দীঘির জলে কালো হিলহিলে শরীরটা নানান ভঙ্গিমায় এঁকেবেঁকে যাচ্ছিল। স্নান করতে করতে তাই দেখছিল বীরা। জলে পড়লে শিবাটা কেমন যেন মাছ হয়ে যায়! অনেক ডাকাডাকি সাধাসাধি করে রোজই ঘরে নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু আজ বীরার খুব খিদে পেয়েছে। তিনবারের বার তাই একটু উঁচু গলায় হাঁক দিল – ‘উঠে আয় এবার। আমি ঘর গেলাম।‘
ব্যস, কথা শেষ হলো কি না হলো, শিবার টিকিটিও আর দেখা গেল না। কোথায় ডুবকি দিয়ে রইলো কে জানে। ভারি বিরক্ত হয়ে বীরা মাথা মুছতে মুছতে ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাবে, অমনি পায়ে একটা হাত জড়িয়ে গেল। আরেকটু হলেই বীরা উল্টে পড়ছিল আর কি! হাতে পায়েই বড়ো হয়েছে ছেলেটা, একটুও বুদ্ধি যদি থাকত! বকতে গিয়েও শিবার দুষ্টুমিভরা হাসিমুখটা দেখে শেষ পর্যন্ত আর বকা হলো না।
বাড়িতে ঢুকে গামছা মেলতে মেলতেই বীরা হাঁক পাড়ে – ‘বৌ ভাত বাড়, আমরা এসে গেছি।‘
মালতী জানে মাথায় জল পড়লে মানুষটা আর দাঁড়াতে পারে না। পেটে যেন আগুন জ্বলে।
চটপট নিকানো দাওয়ায় আসন পাতে। থালায় চূড়ো করে ভাত, ভাতের উপর গর্ত করে ডাল, লাউশাক
আর বাঁধাকপির তরকারি সাজিয়ে আনে। বাপব্যাটায় হাপুস হুপুস খায়। নিজেদের বাগানের
সবজির স্বাদই আলাদা। বড়ো লক্ষ্মী বউ তার – বীরা ভাবে। বাড়ির পিছনের জমিতে নিজেই
টুকটাক চারা লাগায়। মালতী অনুযোগের সুরে শিবাকে বলে – ‘সারাদিন শুধু টই টই করিস।
খাপলা ফেইলে দুটা কুচোমাছ ধরলিও তো পারিস!’
শিবা জবাব দেয় না। চটপট খাওয়া শেষ করে উঠেই বলে – ‘দাদার
খাবার?’
- ‘ওই তো বেঁইধে রেখেছি। এখুন যত তাড়া। দুমিনিট
আগে আইসতে কী হয়?’
জবাব দেবার সময় কই? শিবা ততক্ষণে উঠোন পেরিয়ে গেছে। একটু
আগে এলে ভালো হতো ঠিকই। কিন্তু জলে নামলে তার যে কি হয়! বিশ্বসংসার ভুলে যায় যেন।
দাদা খেতে হাল দিচ্ছে। নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়ে গেছে বেচারার। কাল বাবা গিয়েছিল বীজ আনতে। আজ একটু পরে কোথায় যেন সার
কিনতে যাবে। এসব কিছু মাথায় থাকে না শিবার। তার চেয়ে শীত পড়লে বাবার সঙ্গে....
বীরা
শিউলিও তখন সেই কথাই বলছিল
মালতীকে। মালতী খেতে খেতেই শুনছিল।
- ‘কালীপুজাও পারায়ে গেল বড়বৌ। ঠাণ্ডা পইড়বে এইবার।‘
- ‘গাছের ইজারা নিবে না?’
- ‘উ তো নেওয়াই আছে। গতবার আসার আগেই বায়না
দিয়ে এসেছিলম। এবার গিয়ে দেখব আরো কিছু গাছ পাই কিনা।‘
- তুমার গুড়ের খুব নাম। গতবার অনেকে না পেয়ে ফিরে গিইছিল।
- ‘তুরা আছিস বলেই এত পারি। কম খাটালি তো হয়
না।‘
- ‘গরীবের ঘরে খাটালিই লক্ষ্মী গো। শুধু চাষে
কি আর সোমবচ্ছর চলে?’
- ‘শিবা চঞ্চল বটে, কিন্তু গুড় বানানোতে খুব
ঝোঁক।‘
- ‘উ ও ভালোই বানায়। তবে এখনো তুমার হাতের মতো
তার হয় নাই।‘
- ‘শিখে যাবে ঠিকই। নবাটার চাষেই ঝোঁক।
দুভায়ের মিলমিশ থাকলি উয়াদের কখনো ভাতের অভাব হবে নাই।‘
মালতী এঁটো হাতটাই আলগোছে মাথায় ঠেকায় – ‘ঠাকুর, ভাইয়ে
ভাইয়ে মিল রেইখ।‘
শীত পড়লেই বীরা এবং বীরার মতো আরো অনেকে ঘর সংসার ঘাড়ে
নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পরিযায়ী পাখিদের মতো সেখানে আস্তানা
গাড়ে। তাদের শিউলি কেন বলা হয়, তাও তারা জানে না। শীত শেষ হলে আবার নিজের কুলায়
ফিরে আসে। সেখানে বীরা সাইনবোর্ড টাঙায়। হলদে টিনে কাঁচা হাতে গোটা গোটা করে লেখা –
‘এখানে ললেন গুড় পাওয়া যায়’। সে বসে বসে খেজুর রস জ্বাল দিয়ে গুড় বানায়। নলেন
গুড়ের গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে যায়। পথচলতি
বাবুরা গাড়ি থামিয়ে কিনে নিয়ে যায়। আসপাশের গ্রামগঞ্জ থেকেও লোক আসে। একই জায়গায়
প্রতি বছর আসে বলে তার প্রচুর নির্দিষ্ট গ্রাহক আছে।
ইদানিং আরো কয়েকজন এপাশে ওপাশে খেজুর গাছের ইজারা নিয়ে
গুড় বানাতে বসছে। তবে বীরা খেজুর রসে আখের রস বা চিনি মেশায় না। আর সাঁঝের আঁধারে
তাড়িও বেচে না। এ ব্যাপারে তার খুব কড়াকড়ি। তাই তার বাঁধা গ্রাহকেরা আর কোথাও যায়
না। পুলিসের বড়বাবুও তার পাকা খদ্দের! পয়সা না পাওয়া গেলেও পাহারাটা পাওয়া যায়। বেশ
দূর দূর থেকেও বাবুরা এসে তার গুড় কিনে নিয়ে যায়।
কিছুদিন পর বীরারা চারজন, গ্রামের আরও কিছু গুড়ের
ব্যাপারী মিলে একটা ছোট হাতি ভাড়া করে রওয়ানা দেয়। প্রথমেই নামে বীরারা চারজন। ঢেউ খেলানো মাঠে ছড়িয়ে আছে
কিছু খেজুর গাছ, পলাশ আর ছোট ঝোপ। বটগাছটা একটু দূরে ঝুরি নামিয়ে তলা আঁধার করে
রেখেছে। নব আর শিবা মিলে চটপট তালপাতা আর বাঁশ দিয়ে একটা ছাউনি বানিয়ে ফেলে। একটা
ছোট বাথরুমও আলাদা করে বানায়। নবর তাড়াই থাকে বেশি। ছোট হাতি বা মিনি ট্রাকটি যখন
সবাইকে পৌঁছে ফিরবে, তখন ফিরতি পথে নবকে তুলে নেবে। বীরা নেমেই চলে গেছে গাছের
বায়না নিতে। গাছের মালিক লোক ভালো। এই জমিটা মোটামুটি পরিষ্কার করিয়েই রেখে দেয়।
একগাল হাসি নিয়ে ফিরল বীরা। তার হাসিই বলে দিচ্ছে, সে
এবার আরও কয়েকটি সরেস গাছ পেয়েছে। মালতী ইতিমধ্যে একটু জায়গা খুঁড়ে উনুন বানিয়ে
ফেলেছে। সে সবার হাতে হাতে চা মুড়ি ধরিয়ে দেয়। খেতে খেতে নব বলে – ‘ ইটাতে পলিথিন
দিবে। নয়তো ঠান্ডায় জমি যাবে। ঘর খালি রইবে, তাই। লয়তো আমি কইরে দিতম।‘
ছেলের চিন্তা দেখে বীরা হাসে। ভালোবাসার উষ্ণতায় ভরা
সুখী মানুষের হাসি। মালতী বলে – ‘না, না। তুকে থাকতে হবেক লাই। তু ঘর যা। এই কয়মাস
পিসির ঘরে খেইয়ে নিস। আমি কথা করে এসেছি।‘
- ‘বুঝলি বৌ, ইবার ফিরে গিয়ে নবার বিয়া দুব। তখন
ব্যাটার বৌ রেন্ধে খাওয়াবে।‘
- ‘তুমাদের আর কথাটু লাই?’ – নবর অসোয়াস্তি
চোখে পড়ার মতো।
ঠা ঠা করে হাসতে থাকে বীরা। ফুড়ুক ফুড়ুক বিড়ি টানে।
দুপুরের রোদ ঢিমে হয়। নব চলে গেছে অনেকক্ষণ। একটু দূরে
চায়ের গুমটির উনুনের ধোঁয়া ভেসে আসে। এরপর তেলেভাজা আর চায়ের গন্ধ এই বিকেলের মেঠো
বাতাসের সাথে মিশে যাবে। একটি দুটি করে লোক জমা হবে। পাতা বেঞ্চিগুলোতে বসে এ ওর
খবর নেবে। দূরে একটা বাবুদের থাকার হোটেল কি যেন বলে – রিসট, না রিসরট – তাই তৈরি
হচ্ছে। কামিনগুলোও ফিরতি পথে চায়ের দোকান দেখে দাঁড়িয়ে যায়। বীরা আর শিবা তাদের
ছাউনির সামনে বসে তাই দেখছিল। নব চলে যাবার পরে দুজনে তাদের ছাউনিকে পলিথিনে
মুড়েছে। পুরুলিয়ার এই অঞ্চলে শীতের কামড়টা খুব বেশি। কাল থেকে জোগাড়ে লাগতে হবে। -
‘হেই মা কালি, এবার শীতটা যেন চাইপ্যে পড়ে মা।‘
যত ঠাণ্ডা পড়বে, গুড় তত ভালো হবে। রাস্তা অবধি গন্ধে ম’
ম’ করবে। গুড়ের গন্ধে মাছির মতো লোক জড়ো হবে। বীরা মনে মনে হাসল। এই লাল মোরামের
মাঠে মাছি নেই যদিও। সে উঠে এইবার চায়ের দোকানে চলল - ‘পরিচিত জনের সাথে কথা কইবার
লাগে।‘
-
‘আরে
বীরা যে! আজ আলে?’
-
হঁ
গো। আইসে পড়লম তুমাদের ঠাঁঞে। তুমাদের কুশল মঙ্গল তো?’
-
হাঁ গো। চা খাবে নাকি এককাপ?’
-
‘দাও। দামুখুড়ো আস্যে লাই আজ?’
-
‘বাদলায় গেঁদ্যে ভিজিছিল। খুব জ্বর হলো। মনসা পুজার
দিন...’
বীরার মনটা উদাস হয়ে যায়। সকাল
হতেই আসত দামুখুড়ো। এককাপ তাজা আখের রস খেত। সুখদুঃখের কথা কইত।
হরির বৌটাকে বাঁজা বলে খুব
গঞ্জনা দিত শাশুড়ি। সদরে চিকিৎসা করিয়ে এবার ছেলে হয়েছে। রঘু, মিস্তিরির কাজ
নিয়ে বিটু ওস্তাদের সঙ্গে দিল্লি পাড়ি দিয়েছে। দিল্লি কোথায় কে জানে? সেখানে কি
খেজুর গাছ হয়? তাহলে একবার সেখানে যাবে বীরা। সেখানে প্রধানমন্ত্রী থাকে। বীরা
কোনোদিন প্রধানমন্ত্রী দেখেনি। টিভিতে যখন কথা বলে, কি যে ভালো লাগে! নব বলে, সব
নাকি মিছা কথা। হবে হয়তো। বীরা অতকিছু জানে না।
পরদিন অনেক কাজ। মালতী চারপাশের
আগাছা সাফা করে। এককোণে চৌবাচ্চার মতো উনুন খোঁড়ে। কাঠকুটো জমা করে। পরে
বীরা ধারগুলো ঠিক করে নেবে। একটু দূরে পাটালি জমাবার জন্য সার দিয়ে অনেকগুলো ছোট
ছোট বাটির মতো গর্ত খোঁড়ে। এরপর গোবর দিয়ে নিকোবে। দু তিনদিনের মধ্যেই সব কাজ শেষ
করে ফেলতে হবে। নতুন হাঁড়ি চুন জল দিয়ে ধোবে। তার এখন নিঃশ্বাস ফেলবার সময় নেই।
এদিকে বীরা আর শিবা দা, দড়ি,
হাঁড়ি, নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। খেজুর গাছের আগায় হাঁসুলি দিয়ে কোপায়। নিচের ডালপালা
পরিষ্কার করে। কেটে, চেঁছে তোলে গাছের ছাল। দু-তিনদিন পরে রসে গা নরম হবে। তখন নলি
ঠুকে ঢোকানো যাবে। তারপর সন্ধ্যাবেলায় সেই খাঁজে হাঁড়ি বসিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধবে ওরা।। সারারাত
ক্ষত থেকে রস চুঁইয়ে চুঁইয়ে, নল দিয়ে হাঁড়িতে জমা হবে। ভোরবেলায় সুয্যি ওঠার আগেই বীরা
রসের হাঁড়ি নামিয়ে নেবে। শিবা বাঁকে হাঁড়ি
বেঁধে ঘরে পৌঁছে দেবে। বছরের প্রথম রস খেতে ভিড় জমাবে গ্রামের মাতব্বরেরা। মালতী
একটা হাঁড়ি আলাদা করে সরিয়ে রাখে। জানে, এরা চলে গেলেই উঁকিঝুঁকি দেবে কচিকাঁচার
দল। ওদের জন্য ছোট ছোট কাগজের গেলাস আনিয়ে রেখেছে মালতী। এই বালগোপালদের না খাইয়ে
কাজ শুরু করে না সে। এরা তার নিত্যদিনের বিনেপয়সার গ্রাহক। তার আর একটা কারণও
আছে অবশ্য। রস দিলে ওরা ঢিল মেরে কলসী ফাটায় না। আর মোটামুটি জায়গাটার একটা পাহারা
হয়েই যায়। বাচ্চাগুলো খুশি থাকলে গ্রামের লোকেও খুশি থাকে। কাজে অকাজে সহায় হয়।
তারপর চা রুটি খেয়ে কাজে লেগে
পড়ে বীরা আর শিবা। উনুনে আগুন ধরায়। তার
উপর লম্বা চৌবাচ্চার মতো পাত্র বসায়। ইতিমধ্যে মালতী রসের হাঁড়ির মুখে নাইলনের জাল
বেঁধে দিয়েছে। রসের ভিতর মৌমাছি থাকে, পিঁপড়ে থাকে – তারা আটকা পড়ল জালে। ইয়া
লম্বা ডাঁটিওয়ালা খুন্তি দিয়ে নেড়ে নেড়ে রস জ্বাল দেয় বীরা। আর এ্যাত্তোবড়ো হাতা
দিয়ে ওপরের ফেনা বড়ো হাঁড়িতে ফেলতে থাকে শিবা। বীরা বলে – ‘ভালো করে গাদ ফেইলে দে
শিবা। একটুও ময়লা রইলি চলবে লাই।”
বেলা বাড়ে। পাতলা জলের মতো রস
লালচে থেকে বাদামী হয়, তারপর গাঢ় সোনালী। বীরা শিবাকে শেখায়, কখন কতোটা
আঁচ দিতে হয়। কতোটা থকথকে হলে ডাবা করে ঘন গুড় বাটির মতো গর্তে ঢালতে
হয়। কখন তুলে নিতে হয় ঝোলা গুড়। কাপড় দিয়ে মালতী গর্ত ঢেকে দিয়েছে। বাপব্যাটায়
সেখানে গুড় ঢালে। কিছুটা গুড় আরো ঘন করে খুন্তি দিয়ে চেঁছে তোলে। সেই
গুড়বীজ একটু একটু করে সব বাটিতে মিশিয়ে দেয় বীরা। এই বার ঠাণ্ডা হয়ে গেলেই পাটালি
তৈরি। এক দফা শেষ হতেই আরেক দফা রস চাপায়। একটু বেলা হলেই একে একে আসবে খদ্দেরের
দল।
প্রথমদিনের রস জিরেন। নতুন গুড়
বা নলেন গুড়ের সোয়াদ সবচেয়ে ভালো এই দিনের। পরের দিনের রস দোকাট। এ থেকেও মোটামুটি
ভালো গুড় হয়। অভিজ্ঞ খাইয়ে ছাড়া তফাত ধরতে পারে না। তৃতীয় দিনের রসের নাম ঝালা।
বীরা ঝালার গুড় বানায় না। একটু তিতকে কালচে গুড় তার পছন্দ নয়। নলের মুখ বন্ধ করে
গাছকে বিশ্রাম দেয় দু থেকে তিনদিন। তখন অন্য গাছ থেকে রস নেয় পর্যায়ক্রমে। তিনদিন
জিরোবার পরে গাছ আবার জিরেন রস দেয়। যত কড়া ঠাণ্ডা পড়বে, হিম পড়বে ঘন হয়ে – গুড় তত
সুগন্ধী হবে।
শ্রাবন্তী এলে, বীরা তাকে এইসব
বোঝায়। মালতীর এগিয়ে দেওয়া মোড়ায় বসে খেজুর রস খেতে খেতে গালে হাত দিয়ে সে বীরার
বকবকানি শোনে। মালতীর ঘরকন্নার খবর নেয়। শিবা গুড় ওজন করে। বীরা বলে - ‘আজ অল্প
নিয়ে যান দিদি। আরেকটু ঠাণ্ডা পড়লে তখন বেশি করে নেবেন।‘
-
‘কিন্তু আমি তো রবিবার ছাড়া আসতে পারবো না বীরাভাই।‘
-
‘জানি তো। আমি রেইখে দুব আপনার জন্য।‘
রবিবার হলেই বীরার একটা চোখ
সাদা গাড়িটার জন্যে পাতা থাকে। দিদি যেন ঠিক তার খদ্দের নয়। কেন এতো মায়া বীরা
জানে না। শ্রাবন্তীই কি জানে? আসপাশের অজস্র ভিয়েন উপেক্ষা করে, একগাদা তেল পুড়িয়ে
প্রতিবার সে বীরার কাছেই গুড় নিতে ছুটে আসে। বীরা আর মালতীর সংসার তাকে বড়ো টানে।
যেন এর এক কোণে তারও একটু জায়গা ছিল!
গাড়ি চালাতে চালাতে অনিকেত হাসে
– ‘নতুন সওদাগর?’
-
‘মোটেই না। সওদাগরের অমিতাভ তো জটিল, ধান্দাবাজ। এদের
সংসারের গল্পটা অন্যরকম। সহজ ও সরল।‘
-
‘গল্প লিখবে নাকি?’
-
‘ধ্যেৎ’
-
‘অবশ্য এতো সোজা গল্প হয় না।‘
-
‘ একজন পারতেন। বিভূতিভূষণ।‘
-
‘ তা তুমি যখন তিনি নও, তাহলে গুড় খেয়েই খুশি থাক।‘
অনিকেতের হাতে একটা জোরে চিমটি
কাটে শ্রাবন্তী – ‘শুধু আমার পিছনে লাগা।‘
-
‘তবে তোমার বীরাভাইয়ের গুড় ভালো, সেটা স্বীকার করতেই
হবে।‘
এবছর খুব কড়া শীত পড়েছে। ঝুপড়িতে
লেপের তলায় শুয়েও বীরার হাড় শুদ্ধ কেঁপে যাচ্ছে। কালকের গুড়ের যা তার হবে না!
কিন্তু বড্ডো ঠাণ্ডা লাগছে যে!। একটু উষ্ণতার জন্য সে আরও
গুটিশুটি হয়ে মালতীর গায়ের ওমে গা গরম করে নিতে চাইল। গরম শরীরের ছোঁয়ায় মালতীও
ঘুমের ঘোরেই আরামের নিঃশ্বাস ফেলে পা ছড়িয়ে শুল।
রোজকার অভ্যাসে সূর্য ওঠার আগেই চোখ খুলল বীরার।
আজকে আলসি লাগছে। মনে হচ্ছে আরেকটু শুতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু রসগুলো গেঁজে
যাবে। বীরা জোর করে উঠে পড়ল। পুকুরের দিকে যাবার আগে ছেলে আর বৌকে ডাক দিয়ে গেল।
আজকের চা টা মালতী ভালো
বানায়নি। কেমন যেন তেতো। এই চায়ে কি জাড় কাটে? ছেলেটাও হয়েছে মায়ের ধামাধরা। বলে
কিনা, চা নাকি ভালোই হয়েছে! বীরা একটু বিরক্ত হয়েই দড়িদড়া নিয়ে হাঁড়ি নামাতে চলল।
শিবাও চলল আরেক দিকে।
সাবধানেই হাঁড়িটা নামাচ্ছিল বীরা। নামাবার
মুহূর্তে কি করে যেন একটু টলে গেল। হাতের দাখানা তারে লেগে আওয়াজ হলো চড়াৎ। পড়ে
যাবার আগের ক্ষণমুহূর্তে বীরার মনে পড়ল, মালিক এবারে এই গাছটা ছেড়ে দিতে বলেছিল।
বিজলির নতুন তার টানা হয়েছে পাশ ঘেঁষে। গাছটার রস খুব ভালো জাতের ছিল বলে.....
বীরা আর কিছু
ভাববার সময় পায় নি।
নেমেই একটু অন্যরকম লাগল
শ্রাবন্তীর। জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। অথচ গুড়ের গন্ধ তেমন তো মিঠে লাগছে না! পায়ে পায়ে
এগিয়ে এলো। শিবা গুড় জ্বাল দিচ্ছে। আলগা হাসলো শ্রাবন্তী। ছেলে লায়েক হয়ে উঠেছে।
দ্রুত গলায় বলল – ‘এক কেজি গুড় দেবে গো? আজ একটু তাড়া আছে।‘
সাড়া পেয়ে মালতী বেরিয়ে এলো। এমন
রুখুসুখু ওকে কখনো দেখেনি শ্রাবন্তী।
-
‘শরীর খারাপ নাকি?’
কথা না বলে মালতী মাথা নাড়ল।
ঝোলায় গুড় ভরতে ভরতে শ্রাবন্তী বলে – ‘বীরাভাইকে দেখছি না যে?’
মালতী আবছা গলায় বলল – ‘উ তো
মরে গেল।‘
-
‘কিইইই?’
-
‘আগের পুন্নিমা বাদের দিন ভোরে রস নামাতে গাছে উঠিছিল।
হাতের দাখান ইলিকটিরির তারে লেইগে.....’
দ্রুত হিসেব কষছে অনিকেত – ‘দিন
কুড়ি হলো তাহলে। তা তোমরা ঘর যাওনি? বড়ছেলে কই?’
-
‘উ গেছে মহাজনের কাছে। পুলিস এসেছিল। বিজলির জমির ভিতরি
নাকি গাছটা ছিল। জরিমানা দেবার লাগে। তাই মাপ করার জন্য....
টিভিতে
বলে কাজ করতে করতে মরে গেলে সরকার টাকা দেয়। উলটে আমাদের কেন টাকা দিতে বুলছে
দিদি?’
শ্রাবন্তী কি বলবে বুঝতে না
পেরে বোকার মতোই বলে ফেলে – ‘তোমরা বাড়ি যাওনি কেন?’
মালতী কি এই অবোধ প্রশ্নে
বিরক্ত হলো? বোঝা গেল না। তবে সে জবাব দিল। শুকনো গলায় বললো – ‘দাদনের টাকা নেওয়া
আছে। মানুষ মরে গেলি কি আর টাকার হিসেব শেষ হয়ে যায়? গুড় না বিচলি টাকা পাবো
কেমনে? দুদিন গুড় বানাই নি। তা বাদে...’
শিবার মুখ বেঁকে যায় দুঃখে,
বিদ্রূপে – গরীব মানষের শোকের সময় কই কাকিমা? পুলিশকেও তো এবার বেশি গুড় দিতি হবে!’
শ্রাবন্তী কথা খুঁজে পায় না। তার
বোধহয় কোথাও যাবার ছিল। ছটফটিয়ে উঠে পড়ে। শিবা আস্তে করে বলে – ‘এবারের গুড় অতো
ভালো হয়নি। বাবার মতো সোয়াদ এখনো আনতে পারিনি। তবু...’
-
‘তবু তোমার কাছ থেকেই গুড় নেব আমি। পরের বছরে নিশ্চয়ই
ভালো হবে।‘
পরের বছর এসেছিল শ্রাবন্তী। তারও
পরের বছরে গাড়ি থেকে নামতেই সেই চেনা আঘ্রাণে তার মন জুড়িয়ে গেল। শিবা পাকা হাতে
গুড় জ্বাল দিচ্ছে। একটি কচি বৌ গুড় ওজন করে সবাইকে দিচ্ছে। মালতীর কোলে
সাত-আটমাসের একটি ছেলে। ছোট্ট কপালে সূর্যের মতো একটা কালো টিপ। – ‘ছেলেটার বিয়া দিলাম দিদি। একা হাতে সামাল
দিতে লারছিলাম।‘
শ্রাবন্তী হাত বাড়াতেই একগাল
হেসে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাচ্চাটা। বাচ্চার গায়ের মিষ্টি গন্ধের সাথে নলেন গুড়ের
গন্ধ মিশে যাচ্ছিল। প্ল্যাকার্ডটার দিকে আপনিই চোখ চলে গেল শ্রাবন্তীর - “এখানে ললেন গুড় পাওয়া যায়।“
দোলা সেন||
No comments:
Post a Comment