Monday, September 20, 2021

একটা ফ্যানের জন্য

 

কিছুদিন ধরেই নিবারণ বুঝতে পারছিল যে কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে। ঘটনাগুলো ঠিক যেভাবে ঘটবার সেভাবে ঘটছে না। মনে অশান্তি থাকলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গা চুলকাতে চুলকাতে বিড়ি খাওয়াটা নিবারণের অনেক দিনের অভ্যেস। আজও তাই করছিল। কিন্তু খুট করে বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে, তাড়াতাড়ি বিড়িটা নিভিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। নীতা এখুনি এখানে জামাকাপড় মেলতে আসবে। বিড়ির গন্ধ পেলেই ঝামেলা পাকাবে। অফিস যাওয়ার আগে নিবারণ নতুন করে আর কোনো অশান্তি চায় না।

 

অবশ্য সেভাবে দেখতে গেলে নীতা তো ঝগড়া করেও না। কিন্তু হাসিমুখেই এমন দু তিনটে কথা বলে, যা নিবারণ বাপের জন্মে শোনেনি। ভাবা দূরস্থান। ফলে তখনকার মতো হার স্বীকার করা ছাড়া উপায়ও থাকে না। নিবারণ এমনিতে রাগী মানুষ। তার বাবার মতোই। অথচ বাবার রাগের পরে মায়ের প্রতিক্রিয়া, আর তার রাগের পরে নীতার.... নিবারণের মাথাটা আবার গরম হয়ে গেল। মা, বাবাকে কতো ভয়, কতো মান্য করে চলে এখনো, আর নীতা?

 

সেদিনের ঘটনাটাই ধরা যাক। রাতে নিবারণ বিছানার পাশে আলো জ্বেলে বই পড়ছিল। নীতার অসুবিধে হচ্ছিল। দুবার আলো নেভাতে বলায়, নিবারণের রাগ হয়ে গিয়েছিল। তেড়ে উঠে বলেছিল – “এত যখন অসুবিধে, অন্য ঘরে চলে যাও।“

-       “ খাটটা যখন আমার, এবং এটা যখন শোবার সময় – তখন তুমিই বরং অন্য ঘরে গিয়ে বই পড়।“

-       “ও, খাটটা মহারাণীর বাপের দেওয়া। তাই? তাহলে শোন বাড়িটা যখন আমার, তখন ঘরের মালিকানাও আমার। বেরোও এ ঘর থেকে!”

উত্তরে নিশ্চিন্তে চাদর টেনে পাশ ফিরতে ফিরতে মুচকি হেসে নীতা বলেছিল – “বোধহয় ভুলে যাচ্ছ, বিয়ের পরে বরের সম্পত্তিতে বৌয়ের ফিফটি পারসেন্ট অধিকার। কিন্তু কনেকে দেওয়া উপহার তার স্ত্রীধন।“

রাগে তোতলা হয়ে গিয়েছিল নিবারণ। এক ঝটকায় বালিশটা তুলে পাশের ঘরে চলে গিয়েছিল। অবশ্য ফিরেও এসেছিল একটু বাদে। গরম আর মশার কামড়ের জ্বালাটা রাগের চেয়ে বেশি কষ্টকর লেগেছিল। অন্য ঘরের ফ্যানটা এখনো কেনা হয়নি। এই মুহূর্তে বাড়িতে একটাই ফ্যান। আর সেটা শোবার ঘরে! খানিক পরে নতুন খাট, নতুন বৌ... সকালে আর রাগের চিহ্ন দেখা যায়নি কোথাও।

 

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিবারণ নিজের গামছা নিয়ে বাথরুমে ঢোকে। জামাকাপড় কাচতে কাচতে আরও একবার ভাবে, তার কপালটাই মন্দ।

 

আসলে ব্যাপারটা প্রথমে এরকম ছিল না। অন্তত নিবারণ কিছু টের পায়নি। চাকরি পাবার পর গড়পড়তা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো তার বাড়ির লোকজনও ছেলের বিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। নিবারণও খুব স্বাভাবিকভাবেই ঘাড়ে পাউডার লাগিয়ে কয়েকটি মেয়ে দেখে ফেলল। নীতাকে দেখে তার বেশ পছন্দ হয়েছিল। একেবারেই কোনো প্রসাধন ছাড়া শুধু একটি ভালো শাড়ি পরে এসে সে যখন বসেছিল, তখন নিবারণের মন বলে উঠেছিল মেয়ে দশজনের একজন নয়। দশম। পছন্দের আরও একটা হেতু ছিল। নীতার চাকরি। বিবাহোত্তর জীবনের স্বচ্ছলতাটুকুও সে মনে মনে হিসেব করে নিয়েছিল বৈকি।

 

তা বিয়ে থাওয়া ভালোভাবেই চুকে গেল। মানে বিয়ে, বৌভাত, দ্বিরাগমন, মায় গ্যাংটকে একটা ছোট্ট মধুচন্দ্রিমা পর্যন্ত। গোলমালটা শুরু হলো দুজনে ফ্ল্যাটে আসার পর থেকে। দেশের বাড়ি অনেকটাই দূরে বলে নিবারণ যাতায়াতের সুবিধার জন্য এই ফ্ল্যাটেই থাকত। ছুটিছাটায় বাড়ি যেত। বৌকে সেখানেই এনে তুলেছিল। মায়েরও আসার কথা ছিল, কিন্তু বিয়েবাড়ির ধকলে তার শরীরটা খারাপ হওয়ায় নীতাই বারণ করেছিল।


-       “তোমার এখন যাবার দরকার নেই। আমরা ঠিক গুছিয়ে নেব। শরীর ভালো হলে চলে এসো। চারজনে মিলে খুব আনন্দ করব।“

-       “কিন্তু নীতা, মা না গেলে কি করে...”

-       “খোকা ঠিক বলছে রে মা। তুইও ছেলেমানুষ, আর খোকাও তো কোনোদিন দায়িত্ব নিয়ে কিছু করেনি। তোদের খুব কষ্ট হবে।“

-       “হলে হবে। তিরিশ বছরের দুটো দামড়া লোক কাজ করতে পারবে না, আর উনি ষাট বছরের বুড়ি চললেন শরীর খারাপ নিয়ে কাজ করে দিতে!”

-        “কিন্তু..”

-       “ ওষুধ খেয়ে ঘুমোও দেখি। আর বাবাও তো শুনেছি এই বয়েসেই..”


নিজের মুখের হাসিটা শাশুড়ির মুখে সংক্রামিত করে নীতা অবলীলায় পাশের ঘরে ব্যাগ গোছাতে চলে গেল

 

প্রথম দুদিন বেশ কেটেছিল। আফিস, ঘর গোছানোর ব্যস্ততায় অন্য কোনোদিকে মন দেবার ফুরসত হয়নি। তারপরে এক সকালে –

-       “বাথরুমে তোমার ছাড়া জামাকাপড় আছে দেখলাম। তুমি কি ছুটির দিনে, ওগুলো একসাথে কাচো?”

-       “মা- মানে?”

-       “ওরকমভাবে মেঝেতে ফেলে রাখলে বড়ো নোংরা দেখায়। তুলে ছাড়া কাপড়ের বাস্কেটে রেখে দাও। যখন কাচবে বের করে নিও।“

মুখের দিকে তাকালে নিবারণের বিরাট হাঁ করা মুখটা নিশ্চয়ই নজরে পড়ত নীতার। কিন্তু সে তখন পিছন ফিরে টানটান করে নিজের জামাকাপড় মেলতে ব্যস্ত।

 

নিবারণ চিরকাল দেখে এসেছে, কাজের লোক না এলে তার এবং বাবার ছাড়া জামাকাপড় মাই ধুয়ে দেয়। এমনকি সে জামা কোনোদিন মনোমত পরিষ্কার না হলে বাবার গজগজানি এবং মায়ের অপরাধী মুখটাও চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আর নীতা? যেমন স্বাভাবিকভাবে কথাটা বলল, তাতে নিবারণ তো এটাও জিজ্ঞাসা করে উঠতে পারলো না যে তুমি ধুলে না কেন? নিজের পুরুষকারকেই ধিক্কার দিল নিবারণ। গণ্ডগোলটা তারই। নয়তো বৌয়ের এতো সাহস আর অস্পর্ধা সে বাপের জন্মে দেখেনি।

 

তবে সব কিছুরই তো একটা সীমা থাকে, নাকি? সেদিন খাবার টেবিলে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না নিবারণ। তার খিদেটা একটু বেশি। খেতেও ভালোবাসে। বলতে নেই নীতার হাতের রান্নার তারটিও বড় মিঠে। কিন্তু গত দুদিন ধরে...


-       “সব সবজি দিয়ে মাছের ঝোলটা না করে দুটো আলাদা পদও তো করতে পার। এই একপদ দিয়ে খাওয়া যায়?”


নীতার মুখে অপরাধবোধের সামান্যতম ছায়াটুকুও দেখা গেল না। তবে নরমভাবেই বলল – “অসুবিধা হচ্ছে বুঝতে পারছি। আসলে সকালের কাজ সারতে সারতে দেরি হযে যায়। তুমি যদি সবজিটা কেটে ধুয়ে রাখতে পারো তাহলে দুপদ করে নেওয়াই য়ায়।“


নিবারণ রাগের চোটে তুতলিয়েই গেল।


-       “আ-আমি? সবজি কেটে ধু-ধুয়ে রাখব?”


নীতার খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। নিজের থালাবাটি ওঠাতে ওঠাতে হাসিমুখেই বলল – “ ঘরে আর কেউ নেই যখন –“


আধখাওয়া ভাত ঠেলে দিয়ে নিবারণ উঠে পড়ল – “আমি ক্যান্টিনে খেয়ে নেব।“


মায়ের মতো কেউ সাধতে এলো না। নীতা অনুরোধ করল না, চেঁচামেচিও নয়। নিঃশব্দে থালার খাবারটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে টেবিল পরিষ্কার করে নিল। তারপর শাড়ি পরে রোজকার মতোই টিফিনবাক্স ব্যাগে পুরে অফিস বেরিয়ে গেল।

 

এমন ঘটনা নিবারণ বাপের জন্মে দেখেনি। একবার বাবা রাগ করে চা ফেলে দিয়েছিল। মা কেঁদেকেটে প্রায় পায়ে ধরে দ্বিতীয়বার চা করে খাইয়েছিল। ইচ্ছে করেই সেদিন একটু দেরি করেই অফিস থেকে ফিরল নিবারণ। ফিরে দেখে বৌ চা এবং চপ সহযোগে খাটে পা ছড়িয়ে বসে টিভি দেখছে। নিবারণের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। এই প্রথম সব ভুলে চেঁচিয়ে উঠল – “এবার থেকে কি খাওয়াটাও যার যার, তার তার?”

 

রাগ দেখে নীতা হেসেই ফেলল – “তোমারটা হটপটে রাখা আছে। জামাকাপড় ছেড়ে, হাত-পা ধুয়ে এসো। দিচ্ছি।“

 

নিবারণের গোঁ তবু যায় না।

-       আমার জন্য অপেক্ষা করলে না কেন?”

-       “ তোমার দেরি হচ্ছিল। আর আমার খুব খিদে পেয়ে গেছিল।“

 

সরল সহজ স্বীকারোক্তি। এরপর আর কিছু বলার থাকে না। তবু কে জানে কেন, নিবারণের মনের মধ্যে রাগটা জমতেই থাকল। জমতে জমতে সেদিন রাতে বিষ্ফোরণটা ঘটেই গেল।

 

সেদিন রাতে খাওয়ার টেবিলে গল্প হচ্ছিল। অফিস থেকে ফেরার পথে, সারপ্রাইজ দেবে বলে মাংস কিনে এনেছিল নীতা। রাতের মেনু তাই কষা মাংস আর রুটি। নীতার হাতের রান্নার তারিফও করেছিল নিবারণ। কিন্তু খাওয়ার শেষে নীতা দুম করে বলে বসল – “আজকের বাসনটা তুমি মেজে নিও। আমার ক্লান্ত লাগছে।“

 

এতেও যদি মেজাজ না হারায়, তাহলে আর মেজাজটা আছে কি করতে? নিবারণ বলে সবে আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিল! ক্ষেপে লাল হয়ে চেঁচাতে থাকল –


-       “তোমাকে বিয়ে করে আমার জীবনটা নরক হয়ে গেল। কি ছিরির সংসার!”

-       “তাহলে জেনে রাখ, বিয়ে করার আগে আমিও ঢের ভালো ছিলাম।“ – বিয়ের পরে এই প্রথম মেজাজ হারালো নীতা।

-       “কাপড় কাচো, সবজি ধোও, বাসন মাজো – এমন জানলে বিয়ে করত কোন শালা?”

-       “কেন যে মরতে বিয়ে করতে গেলাম? সকালে উঠে একটু কাগজটা দেখারও সময় পাই না। সারাদিন শুধু অনর্থক কাজ!”

-       “বোকার মতোন কথা বলোনা। বিয়ের পরে সব মেয়েই সংসারের কাজ করে। আমার বন্ধুদের বৌদের দেখে এসো গিয়ে।“

-       “সংসার বুঝি একা মেয়েটারই?”

-       “কথাতেই আছে, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। তা আমার যেমন কপাল

-       “থামলে কেন? পরের লাইনটাও বলো?”

-       “লাইন আবার কি? এটা একটা প্রবাদ।“

-       “না মশাই। এটা একটা ছড়া। পরের লাইনটা হলো – গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে।“


নিবারণকে হতভম্ব অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রেখে নীতা নিশ্চিন্তে শোয়ার ঘরে চলে যায়। গায়ে চাদর টেনে বোধকরি ঘুমিয়েও পড়ে। বাসনগুলো থেকে পেঁয়াজ- রসুনের গন্ধ ছাড়ছে। উপায়ান্তর না দেখে বাসনগুলো ধুয়ে ফেলে নিবারণ। তারপর একবার পাখা, আর একবার খাটটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যধারে শুয়ে পড়ে। পরের মাসে আর একটা ফ্যান কিনে আনবেই সে। আর পারা যাচ্ছে না।

*

*

*

*

মাঝরাতে একবার ঘুম ভেঙেছিল নিবারণের। নীতার দিকে চোখ গেল। একটা ক্লান্ত অসহায় মুখ। গলার কাছে বিনবিনে ঘাম জমেছে। হঠাতই মেয়েটার জন্য বড়ো মায়া হলো নিবারণের। অফিস থেকে ফিরে গরমে ঘেমে নেয়ে অনেকক্ষণ ধরে রান্না করেছিল বেচারি। সত্যিই মেয়েটার খুব খাটুনি যায়। সকালে নিবারণ যখন চায়ের কাপ হাতে খবরের কাগজে চোখ রাখে, তখন নীতা ঝড়ের বেগে ঘর পরিষ্কার করে। ফাঁকে ফাঁকে রান্নাও। অফিস থেকে ফিরে নিবারণ চায়ের কাপ হাতে টিভির সামনে বসে থাকে, আর...

 

নিজেকে বড়ো ছোট মনে হয় নিবারণের, বড়ো স্বার্থপরও। উঠে ফ্যানটা একঘাট বাড়িয়ে দেয়। বিছানায় শুয়ে আলতো হাতে ঘাম মুছিয়ে বউকে কাছে টেনে নেয়নীতাও ঘুমের ঘোরেই দিব্বি নিবারণের বুকের মাঝে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ে। নিবারণ ঘুমিয়ে পড়ার আগে মনে মনে ভাবে, ফ্যান কেনার আগে একটা কিচেন চিমনি কেনা দরকার। রান্নাঘরের তেলকালি ওঠাতে বড্ডো খাটুনি হয় মেয়েটার। আর কাল থেকে একটু তাড়তাড়ি উঠে কাজগুলো দুজনে হাতে হাতে করে নিতে হবে।

দোলা সেন||

No comments: