শীতটা ভালো করে পড়েনি এখনও। আজ দুপুরে তুতুন ছাদে এসেছিল জামাকাপড় তুলতে। রোদের আঁচটা আজ বেশ ভালোই টের পাওয়া যাচ্ছে। ফুরফুরে হাওয়াটা না থাকলে পিঠটা জ্বালা করত ঠিক। মাথার ওপরে উজ্জ্বল নীল রঙ চোখে জ্বালা ধরায়। তুতুন তার থেকে একটা একটা করে ক্লিপ খুলে, ছোট ব্যাগে জমা করে। তারপর কাপড়গুলো ভাঁজ করে বাস্কেটে ভরতে থাকে। সব হয়ে গেলে পিকলুদের মেলে দেওয়া চাদরের ছায়ায় আয়েস করে বসে। পিকলু এই সময় ছাদে এলে বড় ভালো হতো। বিকেলের খেলার পরে রতুমাসীর বাড়ি যাবার প্ল্যানটা করা যেত।
রতুমাসী রোজ সন্ধ্যায় চপ, ফুলুরি ভাজে।
ওর মতো বেগুনী এই চত্বরে কেউ বানাতে পারে না। কিন্তু বেচারির দুদিন ধরে জ্বর। যদিও
পাড়ার স্বাস্থ্যকর্মী ওকে দেখে ওষুধ দিয়ে গেছে, তবু একবার দেখতে যাওয়া উচিত বলেই
তুতুনের মনে হচ্ছে।
কাল বাদে পরশু ভূতচতুর্দশী। জেঠু আজ
বাজার থেকে চোদ্দ প্রদীপ, চোদ্দ শাক কিনে এনেছে। ছাতের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় জ্বালানো
হবে আকাশপ্রদীপ। তার আলো বেয়ে পূর্বপুরুষেরা নেমে এসে জীবিত বংশধরদের আশীর্বাদ করবেন।
তুতুনের বাবা-মাও আসবে কি? হঠাৎই চোখ ছাপিয়ে জল এলো তুতুনের।
কয়েক বছর আগে পৃথিবীতে এক অতিমারী
এসেছিল। অনিয়ন্ত্রিত দূষণ, ভেঙে পড়া ইকোসিস্টেম তার কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছিল। অগণিত মানুষ মারা গিয়েছিল। তুতুনের বাবা মাও তাদের একজন।
প্রকৃতি যেন তার সবচেয়ে উদ্ধত সন্তানদের কান ধরে তাদের সীমানা দেখিয়ে দিচ্ছিল। বাঁচতে
হলে সবাইকে নিয়ে বাঁচতে হবে, কোটি কোটি প্রাণের বিনিময়ে মানুষ সে কথা বুঝেছে। নাহলে
নিশ্চিহ্ন হতে হবে - এটা টের পাবার পর নিজেদের বদলে নিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান
প্রজাতিটির বেশি সময় লাগেনি। নতুন করে জীবনের পাঠ শিখেছে সবাই।
তুতুন শুনেছে,
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে এক পনেরো বছরের কিশোর তার মতো নিশ্চিন্তে আকাশ দেখতে পারত
না। তখন নাকি বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের সারাদিন সবকিছুতে প্রথম হবার দৌড়ে ব্যস্ত রাখত,
বিশেষতঃ পড়াশোনায়। ভাবতে গিয়ে হেসে ফেলল
তুতুন – সবাই প্রথম? তুতুন একটা দৌড়ের মাঠ দেখতে পাচ্ছিল। পিঠে বিরাট ব্যাগ নিয়ে
দৌড়াচ্ছে কয়েকজন। হাঁপিয়ে পড়ছে, পড়ে যাচ্ছে – কিন্তু লাইনের পাশে দাঁড়ানো বাবা-মায়ের দল তাদের থামতে
দিচ্ছে না। ওরা জোম্বির মতো শুধুই
দৌড়ে চলেছে, চারপাশে কি ঘটছে তা ঘুরেও দেখছে না।
তুতুন শিউরে
উঠে ভাবল – ভাগ্যিস ও এখন জন্মেছে। তাই নিজের ইচ্ছেমতো বিষয় – ও যেমন অঙ্ক, পিকলু
যেমন গান নিয়ে পড়তে পায়। অবশ্য পরবর্তী জীবনে নিজের রোজগার করার জন্য কিছু বিদ্যে
এখন থেকেই শিখতে হয়, সেটা আবশ্যিক। তাই স্কুল যাওয়াটা বাধ্যতামূলক।
এইরে! রোদ ঢলে
আসছে। তুতুন তাড়তাড়ি জামাকাপড় নিয়ে নিচে নেমে যায়। খেলার মাঠে পৌঁছাতে দেরি হলে
কেউ ওকে খেলা নেবে না। সময় মেনে চলার খুব কড়কড়ি এখন।
ঝিমলিও জানে
সে কথা। তবে আজকাল তার বাড়ি ফিরতে অনেকটা রাত হয়। সে একটা দোকানে কাজ করে। ইদানিং
সন্ধ্যায় ওর শিফট শেষ হলে ও গুরুর বাড়ি সেতার শিখতে যায়। দুটো জায়গা কাছাকাছি
হওয়ায়, একেবারে সব সেরে বাড়ি ফেরে। বাস থেকে নেমে দেখল, একা, শুধু একা তার জন্যই
পথ বুক পেতে শুয়ে আছে। ঝুমঝুমে আঁধার নেমেছে আকাশের গা বেয়ে। অনেক বাড়িতেই এখন
আলোর সাজ। হিম পড়ার টুপ টাপ শব্দটা অনেকদিন পরে শুনল ঝিমলি। গলায় উঠে আসা গানটাকে
চেপে রেখে, সে এই নিঝঝুম নির্জন রাতটাকে বুকের ভিতর শুষে নিচ্ছিল।
বাড়ির মোড়টা
ঘুরতেই ঝিমলি তুতুনকে দেখতে পেল। লাইটপোস্টের নিচে বসে, বেজার মুখে একটা মথকে ধরার চেষ্টা করছে। বারবারই সেটা ফস্কে
যাচ্ছে। আলগা গলায় হাসল ঝিমলি –
-
ঠাম্মা?
-
আবার কে? এমন
চেঁচাচ্ছিল, যে বাড়ির চেয়ে এখানে থাকাটাই সুবিধা।
-
ঠাম্মাদের
ছোটবেলায় মেয়েরা একা বের হলে তাদের নানান বিপদ হতো। তাই হয়তো ভয় পায়।
-
বিপদ কি শুধু
মেয়েদের হতো রে দিদি? ছেলেদের হতো না? দাদাভাই রাতে বাইরে থাকলে তো ঠাম্মা কিছু
বলে না?
-
কখনো কখনো ছোট
ছেলেদেরও।
-
কি বিপদ রে
দিদি? এখন হয় না কেন?
একটা
দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ফেলল ঝিমলি।
-
এটা বোঝার
জন্য তোকে আরো একটু বড় হতে হবে যে তাতান! এটা তোর এখুনি না বুঝলেও চলবে। বরং
চকোলেট খা।
তাতান? তুতুন
বুঝে গেল, দিদি আর কিছু বলবে না। অগত্যা সে দিদির হাত থেকে চকলেটটা নিয়ে খেতে খেতে
চলল। ঝিমলি জানে ঠাম্মা কিছুতেই মানতে পারে না যে সেই কালো দিনগুলো আর নেই। এখন ধর্ষণের
শাস্তি এক নির্জন দ্বীপে নির্বাসন। সারা জীবনেও আর তারা বাড়ি ফিরতে পারে না। তাই হয়তো এখন আর
কেউ এসব করতে সাহস পায় না। চুরি,ছিনতাই এগুলোও প্রায় বিলুপ্তপ্রায়। আসলে
মোটামুটিভাবে সবাই কিছু না কিছু কাজ করার সুযোগ পায়।
চলতে চলতেই
ঝিমলি জানতে চাইল – আজ রান্নার পালি কার রে?
বেজার মুখটা
আরো বেজার করে তুতুন বলল – দাদাভাইয়ের।
-
সর্বনাশ
করেছে। আমার আজ খুব খিদে পেয়েছে, জানিস?
-
দাদাভাইটা কবে
ঠিকঠাক রান্না করতে শিখবে বলতো? ওর চেয়ে আমি ভালো ওমলেট বানাই। - তুতুনের গলায়
অহংকারটা প্রচ্ছন্ন থাকে না।
ভাইয়ের মাথার
চুলটা ঘেঁটে দিল ঝিমলি। পুলকের চেয়ে এ বাড়িতে সবাই ভালো রান্না করে। তবে সব কাজই
তো সবাইকে করতে হবে। হতাশ মুখে সে ভাইয়ের হাত ধরে বাড়ির দিকে এগোলো।
সকালে
মৌমিতারও মেজাজ চড়া ছিল। পুলক রান্না করতে করতে চোদ্দবার তাকে দিয়ে টেস্ট করিয়েছে।
মৌমিতা ঘর ঝাড়পোঁছ করছিল। তার স্কুলে যাবার তাড়া তখন। এইসবে তার দেরি হয়ে যাচ্ছিল।
ডাক্তার হয়েও তার ছেলেটা কেন যে এত ভোঁদাইমার্কা হলো, কে জানে! তবে ফিরে এসে আজ আর
তাকে বাড়ির কাজে হাত লাগাতে হবে না অবশ্য। পুলকের সারভিং, ঝিমলির
বাসন মাজা আর ওর বরের বিছানার দায়িত্ব। তার মানে সন্ধ্যাটা সে তার নিজের খুশিমতো
কাটাতে পারবে। ভাবতেই মৌমিতার মুখে হাসি ভাঙল।
বিকেলে স্কুল
থেকে ফেরার পথে সে প্রলয়কে ফোন করল।
-
আজ ছুটি কটায়?
-
এই তো, একটু
পরেই। কেন?
-
অফিস থেকে সোজা
বাজারে চলে এসো।
-
তুমি বাজার
করবে আজ??
-
হুঁ। সবজি, মাছ, এইসব কিনতে হবে।
-
আচ্ছা। অনেক বাজার?
-
না, না। তুমি
মেন গেটে থেকো।
-
জো হুকুম
মহারানী।
হালকা হাসি
দিয়ে ফোন বন্ধ করল মৌমিতা। প্রলয় থাকলে অনেক সুবিধে। ওর সাইকেলে ব্যাগগুলো ঝুলিয়ে
গল্প করতে করতে বাড়ি চলে যাওয়া যায়। আজকাল রাস্তায় সাইকেলই বেশি চলে। মৌমিতার
স্কুল কাছে বলে হেঁটেই চলে যায়।
ঘরে ঢুকতে
ঢুকতেই প্রলয় হাঁক পাড়ে – আমরা এসে গেছি মা। পর্দা সরিয়ে একটা বলিরেখাঙ্কিত
হাসিমুখ উঁকি দেয় – আয় আয়। আগে হাত পা ধুয়ে এসে বোস।
-
উঃ মা, আমি কি
কচি বাচ্চা যে, রোজ মনে করাও?
-
ছোটবেলায় এটা
নিয়ে এত জ্বালিয়েছিস, যে ওটাই অভ্যেস হয়ে গেছে।
গোমড়া মুখে
প্রলয় গজগজ করে – কোন মান্ধাতার আমলের কথা...
মৌমিতা
ততক্ষণে জামা বদলে চলে এসেছে।
-
মা তো ঠিকই
বলেছে। আমার সব হয়ে গেল, আর তুমি এখনও.....
-
বলো, বলো।
জানি তো তোমরা সবাই একদলে।
ভারি মুখ আরো ভারি করে প্রলয় হাত পা ধুতে যায়। পিছনে দুই অসমবয়েসী নারীর হাসির
আওয়াজ কানে আসে। অনিতা একটু গলা তুলে বলেন – একদম টেবিলে চলে আয়। চা তৈরি আছে। আজ
তোর পছন্দের চিঁড়ের পোলাও বানিয়েছি।
-
আহা! কি
আনন্দ! এখুনি আসছি।
মৌমিতা অবশ্য
একটু গুণগুণ করে, চা অবধি ঠিক ছিল। তা বলে তুমি আবার এতো....
-
একেবারে বসে
থাকলে অকেজো হয়ে যাবো যে রে মা। সেটা কি ভালো হবে?
-
না, না। মোটেই
ভালো হবে না। আর তোমার মতো চিঁড়ের পোলাও আমরা কেউ বানাতে পারি না।
-
কি যে বলিস!
-
দারুণ হয়েছে। বাচ্চারা
খেয়েছে?
-
পুলক আর তুতুন
খেয়েছে। ঝিমলির তো...
-
তুমি চিন্তা
করো না। ও টিফিন নিয়ে যায়।
-
সেই রে মা।
আমাদের সময়ে আমরা খুব বোকা ছিলাম জানিস? রাস্তায় নোংরা ফেলতাম, বাড়ির সব কাজ একজনের
ঘাড়ে, কেউ কাজের চোটে নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ পেত না, আবার কেউ দিব্বি লোকের ঘাড়ে
চড়েই দিন কাটাত। কতো ঝগড়া, অশান্তি....
-
কেন এসব ভেবে
মন খারাপ করো? সেই কালো দিনগুলো তো আমরা পেরিয়ে এসেছি।
-
ঝিমলিদের মতো
একটা খোলামেলা নিরাপদ জীবন যদি পেতাম!
-
বড়ো কিছু পেতে
গেলে বড়ো দাম দিতে হয় যে মা। এর অন্যথা নেই।
প্রলয়ের গলাটা ভারি শোনাল। অনিতার চোখ ছলছলিয়ে উঠল।
-
সমু আর বনিতা
যদি আজ থাকত!
-
হাজার কাঁদলেও
তো ওরা ফিরবে না মা! তবু তুতুন তো আছে। খুব বুদ্ধিমান হয়েছে জানো? ঠিক দাদার মতো।
-
মুখখানা তো
বনিদিদি বসানো।
পুলক হন্তদন্ত
হয়ে ঘরে ঢুকল। হাতে একগাদা জিনিস।
-
এ কি? এখনও তোমরা
বসে বসে আড্ডা দিচ্ছ? সব কি আমাকেই মনে রাখতে হবে নাকি?
মিটিমিটি হাসল
মৌমিতা – না হয় মনে রাখলিই।
-
তোমার মনে
আছে? অথচ সকাল থেকে একবারও বললে না?
-
তাহলে
সারপ্রাইজটা দিতি কি করে?
-
কি হয়েছে রে
পুকাই?
-
ইউ আর
ইনকরিজিবল বাবা! কিচ্ছু হয়নি! শিগগির আলোগুলো সাজাও। আমি কেক সাজাচ্ছি। মা কোথায়
গেলে?
-
এই তো! মা, ঝিমলির
জন্য এই ড্রেসটা কিনেছি। এটা তুমি ওর হাতে দিও।
-
এ বাবা, আজ ওর
জন্মদিন? দেখো দেখি। আমিই ভুলে গেলাম? সত্যিই খুব বুড়ো হয়ে গেছি।
-
ওদের আসতে
দেরি আছে। আমি একটু পায়েস বসাই গিয়ে।
-
মিতু, আমি
কিন্তু পাঁচভাজা করব বলে দিলাম।
-
আচ্ছা, আচ্ছা।
চলো এখন।
দীপাবলীর আগেই
একটা ঘর আলোয় আলোময় হয়ে উঠল। সব আঁধার সরিয়ে ওরা এখন ঝিমলির অপেক্ষা করছে। সারা ঘর
ভরে যাচ্ছে একটা সেই পুরোনো দিনের গমগমে সুরে –
আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা
আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা।
দোলা সেন||
No comments:
Post a Comment