাইছে।

 

-       কদিনের ছুটি? এইটুকু তুমি ম্যানেজ করতে পারলে না? একেবারে ত্রিদেবের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতে লেগেছ? সাবালক হবে কবে? – মহাদেব রীতিমতো বিরক্ত হলেন।

 

-       ব্যাপারটা আসলে এত সরল নয় স্যার, ইয়ে প্রভু। মেনকা ছুটি চাইছে অনির্দিষ্ট কালের জন্য। সে নাকি মর্ত্যে যাবে। কবে ফিরবে, আদৌ ফিরবে কিনা, তার ঠিক নেই বলছে। অনেক বোঝানো হয়েছে। কিন্তু সেই এক গোঁ ধরে বসে আছে। আপনাদের কাছে যাবে বলে শাসাচ্ছে। তার নাকি মন ভালো নেই।

 

-       হুমম। তা তোমার তো বাপু অপ্সরার লেখাজোকা নেই। একটাকে বাদ দিয়ে দাও। কি এমন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে। আর মর্ত্যে যা ধুলোবালি, পলিউশন – দুদিন বাদে আপনি ফিরে আসার জন্যে কান্নাকাটি করবে।

 

-       ইয়ে, মানে একটা মুস্কিল আছে। - বলছেন আর হাত কামড়াচ্ছেন ইন্দ্র। এই আলভোলা দেবতাটিকে নিয়ে ভারি ঝামেলা। সংসার, রাজনীতির প্যাঁচঘোচ কিছুতেই বুঝতে পারেন না। তাই মরিয়া হয়ে বলে ফেললেন,

 

-        এরকম একটা প্রিসিডেন্স স্থাপন করা হলে পরে খুব মুসকিল হবে প্রভু। সব অপ্সরাই যদি এটা দেখিয়ে ছুটি চায়, তাহলে ইন্দ্রসভার জৌলুশটা আর থাকে কি করে? তার উপর মেনকা তো অন্যতম প্রধানা অপ্সরা।

 

হাঁ হাঁ করে সব দেবতাই একযোগে সম্মতি জানালেন। মেনকা সত্যিই পরম উপভোগ্যা রমণী। রমণে, নৃত্যে, সঙ্গীতে তার মতো পটিয়সী বিরল। সে না থাকলে ...

 

 শিব বিরক্ত হয়ে উঠছিলেন। বিষ্ণু হাল ধরলেন।

 

-       যাকে নিয়ে এতো কাণ্ড, তাকেই ডাকো না হয়। মেনকা কোথায়?

 

অতি অনিচ্ছায় মেনকাকে ডেকে পাঠালেন ইন্দ্র। মেনকা এর অপেক্ষাতেই ছিলনম্রভাবে এসে ত্রিদেবের পাদবন্দনা করে দাঁড়াল বিষ্ণু মেনকাকে দেখছিলেন। সুন্দরীপ্রধানা অপ্সরাটিকে এমন সহজ ,সাধারণ, আভরণহীন বেশে দেখেননি কখনো। সারা অঙ্গে প্রসাধনের লেশমাত্র নেই। লাস্যের চিহ্নও নজরে পড়ে নামূর্তিমতী বিদ্রোহিনী যেন। অথচ কোথাও ঔদ্ধত্য নেই। বিষ্ণু নড়েচড়ে বসলেন। ব্যাপার গুরুতর। ওইজন্য ইন্দ্র মেয়েটাকে আসতে দিতে চাইছিল না! কথাবার্তার হাল ধরলেন নিজের হাতে।

 

-       এই দীনবেশ কেন মেনকা? অপ্সরাদের তো এমন আভরণহীন হয়ে থাকার কথা নয়?

 

-       ক্ষমা করবেন প্রভু, অপ্সরা নয়, আজ এক মা এসে দাঁড়িয়েছে সভায়।

 

-       মা?

 

-       অপ্সরারদের মাতৃভাব থাকতে নেই, অথচ গর্ভধারণ করতে হয় কেন প্রভু?

 

-       মানে?

 

-       সে তো আপনার অজানা নয় দেব। তবু আদেশ করলেন যখন, তখন বলি, আমার গর্ভিনী কন্যা আজ সম্ভবতঃ স্বামী পরিত্যক্তা হতে চলেছে।পূর্বাশ্রমের দ্বার তার জন্য বন্ধ। এই সময়ে আমি তার কাছে, তার সঙ্গে থাকতে চাই।

 

কৌতুক বোধ করলেন বিষ্ণু। ভুলে গেলেন ক্ষণপূর্বে একে দেখে তাঁর অপ্সরার বদলে মেয়ে মনে হয়েছিল।

 

-       যদি সে অনুমতি না পাও? সন্তানস্নেহ তো তোমাদের জন্য নয়!

 

-       তাহলে শুধু কিছুক্ষণের জন্য একবার সেই অভাগিনীকে দেখে আসার অনুমতি দিন মহাভাগ। তারপর থেকে আর কখনো এই স্পর্ধা প্রকাশ করবো নাকথা দিলাম।

 

চমকে উঠলেন নারায়ণ। শেষ কথাটা মেনকা তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছে! তিনি অন্তর্যামী তিনি জানেন মেনকা কি করতে চাইছেজানেন মহাদেবী লক্ষ্মী এবং দুর্গাও। অথচ দুজনেই দাঁড়িয়ে উঠে বরাভয় মুদ্রায় আশীর্বাদ করছেন মেনকাকে। হার মানলেন বিষ্ণু। স্মিত হেসে বললেন – তোমাকে মুক্তি দিলাম স্বর্গের বন্ধন থেকে। তুমি তোমার মেয়ের কাছে যেতে পার। এখানকার দরজা তোমার জন্য খোলা রইলো। কাজ শেষ হলে ফিরে এসো।

 

লক্ষ্মী হাসলেন – সব জেনেও শুধু শুধু ....

 

-       মেয়েটার ঐকান্তিকতাটা বুঝে নিতে হবে না?

 

সভা ভেঙে গেল।

 

[২]

 

সে অনেক আগের কথা। ইন্দ্র দুর্বাসার শাপে লক্ষ্মীহীন হযেছেন। অকাজ করে ঝামেলায় পড়তে তিনি বরাবরই ওস্তাদ।  লক্ষ্মীর অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গ থেকে সব সৌভাগ্য, সৌন্দর্য, আনন্দ বিদায় নিয়েছে। অসুরেরা স্বর্গের দখল নিয়ে নিয়েছে। বিপদে পড়লে, চিরকাল যা করেছেন, আজও তাই করলেন দেবরাজ। বিষ্ণুর কাছে গিয়ে কেঁদে পড়লেন।

 

বিষ্ণু চিন্তিত হলেন। ঘটনাটা খুবই জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। লক্ষ্মী এইসব শাপটাপ দেখে বিরক্ত হয়ে, একেবারে সমুদ্রের তলায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। ওঠার নামও নিচ্ছেন না। সেখান থেকে তাঁকে আনতে হলে সমুদ্রমন্থন করা ছাড়া উপায় নেই। তার জন্য মন্দার পর্বতকে দণ্ড বানিয়ে বাসুকি নাগকে দড়ি হিসেবে এই কাজের জন্য ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু এই সুখী দেবকুলকে দিয়ে এই বিশাল কাজ হবে না। অতএব দেব, দানব, যক্ষ,রক্ষ সবাইকে ডাকা হলো। এরকম কথা দেওয়া হলো যে, এই মন্থনে যা সম্পদ পাওয়া যাবে তা সমানভাবে ভাগ হবেদেবাসুরের সমান ভাগ!

 

জলের প্রবল আলোড়নে জলের তলা থেকে অনেক রত্ন, জীব, জন্তু, বিষ, অমৃত সব উঠে এল। আর উঠে এলো একদল অনিন্দ্যসুন্দরী মেয়ে। মেনকা, রম্ভা, পুঞ্জীস্থলা ....

 

তারপর তো দেবতারা যথারীতি দু-নম্বরী করে নিরানব্বই ভাগ ভালো জিনিস নিজেদের ভাগে নিয়ে নিলেন। মায় অমৃত অবধি।

 

মেনকা তিক্ত হাসল। ছলে বলে স্বার্থসিদ্ধিতে দেবতাদের জুড়ি নেই। দিব্যি ছিল ওরা জলের তলায়। খুব আনন্দেই দিন কাটত তাদের। নাচে, গানে, খেলায় ভরা এক স্বাধীন জীবন ছিল। এই মন্থনের ফলে, ওপরে উঠে মেনকা তাই দিশেহারা বোধ করছিল। কোথায় যাবে এখন? অথচ তাদের বলা হয়েছে, স্বাধীনভাবে নিজেদের সাথী বেছে নিতে! মেনকা সুর খুঁজছিল, সঙ্গীত খুঁজছিল। দেবাসুর, দৈত্যদানব সবার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল সে। এই সময় তার চোখ পড়ল বিশ্ববসুর ওপর। মেনকার স্বপ্নের  প্রতিরূপ যেন। সুরের রাজা গন্ধর্বকে বেছে নিতে তার একটুও দ্বিধা হয়নি। মেনকার দেখাদেখি ওর বাকি বন্ধুরাও অন্যান্য গন্ধর্বদের জীবনসাথী হিসেবে বেছে নিল। অমৃতের ভাগ পেল ওরা, অনন্ত যৌবন পেল। দেবরাজ ইন্দ্রে সভায় নাচগানের অধিকার পেল। আনন্দ রাখার জায়গা কই?

 

বিশ্ববসুর প্রেমে মাতোয়ারা দিনগুলো কাটছিল মন্দ নয়। কিন্তু চিরযৌবন আর একনিষ্ঠতা পাশাপাশি থাকতে পারে না বোধহয়।  বিশ্ববসু অন্য অপ্সরাদের দিকে ঝুঁকল, আর মেনকা দেখল, অপ্সরাদের অন্যতম কর্তব্য হলো দেবতা ও ইন্দ্রের আদেশমতো অনেকের মনোরঞ্জন করা। একনিষ্ঠ প্রেম, সন্তানস্নেহ তাদের জন্য নয়। মেনে নিয়েছিল মেনকা। বৈচিত্র্যময় জীবনটাকে উপভোগ করতেও শুরু করেছিল।  তাই যখন তার আর বিশ্ববসুর সন্তান হলো, তখন সেই মেয়েকে এক মুনির আশ্রমে, গাছতলায় ফেলে আসতে তার একটুও আটকায়নি।

 

সেই মুনির নাম স্থুলকেশ। তিনি এই শিশুটিকে কুড়িয়ে নিলেন। চিহ্ন দেখে তার জন্মবৃত্তান্ত জানলেন। তারপর তাকে আশ্রমেই সন্তানস্নেহে মানুষ করতে লাগলেন। নাম দিলেন প্রমদ্বরা। সে বড় হলো। রুরু নামের এক পুরুষ তার প্রেমে পড়ে বিয়ে করতে চাইল। স্থুলকেশ আপত্তি করলেন না। কন্যাদায় বলে কথা! মেনকা খবর পেয়ে দেখতে এলো। মেঘের আড়াল থেকে মেয়েকে দেখছিল সে। মেয়েটাকে বেশ সুন্দর দেখতে হয়েছে। হবারই কথা। ইসসস, এ যদি অপ্সরা হতো, তাহলে অনন্ত যৌবন ও অনন্ত ভোগ ও আনন্দের স্বাদ পেতে পারত। মেনকা মেয়েটার এমন একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তার বড়ো হওয়া অবধি অপেক্ষা করছিল। বোকা মেয়েটা এর মধ্য রুরু নামে একটা ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে সব মাটি করে দিল। এখন সারাজীবন ওর এই ধুলোবালিমাখা দুঃখময় জগতেই দিন কাটবে। মেনকার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল মেয়েটার অবশ্য তাতে হেলদোল নেই। সে তার সখীদের সঙ্গে খেলায় ব্যস্ত।

 

ধরণীর ক্ষণবাদিতা প্রমাণ করতেই বোধহয়, প্রমদ্বরার পা পড়ল এক বিষধর সাপের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে সেই সাপ তার সবটুকু বিষ ঢেলে দিল মেয়েটার শরীরে। মুহূর্তমধ্যে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল প্রমদ্বারা। কালকূটের জ্বালায় নীল হয়ে গেল তার মৃত শরীর।

 

খবর পেয়ে দৌড়ে এলো রুরু। প্রিয়ার দেহ দেখে দুঃখে আকুল হয়ে উঠল। খানিক বাদে উঠে স্থির স্বরে বলল – আমি যদি সত্যবাদী হই, আজীবন ধর্মপথে থেকে থাকি, যদি আমার ভালোবাসায় কোনো ফাঁকি না থেকে থাকে, তাহলে আমার সব পূণ্যের বদলে আমার ভাবি স্ত্রী প্রাণ ফিরে পাক।

 

তা, এসব কথায় কান দিতে দেবতাদের ভারি বয়েই গেছে। যথারীতি কেউ এসবে পাত্তাও দিল না। তখন রুরু বলল - প্রিয়াহীন হয়ে আমার বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার আমি দেহত্যাগ করছি। জীবনে না হোক, মরণেই আমরা মিলিত হবো। আর এই ব্রহ্মহত্যার দায় আমি মৃত্যুর দেবতাকে দিয়ে যাচ্ছি।

 

যম বেচারা হাঁকপাক করে উঠলেনপ্রমদ্বরার মৃত্যু ওর নিয়তি ছিল। কিন্তু এই রুরুকে দিয়ে ভবিষ্যতে আরো কিছু কাজ করাবার কথা আছে সেটা না হলে তিনি গভীর সমস্য়ায় পড়বেন। তার উপর ব্রহ্মহত্যার দায়! কিন্তু এই ছেলেটা দেখা যাচ্ছে স্থিরনিশ্চয়। তখন, অনেক ভেবেচিন্তে একটা পথ বের করে, হাসিমুখে রুরুর সামনে হাজির হলেন

 

-        শান্ত হও বাপু। পূণ্য দিয়ে কি আর মানুষ বাঁচে? তাহলে তো কোনো পূণ্যবান লোকেরই মৃত্যু হতো না। ওভাবে কিছু হবে না। তবে তুমি যখন এতোটাই আকুল হয়েছ, তখন একটা উপায় করতে পারি। তবে ...

 

-       আমি সবকিছুতে রাজি। বলুন কী করতে হবে।

 

-        সে বড় কঠিন কাজ হে। দেখো বাপু, আয়ুর হিসেবে গোলমাল করার অধিকার স্বয়ং ব্রহ্মারও নেই তোমার প্রিয়া বাঁচতে পারে, যদি তুমি ...

 

-       তাড়তাড়ি বলুন না, কী করতে হবে? আমি সব কিছুতেই রাজি।

 

-       অত অস্থির হয়ো না হে ছোকরা। তোমার জীবনের অর্ধেক অংশ ওই মেয়েকে দিতে হবে। তাতে তোমরা দুজনেই অল্পদিন মাত্র বেঁচে থাকবে। তাই ...

 

-       এই মাত্র? আর কিছু নয়? – রুরু হেসে উঠল।

 

-       পনি যদি আমার সমস্ত আয়ুর বদলে আমাদের একদিন বেঁচে থাকার শর্ত দিতেন, তাতেও আমি রাজি হতাম। প্রমদ্বারা ছাড়া অনেকদিন বাঁচার চেয়ে, দুজনে একসঙ্গে একটা মুহূর্ত কাটানোও আমার কাছে দামি।

 

স্তব্ধ হলো মৃত্যুপৃথিবীর ক্ষণজন্মা ফুলের হাসিতে স্বর্গের পারিজাত নিষ্প্রভ হয়ে গেল। রুরুর আয়ু নিয়ে বেঁচে উঠল প্রমদ্বরা। আন্তরিক আশীর্বাদ করে ফিরে গেলেন সর্বশক্তিমান মরণ।  আনন্দে অধীর হয়ে উৎসবে মেতে উঠল তপোবন।

 

সর্বশক্তিমান? হাসলেন নারায়ণ। তিনি জানেন এই মরণশীল পৃথিবী যুগে যুগে দেখিয়েছে – সে ‘মৃত্যু থেকে বড়ো’যমকে বারবার হার স্বীকার করতে হবে সাবিত্রী, নচিকেতা .....। থাক, বাবি নামগুলো এখন আর নাই বা বললেন।

 

আর সবার অন্তরালে বদলে যাচ্ছিল এক অপ্সরার জীবনবোধ। সে অপ্সরা থেকে নারী হয়ে উঠছিল। স্নেহ, প্রেম, মাতৃত্ব, ত্যাগ ... শব্দগুলো তার হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছিলচিরকালীন শব্দটার মানে বদলে যাচ্ছিল দ্রুতহারে। মন থেকে মেয়েকে আশীর্বাদ করে সে ফিরে গেল তার আনন্দলোকে। কিন্তু যে এসেছিল, সেই ফিরতে পারল কি?

 

[৩]

দিন তার আপন ছন্দেই কাটে। কয়কশো প্রজন্ম পার হয়ে যায়। স্বর্গের আনন্দময় জীবনে তার কোনো দাগ পড়ে না। সত্যযুগ শেষ হয়ে তখন ত্রেতা শুরু হবে হবে করছেএমন সময়ে একটা ঘটনা ঘটল। পৃথিবীতে বিশ্বামিত্র নামে এক ক্ষত্রিয় রাজা ভীষণ তপস্যা শুরু করেছে। তার তপস্যার তাপে স্বর্গের সুশীতল আবহাওয়াও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ইন্দ্র চিন্তায় পড়ে গেলেন। এতো তপস্যা করে কী চায় লোকটা? শেষে ব্রহ্মার কাছে ইন্দ্রের আসনটাই চেয়ে বসবে না তো? বেচারি ইন্দ্রের কী হবে তাহলে? ত্রিদেবের আর কী? তপস্যা ভালো হলে বর দেবার জন্য ওঁদের হাত তো উঠেই আছে! যতো ঝামেলা তো দেবরাজেরই! নাঃ, এর তপস্যাটা ভণ্ডুল করতেই হবে। তবেই শান্তি। এই অপ্সরার দল এসব কাজে খুব দক্ষ। তবে এবার মনে হচ্ছে শ্রেষ্ঠ অপ্সরাকেই পাঠাতে হবে। তিনি মেনকাকে ডেকে পাঠালেন।

 

ভালো করে কর্তব্যকর্ম বুঝে নিয়ে সুন্দরীশ্রেষ্ঠা মেনকা আবার এলো পৃথিবীতে। নাচ, গান আর শরীর দেখিয়ে সে বিশ্বামিত্রকে মোহিত করে ফেলল। তারপর শুরু হলো তাদের যৌথ জীবনযাপন। অপ্সরাদের ভালোবাসা বারণ। সে কি ভালোবেসেছিল এই অমিততেজা মানুষটিকে? প্রমদ্বরার কথা তখন তার মনে পড়েছিল কি? সে জানিনা, কিন্তু পত্নীর যত্নে, প্রিয়ার প্রেমে, ললিতার কামকলায় সে কোনো ফাঁক রাখেনি। রুরু-প্রমদ্বরার জীবন তাকে এই নিবেদিত ভালোবাসা শিখিয়েছে। মাধবীলতার সুবাসে ধীরে ধীরে আবছায়া হয়ে উঠছিল পারিজাত বন।

 

এমন সময়ে তাদের দ্বৈত জীবনে এক নতুন প্রাণ, তার আসার কথা ঘোষণা করল। মেনকার আনন্দ আর ধরে না। কিন্তু খবর পেয়ে চমকে উঠল বিশ্বামিত্র। মেনকার প্রেম যে কথা ভুলিয়ে দিয়েছিল, বাস্তবের মাটি তাকে তা মনে করিয়ে দিল। অপ্সরার এই প্রেম তো তার সাধনা ভোলাবার কৌশল! তার ব্রহ্মত্ব লাভের পথের বাধা। মেনকা তার তপোভঙ্গের জন্য ইন্দ্রের পাঠানো এক সুন্দর ছলনা মাত্র যতই অনুনয় করুক মেনকা, বিশ্বামিত্র আর ভুলবে না! সে সব ছেড়ে আরো গভীর বনে তপস্যা করতে চলে গেল! এরপরে বহু তপস্যার পর, যিনি লোকালয়ে আসবেন, তিনি ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র।

 

ধরণীর ধূলিকে আপন করা সহজ নয়। অনেকখানি দাম দিয়ে মেনকাকে তা বুঝতে হলো। এবারেও একটি ভারি সুন্দর মেয়ের জন্ম দিল সে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে তার মন স্নেহে ভরে ওঠে। কিন্তু তার বুকে সেই অমৃতধারা কোথায়? ইন্দ্রের দেওয়া কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আবার স্বর্গে তার ডাক পড়েছে। কিন্তু এই সন্তান? অপ্সরার সন্তান পালনের অধিকার নেই, তা সে জানে। তার বুক ভেঙে কান্না আসে। অপ্সরার অশ্রু ঝরে না। পরম যত্নে সে মহর্ষি কণ্বের আশ্রমের কাছে মেয়েকে গাছতলায় পাতার বিছানায় শুইয়ে দেয়। বনের পাখিরা মেনকাকে ঘিরে আসে। গার্হস্থ্য জীবনে এদের সঙ্গে তার বড় ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। তাদের হাতেই মেয়েটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে সে আড়ালে যায়। যতক্ষণ না কেউ এসে ওকে তুলে নিচ্ছে, সে কোথাও যেতে পারবে না!

 

আশ্রমের শিক্ষার্থীদের বন থেকে রোজ যজ্ঞের কাঠ, পুজোর উপকরণ, ফুল, ফল যোগাড় করে আনতে হয়। সেরকমই এক তরুণের চোখ টানল গাছতলায় পাখির ভিড়সে কৌতূহলী হয়ে এগোতেই শিশুটির দেখা পেল। মহর্ষি কণ্বকে দৌড়ে গিয়ে খবর দিল। কণ্বের সঙ্গে এলেন মাতা গৌতমী। পাখির আশ্রয়ে থাকা মেয়েটিকে বুকে তুলে নিয়ে বললেন – এ আমাদের শকুন্তলা। মেনকা শকুন্তলা নামখানি বুকে নিয়ে ইন্দ্রের সভার দিকে রওনা হলে। কিন্তু আজ যেন তার পা চলতে চায় না।তবু যেতে হবে। হবেই। মেনকা তিক্ত হাসল। গৌতমীর কোলে বেড়ে উঠবে তার মেয়ে। মেনকা তার প্রথম চলা, তার আধো আধো বুলি, তার আবদার কিছুই দেখতে পাবে না! সে তখন সুন্দর পোষাক পরে নাচে গানে সবার মন ভোলাতে ব্যস্ত থাকবে। এই জীবন আশীর্বাদের? গরম জলের তাপে অপ্সরার নরম গাল যেন পুড়ে যায়। মেনকার ভিতর থেকে কে যেন বলে দেয় – এর নাম কান্না। মেনকা তাড়াতাড়ি চোখ মোছে।

 

সেই থেকে মাঝে মাঝেই সে চুপি চুপি আসে। দূর থেকে মেয়ের বড়ো হওয়া দেখে। বড়ো সন্তপর্ণে সবার চোখ এড়িয়ে সে চুরি করে নিয়ে যায় সুন্দর কিছু দৃশ্যের স্মৃতি।

 

বড়ো হচ্ছিল শকুন্তলা। কণ্ব আর গৌতমীর শিক্ষায় কোনো খুঁত ছিল না।  সেই সময় হস্তিনাপুরের রাজা ছিলেন দুষ্মন্ত মৃগয়া করতে বেরিয়ে তিনি শকুন্তলার মন শিকার করে ফেললেন। মুনির মেয়ে ভেবে একটু ইতস্ততঃ করছিলেন বটে, কিন্তু শকুন্তলা যখন জানালো যে সে অপ্সরার মেয়ে, মহর্ষি কণ্ব তার পালকপিতা, তখন তিনি নিশ্চিন্ত হলেন। কালিদাস যাই লিখুন, মেনকার ভারি সন্দেহ হয় রাজাটি তার মেয়েকে ভালোবাসে তো? নাকি অপ্সরার মেয়ে বলে ...। মেনকা প্রাণপণে দুষ্মন্তের চোখে রুরুর সেই নিবেদিত দৃষ্টি খোঁজে। পায়না। অস্থির হয়ে ওঠে সে। কিন্তু তার কিই বা করার আছে?

 

তা মেনকার যতই সন্দেহ থাক, শকুন্তলা-দুষ্মন্তের প্রেমের জোয়ারে ভাঁটা পড়ে না। কপালগুণে কণ্ব ও গৌতমী তখন কিছুদিনের জন্য আশ্রমের বাইরে গেছেন। শকুন্তলা তার পিতৃপ্রতিম মানুষটির জন্যে অপেক্ষা করতে চায়, কিন্তু রাজার প্রেমে সে ধৈর্য কই? অগত্যা সখীরা মিলে দুজনার গন্ধর্বমতে বিয়ে দিয়ে দিল। শরীরে শরীর মিলে আগুন জ্বলল। দিন যায়। রাজার ভোগ সম্পন্ন হয়েছে। তাঁর মনে পড়েছে, বনের বাইরে তাঁর সৈন্য তাঁর জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। অতএব তিনি শকুন্তলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেন। যাবার আগে ভোগতৃপ্ত পুরুষ যেমন নারীকে সান্ত্বনা দেয়, তেমনি করেই বলে গেলেন, রাজধানীতে গিয়েই নাকি তিনি তাঁর প্রেয়সীকে মহা সমারোহে, সম্মানের সঙ্গে রাজ্যে নিয়ে যাবেন। মেনকার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস পড়ল।

 

 বনবাসিনী শকুন্তলা, সরলা শকুন্তলা, প্রেমিকার বিশ্বাস ও নির্ভরতায় রাজার অপেক্ষায় থাকে। রাজা আর আসেন না। কণ্ব ও গৌতমী এসে সব শুনলেন। বুঝলেন আর কিছু করার নেই। গন্ধর্ববিবাহ শাস্ত্রমতে সিদ্ধ। অতএব তাঁরা নিশ্বাস চেপে শকুন্তলাকে আশ্রমেই রেখে দিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই শকুন্তলার গর্ভচিহ্ন দেখা গেল। গৌতমী তাকে ভারি যত্নে রাখেন। কন্যাস্নেহে মানুষ করেছেন, এ মেয়ে তাঁর ভারি আদরের। কিন্তু এইবার কণ্ব বেঁকে বসলেন। তিনি জানেন, শকুন্তলার সন্তান এখানে হলে সে বাবার কোনো স্বীকৃতি পাবে না। অতএব তিনি তাঁর দুই শিষ্য দিয়ে শকুন্তলাকে হাস্তিনাপুরে পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন।

 

মেয়েকে যথাবিধি সব উপদেশ দিয়ে, কর্তব্যকর্ম বুঝিয়ে অবশেষে পরিষ্কার দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণে যা বললেন, তার সার কথা হলো –

 

-       তুমি বাপু আসলে বিশ্বামিত্র আর মেনকার মেয়ে। আমরা তোমায় এতদিন লালনপালন করেছি বটে, কিন্তু তুমি নিজের স্বাধীন ইচ্ছেয় দ্যুষ্মন্তের বউ হয়েছ। তার সন্তানের মা হতে চলেছ। কাজেই তোমার উপর আমার আর কোনো দায় নেই। যথাবিহিত সুরক্ষা দিয়ে আমার শিষ্যেরা তোমাকে রাজবাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। তারপর রাজা তোমায় মেনে নিলে ভাল, না হলেও তোমার জন্য এই আশ্রমে আর কোন জায়গা হবে না। এখন থেকে তোমার ভাগ্য তোমাকেই তৈরি করে নিতে হবে।

 

[৪]

সখীরা শকুন্তলাকে যথাসাধ্য সাজিয়ে গুছিয়ে চোখের জলে ভেসে আশ্রম থেকে বিদায় জানাল। শেষবারের মতো তার আবাল্য পরিচিত আশ্রয়কে শেষবারের মতো দেখে শকুন্তলা পথে নামল মাতা গৌতমী আর শারদ্বত, শার্ঙ্গরব নামে দুই শিষ্য চললেন তাঁকে পৌঁছে দিতে।

 

রাজসভায় যা হবার তাই হলো। দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে চিনতে পারলেন না। রাজাদের জীবনে অমন কতো ঘটনা ঘটে! সব মনে রাখতে গেলে তো আর রাজকার্য করাই যায় না। তার উপর এই মেয়ে আবার অন্তঃসত্তা! এতদিনের চিন্তায়, ভাবনায়, পথশ্রমে, প্রসাধনহীনা মেয়েটিকে রাজসভার ঔজ্জ্বল্যে খুব সাধারণ লাগছিল। অতএব শকুন্তলার কপালে রাজার তিরস্কার ও বিদ্রূপ ছাড়া কিছুই জুটল না। গৌতমী বললেন – মহারাজ দুষ্মন্ত, এই কন্যা সত্য কথাই বলছে। সে তোমার পত্নী। এবার তুমি তাকে গ্রহণ করবে না ত্যাগ সে তোমার ব্যাপার। আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়েছে। আমরা বিদায় নিলাম।

 

 একাকী শকুন্তলা রাজসভায় দাঁড়িয়ে রইল

 

দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে রীতিমত অপমান করলেন। এমন কি “স্বর্গের বেশ্যার মেয়ে আর কতোই বা ভালো হবে, নিজেও নিশ্চয়ই...” - বলতেও ছাড়লেন না। কতো আর সহ্য করা যায়! তেজস্বিনী শকুন্তলা এবার মুখ খুলল –

 

-       নিজের দিকে তাকিয়ে কথা বলো হে রাজা! আমার মা স্বর্গচারিণী, তুমি তুচ্ছ ধূলার সন্তান। আমি ইচ্ছামাত্র সর্বত্র যেতে পারি। আর তুমি? ঠিকই বলেছ, আমার সাথে তোমার আকাশ আর পাতালের তফাত। তুমি নিজে মিথ্যবাদী হয়েও ভালোমন্দের জ্ঞান দিচ্ছ আমায়? নেহাত তুমি আমার স্বামী, তাই এতক্ষণ কিছু বলিনি। শোন হে মহারাজ, তোমায় ছাড়াই আমি সন্তান মানুষ করতে পারব। আমি তোমায় ত্যাগ করলাম। আজ বলে যাচ্ছি আমার সন্তান তোমার চেয়েও অনেক বড় রাজা হবে। রাজচক্রবর্তী।

 

জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার মেয়ের কাছ থেকে পেয়ে এক মা তখন চোখের জলে ভেসে যাচ্ছিল। কিন্তু আজ তা তাকে পুড়িয়ে দিল না। বরং শান্ত করল, স্নিগ্ধ করল, তৃপ্ত করল। শকুন্তলা রাজসভা থেকে বেরিয়ে এলে মেনকা তার সামনে এসে দাঁড়াল। দু হাত বাড়িয়ে বলল –  মা আমার, আমার সঙ্গে যাবি?

 

-       অপ্সরা মেনকা?

 

-       না। তোর মা। তোর সুখের দিনে আসতে পারিনি বলে, আজ আমায় ফিরিয়ে দিবি? সব ছেড়ে আমি যে আজ তোর কাছেই এসেছি।

 

তাকিয়ে দেখল শকুন্তলা। দুচোখ টান করে এক মা-কেই দেখল। তারপর নিশ্চিন্তে বাড়ানো দুহাতে নিজেকে সঁপে দিল।

 

হেমকূট পর্বত। গন্ধর্ব আর অপ্সরাদের বাসস্থান। সেখানে মা-মেয়ের সংসারে একটি নতুন প্রাণের আবির্ভাব হয়েছে। সবাই মিলে তার নাম রেখেছে ভরত। মেনকা জীবন চিনছে। মেয়েকে দেখে নারীর প্রকৃত রূপ জানছে। এই ভরত আর শকুন্তলার খুশির কাছে তার নিজের সুখ, আনন্দ, এমন কি জীবনও কতো তুচ্ছ বুঝতে পারছে। বুঝে শান্তি পাচ্ছে।

 

একদিন পুরোনো দিনের কথা হতে হতে, শকুন্তলা বলল,

 

-       তুমি ছুটি না পেলে একদিনের জন্য এসে কি করতে চেয়েছিলে মা?

 

-       তখনো জীবন চিনিনি রে মা। - মেনকা একটু শিউরে উঠল।

তোকে বলতে চেয়েছিলাম, যে পুরুষ স্বামীর, পিতার দায়িত্ব নেয় না, তার উত্তরাধিকার নদীর জলে ভাসিয়ে দিতে।

 

মেয়ে হাসল –  এখন হলে কি বলতে তুমি?

 

-       বলতাম, কোনো এক কাপুরুষ, মিথ্যেবাদীর স্বীকৃতির চেয়ে জীবন অনেক বড়ো। ভরতকে আমরা সেই জীবন চেনাবো

 

[৫]

জীবন চিনতে মেনকার আরো বাকি ছিল। দেবতাদের হয়ে যুদ্ধ করতে দুষ্মন্ত স্বর্গে এসেছিলেন। যুদ্ধে জেতার পরে ইন্দ্র তাঁকে বিশ্রামের জন্য হেমকূট পর্বতে পাঠালেন। পরিবেশ মনোরম। তাছাড়া বিনোদনের যথেষ্ট সুব্যবস্থা।  দুষ্মন্ত খুশিমনে রাজি হলেন। ইন্দ্রকে চিনতে তাঁর অনেক বাকি। সেখানে একদিন ঘুরতে ঘুরতে ‘হঠাৎই’ ভরতের সাথে দেখা। সুন্দর রাজলক্ষ্মণযুক্ত অতি বলবান বালকটিকে দেখে তাঁর স্বাভাবিকই খুব ভালো লাগল। বালকের পরিচয় জেনে তিনি হতবাক। দেবতাদের কথা অস্বীকার করা যায় না। তার উপর এমন যোগ্য ছেলে! শকুন্তলাকে দেখে তিনি আবারও মুগ্ধ হলেন। রাজসভার সেই ক্লান্ত বিধ্বস্ত মেয়েটির সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। অতএব তিনি শকুন্তলাকে ছেলেসহ তাঁর প্রাসাদে নিয়ে যেতে চাইলেন! শকুন্তলার প্রতি তাঁর প্রেম আবার জেগে উঠেছে।

 

মেনকা মনে মনে হাসল পুরুষের এই দৃষ্টি এক অপ্সরার চেয়ে ভালো আর কে চেনে? শকুন্তলা মায়ের হাত ধরে শুধু বলল –

 

-       অনুমতি দাও মা। ভরতের জন্য, তার কুলপরিচয়ের জন্য এ ছাড়া আর অন্য পথ নেই।

 

মেনকা তাকিয়ে দেখল, প্রিয়ের জন্য শুধু প্রাণ নয়, আরো অনেক কিছু ত্যাগ করা যায়। এক অসহ অপমান ভুলে নতুন করে সবকিছু শুরু করার চেষ্টা করা যায়। কন্যা থেকে, প্রিয়া থেকে এক সন্তানের মা হয়ে ওঠা যায়। তার চোখে কোথাও রুরু আর শকুন্তলা এক হয়ে যাচ্ছিল। সে শকুন্তলাকে মন থেকে আশীর্বাদ করল।

 

মেনকা জানে, এরপর তাকে ইন্দ্রের সভায় ফিরে যেতে হবে। সেই জন্যেই দুষ্মন্তকে হেমকূটে পাঠানো তার ছুটি শেষ হয়েছে। আত্মজার ভালো থাকার দাম তাকে এবার মিটিয়ে দিতে হবে। সে তার মাতৃরূপটি খুব গোপনে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখল। এ তার একান্ত আপনার ধন। এতে অন্য কারো অধিকার নেই। বহুদিন পরে সে তার প্রসাধনের পেটিকা খুলে বসল।

দোলা সেন||

 

 

 

 

No comments: