(১)
চৈতি
হাওয়া আগুন ছড়ায়। বিবর্ণ হলদে পাতারা পথের উপরেই দৌড়াদৌড়ি করে ছোঁয়াছুয়ি খেলে। লাল
মাটির থেকে ভাপ ওঠে। এদিক ওদিকে ধুলো পাক খেতে খেতে ওপরে উঠে আবার নেমে আসে।
রোদ্দুরে চোখ জ্বালা করে। চোখের জল যদি আসেও গড়াবার আগেই শুকিয়ে হাওয়ায় মিশে যাবে –
ভাবলো রাই। সারা দুনিয়ায় শুধু এই ঘাটের উপরে গাছের ঘন ছায়া। চাতালে পাথরটায় বসে
বাসন মাজলে পিঠে মাথায় রোদ লাগে না। বরং জলের ছোঁয়ায় বাতাসও যেন একটুখানি নরম বলে
মনে হয়।
রান্না খাওয়া সেরে রাই বাসনের পাঁজা নিয়ে
পুকুরধারে এসে বসে। ঘষে ঘষে রুপোর ঝলক আনে বাসনগুলোতে। তারপর সেগুলো রেখে সে
মৎসকন্যা হয়ে যায়। জলের মধ্যে আলুথালু। গালের উপর লেপটে কুচো চুল। জল আঙুল বুলিয়ে
তার এলোখোঁপার বাঁধন খুলে দেয়। জলের উপর শুধু তার পানপাতার মতো মুখখানি জেগে থাকে।
কমলারঙা শাড়িখানা ফুলে ফুলে ওঠে। জল তার শরীরময় খেলে বেড়ায়। রত্যাতুরা রমণীর মতো
সে শিউরে ওঠে। জল তার আঁচল সরিয়ে দিতে চায়। ক্রমেই দুঃসাহসী হয়ে উঠছে দেখে রাই চোখ
পাকায়। সে হাসে। ছোট ছোট ঘুর্ণিতে তাকে ঘিরে নাচতে থাকে। আদরের হাত বুলিয়ে তাকে
সরাতে সরাতে ঘাটে ওঠে রাই। অন্য বৌ ঝিয়েরা অনেকক্ষণ কাজ সেরে যে যার মতো ফিরে
গেছে। ঘাট এখন শুধু তার একার। বিকেলের ছায়া আরও ঘন হয়ে এসেছে। গামছাটা চিপে ভেজা
বুকের ওপর মেলে দিতে দিতে রাই দেখে –
আঁধার হলো মাদার গাছের তলা
কালি হয়ে এলো দীঘির জল,
হাটের থেকে সবাই এলো ফিরে .....
মাথা
নেড়ে হাসলো রাই। তার ঘরের লোকের ফেরার সময় এখনো হয়নি। কিন্তু আকাশের গতিক ভালো নয়।
মাটি থেকে একটা সোঁদা গন্ধ উঠছে। পাখির ছানার হাঁ-করা ঠোঁটের মতো আকুলতা নিয়ে গাছের
পাতাগুলো স্থির হয়ে প্রহর গুণছে। রাই তাড়াতাড়ি বাসন নিয়ে ঘরের পানে রওনা দিল।
জানলা,
দরজা বন্ধ করতে না করতেই হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টিটা নামল। ঝোড়ো হাওয়ায় দরজা জানলা খটখটিয়ে
উঠল। তার সাথে তাল মিলিয়ে শাশুড়ির ঘুমভাঙা গলা খনখনিয়ে উঠল – বাসন মাজতে এতক্ষণ
লাগে? কোথায় গা ঢলিয়ে এলি? আসুক খোকা। তারপর তোর...
সারা
শরীর তপ্ত হয়ে ওঠে ফের। তাতে বুঝি গায়ের কাপড় গায়েই শুকিয়ে যায়! তবু আলনা থেকে
কাপড় নিতে নিতে রাই শান্ত মৃদু গলায় জবাব দেয় – আমাকে জিজ্ঞাসা করা কেন? দিদি সে
খবর এখনো পায়নি বুঝি?
তেলে-বেগুনে
জ্বলে উঠলো মানদা – জয়ী বুঝি তোর নামে লাগানি ভাঙানি করতেই এবাড়ি আসে? আমার পোড়া
কপাল তাই.....
রাইয়ের
ততক্ষণে জামাকাপড় ছাড়া হয়ে গেছে। ঠক করে চায়ের কাপটা মানদার সামনে রেখে বলে – গরম
চা খেয়ে গলাটা একটু ছাড়িয়ে নাও। তারপর না হয়...
মানদা
থমকে যায়। এইটুকু মেয়ে কিসের জোরে এভাবে সবাইকে তাচ্ছিল্য করে, সেটা সে বুঝতে পারে
না। সব কিছুই যেন ওর গা দিয়ে পিছলে যায়। এতক্ষণ ধরে চেঁচালো মানদা, কিন্তু রাইয়ের
দুটো কথায় যতো জ্বালা, তার একাংশও যে ওকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি, তা বুঝে চুপ হয়ে
গেল। বিড়বিড় করে গজগজ করতে থাকল। রাই অবশ্য সে গজগজানি শোনার জন্য বসে নেই। সে
ততক্ষণে নিজের কাপটা নিয়ে বাগানে চলে গেছে।
সন্ধ্যে
গড়িয়ে রাত। আজ বৃষ্টি ভালোই হয়েছে। ভেজা হাওয়ায় ঝুমঝুমিয়ে তারার ফুল ফুটেছে।
রান্না সারা হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। ছাদের আলসেতে হেলান দিয়ে রাই দাঁড়িয়েছিল। ছাদ
ভিজে চুপ্পুর। অন্যদিন এখানে মাদুর পেতে বসে, আলো জ্বেলে বই পড়ে এই সময়টা। এটা তার
বড় প্রিয় একান্ত সময়। কুঁড়েমি ছেড়ে কৃষ্ণপক্ষের একফালি চাঁদ উঠে এসেছে। আলো দিতে
তার ভারি অনিচ্ছে।
নীচে
অয়নের গলা পাওয়া গেল। রাই ছাদেই আরও
খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল। মানদার নালিশের ঝুড়ি খালি হোক আগে। জানে অয়ন তাকে কিছুই
বলবে না। বড়জোর একটু মিনমিনিয়ে বলবে - মাকে এতো না রাগালেও তো পার!
সারাদিনে
যা হয় না, সেটা এখন হয়। অয়নের এই কথাতে যেন সারাগায়ে বিছুটির জ্বালা ধরে রাইয়ের।
রাগ হলে চেঁচাক অয়ন। তাকে শাস্তি দিক। নয়তো মাকে মুখের উপর বলুক, ‘তুমি ভুল বলছ।
রোজ রোজ এতো নালিশ কিসের? মানিয়ে থাকতেও তো পার?’
এই
যে সর্বদা সবাইকে খুশি করার চেষ্টা, নিজেকে সবার পিছনে রেখে নেই হয়ে থাকা – এটা
মেনে নিতেই সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় রাইয়ের। লোকটার মুখে কেমন যেন কেঁচোর মতন একটা
গ্যাদগেদে হাসি সারক্ষণ লেপটে থাকে। রাতে অনেকক্ষণ ধরে রাইয়ের মান ভাঙায় অয়ন,
রাতভর তাকে নরম আদরে, সোহাগে ভরিয়ে রাখে।
উদ্দাম
ঝড়ের তৃষ্ণা রাইয়ের, মলয় পবনের মৃদু স্পর্শ তাকে আরও ক্ষুব্ধ, বিমর্ষ করে তোলে।
তবুও সে পরদিন সকালে উঠে হেঁসেলে আগুন দেয়। ঘর ঝাড়পোঁছ করে। দুপুরে দীঘির জলে সাঁতরায় একটু
বেশি সময় ধরে। পরদিন অয়ন তার জন্য ঝোলায় ভরে নতুন বই নিয়ে আসে। রাই ভালো করে রাগ
করতেও পারে না। সাত
বছরের বিবাহিত জীবনে একবারও ঝগড়া হয়েছে বলে তার মনে নেই। যেটুকু হয়েছে, সেটা
নিতান্তই একতরফা। সুখীই থাকার কথা, তবু কি যেন নেই, কিসের যেন অভাব রাইকে নির্জন
অবকাশে তাড়িয়ে বেড়ায়।
বিয়ের
পাঁচ বছর পার করার পরেও ছেলেপিলে হলো না কেন – সে প্রশ্ন সবার চোখেমুখে। ওর ওপর
শাশুড়ির রাগের কারণও খানিকটা এই জন্যেই। রাইয়ের অস্থির লাগে। কতোবার ঘরের
মানুষটাকে বুঝিয়েছে – চলো একবার ডাক্তার দেখাই।
কেন
কে জানে, ডাক্তার, পরীক্ষা - এসব কথা শুনলেই কুঁকড়ে যায় অয়ন। বারবার বলে – “কি দরকার? এইতো বেশ আছি। মিছিমিছি ডাক্তারের
পিছনে ছুটে লাভ নেই। হওয়ার হলে এমনিই হবে।“
হাল ছেড়ে দিয়েছিল রাই। বদ্ধ জলার মতো শান্ত লয়ে দিন
কাটছিল। ঠিক তেমনই একঘেঁয়ে। মাঝে মাঝে পচা শেওলার গন্ধ এলেও তা সরিয়ে ডুবকি দেওয়া
যেত। নীচের জলটা তো পরিষ্কারই
ছিল তখনও।
(২)
সেদিনও বিকেলে ঘাট থেকে ফিরছিল রাই। মাথায় বাসনের পাঁজা।
পিছন থেকে আওয়াজ এল – অয়ন মণ্ডলের ঘরটা যেন কোনদিকে?
হালকা হিন্দি টানে পরিষ্কার বাংলা কথা। রাই অবাক হয়ে
ফিরে তাকিয়েছিল। কৌতুকভরা দুখানা চোখ ওর মুখের উপর সেঁটে বসেছিল। দৃষ্টি আর একটু
নামতেই, সচকিতে রাই গায়ের উপর গামছাটা টেনে নিল। ভিজে কাপড়ে তার শরীরের প্রতিটি
খাঁজ দৃশ্যমান। রাই জানে তাকে দেখে
পুরুষের এই মুগ্ধতা অবধারিত। লোকটার এই চেয়ে থাকাটায় তার মধ্যে একটা অসোয়াস্তি
চারিয়ে যাচ্ছিল। তার মনে হলো, এই
তাকানোতে কেমন যেন নির্মল মজা আর দুষ্টুমিও মিশে আছে।
- চলুন, দেখিয়ে দিচ্ছি।
বাধ্য
ছেলের মতো ঘটা করে মাথা নাড়ল। তারপর নিঃশব্দে পিছু পিছু ঘরের দাওয়ায় এসে দাঁড়াল।
রাই কিছু বলবার আগেই গলা ছেড়ে হাঁক পাড়ল – সইমা ও সইমা, আর কতো ঘুমোবে? শিগগির উঠে
বাইরে এসো বলছি!
রাই
হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওই চোখের মানে এখন বুঝতে পারছে। কিন্তু যাকে সে চেনে না, সে
তাকে কি করে পিছন থেকে চিনে নিল, সে ব্যাপারটা স্পষ্ট নয় এখনও। হাসিমাখা চোখদুটো
আবার তার দিকে ফিরল – এবার বোধহয় ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
শশব্যস্তে
ঘরে ঢুকে আগল দিল রাই। জামা পরতে পরতে
একবার নিজের মনেই মুখ ভ্যাঙালো। তারপর হেসে ফেলল।
শাশুড়ির
মুখে এতো খুশির হাসি রাই অনেকদিন দেখেনি। সারা শরীর দিয়ে যেন আনন্দ ছলকে পড়ছে। সে
সামনে এসে দাঁড়াতে হাসিমুখেই বলল – দেখ তো, ঘরে কি আছে। ছেলেটাকে একটু মিষ্টিমুখ
করাই। এ আমাদের শ্যাম রে বৌ। অনেকদিন বাদে দেশে এলো।
এইই
শ্যাম? অয়নের প্রাণপ্রিয় খেলার সাথী? রাই এর কথা অয়নের মুখে, শাশুড়ির মুখে এতোবার
শুনেছে যে মনের মধ্যে গেঁথে গেছে। হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই তো কপালে সেই ত্রিনয়ন! পেয়ারা
পাড়তে গিয়ে পাথর ছুঁড়েছিল অয়ন। ডালে লেগে ছিটকে এসে শ্যামের কপালের দুই ভুরুর মাঝে বিঁধে গিয়েছিল।
বাড়িশুদ্ধ লোক যখন অয়নকে এই মারে কি সেই মারে, তখন শ্যামই হেসে বলেছিল,- অয়ন তো আমার
কপাল খুলে দিল জ্যাঠাবাবু! দেখো আমার ত্রিনয়ন গজিয়েছে!
অয়নকে
মার খাওয়া থেকে সেদিন শ্যামই বাঁচায়। পাশাপাসি বাস। এক ক্লাসে বেঞ্চি ভাগ করে বসা।
বাড়ির কুলের আচার থেকে লোকের গাছের ফল সবই ভাগাভাগি করে খেয়ে বড় হচ্ছিল। ঘটনাটা
ঘটল ক্লাস টেনের বোর্ড পরীক্ষার পর। বাবা, মায়ের সাথে, শ্যাম দার্জিলিং বেড়াতে
গিয়েছিল। খাদে বাসটা উল্টে পড়ে যায়। অদ্ভুতভাবে বেঁচে গিয়েছিল শ্যাম, কিন্তু তার
বাবা, মা বাঁচেননি। এর পরে তার বড়মামা তাকে জামশেদপুরে নিজের কাছে নিয়ে যান। তার পরেও
সে মাঝে মাঝে ছুটিছাটাতে বাড়িতে পিসির কাছে আসত। তখন দু’ বন্ধুতে দেখা হতো। তারপর
পিসিও মারা গেলেন। আর তার আসাও বন্ধ হয়ে গেল। অয়নের বিয়ের সময় এসেছিল বটে, কিন্তু
তখন এত অজস্র লোকের সঙ্গে আলাপ করানো হয়, যে আলাদা করে আর চেহারাটা রাইয়ের মনে ছিল
না। তারপর আর আসেনি শ্যাম। আর আজ এই এতদিন পরে...
মানদা
উঠে গেছে ঠাকুরকে সন্ধ্যারতি দিতে। রাই শ্যামের জন্য ঘর গুছিয়ে দিচ্ছিল। শ্যাম উঠে এসে দরজায় দাঁড়ালো। ভুরু
কুঁচকালো রাই – এবার বলুন তো, বিকেলে আমায় চিনলেন কি করে?
শ্যাম
মিটিমিটি হাসছে – জানতে হলে যে উন, এন, আনগুলো যে ছাড়তে হবে সখি?
কথা
বলার ভঙ্গীতে রাই হেসে ফেলল।
-
উন, এন, আন?
-
ভাবো ভাবো। ভাবা প্র্যাকটিস করো।
-
বলুন না? দাঁড়ান, দাঁড়ান ...এই উন আর
আন?
দরাজ
গলায় হেসে ওঠে শ্যাম। এত জোরে যে, জানলার পাল্লাটাও যেন খটখটিয়ে ওঠে। রাইও হেসে
ফেলে – আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। এবার বলো তাহলে।
-
কিসের এতো হাসি? আমি কি ভাগ পেতে পারি?
অয়ন
কখন ঘরে ঢুকেছে, রাই টের পায়নি – তুমি আজ এত তাড়াতাড়ি?
-
স্টেশনমাস্টারের ওখান থেকে আমি ওর
অফিসে ফোন করে দিয়েছিলাম তো! তবে তোর বউয়ের ক্ষমতা আছে। ঝাড়া তিন ঘণ্টা ধরে আপনি
আজ্ঞে চালিয়ে যাচ্ছে।
-
অয়ন
হেসে ওঠে। প্রাণখোলা হাসি। রাই একটু চমকে অয়নের মুখের দিকে তাকায়। কতদিন পরে এমন
মন খুলে হাসছে অয়ন! সেই সঙ্কুচিত ভাবটা উধাও। শ্যাম কি ম্যাজিক জানে? এবার চোখ
পাকিয়ে অয়নকেই পাকড়ালো শ্যাম –
-
বউয়ের
কাছে ক্রেডিট নিতে শিখেছিস? গতবছর তুই যখন কলকাতায় এলি, তখন আমিই তো তোর বউয়ের
গিফ্ট পছন্দ করে কিনে দিলাম। ইউনিক ছিল কিনা বল?
আর
তুমিও বলিহারি সখী, পায়ের ঝুমঝুমে মল পরে ঘুরছ, আর সেটা কার পছন্দের তা জানো না?
আবার
সমবেত হাসি। ঘরের সবটুকু গুমোট কেটে গিয়ে বাসন্তী হাওয়া বইতে থাকে। রাই হেসে বলে –
তোমরা গল্প কর। আমি রাতের জোগাড় দেখি।
অন্যদিনের
মতো অয়ন আজ শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল না। রাইকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখেও শ্যামের কথাই বলে
চলছিল। একাট ছোট্ট হাই চেপে রাই জানতে চাইল – তোমার বন্ধু এখন কিছুদিন থাকবে তো?
-
হুমম। নতুন কারখানাটায় চাকরি নিয়ে
এসেছে। আগে মহারাষ্ট্রের কোন এক জায়গায় ছিল। তারপর কলকাতায়। এবারে এখানে পোস্টিং হয়েছে। কদিন এখানে থেকে নিজেদের বাড়িটা একটু
ঠিকঠাক করে নিক। হরিকাকা দেখাশোনা করে বটে। তবে অনেকদিন বাস নেই....
শুনতে
শুনতেই রাই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
(৩)
দিনগুলো
হুড়মুড় করে কাটছিল। সকালে অয়ন আর শ্যাম কাজে বেরিয়ে গেলে, দুপুরের দিকে রাই একবার
টুক করে শ্যামের বাড়ির কাজ দেখাতে চলে যায়। বুড়ী বাড়িটা ঘষামাজা খেয়ে, রঙ মেখে
আবার লাজুকলতা কনেবৌটি হয়ে উঠছে – সেটা দেখতে তার ভারি ভালো লাগে। মিস্তিরিদের
কাজের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে, কোথাও নতুন নির্দেশ দিতে, রাই বেশ মজা পাচ্ছিল। আসলে যে
কোনো নির্মাণের অংশ হওয়ার মধ্যে একটা রোমাঞ্চ আছে। শ্যামও খুশি। তার অনেকটা সময়
বেঁচে যাচ্ছে। সবার সামনেই সে রাইয়ের ভাবনার তারিফ করে। সেদিনও রাই মিস্তিরিকে কি
একটা বোঝাচ্ছিল। কিন্তু সে সেটা করতে রাজি নয়। তাতে তার অনেক খাটনি বাড়বে। রাইও
নাছোড়বান্দা। শেষে মিস্তিরি একটু বিরক্ত হয়েই বলল – মালিকের এতো নখরা নাই। আপনারই
বেশি বেশি?
রাইয়ের
মনে হলো, লোকটা তার গালে সপাটে চড় মারল। সত্যিই তো! কি অধিকারে সে...
কিন্তু
সে কিছু করা বা বলার আগেই পিছন থেকে একটা ইস্পাতকঠিন গলা আছড়ে পড়ল – এই মুহূর্তে
কাজ বন্ধ করো। আর যেটুকু পয়সা হয়েছে সেটা নিয়ে এখুনি বিদায় হও।
পাশে
বোমা ফাটলেও রাই এর চেয়ে বেশি চমকাতো না। শ্যামের এই গলা, এই রূপ তার কল্পনার
বাইরে। চমকেছে
মিস্তিরিও। এমন সময়ে শ্যামকে সে একেবারেই আশা করেনি। সে মিনমিন করে কিছু বলতে গেল।
শ্যাম আঙুল তুলল – ব্যস!
কারখানায়
একটা কাজের কথা সেদিন এই বাবুর কাছে, সে দরবার করেছিল। এর পরে সেখানকার কিছু নতুন
বাড়ির কাজও তাকে দেবে বলেছিল শ্যাম। মিস্তিরি
একেবারে হাতজোড় করে রাইয়ের পায়ে পড়ল – ভুল হয়্যে গেছে দিদিমণি। মাপ কইরে দেন
আজ্ঞে। কান মুলছি নাক মুলছি। পড়ালিখা না জানা মুখ্যু মানুষ – আর কখনো এমনধারা হবে
নাই গো।
রাই
রীতিমতো অপ্রস্তুত। সেও
করুণ মুখে শ্যামের দিকেই তাকালো – দেখো দেখি!
শ্যাম
বুঝল। হেডমিস্তিরিকে ডেকে বলল – কাজ করতে হলে দিদিমণির কথামতোই কাজ হবে।
তড়িঘড়ি
মাথা নাড়ল মিস্তিরি। সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচল যেন। রাই চোখ টান করে শ্যামকেই দেখে
যাচ্ছে। বান্ধবীর অপমানে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা এক পুরুষকে। না চাইতেও অয়নের সাথে
তুলনাটা এসেই গেল। আরেকদিনের কথাও এইসঙ্গে মনে পড়ে গেল। সেদিন শাশুড়ি শ্যামের
সামনেই রাইকে তুলোধোনা করছিল। অয়ন যথারীতি চুপ করে ছিল। কিন্তু শ্যাম হাসতে হাসতেই
বলেছিল – সইমা, রাই কিন্তু বড়ি পাহারাই দিচ্ছিল। তুমি ডাকলে বলেই ও উঠে গেল। আর কাক এসে বড়িতে মুখ দিল। আমি এখানে
বসেই বই পড়ছিলাম। খেয়াল করিনি। তুমি বরং আচ্ছা করে আমার কান মুলে দাও।
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল রাইয়ের। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল – তুমি এমন
অসময়ে?
-
একটা কাজে কাল দিল্লি রওনা হতে হবে।
তাই একটু আগেই বেরিয়েছিলাম। জানি তুমি এই সময়ে এদিকে থাকো। তাই ডাকতে এসেছিলাম।
-
কালকেই? কবে ফিরবে?
- উতলা
হলে নাকি সখি?- শ্যামের মুখে কৌতুকমাখা হাসিটা আবার ফিরে এসেছে।
- সবসময় সখি সখি করো কেন? ভারি অদ্ভূত।
- সত্যি জানো না??
- নাহ্। কেন?
- সখি, তুই যদি রোদে পুড়িস আমি হব মেঘ,
আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে দেবো রংধনু আবেগ।
রাইয়ের গাল যেন সূর্যাস্তের মেঘ। দ্রুত পালিয়ে বাঁচল। সামান্য একটা
ঠাট্টা সহজভাবে নিতে পারল না বলে, একান্তে নিজেকেই চোখ রাঙালো। যে কোনো কবির
কবিতার লাইন সামান্য বদলে নিজের কথা অবলীলায় বলতে পারে মানুষটা। রাগ করলে বলে –
দোষ কী তাতে? স্বয়ং রবিঠাকুর অনুমতি দিয়েছেন। জানো না কি?
- তোমার কানে কানে দিয়ে গেছেন বুঝি?
- উঁহু। রীতিমতো কাগজে কলমে।
- প্রমাণ দাও।
- ...” তুমি মিছে ধরো দোষ,
হে সাধু পণ্ডিত, মিছে, করিতেছ রোষ।
যাঁর ধন তিনি ওই অপার সন্তোষে
অসীম স্নেহের হাসি হাসিছেন বসে।“
একদম কোট-আনকোট বললাম। চাইলে মিলিয়ে
নিতে পার।
রাই চোখ পাকায়। আবার হেসেও ফেলে। শ্যাম পারেও বটে!
দিল্লি থেকে ফিরবার পথে, কলকাতা থেকে
নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে এল শ্যাম। রাইয়ের চোখে পলক পড়ে না – গিটার?
অয়ন হাসছে – শ্যাম দারুণ গিটার বাজায়।
রাই সপ্তকে বেজে উঠলো।
- আমায় শেখাবে? কতদিনের শখ?!
চোখে
চোখ রাখল শ্যাম – মজুরি লাগবে।
রাই
দৃশ্যতই থতমত খেল। হো হো করে হেসে উঠল শ্যাম – আপাতত তোমার হতের মুড়িমাখা আর চা
হলেই চলবে।
-
কানের সোনা চাই না?– অয়ন খুব হাসছিল। রাই
প্রায় ছুটেই পালিয়ে গেল। অয়ন রাইয়ের চলে যাওয়া দেখছিল।
-
তুই আমায় এ বাড়ি থেকে ভাগিয়ে ছাড়বি
দেখছি।
একে তো নামটাই বিদঘুটে! যাকগে, বাড়ির কাজ কতদূর?
-
মোটামুটি হয়ে এসেছে। কাল দেখিস।
পরদিনই
শ্যাম চলে গেল। দিন আগের ছন্দে ফিরেও ফেরে না। কোথাও যেন এক চোরাটানে ছোট ছোট
ঘুর্ণি তৈরি হয়। মিলিয়ে গেলেও একটা রেশ থেকেই যায়। সদা হাসিখুশি রাই ভিতরে ভিতরে
বিরক্ত হয়ে ওঠে। রোজ সন্ধ্যেয় এক উন্মুখ প্রতীক্ষা টের পেয়ে নিজেকেই চোখ রাঙায়। সন্ধ্যেয়
মাঝে মাঝে শ্যাম আসে। গিটারের তারে রাইয়ের মনটা ছিঁড়তে থাকে। বাজনার সাথে গলা মেলাতে গিয়ে সুরে ভুল
হয়ে যায়।
আকুল
শরীর মোর বেআকুল মন।
বাঁশির
শবদে মো আউলাইলোঁ রন্ধন||
আজকাল
আর বই পড়া হয় না। শুধু দুপুরের সাঁতার দীর্ঘায়িত হয়।
শেষে একদিন অয়নকেই ধরে পড়ল।
-
বড়মার
থানে নিয়ে যাবে আমায়?
-
কেন? কি করবে সেখানে?
-
রাসুবৌদি বলছিল, ওখানে মানত করলে...
-
এসবে কিছু হয় না, সে তোমাকে অনেকবার
বলেছি। ইচ্ছে হলে বরং একটা ছেলে কি মেয়ে দত্তক নাও।
বলে
ফেলেই মনে মনে জিভ কাটল অয়ন। অজানিতে একটা নিষিদ্ধ স্থানে হাত দিয়ে ফেলা শিশুর
মতোই তাড়তাড়ি সামনে থেকে পালিয়ে গেল। মানদা
তুলসীতলায় প্রদীপ দিচ্ছিল। এই প্রথমবার সে বউয়ের পক্ষ নিল।
-
তুই যাবি বউ? অনেকেই ফল পেয়েছে। অয়ন
রাগ করে বলে বলতে পারি না।
-
আমি তো চিনি না, মা। কে নিয়ে যাবে?
-
সে ব্যবস্থা আমি করব। তোকে ভাবতে হবে
না।
অয়ন
ফিরল সেই রাতে। মধুর দোকানে বসে দু পাত্তোর টেনে এসেছে। চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে
শুয়ে পড়ল। অন্যদিন মানদা বকাবকি করে, রাই গম্ভীর হয়ে থাকে। আজ কোনোটাই হলো না দেখে
একটু অবাক হলো বটে, কিন্তু নেশার জন্য ঘুম আসতেও দেরি হলো না।
(৪)
বর্ষার
জলে চুপচুপে গাছেরা এখন সোনারঙা রোদ জড়িয়ে ছালবাকল শুকিয়ে নিচ্ছে। সবুজ পাতা
ঝিকমিকিয়ে পান্নার মতো জ্বলছে। ধানক্ষতের সবুজ ঢেউ দেখতে দেখতে রাইয়ের কেমন যেন
ঘোর লাগে। বাসের জানালায় মুখ চেপেই ফিসফিসিয়ে বলে
- দেখো সখা, কি সুন্দর!
শ্যাম পাশে বসে কি দেখছিল কে জানে! ধানী
ক্ষেত, নাকি এক অনাবাদী জমি, নাকি রাইয়ের মুখ – চটকা ভেঙে আলগা হাসল। গুনগুনিয়ে
উঠলো,
-
ভালোবেসে সখী, নিভৃত যতনে, এ নামখানিই
রেখো,
তোমার
মনের মন্দিরে.....
রাই
চমকে উঠল। লাল হয়ে উঠলো পলাশের মতো - ধ্যেৎ।
শ্যাম
হাসছিল না।
-
থাক না একটা ছোট্ট ডাক। শুধু একান্ত
আমাদের দুজনের? খুব কি বেশি চাওয়া সখী?
রাইয়ের
চোখ ছলছল করছিল। খুব ধীরে ধীরে বলল – বড়মার
থানে কেন যাচ্ছি, জান?
-
সম্ভবতঃ মানত করার জন্য। সইমা আমায়
সেটাই বলেছিল।
রাই
অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। শ্যাম একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল – এবার নামতে হবে। এসে
গিয়েছি।
মেঠো
পথ এঁকেবেকে এক নদীর তীরে পথ হারায়। বর্ষায় তার তনুখানি একটু ষ্ফীত। বাসরাস্তার ধারের
দোকানীর কথামতো নদীর পাড়ে ছোট আশ্রম। এই সকালেও বেশ কিছু দর্শনার্থীর ভিড়। রাই
অপেক্ষা করছিল। ডাক পড়তে শ্যামকে বলল – আমার সাথে ভিতরে যাবে একটু? একা একা যেতে
কেমন যেন লাগছে।
তকতকে
বেদীর ওপর একখণ্ড পাথরে সিঁদুর, শাড়ি জড়ানো। বেদীর নীচে পশুচর্মের আসনে বসে
মুণ্ডিতমস্তক এক সন্ন্যাসিনী। ভারি স্নিগ্ধ চেহারা। রাই বেদীতে ফুল দিল। সন্ন্যাসিনী
প্রণতা মেয়েটির মাথায় হাত রাখলেন – বড়োমা তোমার মনোকামনা পূর্ণ করুন। নদীর জল
মাথায নিয়ে এই রেশমী দড়িটি যুগলে সামনের গাছের ডালে বেঁধে দিও। তোমাদের ভালো হোক।
রাই
দুহাত জোড় করে খানিকক্ষণ বসে রইল। তার দুচোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে। সে কোনো ভুল
সংশোধনের চেষ্টা করলো না। প্রণামী দিয়ে বাইরে এলো। শ্যামের মতো হাজির-জবাব ছেলেও
খানিকটা থমকে গেছে। বাইরে এসে একবার বলার চেষ্টা করল – কি মুস্কিল...
রাই
নিজের ঠোঁটের উপর আঙুল ছোঁয়াল। শ্যাম
কি বুঝল কে জানে। চুপচাপ রাইকে অনুসরণ করল। রাই নদীর জল ছিটালো নিজের মাথায়,
শ্যামের মাথাতেও। নিঃশব্দে শ্যাম রাইয়ের হাত ধরে মানতের দড়ি বেঁধে দিল অশ্বত্থের
ডালে। তারপর রাইয়ের হাত ধরেই নদীর পাশে চুপটি করে বসল।
অনেক,
অনেক পরে খুব মৃদুস্বরে ডাকল – সখি?
-
উঁ।
-
একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?
-
বলো।
-
তোমরা ডাক্তার দেখাচ্ছো না কেন? যদি
কারো কোনো অসুবিধে থাকে...
-
আমি আনেক বলেছি গো। ও রাজি হয় না।
-
কিন্তু সেবার কলকাতায় তো...
শ্যাম
হঠাৎ চুপ করে গেল। রাই তীক্ষ্ণস্বরে বলল – সেবার কলকাতায় কি?
-
কিছু না। বাড়ি চল।
-
আগে বলো। না বলা অবধি আমি উঠবোই না।
-
কি ছেলেমানুষি হচ্ছে?
শ্যাম প্রায় ধমকেই উঠলো।
ধরা হাতটাতে এক টান দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। টানের চোটে রাই প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। একটা
সবল হাত তাকে পড়তে দিল না। রাই থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। কঠিন পরুষস্পর্শ!
পুলকে পুরয়ে অঙ্গ, আঁখে নামে জল,
তাহা নিবারিতে আমি হইয়ে বিকল||
রাইয়ের
দুই চোখে বানভাসি। শ্যাম আস্তে করে বলল – বাসের সময় হয়ে গেছে।
সারা
রাস্তা রাই চুপটি করে জানালায় মুখ ঠেকিয়ে বসে রইল। সে প্রাণপণে একটা হিসেব মেলাতে
চাইছিল। অয়ন কি কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিল? সেকথা তো তাকে বলেনি কেউ। ফেরার
সময় অয়ন ওর জন্য নূপুর নিয়ে আসে। অথচ, নূপুরের আওয়াজে অয়নের বিরাগ ছিল বলে রাই
নিজেরটা খুলে রেখেছিল। তারপর থেকে ডাক্তার দেখাতে বললেই অয়নের আপত্তি, কোনো কারণেই
তার বিরোধ না করা –একটা বড়ো প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে যেন। রাইয়ের মাথায় আগুন জ্বলছিল।
বাস থেকে নেমে সে শ্যামের দিকে একবারও না তাকিয়ে হনহনিয়ে বাড়ির দিকে চলল। রাতে
অয়নের সঙ্গে তার একটা অকারণ ঝগড়া হয়ে গেল।
শ্যামের
ঘোরাঘুরি, কাজের চাপ বাড়ছিল। আজকাল রোজ আসতে পারে না। সেদিনের পর থেকে অয়নও একটু
বাইরে বাইরে থাকে। কেমন যেন গম্ভীর, চিন্তিত। রাই নিজের মনে ছটফটায়। শ্যামের সঙ্গে
মানত করতে পাঠিয়েছিল বলে, সেদিন জয়ী এসে মায়ের উপর রাগারাগি করছে। রাইকেও কথার
ঘায়ে রক্তাক্ত করেছে। অন্য সময় রাইও ছেড়ে কথা বলে না। কিন্তু এই প্রথম নিজেও যেন
কি এক অনির্দেশ্য অপরাধের ভারে অবনত হয়ে রইল।
(৫)
এবছরের
বর্ষা একটু দীর্ঘমেয়াদী। শ্রাবণ চলে গেছে, কিন্তু তার বিদায় নেবার কোনো ইচ্ছে নেই।
শ্যামকে পরপর কদিন ভিজে ভিজে কাজ দেখতে হয়েছে। দুদিন ধরে তার জ্বর। সে দুপুরে ঘরেই
ঘুমোচ্ছিল। মাথার উপর ঠাণ্ডা হাতের ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙল।
-
একটা খবরও দাওনি? নেহাত আজ কচিবউ গিয়ে
বলল তাই...
-
কচিবউকে আমি মানা করেছিলাম!
-
জানি। কিন্তু কেন? কেন সখা?
-
বলছে
আর দুহাতে তাপ মাপছে রাই। কপালে গালে বুকে। তপ্ত গা নিজে পোড়ে, রাইকে পোড়ায়। মৃগের
কস্তুরী ঘ্রাণ রাইকে পাগল করে। আর পারল না শ্যাম। দুহাতে রাইয়ের মুখখানা ধরল – খুব
কষ্ট হয়েছে? আমিও আর পারছি না। তোমাকে না দেখে, তোমার থেকে দূরে থেকে, মরে যাচ্ছি।
রাইয়ের
দুচোখ জলে ভেসে যাচ্ছিল।
রূপ লাগি আঁখি ঝুরে, গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর||
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।
পরাণ পিরিতি মোর, থির নাহি বান্ধে||
শুনশান
দুপুর আরো একটু নিঝুম হয়। গাছের পাতাটি
নড়ে না। শুধু এক ঘরের মধ্যে প্রবল ঝড় ওঠে। সেই ঝড়ে সব উড়ে গিয়ে, শুধু ভালোবাসার
আকুলতাটুকু বেঁচে থাকে।
সমাজ,
সংসার মিছে সব
মিছে
এ জীবনের কলরব...
ঝড়
শান্ত হয়। দুজন সুখী তৃপ্ত মানুষ পাশাপাশি শুয়ে থাকে। একটু পরে এক লাজুকলতা মুখ
খানিক জোর করেই হাত ছাড়ায়। সংবৃত হয়ে গরম হরলিকস আর মুড়ি নিয়ে আসে।
-
থার্মোমিটার
কই?
-
আর
তাপ নেই। - কৌতুকমাখা চোখদুটো চিকিয়ে উঠল।
-
অনেক
বীরত্ব হয়েছে। সন্ধ্যেয় আবার আসব, খবর নিতে।
-
আবার?
– শ্যাম ছদ্ম ত্রাসে চোখ বন্ধ করে।
পিঠের
ওপর গুম করে কিল বসিয়ে, ছুটে পালায় রাই। সন্ধ্যের পরে রাই এলো না। এলো অয়ন। রাইয়ের
মুখে বন্ধুর জ্বরের কথা শুনে এসেছে। শ্যামকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল। মানদাও খবর না
দেবার জন্য আন্তরিক অনুযোগ করল।
কিন্তু শরীর একটু সুস্থ হতে না হতেই শ্যামকে আর কিছুতেই ধরে রাখা গেল না।
রাইয়ের
গালে গোলাপি আভা ফিরে এসেছে। আগের চেয়েও নিপুণ হাতে ঘর সামলায়। অয়নকে যত্ন করে। শুধু দীঘি অভিমানে টলটল করে। রাই নাকি তাকে
আজকাল কম সময় দিচ্ছে।
সেদিন সকাল থেকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছিল। রাই গাছ থেকে
লঙ্কা তুলতে উঠোনে নেমেছিল। খাবার সময় মুট করে ভাঙা লঙ্কা তার ভারি প্রিয়। সুযোগ
পেয়ে বৃষ্টি তার চোখে মুখে অজস্র চুম্বন এঁকে দিল। শিউরে উঠলো রাই। তার মনে হলো,
দীঘি তাকে যেন ডাক পাঠালো। অনেকদিন বাদে রাই দীঘিতে গেল। কেউ কোত্থাও নেই আজ। জগত
ভুলে জলে খেলছে রাই। শ্যাম রাইকে খুঁজতে
খুঁজতে এদিকেই এসেছিল। একটুও হিংসে না করে জল তাকেও ডেকে নিল।
রাইয়ের ভালো লাগছিল। জলের তলায় এমন করে তাকে কেউ
খোঁজেনি। ফিসফিসিয়ে বলতে চাইল –
আতিশয় না চাপিহ আধর দাঁতে।
সখি সব দেখিআঁ বুলিব দন্তাঘাতে||
নখঘাত না দিহ মোর পয়োভারে।
আইহন দেখিলেঁ মোর নাহিঁক নিস্তারে||
শ্যামেরও কিছু হয়তো বলার ছিল। যে কথা শুনিবে না কেহ আর।
কিন্তু হৃদয় দিয়ে হৃদয় অনুভবের সময় কথা নিতান্তই বাহুল্য।
আশ্বিনের
শুরুতেই এক অঘটন ঘটে গেল। মানদা বাগানে পুজোর ফুল তুলছিল। বর্ষার শেষদিকটায় প্রতিবারই
বাগানে কিছুটা ঝোপজঙ্গল হয়।
বর্ষার শেষে কাটিয়ে দেওয়া হয়। এবারে বৃষ্টির জন্য দেরি হচ্ছিল। ফুল তুলবার সময়ে পায়ে কাঁটা ফুটল কি? নাকি পোকা
কামড়াল? কাদা পা। মানদা ঠিক বুঝতে পারল না। পা ধুয়ে পুজো করতে বসল। পুজোটা শেষ হোক। তারপর দরকার বুঝলে মলম
লাগাবে। পুজো করতে করতেই লুটিয়ে পড়ল ঠাকুরের আসনে। একটু পরে রাইয়ের চিৎকারে বাড়িতে
লোক ভেঙে পড়ল।
মায়ের
মৃত্যুর পরে অয়ন আরো চুপচাপ, আরো অন্তর্মুখী হয়ে পড়ল। রাই দশটা কথা বললে একটা
উত্তর দেয়। রাতে প্রায়ই নেশা করে আসে। রাই অস্থির হয়ে পড়ল। শ্যাম নামক দ্বীপটি না
থাকলে রাই কি করত, রাই জানে না। শ্যাম ওদের দুজনকে দুহাতে আগলাচ্ছিল। কিন্তু
সে স্বস্তিও টিঁকলো না। কোম্পানি শ্যামকে দুবছরের জন্য বিদেশের ট্রেনিংয়ে পাঠাবার
প্রস্তাব দিয়েছে। ফিরে
এলে মোটা মাইনে, ভালো পোস্টিং। রাই চোখে আঁধার দেখল।
-
মন স্থির করো সখি। দুবছর পর আমি ফিরব।
তারপর তোামকে বরাবরের মতো নিয়ে চলে যাব।
-
ফিরবে তো সখা? কানুর মতো ভুলে যাবে না?
-
আমি কানু নই সখি। আমি তোমার শ্যাম।
(৬)
পল
পল করি দিবস গোঙায়লু,
দিবস
দিবস করি মাসা।
মাস
মাস করি বরষ গোঙায়লু,
ছোড়লু
জীবনক আশা||
তা
দিন ঠিকই কাটে। দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, সুদীর্ঘ বরষ মাস হলেও কাটে। রাইয়ের মুখ
শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হয়। অয়ন যতোটা পারে বাইরে সময় কাটায়। তবু সাধারণ কর্তব্য
যথাসাধ্য করে দুজনেই। রাই ঘর গোছায়। অয়ন বাজার থেকে রাইয়ের পছন্দের জিনিস খুঁজে
নিয়ে আসে। দিনশেষে দুটি প্রাণী অনেক সময়
চুপচাপ একই বারান্দায় বসে থাকে। চারপাশের নৈঃশব্দ্য আরও ভারি হয়ে ওঠে। রাই আস্তে
করে হয়তো কখনো জিজ্ঞাসা করে – রাতে কি খাবে?
অয়ন
অন্যদিকে তাকিয়েই উদাস গলায় জবাব দেয় – যা তোমার সুবিধে।
তারপর
আর কথা এগোয় না। একসময় রাই উঠে যায় রান্নাঘরে। অয়ন একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে পাড়ার ক্লাবের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
ভালো মাছ থাকলে পুরোনো মাছওয়ালা কখনো সখনো এসে
মাছ দিয়ে যায়। রাই যত্ন করে রান্না করে। অয়ন দইমাছ খায় না। শ্যামের খুব পছন্দের পদ। রাই মনের ভুলে দইমাছ বানিয়ে ফেলে। খেতে
দিতে গিয়ে হঠাৎ সেকথা মনে পড়ে। অয়নের মাথা নিচু করে দইমাছ খাওয়া দেখতে দেখতে, তার
চোখে জল উপছিয়ে আসে। একটা ঝগড়া হলে হয়তো দুজনেই স্বস্তি পেত। কিন্তু ফাঁকটা কিভাবে
কখন যেন এতোটাই বেড়ে গেছে, যে ঝগড়াও করতে পারে না কেউ।
দুবছরের
শেষ পর্যায়ে দুজনেই উন্মুখ হয়ে পাশের বাড়ির আওয়াজের দিকে চোখ কান পেতে রাখে। একটু
আওয়াজ হলে সন্তর্পণে চমকে তাকায় – আলোর দেখা পাওয়া গেল কি?
শ্যাম
ফিরল আড়াই বছরের মাথায়। অয়নের সাধাসাধি সত্ত্বেও সে কিছুতেই এ বাড়িতে থাকতে রাজি
হলো না। অয়নের এতো উচ্ছ্বাস দেখে রাইও ভিতরে ভিতরে একটু সন্ত্রস্তই। একান্তে
শ্যামকে পেয়ে রাই যেন বধূসরা নদী। শ্যামের চোখও শুকনো নেই। তবু রাইকে শান্ত করার
চেষ্টা করল – এতো চোখের জল তো পুলোমাও ফেলেননি! তুমি তো সমুদ্র বওয়াবে দেখছি।
কান্নার
মধ্যেই হাসলো রাই – মথুরা নগরে ছিলে তো ভালো?
-
মথুরাই বটে! – শ্যামও হাসলো। মজা করে
বললো – মেমসাহেবদের ভিড়ে কি আর...
-
আমি মোটেও সে কথা বলি নি?
-
এতো ভরসা করো?
রাই
প্রিয় বুকে মুখ রাখে। অষ্ফুটে বলে
- হৃদয়ক মৃগমদ গীমক হার ।
দেহক সরবস গেহক সার ॥
পাখিক পাখ মীনক পানি ।
জীবক জীবন হম তুহু জানি ॥
শ্যাম আদর করতে গিয়েও হেসে ফেলল –
তুমি একটুও বদলাওনি। কথায় কথায় পদাবলী! তুমি সত্যি সত্যি রাই। আমার পাগলী।
- কিন্তু এরপর?
- এরপর অয়নের সাথে কথা বলতে হবে।
রাই খুশিতে ঝলমলাতে গিয়েও কেমন যেন মিইয়ে গেল।
- অয়নের কি খুব কষ্ট হবে?
- অয়ন কি তোমায় নিয়ে খুশি আছে? – শ্যামের
গলা একটু তীক্ষ্ণ।
- নাহ্। বরং আমি না থাকলে হয়তো...
শ্যাম দুদিন অফিস নিয়ে একটু ব্যস্ত
ছিল। সেদিন সন্ধ্যেয় অয়ন এল।
- আয় আয়। কচিবউ আছে এখনো। চা করতে বলি.
দাঁড়া।
- কচিবউকে বরং ছুটি দিয়ে দে। তোর সঙ্গে
একটু কথা ছিল।
শ্যাম উঠে গিয়ে একটু পরে দু কাপ চা এনে
টেবিলে রাখল – বল।
অয়ন চায়ের দিকে তাকিয়েও দেখল না। হিপ
ফ্লাস্কটা পকেট থেকে বার করে গলায় তরল আগুন ঢালল। বিনা ভূমিকায় সরাসরি প্রশ্ন রাখল
– রাইয়ের ব্যাপারে কি মনস্থ করলি?
শ্যাম চুপ করে
থাকল কিছুক্ষণ। তারপর একটা সিগারেট ধরাল।
-
তুই জানতি? রাই বলেছে?
-
রাইয়ের সঙ্গে এ
ব্যাপারে কোনো কথাই কোনোদিন হয়নি। কিন্তু রাইকে আমি ভালোবাসি শ্যাম। ওর কথা বুঝতে
পারবো না?
-
সত্যি ভালোবাসিস?
তাহলে রাই এত অসুখী কেন? তুই ডাক্তার দেখালি, অথচ চিকিৎসা করালি না। একটা ছেলে-মেয়ে থাকলেও...
-
তোদের হলো না কেন
শ্যাম?
-
কি?
-
ছেলে বা মেয়ে?
প্রশ্নটা
বুলেটের মতো এসে লাগল। অর্থটা বোধগম্য হতে একটু সময় নিল। অয়ন চুপ করে শ্যামকে দেখে
যাচ্ছিল। শ্যাম কথা খুঁজছিল। অয়ন আরেক ঢোঁক পানীয় গলায় ঢালল।
-
কলকাতায় গিয়ে ডাক্তার
দেখিয়েছিলাম। আমার কোনো সমস্যা নেই।
-
তাহলে?
-
রাই একথা মানতে পারত
না। কষ্ট পেত। ওকে এতটুকু কষ্ট দেবার কথা ভাবতেও পারি না। তাই ওকে কিছুই বলিনি।
-
তুই পাগল। রাইয়ের
চিকিৎসা করানো দরকার ছিল।
-
হয়তো। পরে ভেবেছিলাম,
জানিস? কিন্তু ততদিনে ও তোর প্রেমে পড়ে গেছে। তুই
তখনও বুঝিস নি। আমি বুঝেছিলাম।
-
তুই কি প্রমাণ করতে
চাইছিস? – শ্যাম ক্রমশঃ উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল।
-
কিচ্ছু না। আ-মি...
রাই আমাকে নিয়ে তৃপ্ত ছিল না। আমি জানতাম।
-
রাই তোকে নির্বীর্য
ভাবত।
-
চিরকালীন শ্যাম-রাইয়ের
কাহিনীতে আইহন তো নপুংসক। তাই না? রাইকে
জিজ্ঞাসা করিস। ও সারাদিন পদাবলীতে ডুবে থাকে। ঠিক বলে দেবে। কিন্তু আইহনও কি
রাধাকে ভালোবেসে এই কলঙ্ককে আপন করে নিয়েছিল? কে জানে? তুই জানিস? হাঃ হাঃ হাঃ...
টলতে টলতে
মাতালটা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নেশার ঘোরে খেয়ালও করল না, দরজার পাশে এক নারী পাথরে
পরিণত হয়েছে।
(৭)
কাল রাই
আসেনি। অপেক্ষা করতে করতে শ্যাম একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল। গভীর রাতে ঘুমের ঘোরে তার একবার
মনে হয়েছিল, কেউ তার দিকে অনিমিখে চেয়ে রয়েছে। গিটারটা যেন একবার টুং করে বেজে
উঠেই চুপ করে গেল। শ্যাম একবার ওঠার চেষ্টা করল, কিন্তু রাতের কথোপকথনের গভীর
অবসাদ তাকে উঠতে দিল না। সে ঘুমের ঘোরে একবার শুধু বিড়বিড় করে বলল – রাই আমি আসছি।
তারপরেই ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল। সকালে যখন ঘুম ভাঙলো, তখন তার বালিশের পাশে একটা
চিঠি পড়ার অপেক্ষায় শুয়েছিল।
চিরসখা হে,
রাই বলছি। আমি
অপূর্ণ কিনা, আমি জানি না। আর সন্তানধারণেই নারীর পূর্ণতা প্রাপ্তি কিনা, সেকথাও
জানি না। অপূর্ণ যদি হয়েও থাকি, তাহলে যিনি আমার এই অপূর্ণতার বোধ দূর করতে
পারবেন, আমি তাঁর সন্ধানেই চললাম। আমার খোঁজ করো না। আমার জন্য শোকও নয়। কারণ আমি আলোর সন্ধানে যাচ্ছি। তোমরা আমার এই বাঁচার রসদ
কেড়ে নেবার চেষ্টা করো না। এটুকুই আমার অনুরোধ।
অয়নকে নিয়ে
তৃপ্ত হতে পারিনি। আমি পুরুষের শক্তি খুঁজতাম। অয়নের সবাইকে খুশি করে চলার চেষ্টা,
আমার মাথায় আগুন ধরাত। আজ মনে হচ্ছে তার পিছনে ওর দুর্বলতা নয়,অন্য বোধ কাজ করত।
মানুষগুলোকে বড্ডো ভালোবাসত বলেই হয়তো তাদের সামান্য কড়া কথাও বলতে পারত না। এতো
দুঃখ দিয়েছি তাকে, তবু সে একবারও উফফ্ অবধি বলেনি। সবসময় আমার আনন্দ ওর ভাবনায়
অগ্রাধিকার পেয়েছে। এটা কোনো দুর্বল মানুষ পারত না। তাই আজ নিজেকে অপরাধী মনে
হচ্ছে।
শ্যাম, আমার
শ্যাম, তোমার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। তুমি আমার আনন্দধন। ভালোবাসা কাকে বলে তোমার
হাত ধরেই শিখেছি। প্রাত্যহিকতার মলিনতায় তাকে কি করে নামাই বলোতো? কাল তোমাদের সব
কথা আমি শুনেছি। সব শোনার পরে আমার মনে হয়েছে আমাদের দুজনের মাঝখানে কোথাও না
কোথাও অয়ন এসে দাঁড়াচ্ছে। এই দ্বিধা নিয়ে কি আমি তোমার পূর্ণতার ঘরে যেতে পারি?
আমি তাই সেই
চিরকিশোরের খোঁজে চললাম। যদি তিনি আমার মনের সব দ্বিধা দূর করতে পারেন, তাহলে
সম্পূর্ণ মুক্ত মন নিয়ে তোমার কাছেই ফিরব। যদি,… যদি ফেরার পথ
তখনও খোলা থাকে, তবেই। নইলে আমার জন্য পথ, গান আর ঝোলা তো রইলোই। ঝোলায় তোমার
গিটারটা নিয়ে গেলাম। ওর তারে তারে ভালোবাসা বাঁধা আছে। শ্যামনাম গাইতে হলে ওকে
ছাড়া তো আমার চলবে না গো।
ভালো থেকো।
বিশ্বাস করো, আমিও ভালো থাকার সাধনা করতেই যাচ্ছি। ফিরব একদিন। কবে, কিভাবে ফিরবো,
সেটুকুই জানিনা কেবল। ভালোবাসায় বিশ্বাস রেখ। ভালোবাসার কাছে একদিন না একদিন
সবাইকে ফিরতেই হয়।
- তোমার রাই
দোলা সেন||
No comments:
Post a Comment