[প্রথম পর্ব]
- তাহলে ফাইনাল তো?
পাশের সোফায় বসা টেকোমাথা লোকটি হাসল একগাল –
- বলো তো ফার্স্ট পেজেই.....
- কবে এমন অন্যায় আবদার করেছি বলুন তো? - মোহন হাসি হাসল মেয়েটি।
- আমি পেজ থ্রি পেলেই বর্তে যাব।
নীল-সাদা মিনিস্কার্টের ওপর ঘননীল অফ শোল্ডার টপ। জুসের গেলাসে আলতো চুমুক। পায়ের উপর পা তুলে বসল আরাম করে। লোকটি সিগারেট হাতে নিল। সামনে ঝুঁকে পড়ে নিপুণ হাতে লাইটার জ্বালিয়ে দিল মেয়েটি। চোখের আরামের কোন ত্রুটি রাখল না। সে জানে পুরুষের দৃষ্টি কোনোমতেই সরবে না এখন। আদুরে হাসি ফোটাল গলায় –
- কাল আমার শো আছে। অফিসে আপনার কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছি। আপনি ব্যস্ত মানুষ। কাগজ, ম্যাগাজিন সব সামলাতে গিয়ে, আমায় ভুলে যাবেন না তো?
যেন
অভিমানেই ঠোঁটটা ফুলে উঠলো একটু। একটা ইচ্ছে শক্ত হাতে দমন করে হাত বাড়িয়ে সঙ্গিনীর হাতে গভীর চাপ দিল সে – আসবো বললাম তো! মনামির শো বলে কথা! রীতেশ কে বলেছি ছবি তোলার জন্য।
দুহাতে হাতটা ধরে কাছে সরে এল মনামি – রীতেশ?
- ম্যাগাজিনের কভার পেজ করার জন্য ওর চেয়ে ভালো লোক নেই।
আনন্দে রবিন মেহতাকে জড়িয়ে ধরল মনামি। শব্দ করে গালে চুমু খেল একটা – ইউ আর এ রিয়েল ডার্লিং!
তারপরেই সরে এলো। মেহতা হাসল – ঠিক আছে। তবে এরপর একটা ব্রেক দরকার তোমার। রেস্ট না নিলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।
- পরপর কয়েকটা শো আছে। তারপর পাক্কা কদিনের ছুটি।
- প্রমিস?
- প্রমিস।
খোলা পিঠে একটু চাপ দিয়ে মেহতা উঠে পড়ল – অফিসে একটা জরুরি মিটিং আছে।
মনামিও হাসিমুখে উঠে দাঁড়াল। মেহতা বেরিয়ে যেতেই সোফায় গা এলিয়ে বসল, আরাম করে। রেস্তোঁরার এই কোনাটা অন্য অংশ থেকে দেখা যায় না। সামনের দেওয়ালে কাঁচের উপর আলো আর শব্দের বিভ্রম। সমুদ্রতীরে বসার অনুভূতি তৈরি করে। মনামি তৃপ্তির হাসি হাসল। মেহতার উদ্দেশ্যে অষ্ফুটে বলল – সনফ আ বিচ!
**************
- তিতলি, অ্যাই টিকলি, টিকটিকি রেএএএ –
এসক্যালেটরের শেষ ধাপে কোনোমতে আছাড় খাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাল তিতলি ওরফে রিতিকা। এই বিলাসবহুল মলে, যেখানে চাপাস্বরে কথা বলাই বিধি, সেখানে সব নিয়ম উল্টে এমন বিদঘুটে নাম ধরে হাঁকাহাঁকি করতে পারে একজনই। কিছু ভাবার আগেই প্রতিবর্ত্ম ক্রিয়ায় সেই নামটি আপনিই উচ্চারিত হলো – আরশোলা! তারপরে মুখ উঁচু করে দেখল, সিঁড়ির মাথায় বছর তিরিশের যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে, সে আরশোলা, মানে মণিমালা না হয়ে যায় না।
ফিরতি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই সে মেপে নিচ্ছিল স্কুলজীবনের বেস্ট ফ্রেন্ডকে। সেই চোখ ধাঁধানো ফিগার, ঝকঝকে হাসিমাখা চোখ আর নিখুঁত সুন্দর মুখখানি একইরকম আছে। শুধু একঢাল লম্বা চুলের বদলে ঘাড় অবধি ছাঁটা উমনো ঝুমনো চুল। তাতে যে মেয়েটিকে আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগছে তা মেনে নিল রিতিকা।
আর বিশেষ কিছু ভাবার অবকাশ পেল না। সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে একটানে তুলে, তিতলিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে, দুগালে চুমুর বন্যা বইয়ে দিল মণিমালা। তারপর ছেড়ে দিয়ে চোখ পাকালো – কতোদিন পর? কোথায় ডুব দিয়েছিলি?
লোকজনের যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখাটাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে তিতলিও হাসিতে উজ্জ্বল হলো – উমম...
স্কুল ছাড়ার পরে আজ এই প্রথম।
- উঁহু থার্ড সেমের পর পুজোর কথা ভুলে যাচ্ছিস?
- তার মানে বারো বছর! ভাবা যায়?
- এক যুগ। তাই তো মিস খনা? – মণিমালা আলগা হাসল।
- হি হি। তোর মনে আছে?
- নাঃ। সব ভুলে গেছি রে। বাদলের ফুচকা, অঞ্জলিদির অঙ্ক ক্লাস, মিতাদির ক্লাসে চুপি চুপি গান গাওয়া – সব, সব ভুলে গেছি।
মণিমালা উঁচু গলায় হেসে উঠল আবার। তিতলিরও ঠোঁট ভেঙে হাসি ঝরল – টিঙ্কুর টিফিনবক্সে কে যে আরশোলা ঢুকিয়ে রেখেছিল – সে কথা আমিও ভুলে গেছি তো!
- তাই প্রথমেই মুখ দিয়ে আরশোলা বের হলো?
দু বন্ধুর অট্টহাসিতে লোকে চমকে তাকাল। রিতিকা সচকিত হযে বলল – এই, এভাবে না। চল কোথাও বসি।
- ঠিক বলেছিস। চল, টপ ফ্লোরে যাই।
- সেখানে তো ব্যাঙ্কোয়েট হল রে!
- জানি। তুই যাবি? না...
তিতলি জানে, এখন কিছু জিজ্ঞাসা করলে, মণিমালা স্রেফ হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যাবে। মুখে কিছুই বলবে না। তাই শুধু একটু হাসল – পাল্টাস নি দেখছি।
মণিমালা গটগটিয়ে গিয়ে ব্যাঙ্কোয়েটের দারোয়ানকে বলল – পাঁচ নম্বর ঘরটা খুলে দাও তো।
দারোয়ান যেভাবে ঝটাকসে দাঁড়িয়ে, লম্বা সেলাম ঠুকে, ঘর খুলতে দৌড়ালো, তা দেখে রিতিকা অবাক। মণির অবশ্য এসব দিকে খেয়াল নেই। সে তিতলির হাত ধরে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে নির্দিষ্ট ঘরের সোফায় পা ছড়িয়ে বসল। ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলল বিছানার ওপর। মৃদু গলায় বলল – আমাদের জন্য একটু স্ন্যাকস আর কোল্ড ড্রিংকস পাঠিয়ে দিও আপাতত।
ছেলেটি আবার একটা সেলাম ঠুকে অন্তর্ধান করল। রিতিকা চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল। দেয়াল জোড়া কাঁচের জানলা দিয়ে গঙ্গা আর তার ধারের গাছপালা দেখা যায়। বিকেলের রোদ হলদে হয়ে এসেছে। মণি নিজের খেয়ালে বকে যাচ্ছে – সেদিন তোকে কম ঝামেলা পোয়াতে হয়নি। তুই বলে দিলে, হেডুর মেয়ের টিফিনবাক্সে আরশোলা ছাড়ার অপরাধে আমাকে সাসপেন্ড করে দিত নির্ঘাত। আর ওই নেকি যা নাটক করেছিল!
তোর এখনো এতো রাগ? – তিতলি হাসছিল।
- তুই বুঝছিস না, আমার তো এমনিতেই বদনামের অভাব ছিল না, নেহাত তোর দৌলতে রেজাল্টটা ভালো হতো। সেটাই রক্ষা। নেকিটা সব ব্যাপারে নাক গলাতো!
[দ্বিতীয় পর্ব]
স্প্রাইটে চুমুক দিয়ে চিকেন উইংসে আলতো কামড় দেয় তিতলি। জানলার বাইরে এখন একটা মাঠ দেখতে পাচ্ছে ও। ঘন বেগুনি স্কার্ট আর সাদা শার্ট পরা মেয়েরা মাঠময় ছিটিয়ে রয়েছে। কারো হাতে টিফিন বাক্স, কারো হাতে বাস্কেটবল, কেউ কাবাডি কোর্টে হৈ হৈ করে খেলছে। গাছতলায় বসে গল্পও করছে কয়েকজন। ঘণ্টা পড়তেই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সবাই যে যার ক্লাসে চলল। মণির অন্যমনস্ক চোখেও কি ওই মাঠটা ধরা পড়েছে? তিতলি জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও করল না। তার আর মণির বন্ধুত্ব সবার কাছেই একটা প্রশ্নচিহ্ন ছিল। তিতলি শান্ত, সংযত একটু অন্তর্মুখী। আর মণিমালা ছিল হুজুগে, আবেগী, বেপরোয়া। তার প্রচুর ছেলেবন্ধু। হামেশাই সে তাদের কারো প্রেমে আপাদমস্তক হাবুডুবু খায়, আবার কিছুদিন বাদে ভুস করে ভেসেও ওঠে। ক্লাসের ‘ভালো’ মেয়েরা তাকে একটু বাঁকাচোখে দেখবে – সেটাই স্বাভাবিক। পাত্তা দিত না মণি। হেসে
বলত – ‘লোগোঁ কা কাম হ্যায় কহনা।‘ নিজে যা ভালো বুঝত তাই করত। তার সোজাসাপটা কথার চোটে অনেকেই ছিটকে দূরে চলে যেত। আবার এটাই সম্ভবতঃ তিতলিকে ওর দিকে আকৃষ্ট করে। তিতলি একমাত্র মণির কাছেই খুব খোলামেলা থাকতে পারত।
টিফিনটাইমে, বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে মণি বলেছিল – ছেলেরা যতদিন বন্ধু থাকে, ততদিনই ভালো বুঝলি টিকটিকি? প্রেমে পড়লেই কেমন যেন ন্যাকা ন্যাকা, গলে পড়া হাবভাব। কেমন যেন গা কিলবিল করে আমার। সহ্য করতে পারি না। দিই ভাগিয়ে।
- আর যদি ওরা পাত্তা না দিত, তাহলে ভালো লাগতো তোর?
- এমনটি আর পড়িল না চোখে...
গুণগুন করে মণি।
- সুরটা ভালোই বসেছে। পুরোটা গেয়ে ফেল। শুনি।
- বললেই হলো? পরেরটা গাইবো কি করে অ্যাঁ? “আমার যেমন আছে”?
দুজনেই হেসে ওঠে খিলখিলিয়ে। তারপর মণি একটু গম্ভীর হয় – সিরিয়াসলি বলছি। যা রাগ ধরে না! সুমিতের কথাই ধর। দিনের মধ্যে দশবার ফোন করবে। না ধরলেই মুখ হাঁড়ি। আরে আমার কি আর অন্য কোনো কাজ নেই? কিছুতেই বোঝে না। দিলাম ভাগিয়ে।
- বেশ করলি। খুব করলি। আহা, আমার যদি এমন একটা চোখে হারানো অ্যাডমায়ারার থাকত!
কপট দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তিতলি।
- বেশ হতো তাহলে। ধর, তুই আগাথা ক্রিস্টি পড়ছিস। শেষ চ্যাপ্টারে পৌঁছেছিস। তখন তোর ফোন আসত – সোনা কি করছিলে? জানো, এই বৃষ্টির জলের নাচে তোমার চলার ছন্দ দেখতে পাচ্ছি।
তিতলি হাসিতে লুটিয়ে পড়ল।
- সর্বনাশ করেছে। তুই কি আমাকেই খুনী বানাবি নাকি? না বাবা, ওসব তুইই সামলা। আমার কম্মো নয়। খুনখারাপি হয়ে যাবে।
- তবেই বোঝ। আমার দোষ?
সঞ্জয়ের সঙ্গে প্রেমটা অবশ্য বেশ গাঢ় ধরণের হয়েছিল। সঞ্জয় কিছুটা ভবঘুরে টাইপের। দুটিতে মিলে সাইকেলে ঘুরে বেড়াতো নানা জায়গায়। কাছাকাছি কোথায় দুশো বছরের পুরোনো মন্দির আছে, কোন পাহাড়ের মাথায় সমুদ্রগুপ্তের শিলালিপি আবিষ্কার হয়েছে – সঞ্জয়ের সব নখদর্পণে। তার উপর মাঝে মাঝে কোনো খবর না দিয়ে হাওয়া হয়ে যেত কয়েকদিনের জন্য। প্রথম প্রথম বাড়ির লোকে উদ্বিগ্ন হতো, এখন ব্যাপারটা তাদেরও অভ্যেস হয়ে গেছে। প্রায় বছরখানেক যাবার পরে তিতলিও ভাবতে শুরু করেছিল মণি এতোদিনে নিজের দোসর খুঁজে পেয়েছে। তখনই একদিন টিফিন টাইমে মণি বলল – সঞ্জয়কেও ভাগালাম।
- সে কি? বেশ তো...
- নাহ্। আমার কপালটাই খারাপ।
অন্যবারের মতো হাসলো না মণি। বরং টপ টপ করে গড়িয়ে পড়া জলে ওর স্কার্ট ভিজে যেতে থাকল। এই প্রথম মণিকে কাঁদতে দেখলো তিতলি। কোনো কথা না জিজ্ঞাসা কর বন্ধুর পিঠে হাত রেখে চুপ করে বসে রইলো। মণিও সেদিন কিছু বলল না। পুরো সময়টা চুপটি করে তিতলির হাত ধরে থাকল।
পরের দিন খুব নীচু গলায় বলল – তুই তো কিছু জানতে চাইলি না?
- তোর কষ্ট হলে শুনতে চাই না। আমার কাছে তোর ভালো থাকাটাই প্রধান কথা।
তিতলিকে জড়িয়ে ধরে মণি আবার কিছুটা কেঁদে নিল। বলল –
- সঞ্জয় এবার গিয়ে কিছুদিন এক সাধুর আখাড়ায় ছিল। সেদিন নদীর ধারে বসে সেই গল্পই শোনাচ্ছিল। সেখানে ও গাঁজা খেয়েছে। তাতে নাকি বেশ হাওয়ায় ভাসার ফিলিং হয়। আমাকে ইমপ্রেস করতেই বোধহয় একটা ছিলিম নিয়ে এসেছিল। তাতে ধরিয়ে একটান দিয়েওছিল। আমিও ওর হাত থেকে নিয়ে যেই না টেনেছি – উঃ কি কাশি!
দুঃখের গল্প। কিন্তু তিতলি হেসে ফেলল – পারিসও। তা শুধুই কাশলি, ভাসলি না?
মণি একটু গম্ভীর হয়ে গেল – তুই জানিস, আমি যখন দম আটকে কাশছিলাম, তখন সাহায্য করা দূরে থাকুক, ও আমায় ভয়ঙ্কর রকম বকছিল।
- সে কি? বকার মতো কি হলো? তোর অভ্যেস নেই। কাশি তো হতেই পারে!
তার জন্য নয়। আমি মেয়ে হয়ে গাঁজা টানতে গেলাম কেন, তাই। ও ভেবেছিল, আমি হাতে নিয়ে, দেখেটেখে ওকে ফিরিয়ে দেব। আমি যে টানতে পারি, এটা ও ভাবতেই পারে নি।
- হুমম। তারপর?
খুব ঝগড়া হলো। তখন বলে কি, মেয়েদের বাউণ্ডুলেপনা ওর পছন্দ নয়! আমি যে সবার সাথে হ্যা হ্যা করি – সেটা এবার ছাড়তে হবে। আরো নানাবিধ ডু অ্যান্ড ডোন্টসের লিস্টি। ভাবতে পারিস, সঞ্জয়.... অফ অল পার্সনস, সঞ্জয় একথা বলছে?
- হিপোক্রিট। - তিতলি এক কথায় রায় দেয়। - ঠিক করেছিস। আর কাঁদিস না।
চোখ মুছে হাসতে গিয়েও ফুঁপিয়ে উঠলো মণি।
পরে সঞ্জয় মিটমাট করতেও চেয়েছিল। আর এই প্রথম মণিও চেষ্টা করেছিল সব ভুলে একসাথে থাকার। কিন্তু ছেঁড়া তার আর জোড়া লাগলো না। দুজনেই নিজ নিজ বৃত্তে অনড় রইলো। মণি বেশ কিছুদিন মনমরা ছিল। তরপর আবার সব ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
- আমি নিজের মতো করে বাঁচতে চাই টিকলি। কারোর ইচ্ছের পুতুল হয়ে নয়। আই নিড মাই ওউন
স্পেস। আই নেভার ইন্ট্রুড ইন এনিওয়ানস স্পেস অ্যান্ড আই ডোন্ট অ্যালাউ এনি টম, ডিক,
হ্যারি টু ইন্টারফিয়ার
ইনটু মাই স্পেস আইদার।
- দিস পার্ফেক্টলি ডেস্ক্রাইবস ইউ ডিয়ার। চল, ফুচকা খাই।
এরপর পরীক্ষা, বারোর পরে দুজনের বিষয়, কলেজ আলাদা হয়ে গেল। তিতলি চলে গেল ত্রিচিতে, আর মণি গেল আহমেদাবাদে। তারপর যা হয়, যোগাযোগ ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে থাকে। অবসরে মনে পড়ে হয়তো, আবার আড়ালে চলে যায়। আজ হঠাৎ দেখায় সব কিছু যেন প্লাবনের মতো দুজনকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
মণিও ভাবছিল – সেই তিতলি! দুই বেণী ঝোলানো পানপাতা মুখটা এখন একটু ভরাট হয়েছে। বেশ ব্যক্তিত্বময়ী লাগছে। হালকা রঙের শার্ট, জিনস, আর ক্লিপে আটকানো লম্বা চুল – শব্দ করে হেসে উঠল মণি – তোকে তো পুরো এক্সিকিউটিভ লাগছে রে!
তিতলির চটকা ভাঙল – ভুল লাগছে না। বলেই হেসে ফেলল। ওসব বাদ দে। তোর খবর বল আগে। দারুণ দেখতে হয়েছিস কিন্তু।
- ওটা তো অ্যাসেট রে!
কথাটা কট করে কানে লাগল। লাল শাড়ির ওপর পড়ে থাকা অনাবৃত বাহুটার দিকে আপনিই চোখ চলে গেল। তারপর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল – এমন চমকে দিস না!
- মাঝে মাঝে চমকানো ভালো। হার্ট ভালো থাকে। আরে! কথায় কথায় এতোটা সময় চলে গেল? আমকে এখনি এক জায়গায় যেতে হবে। তোর ফোন নম্বরটা দে। যোগাযোগ করে নেব।
- তাই তো রে! আমকেও তো... । লেখ ৯৮৪....
- মিস কল দিয়ে রাখলাম। সেভ করে নিস। শিগগিরই দেখা হবে।
- অবশ্যই। আর হারাতে দেব না।
[তৃতীয় পর্ব]
দ্রুত পায়ে মল থেকে বেরিয়ে এল মণিমালা। গাড়িতে বসে আয়নায় একটু ঠিক করে নিল নিজেকে। তারপর বলল – আইস স্কেটিং রিনক। একটু তাড়তাড়ি চালাতে পারবে? আমার বেরোতে একটু দেরি হয়ে গেল!
দীনেশ অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দিয়ে রিয়ার ভিউ মিররে লুকিয়ে দেখল একবার। ম্যাডামের এমন নরম গলা! ম্যাডামকে কেমন যেন ছেলেমানুষ মনে হচ্ছে!
বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার মনামি গাড়ি থেকে নামতেই শোয়ের এক কর্মকর্তা এগিয়ে এলেন। একটু আগের সেই মণিমালাকে অবশ্য এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মনামি জানতে চাইল – শো-স্টপার কাকে পেলেন? যাঁদের আসার কথা ছিল, তাঁরা সবাই এসেছেন?
ভদ্রলোক বিগলিতভাবে জবাব দিলেন – আপনার শো সবসময়েই সাকসেসফুল। তবে আজকেরটা বোধহয় সবাইকে ছাপিয়ে যাবে।
মনামি হলে ঢুকতেই অনেকগুলো চোখ এদিকে ফিরল। মোহন আগরওয়াল পাশের জনকে ফিসফিসিয়ে বললেন – মনামি নিজেই শো-স্টপার হতে পারত।
মনীশ মাথা নেড়ে সায় দিল। বাস্তবিক, মহিলা যাই পরে চোখ ফেরানো যায় না।
শো শেষ হয়েছে। সবার প্রতিক্রিয়া দেখে মনামি খুশি হলো। সে হাসিমুখে সাংবাদিকদের দিকে এগিয়ে গেল। আগের মাসে ফ্যাশন ইন্ডিয়ায় রীতেশের ছবিটাই কভার
পেজে ছিল। কালকেও পেজ থ্রির পুরো মনোযোগ ওর চাই। একচুল জমিও ও ছাড়বে না।
রাত নেমেছে। নিজের ফ্ল্যাটে সোফায় পা ছড়িয়ে বসেছে মনামি। ভেজা চুল থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছে মুখের ওপর। মিতালি অবাক হলো। দিদিকে এমন সাদাসিধা ভাবে দেখতে অভ্যস্ত নয়। জানতে চাইল – খাবে না?
- পরে খাবো। আগে একটা কনিয়াক বানিয়ে দে তো।
মিতালি এসব ব্যাপারে পারদর্শী। মনামিই তাকে হাতে ধরে সবকিছু শিখিয়েছে। মিতালি আর কিছু বললো না। দিদিকে সে বড্ডো ভালোবাসে। দিদি না থাকলে সে আজ....
সে মনামির সামনে টেবিলে সবকিছু গুছিয়ে দিল। তারপর রাতের খাবার ঠিক করতে রান্নাঘরে চলে গেল। চিকেন স্যুপ টা দিদি স্নানে যাবার সময়েই বসিয়ে দিয়েছিল। সেটা প্রায় হয়ে এসেছে। হালকা গার্ণিশ করে গার্লিক ব্রেড তৈরি করে রাখল। মনামি রাতে খুবই হালকা খায়। মিতালি এই কাজটা রাঁধুনীর হাতে ছাড়ে না।
মিতালি এইসব বানাতে বানাতে মনামির কথাই ভাবছিল। সেইসঙ্গে নিজের কথাও। তার গল্পটা খুবই সাধারণ। ছোট্ট মফস্বলের মেয়ের ভুল লোকের প্রেমে পড়ার গল্প। বিয়ের জন্য ঘর থেকে পালানোর গল্প। সে এখন জানে, এই কাহিনীগুলো আসলে খুবই একঘেয়ে। সেই একই শুরু। শেষটা যে এক হতে পারেনি, তার কারণ মনামি। বিজন আর তার বন্ধুরা মিলে এক রাতে তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে, রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছিল। কোনো শোয়ের পরে ফেরার পথে মনামি তাকে দেখতে পায়। হাসপাতাল, ডাক্তার, ওষুধ, মায় মিতালির কাছ থেকে বাড়ির ঠিকানা নিয়ে তাদের খবর দেওয়া – সমস্ত কিছু মনামি একা হাতে সামলায়। শুরুর মতো এই পর্বটাও গতানুগতিক পথেই হাঁটল। মিতালির বাবা মায়ের আরো একটি মেয়ে আছে। তাছাড়া পারিবারিক সুনামেরও একটা ব্যাপার থাকে। অতএব...। পৈত্রিক সূত্রে শুধু একটাই
উপদেশ পেল মিতালি - সে যেন আবার থানা পুলিশ করে বাড়ির মান মর্যাদা ধুলোয় না মেশায়।
এই সব মিটে গেলে, মনামি ওর সাথে দেখা করতে এসে বলেছিল – তোমার সামনে দুটো রাস্তা আছে। এক – ভুলের জন্য সারাজীবন আফশোস করা। তাহলে তোমায় আমার চেনা জানা কোনো হোমে দিয়ে আসতে পারি। সেখানে কিছু শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে পার। দুই – আমার সাথে আমার বাড়িতে থাকতে পার। তবে সেটা তখনই সম্ভব, যদি –
- যদি কি দিদি?
- যদি মন থেকে মানতে পারো, অসাবধানে পথ চলতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্টের মতোই এটাও একটা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। তোমার চোট লেগেছিল। এখন সেরে গেছে। ভবিষ্যতে সাবধান হয়ে চললেই হবে। এটা ভাবতে পারলে তবেই একমাত্র আমার সঙ্গে যেতে পারো।
- সাবধান হবো দিদি। আর কখনো এমন ভুল করবো না।
- তুমি আমার কথাটা বুঝতে পারোনি। আমি ভুল করার কথা বলিনি। মানুষ কখনো জেনে বুঝে ভুল করে না। ভুল হয়ে যায়। কাজেই, সেটা না হবার গ্যারন্টি কেউ দিতে পারে না। আমি বলছি, তোমার সাথে ঘটা বিষয়টাকে একটা রোড অ্যাক্সিডেন্টের সমতুল্য ভাবতে পারলে তবেই আমার সঙ্গে চল।
মিতালি অবাক হয়ে শুনছিল। এমনধারা কথা সে আগে কখনো শোনেনি। তার ভাবনার জগতে একটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল। সে চুপ করে রইলো। মনামি বুঝল। বলল – তোমার ডিসচার্জ হতে এখনো দুদিন দেরি আছে। ভালো করে ভেবে নাও।
ডিসচার্জের দিন মনামি আবার এসেছিল। মিতালি ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিল।
- তোমার সাথেই যাব দিদি। মরার পথ তো খোলাই রইলো। জীবনের পথেই একবার চলে দেখি।
মনামি চমকে উঠল একটু – কতদূর পড়াশোনা করেছ?
- ফিলজফি অনার্স। পরীক্ষা দেবার পরেই...
মনামি শিস দিয়ে উঠল – উরিশ্লা – এ তো পুরো ছুপা রুস্তম!
মিতালি খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। আর মনামি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল – হাসলে কিন্তু তোকে বেশ দেখায়।
তারপর মনামি তাকে দিনে দিনে গড়ে তুলেছে। সে আজ মনামির নিজস্ব সহকারী কাম সেক্রেটারি কাম গৃহকর্ত্রী কাম......
মিতালির অ্যাকউন্টে মাস গেলে মোটা টাকা জমা পড়ে। মানামি তাকে অন্য চাকরি খুঁজে নেবার অফারও দিয়েছিল। কিন্তু সেই দিদিকে ছেড়ে যেতে রাজি হয়নি।
**********************************************************************************************
[চতুর্থ পর্ব]
মিতালি পেরেছে। সেদিনের সেই ঘটনা মনে রেখেই জীবনকে নতুন করে সাজিয়েছে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, নিজের শর্তে বাঁচতে শিখেছে। মনামির সঙ্গে নানা জায়গায় যেতে হয় তাকে। এই চলার পথে নানা সময়ে তার অনেক স্তাবক জুটেছে। মিতালি হাসিমুখে প্রশংসা কুড়িয়েছে। উপভোগ করেছে। কিন্তু ভেসে যায়নি। শুধু সেই একজন বেশি জড়িয়ে যাচ্ছিল। তার নাম রূপম। সে ভাসতে চেয়েছিল, ভাসাতে চেয়েছিল। মিতালিও নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। একদিন রূপম তাকে তার বাবা মায়ের সাথেও দেখা করিয়ে নিয়ে এল।
বাদামভাজারা মনের কথা বলতে খুব সাহায্য করে। খোলায় চোখ রেখে আনমনে পাশের লোকটিকে অনেক কথা বলা যায়।
- আমাকে বাড়িতে নিয়ে গেলে কেন রূপম?
- কি আশ্চর্য! বাবা মা তাদের ভাবী পুত্রবধূকে দেখবেন না? এরপর তো আমি তোমাদের বাড়িতেও যাব। তারপর...
- আমার বাবা মা থেকেও নেই রূপম। তাদের কাছে গিয়ে কোনো লাভ নেই।
- মানে? রাগারাগি করে বাড়ি ছেড়ে এসেছ? বরাবরের মতো?
- নাহ্। আমি রেপড হবার পরে তারা আমার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে চায়নি।
- ক্কীইইই.....
- বয়েস কম ছিল। লোক চেনার অভিজ্ঞতাও ছিল না। একজন ভুল লোককে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিলাম। সে আর তার দুই বন্ধু মিলে একদিন আমায়...
তারপর মনামি আমায় বাঁচায়। বাবা মা সেই থেকে আর যোগাযোগ রাখে না।
এবার মুখ তুলে পাশের লোকটির দিকে চোখ তুলে তাকায় মিতালি। রূপমের মুখ সাদা হয়ে গেছে। খসখসে গলায় বলল –
- এ কথা আগে বলোনি কেন?
- ঢাক পিটিয়ে বলার মতো বলে মনে হয়নি তাই।
- আশ্চর্য.....
- আশ্চর্যই বটে। - মিতালির ঠোঁটে তেতো হাসি ভাঙলো – তবু বলতে চেয়েছিলাম। মনে করে দেখ, তুমিই শুনতে চাওনি। বলেছিলে আমার অতীত নয়, আজকের আমিই তোমার একমাত্র বিবেচ্য!
- কি আশ্চর্য! সে তো একটা সাধারণ কথা। আমি কী করে জানবো......
- এখন তো জানলে। এর পরের কথাটা তোমার মুখের ভাব বলে দিচ্ছে রূপম। আমি বলি কি, আর কিছু বলার দরকার নেই। তুমি বাড়ি যাও। আমি একটা উবের ডেকে নিচ্ছি।
মাথা সোজা করে ফিরে এলেও, বাড়ি এসে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়েছিল মিতালি। আবারও ভুল লোককে বিশ্বাস করল সে? আর কবে শিখবে ও? তার মনে কোথাও বিজন আর রূপম মিলেমিশে যাচ্ছিল।
*********
সেদিন, মিতালির নীরব কান্না মনামিকে অনেক কিছু বলছিল। মনামির এ আশঙ্কা ছিলই। তবু রূপমের আবেগে সে যেন কোথাও একটু সত্যির ছোঁয়া সে দেখতে পেয়েছিল। মাথা নাড়ল মনামি। ছেলেটা সংস্কার কাটিয়ে উঠতে পারল না। মনামি জানে, জীবন তাকে শিখিয়েছে – মুখ আর মনের সংস্কার এক নয়। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রূপমের একটা ভালো চাকরির জন্য সে বাসুসাহেবকে বলে রেখেছিল। বাসুসাহেব রাজি হয়েছিল। মাসখানেক পরে একবার শুধু মনে করিয়ে দিতে বলেছিল। ফোনটা করার আর দরকার নেই। মিতালিকে ওর কান্নাটা কাঁদতে দিয়ে মনামি নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল। কাবার্ড থেকে গ্লেনফিডিকের বোতল আর গেলাস নিয়ে টেবিলে রেখেছিল। গেলাস উঠিয়ে বলেছিল – চিয়ার্স রে বেজন্মার দল!
দু এক পেগে নেশা চড়বে, মনামি এমন কাঁচা নেশাড়ু নয়। তবু রোমির মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। রোমি, তার কলেজজীবনের রুমমেট। কোর্স চলার ফাঁকে যখনই সময় পেত, দুজনে এদিক ওদিক হাওয়া হয়ে যেত। আমেদাবাদ এবং তার চারপাশের নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াত দুটিতে। রোমির কাছেই মণিমালার বাইক চালানোয় হাতেখড়ি। কি সুন্দর ড্রেস ডিজাইন করত রোমি! স্যারেদের অনেকেই তার মধ্যে ভাবী রিতু কুমার বা মনীশ মালহোত্রাকে দেখতে পেতেন। শুধু একজন ছাড়া। রোমির কাজ কেন জানি কিছুতেই গুপ্তা স্যারের পছন্দ হতো না। অথচ ওঁর হাতেই দু দুটো পেপারের নম্বর। কিছুতেই যখন দিশা পাচ্ছে না, তখন এক সিনিয়র যে উপদেশ দিল, তার সাদা বাংলা
হচ্ছে – একবার স্যারের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলে দেখ না? কোথায় গণ্ডগোল হচ্ছে, স্যার হয়তো বুঝিয়ে দেবেন। তবে কিনা....। তা অতো ভাবলে চলবেও না। নম্বর আর রেকোটা খুব দরকার রে।
হরিশ গুপ্তা এমনিতে রাশভারী লোক। রোমি একটু ভয়ই পাচ্ছিল প্রথমটায়। মণিমালাই সাহস দিল – এতো ভয় পাচ্ছিস কেন? স্যার তো আর তোকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে না! বড়জোর বকতে পারে। সোনিদি যখন বলছে, একবার গিয়েই দেখ কি হয়। সিনিয়র স্টুডেন্ট। কলেজের হালচাল তোর আমার চেয়ে বেশিই বুঝবে।
তাই গিয়েছিল রোমি। তার সমস্যার সমাধানও হয়েছিল। স্যার তাকে আলাদাভাবে ডেকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে আর কোনো সমস্যা হয়নি। পরের সেমিস্টারে স্যারের দুটো পেপারেই সে হায়েস্ট পেল।
রোমির খুশি হবার কথা। কিন্তু দিন দিন সে কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়তে লাগল। বেশির ভাগ সময় ঘরের মধ্যেই, বইয়ের সাথে তার দিন কাটে। ইদানিং মণিমালাকেও এড়িয়ে চলে। তিনবার জিজ্ঞাসা করলে একবার উত্তর দেয়। তাও কেমন ভাসা ভাসা। আর কপালগুণে মণিমালার তখন এক নতুন বয়ফ্রেন্ড জুটেছে। মাঝে মাঝে তার সঙ্গে আউটিংয়ে যায়। কাজেই রোমিকে সেভাবে সময় দেওয়া হয় না। রোমি ভালো রেজাল্ট করছে, পড়াশোনায় বেশি মনোযোগী হয়েছে – মণিমালা এতে কোনোরকম সমস্যার আঁচ পায়নি। বরং মাঝে মাঝে ঠাট্টাও করেছে – গুপ্তা স্যার তো তোকে পুরো পাল্টে দিলো রে! রোমি চুপ করে থাকত। জবাব দিত না। বড়জোর একটা বই টেনে নিত। এর মধ্যে একটা সেমিস্টার ব্রেকের ছুটি পড়ল। মণিমালা আর আর রোমির ট্রেন মোটামুটি এক সময়ে, তবে ভিন্নদিকে। স্টেশনে হঠাৎ মণিকে জড়িয়ে ধরে, রোমি তার কানে কানে বলল – তোর মতো বন্ধু আমার আর একটাও নেই। তোকে খুব ভালোবাসি – এটা মনে রাখিস।
মণিমালা অনেকদিন বাদে বন্ধুর উচ্ছ্বাসে খুশি হয়েছিল। কিন্তু তখনই ওর ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢোকায়, কথা আর বাড়েনি। হাত নেড়ে – আই লাভ ইউ ট্যু...থ্রি, ফোর, ইনফিনিটি..... বলতে বলতে ট্রেনে উঠে পড়েছিল। তারপর উচ্ছ্বসিত হাত নাড়ানাড়ি....
[পঞ্চম পর্ব]
ছুটি শেষে, মণিমালা ঘরে ফিরে দেখল – দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। তার মানে, রোমি তার আগেই ফিরে এসেছে। একটু খুশি খুশি মনেই সে কড়া নাড়ল। সাড়া পাওয়া গেল না। এবার একটু
জোরেই ধাক্কা দিল দরজায়। ডাকলো নাম ধরে। তাও সাড়া নেই! মণি একটু অবাক হলো – রোমি যদি ঘুমিয়েও থাকে, তাহলেও তো...। তাছাড়া ওর ঘুম এমনিতেই পাতলা। আরো কয়েকবার জোরে জোরে ধাক্কা দিলো। আসপাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো কয়েকজন। সবাই সদ্য ফিরে ক্লাসে জন্য তৈরি হচ্ছিল। সুনীতা বলল – দারোয়ান বলছিল, রোমি গতকালই ফিরে এসেছে।
তারপর সুপার, দারোয়ান, পুলিশ........। সেদিন আর কারো ক্লাস করা হলো না। অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল রোমি। হাতের শিরাও কেটে ফেলেছিল। বোধহয় কোনো সুযোগই ছাড়তে চায়নি। এক লাইনের একটা নোট পাওয়া গেল – “আই অ্যাম কমিটিং
সুইসাইড।” সাদা কাগজটার উল্টোপিঠে একটা ড্রেসের নকশা। পুলিশ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আর কোনো হদিশ পায়নি।
..................
মণিমালা পেল। সে ঘর পালটে ফেলেছে। ওই ঘরে আর থাকতে পারছিল না। বইগুলো গুছিয়ে রাখতে গিয়ে গেহলারের বইটায় তার চোখ আটকাল। বইয়ে স্বচ্ছ মলাট দেওয়া তার নেশা। তাতে বই খুঁজে পেতে সুবিধে হয় তার। বইও ভালো থাকে। কিন্তু এটায় ক্যালেন্ডারের মলাট দিল কে? রোমি? কিন্তু তার তো মলাট দেবার অভ্যাস ছিল না। বরং মণিমালাকে এই স্বভাবের জন্য স্কুলের বাচ্চা বলে খ্যাপাতো। ভাবছে আর আনমনে বইটায় হাত বোলাচ্ছে মণি। কি মনে হলো একসময়, মলাটটা খুলে ফেলল। তার পরেই মলাটের ভিতরের সাদা অংশের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল।
প্রিয় মণি,
এই চিঠি যখন তুই পড়বি, তখন আমি অনেক দূরে। তোর মনে আছে বলেছিলাম, তোকে বড্ডো ভালোবাসি? তাই যাবার আগে তোকেই কিছু বলে যাওয়ার কথা মনে হলো। মাকে জানাতে পারলাম না রে। সারাজীবন পুজোআচ্চা করা মানুষটা খুব আঘাত পেত। তার চেয়ে এটা রহস্যই থাক। তোকেই বলছি, কারণ কাউকে না বলে মরতেও পারছি না। তবে তুই কাউকে বলিস না। আমি চাই না একথা আমার মা জানুক।
মণি, আমি গুপ্তা স্যারের কাছে লেসন নিতে গিয়েছিলাম। তিনি
আমাকে আলাদাভাবে ‘লেসন’ দিয়েছিলেন। দিতে পেরে খুশি হয়েছিলেন। এরপর দুটো পেপারে
হাইয়েস্ট পেতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু আমি রোজ একটু একটু করে মরে
যাচ্ছিলাম। উনি আমাকে আরো ‘লেসন’ দিতে চাইছিলেন। আমি আর পারছিলাম না।
হোস্টেলে
লোডশেডিং হলে দুদিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গালাগালির ঝড় তুলতাম সবাই মিলে – মনে পড়ে? হিন্দিতে খাসা খাসা গালি আছে, কিন্তু কন্যা-ধর্ষণকারীর জন্য কোনো গালি ওরাও বানাতে
পারেনি। নাকি পেরেছে, আমরাই জানি না? শিক্ষক তো
পঞ্চপিতার এক পিতা, তাই না? আমার মা বলত।
আমি সব ছেলের
চোখে ধর্ষণেচ্ছা দেখছিলাম আজকাল। আর সব মেয়ের চোখে আমার জন্য ঘেণ্ণা! আর পারছি না
রে। যদি কোনোদিন এমন হয়যে, মা আর তোর
চোখেও?...
চলি রে। ভালো
থাকিস, সাবধানে থাকিস। আমাকে
ভালোবাসিস প্লিজ!
তোর রোমি
মণি স্তব্ধ
হয়ে বসে রইলো অনেকক্ষণ। চোখের জলে লেখাগুলো ভেসে যাচ্ছিল। অসহায় রাগে মাথা ছিঁড়ে
যাচ্ছিল ওর। আগুনে, জলে মাখামাখি
রাত কাটল, দিন কাটল – এক, দুই, তিন....
একসময় সোজা
হয়ে দাঁড়ালো। চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলল। তারপর কলেজ গেল। গুপ্তা স্যারের সঙ্গে দেখা করা
দরকার খুব।
-
স্যার, টুয়েন্টয়েথ সেঞ্চুরি ফ্যাশনের কয়েকটা জায়গায় একটু ডাউট
হচ্ছে। আপনি যদি দেখিয়ে দিতেন...
-
সিওর। তোমাদের মতো ছাত্রীরাই তো শাইন করে। বাট, কাম আফটার আ ফিউ ডেজ। আমার এখন মনটা ভালো নেই।
-
হ্যাঁ
স্যার, রোমির জন্য আমাদের সবারই মন খারাপ।
-
অতো
ভালো ছাত্রী,
কি যে হলো...। বাই দ্য ওয়ে, ইউ সাপোজড টু বি হার রুমমেট, রাইট?
-
হ্যাঁ
স্যার, ছিলাম তো। একসাথেই থাকতাম। খুব চাপা মেয়ে ছিল তো! কি যে হয়েছিল, আমরা কেউই বুঝতে পারিনি।
-
হুমম্।
কাউকেই কিছু বলেনি?
-
আমার
সাথেই তো বেশির ভাগ সময় থাকত। কিচ্ছু বুঝতে পারিনি। পারলে কি আর....
উপচিয়ে আসা চোখের জলে বাকি কথা আর বেরোয়
না। গুপ্তা স্যার বিচলিত হয়ে পড়েন। মেয়েটাকে এভাবে বলা ঠিক হয়নি। মাথায় পিঠে হাত
বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকেন। এই আদরটুকুতে মণির কান্না আরো উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।
-
আরে এতো কাঁদলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে
তো। ঠিক আছে, দুদিন
পরে আসতে পারবে?
উই হ্যাভ এ মিটিং অন স্যাটারডে। তারপরে এসো। তোমার জন্য নাহয় আমি
কিছুক্ষণ কলেজে থেকে যাব। এই ধরো দুটো নাগাদ।
চোখ মুছে ধরা গলায় মণি বলল – সেদিন তো আমাদের ক্লাস নেই স্যার।
আমি আসতে পারব। কোনো অসুবিধে নেই।
-
দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল।
কান্না দেখলে আমার খুব খারাপ লাগে। নাও স্মাইল অ্যান্ড গেট লস্ট।
গুপ্তা স্যারের হাসিতে পিতার প্রশ্রয়। মণি বাইরে এসে কিছুটা
দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। রোমি ঠিক লিখেছিল তো? তবু
সাবধানে এগোতে হবে।
শনিবার
গেল মণি। স্যার খুব সুন্দর করে পড়িয়ে দিলেন।
দু একটা জায়গায় আরো কিছু রেফারেন্সের দরকার ছিল। স্যার একটু মুশকিলে পড়লেন
– এই বইগুলো একটু দুষ্প্রাপ্য। লাইব্রেরিতে আছে কিনা দেখতে হবে।
-
লিস্ট করে নিই। খুঁজে দেখব। না পেলে তো মহা
মুস্কিল।
-
দেখো।
আই হ্যাভ দেম ইন মাই ওউন কালেকশন। । তবে সে তো বাড়িতে।
-
আপনি
যদি অ্যালাউ করেন,
তাহলে...
-
ছাত্রছাত্রীদের
জন্য আমার দরজা সবসময় খোলা। বাট দ্য সিচুয়েশন ইজ ডিফারেন্ট নাও। ওকে। আগে লাইব্রেরিতে দেখো। না পেলে তখন অগত্যা...
মণির
হিসেব মিলছিল না। সে একটু চিন্তায় পড়ল। রোমির কথার সাথে মিলছে না কেন? হয়
রোমি তিলকে তাল করেছে,
অথবা এই গুপ্তা স্যারটি খুবই গভীর জলের মাছ।
খুব সাবধানে এগোতে হবে। সোহমকে সঙ্গে নিলে ভালো হয়। ছেলেটাকে বিশ্বাস করা যায়। ওর
মাথা খুব পরিষ্কার এবং যাকে বলে টেকস্যাভি ছেলে। হয়তো কিছু বুদ্ধি দিতে পারে। ওর
নতুন বয়ফ্রেন্ড হয়তো একটু দুঃখ পাবে।
কিন্তু সে এসব কথা পাঁচকান করতে চায় না। এইটুকু প্রাইভেসি রোমির প্রাপ্য। এ কাজের জন্য সোহমই সেরা। মণি কোনো
চান্স নিতে চাইছিল না। সে মোবাইল খুলে একটা নম্বর ডায়াল করল।
[ষষ্ঠ পর্ব]
কানকারিয়া লেক। রোমির সাথে অনেকবার
এসেছে মণিমালা। আজও রোমির বাইকটা নিয়েই এসেছে। রোমির মা ওটা ফেরত নিয়ে যেতে চাননি।
বলেছিলেন, - আমি
জানি, তুমি
ব্যবহার করলে রোমি খুশি হবে। সোহম আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। কলেজ থেকে এতদূরে ডাক পেয়ে, সে
একটু অবাক হয়েছে। মণিমালা ভঙ্গুর হাসল – তোর সাথে কিছু জরুরি কথা আছে। কলেজের কারো
চোখে পড়ুক, আর
এ ব্যাপারে কেউ কিছু জানুক - চাইছিলাম না।
সোহম বুঝদারের মতো মাথা নাড়ল। যদিও
মণিমালা ঠিক কী বলতে চাইছে, সে বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।
অস্পষ্টভাবে দু-একটি সম্ভাবনা তার মাথায় আছে। কিন্তু সে চুপ করে মণিমালার পাশে বসে
পড়ল। সে জানে, এই
সময় মানুষকে একটু সময় দিতে হয়। মণি চুপ করে বসেছিল। কথা শুরু করা দরকার। সোহম উঠে
দুটো আইসক্রিম নিয়ে এল।
-
জানিস কি এটা এখানকার দ্বিতীয় বৃহত্তম
লেক?
মণিমালা আলগা হাসল – লেকের বাংলা পেলি
না?
সোহমও হাসল – এই জায়াগাটা আমারও খুব
প্রিয়। প্রায়ই আসি।
-
আমরাও আসতাম। মানে আমি আর রোমি।
সাবধানে নিঃশ্বাস ফেলল সোহম – ইট ওয়জ
সো আনএক্সপেক্টেড।
-
হুঁ। আগে বুঝতেই পারিনি। পারলে...
-
এখন পেরেছিস?
লম্বা শ্বাস নিল মণি – পেরেছি বলবো না।
তবে একটা সন্দেহ হচ্ছে। তবে সন্দেহই।
-
সেটা যাচাই করে দেখতে চাস। তাই তো?
-
আমি জানতাম তুই বুঝবি।
-
বল।
-
রোমি গুপ্তা স্যারের কাছে নম্বর
পাচ্ছিল না। পরে ওর কাছে পড়া বুঝতে যেত। হায়েস্ট পেয়েছিল। কিন্তু ওর মুখে আমি তার
জন্য কোনো আনন্দ দেখিনি।
-
মণি চুপ করে রইল। সোহম কিছুক্ষণ
অপেক্ষা করল। তারপর বলল – এইটুকুর জন্য তুই আমায় এতদূরে ডেকে আনিস নি। আরো কিছু
আছে। যেটা তুই বলতে চাস না। ওকে। আমিও জানতে চাইবো না। কিন্তু এখন তুই কি করতে চাস?
মণি সোহমের প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞ বোধ করল।
এই জন্যেই ও সোহমকে এতো ভরসা করে। বলল – আমি গুপ্তা স্যারের ব্যাপারটা বাজিয়ে
দেখতে চাই। যদি এ ব্যাপারে ওর হাত থাকে, আমি ওকে ছেড়ে দেব না। আবার একই সঙ্গে,
রোমির নামে কোনো কথা উঠুক, তা আমি চাই না।
-
এইজন্য তুই গুপ্তার কাছে গিয়েছিলি?
-
তুই জানলি কি করে?
-
আমাকে ভাস্করণ ম্যাম ডেকেছিলেন।
ম্যামের চেম্বারটা গুপ্তা স্যারের পাশে তো। তখন
চোখে পড়েছিল।
-
তাই বল। আমি ভাবছিলাম...
-
খুব সাবধান মণি। আমি শুনেছি, গুপ্তা
খুব গভীর জলের মাছ। ওর নামে নানান জনের নাম জড়িয়ে হালকা কিছু গুজব কানে এসেছে বটে, কিন্তু
ওর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই। বরং অনেকেরই ধারণা, লোকে
মিছিমিছি বদনাম রটায়।
-
আমি সেটা আগে জানতাম না। এখন শুনছি।
সেজন্যেই আমি নিজে যাচাই করে নিতে চাই।
-
এতোটা রিস্ক নিবি? আসিফ
জানে? ও
তোকে মানা করেনি?
-
রোমি আমার বন্ধু ছিল সোহম। এটুকু দেখা
আমার কর্তব্য। আসিফকে এখনও কিছু বলিনি। ওর পেটে কথা থাকে না।
-
পরে যদি...
-
তাহলে বুঝব আমার নির্বাচন ভুল ছিল। তুই
কি আসিফকে না বললে স্বস্তি পাচ্ছিস না? তাহলে কথা এই পর্যন্ত থাক। তুই কাউকে কিছু বলবি
না। আমি একাই চেষ্টা করব।
সোহম বড় করে নিঃশ্বাস ফেলল। পরিস্থিতি ক্রমশঃ জটিল হয়ে যাচ্ছে। সে ধীরে ধীরে প্রতিটি কথা
ওজন করে বলল –
-
অ্যাজ এ ফ্রেন্ড, আমি
তোকে শুধু প্রবলেমগুলো দেখিয়ে দিচ্ছিলাম। তুই যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছিস, তখন
আর এ ব্যাপারে কোনো আলোচনা করব না। এবার যা বলি ভালো করে শোন।
রোমি
আমারও বন্ধু ছিল। কেউ
যদি এই ঘটনার জন্য দায়ী হয়, তাহলে তাকে ছেড়ে দেবার প্রশ্নই নেই। আমি আছি
তোর সাথে।
কি করতে
চাস বল। প্ল্যানটা ঠিকভাবে সাজাতে হবে।
এরপর কিছুদিন ধরে আলোচনা চলল। মণিমালার
পরিকল্পনায় যেটুকু দুর্বলতা ছিল, সোহমের সঙ্গে বসে সেগুলো ঠিক করল। গুপ্তা সম্বন্ধে নানা তথ্যে ওদের নোটবুক বোঝাই
হতে থাকল। সব ঠিক হবার পরেও সোহমের ইতস্তত ভাবটা কাটছিল না।
-
শেষবারের
মতো বলছি রে মণি। অনেক বেশি রিস্ক নিচ্ছিস। গুপ্তা লোকটা অতি ঘোড়েল। যদি সময়ের একটুও গোলমাল হয়...
-
আই ডোন্ট কেয়ার আ ফিগ।
-
আই নো। কিন্তু যদি কিছু গোলমাল হয়, যদি
নিজেকে বাঁচাতে না পারিস?
মণি হাসল। জবাব দিল না। পার্ক থেকে
একটু মাটি তুলে সোহমের হাতে লাগিয়ে দিল। সিরিয়াস কথার মধ্যে এই ছেলেমানুষিতে একটু
বিরক্ত হলো সোহম। উঠে গিয়ে হাত ধুয়ে এল।
-
কি যে ছেলেমানুষি করিস না?
মণি
আর হাসছিল না।
-
ছেলেমানুষি করিনি। ডেমো দিলাম।
-
মানে?
-
মানে আবার কি? চামড়ার
জিনিস, ধুলেই
পরিস্কার। বড়োজোর একটা ভালো সাবান দরকার হবে।
সোহম অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল।
মণিমালার কথার অর্থ বুঝতে তার একটু সময় লাগল। তারপর যখন চোখ তুলল, তখন
সেখানে বিস্ময়,
শ্রদ্ধা, ভালোবাসা
মাখামাখি হয়ে আছে।
-
তুই এভাবে ভাবিস? রিয়েলি? রোমি
এভাবে ভাবতে পারলে আজ মরত না রে। তোকে একটা কথা বলি। কেউ জানে না। রোমিকেও বলা
হয়নি। আমি রোমিকে ভালোবাসতাম। ভেবেছিলাম এই স্প্রিং ফেস্টিভ্যালে ওকে প্রপোজ করব।
তার আগেই...
-
রোমি বুঝতে পেরেছিল। ইন ফ্যাক্ট, ও
তোকে পছন্দও করত। কিন্তু সিওর হতে পারছিল না। আমি জানতাম। তারপর তো একদম চুপচাপ
হয়ে গিয়েছিল। তোকে সঙ্গে নেবার এটাও অন্যতম কারণ।
সোহম
হাত বাড়িয়ে বন্ধুর হাতটা ধরল। দুজনে
চুপ করে সামনের জলরাশির দিকে চেয়ে রইল। অনেক সময়েই নীরব স্পর্শ শত কথার চেয়ে
বাঙ্ময়।
*********
গুপ্তা
স্যারের কাছে বেশ কয়েকটা ডাউট ক্লিয়ারিং ক্লাস করল মণিমালা। দু একবার স্যারের
বাড়িও যেতে হয়েছে। মিসেস গুপ্তা খুব শান্ত, চুপচাপ ধরণের মহিলা।
তাকে ডেকে বসান, মাঝে মাঝে পড়ার মধ্যে
কফিও বানিয়ে আনেন, তবু তাঁর
অপ্রসন্ন চোখে, ব্যবহারে কোথাও একটা
নিষেধের বেড়া আছে। সেটা মণিমালা অনুভব করে, কিন্তু সেটা
এতো গোপন, অথচ এতো তীক্ষ্ণ যে, নিজেরই একেক সময় মনে হয়, ঠিক বুঝছে তো? কিন্তু মহিলার সঙ্গে একান্তে কথা বলার সুযোগ হয় না।
যতক্ষণ ওবাড়ি থাকে, স্যারের
স্টাডি ছেড়ে উঠতে গেলেই স্যার মৃদু ধমকে বইয়ে মন দিতে বলেন। দু একবার স্যার উঠে
গেলে, মণিমালা সোহমের কথামতো
চারিদিকে খেয়াল করে দেখে। বোঝার চেষ্টা করে কোনো লুকোনো ক্যামেরা আছে কিনা। খুব
বেশি ঘাঁটাঘাটি করতে সাহস হয় না। ক্যামেরায় ধরা পড়লে মুশকিল।
সেদিন সুযোগ
জুটে গেল। লোডশেডিং হয়েছিল। আর পড়ানোর ফাঁকে স্যারের কাছে একজন এসেছিল। স্যার ওকে
পড়তে বলে উঠে গিয়েছিলেন। মণিমালা সুযোগটা ছাড়েনি। লোডশেডিংয়ে ক্যামেরা কাজ করবে
না।
মনে মনে হাসল মণিমালা। লোডশেডিং হলে ম্যাডাম ফ্যান চালালেও
আপত্তি করেন। আশা করা যায়, ক্যামেরা
থাকলেও ইনভার্টারে সাথে সংযোগ থাকবে না। সে দ্রুত হাতে বইয়ের তাক, শো-পিস গুলো নেড়েচেড়ে দেখে নিচ্ছিল। হতাশ হয়ে চেয়ারে
বসতে যেতেই ওর সারা শরীর জমে পাথর হয়ে গেল। দরজায় মিসেস গুপ্তা দাঁড়িয়ে আছেন!
বিদ্রূপের গলায় বললেন - এতো বই ঘেঁটে কোন জ্ঞানের চক্ষু উজ্জ্বল করছো, সে তুমিই জানো।
[সপ্তম পর্ব]
মণিমালা বুঝল,
তার অনুসন্ধান এখানেই শেষ। স্যার এখুনি ওকে তাড়িয়ে দেবেন। এতো বোকার মতো ধরা পড়ল
যে, তার আর কিছু বলার রইলো না! তার গলার কাছে কান্নার দলা পাকিয়ে উঠল। স্যারের
পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। মণিমালা ঘামছিল।
-
তোমরা একটু
কফি নেবে কিনা জানতে এসেছিলাম। মেয়েটা অনেকক্ষণ এসেছে।
সহজ স্বাভাবিক
গলা। চমকে ওঁর মুখের দিকে তাকালো মণি। দৃষ্টিটা যেন একটু নরম! মণিমালা তাড়াতাড়ি
বলল – আজ যাই স্যার? আজ একটু অন্য কাজ ছিল।
গুপ্তার ভুরু
কুঁচকে উঠল। মণিমালাকে আপাদমস্তক দেখে বললেন – ইতনা পসীনা কিঁউ?
মণিমালা কিছু
বলার আগে মিসেস গুপ্তার গলা শোনা গেল। তিনি যেতে যেতেই বললেন – ব্যাটারিটা পুরোনো
হয়ে গেছে বলে, আমিই ফ্যানটা বন্ধ করে দিয়েছি। তোমাদের ফ্যান চালাতে হলে বলো, বাকি
আলোগুলো বন্ধ করে দেব তাহলে।
গুপ্তা একটু
স্বাভাবিক হলেন। একটু বিরক্ত গলায় বললেন – ইনকরিজিবল! ও এরকমই বাতিকগ্রস্ত। মাই
প্রেসাস বেঙ্গলি ওয়াইফ! সরি। তুমি অন্যদিন এসো। আমি এদিকে দেখছি। শেষ কথাটা বলার
সময় গুপ্তার চোখের শীতল দৃষ্টিটায় মণিমালা আজ দ্বিতীয়বার শিউরে উঠল। তার কেন জানি সাপের উপমা মনে পড়ছিল।
পরদিন
কানকারিয়া লেকের ধারে আবারও দুটি ছেলেমেয়েকে ঘনিষ্ঠভাবে বসে থাকতে দেখা গেল।
আইডিয়াটা সোহমের। প্রেমিকযুগলের সংখ্যা এখানে এতো বেশি যে, লোকের খেয়ালে পড়ার
সম্ভাবনা কম। ওদের কথাবার্তা কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না। সোহম মিটিমিটি হাসছিল।
-
তোর মতো
সুন্দরীর সাথে এভাবে বসতে ভালোই লাগছে। কিন্তু আসিফের বুকে ব্যথা লাগতে পারে।
মণিমালা দুম
করে সোহমের পিঠে কিল বসিয়ে দেয়।
-
আসিফের মায়ের
খুব শরীর খারাপ। তাই বাড়ি গেছে। হাসপাতাল, ডাক্তার নিয়ে দৌড়োদৌড়ি করছে। ওর এখন
অন্যদিকে মন দেবার সময়? ওই রাতের দিকে সামান্য কথা বলার সুযোগ পায়।
-
সরি সরি। জানতাম না রে।
-
হুঁ। চিন্তার
বিষয়। তবে সময়মতো চিকিৎসা আরম্ভ হয়েছে। রেসপন্স করছেন। তবে আই সি ইউ থেকে ছাড়তে
এখনো দেরি আছে।
-
আশাকরি ভালো
হয়ে যাবেন।
-
ডাক্তারও তো
তাই বলছেন। যাকগে, শোন। আমি খুব ভালো করে চেক করেছি, কোথাও সিসিটিভি দেখতে পাইনি।
মনে হয় নেই।
-
আছে তো বটেই।
সেটার ভয় না থাকলে কেউ না কেউ মুখ খুলত।
-
জানিস, সেদিন
স্যার ছিল না। আমি এটা ওটা নামিয়ে দেখছিলাম। মিসেস গুপ্তা দেখে ফেলেছেন।
-
ছাগল কোথাকার।
তোর ওবাড়ির পাট উঠলো তাহলে!
-
সেটাই
আশ্চর্য। উনি বরং আমায় বাঁচিয়ে দিলেন। শোন তো ঘটনাটা...
-
যাচ্চলে! তার মানে
উনি এ ব্যাপারটা জানেন, এবং তোকে সাপোর্ট করছেন?
-
ওঁর চোখটা...
এমনিতে এতো রাফ, যেন ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করতে পারলে খুশি হন.... অথচ সেদিন খুব
নরম, কেমন যেন স্নেহময় ছিল জানিস?
-
মানেটা কি?
-
জানিনা। তবে
উনি স্যারকে কিছু বলবেন না। এটা আমি নিশ্চিত।
রাতে শুয়ে শুয়ে
মণিমালা সেদিনের কথাই ভাবছিল। মহিলার চোখে যেন কি ছিল। কিছুতেই ধরতে পারছে না। অথচ
কিছু তো বটেই। বারবার সেদিনের ঘটনাটা চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে মণি। আর এই রিপিট টেলিকাস্ট দেখতে দেখতেই হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে
লাফিয়ে ওঠে। মোবাইলের স্পীড ডায়ালে চাপ দেয়।
-
আমি একটা ছাগল,
বুঝলি? পুরো রামছাগল একখানা।
-
সেটা তো আমি
জানি। কিন্তু তুই এই জানাতেই রাত দুটোয় আমার ঘুম ভাঙালি?
-
নাহ্। শোন মন
দিয়ে.....
-
একদম ঠিক
বুঝেছিস। ওটাই সবচেয়ে সেফ
জায়গা। সবার চোখের সামনে, অথচ কারো নজরে পড়বে না। কাল বিকেল পাঁচটায় কানকারিয়া
লেকে আয়। প্ল্যানটা ফাইনাল করতে হবে। এর মধ্যে আমায় জ্বালাবি না একদম। ঘুম তো
গোল্লায় দিলি। এখন আমায় কাজ করতে দে।
-
***********
কয়েকদিন পর। মণিমালা অগাধে ঘুমাচ্ছিল। রিংয়ের আওয়াজে ঘুম ভাঙল। অচেনা নম্বর।
-
হ্যালো...একটা চাপা ত্রস্ত গলা।
-
হু ইজ দেয়ার?
-
জাস্ট লিসন।
আমি কাল বাপের বাড়ী যাচ্ছি, দু-তিনদিনের জন্য। বি কেয়ারফুল।
-
ওহ্। থ্যাঙ্কস
ম্যাম।
ফোনটা কেটে
গেল। মণিমালা মোবাইলের দিকে তাকালো। এখন রাত একটা। ম্যাম ওর নম্বর জানেন? কৃতজ্ঞ
বোধ করল সে। চোখেমুখে জল দিয়ে মোবাইলটা হাতে তুলে নিল।
এক ঝলক বৃষ্টি
হয়ে গেছে। গুমোট গরমটা কেটে গিয়ে আরামদায়ক শিরশিরে হাওয়া দিচ্ছে। সন্ধ্যায়
ক্যান্টিনে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে মারতে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিল
মণিমালা। সোনিয়া কে দেখে ওর টেবিলে উঠে গেল।
-
হাই সোনিদি!
সোনিয়া ওকে
দেখে একটু হাসল। তেতো হাসি।
-
আজ তোর
স্পেশাল ক্লাস নেই?
-
নাহ্। স্যার
বলেছেন সময়মতো ডাকবেন।
-
গুড। উনি ওঁর ছাত্রীদের ভালো রেকো দেন।
-
জানি। তুমিই
রোমিকে বলেছিলে।
-
ওর হাল খুব
খারাপ ছিল। ডিড নট হ্যাভ এনি আদার অপশন। তবে তুই তো ভালোই আছিস
মনে হয়।
-
ভালো থাকাটা
অভ্যেস করতে হয় গো। কাউকে তো কাজটা শুরু করতে হবে!
-
মতলব?
-
কিছু না। বলতে
এসেছিলাম, তুমিও ভালো থেকো। রোমির জন্য এতো কষ্ট পেয়ো না।
-
ধ্যানসে সুন।
গুপ্তার কিন্তু পলিটিক্যাল কানেকশন আছে। লোকটাকে বোকা ভাবিস না। ডোন্ট টেক হিম
ইজি।
-
এ কথা বলছ
কেন?
-
অ্যায়সেই। তোকে অন্যরকম মনে হয়। তাই সাবধান করলাম।
-
থ্যাঙ্কিউ।
আমি কেরিয়ার বানাতেই এসেছি।
-
সেটা হলেই
ভালো। আমিও সাতে পাঁচে থাকা পছন্দ করি না। বাই।
সোনিয়া
ব্যাগটা উঠিয়ে হাঁটা লাগালো। মণিমালা ফিরে গিয়ে
দেখে গরিমা চিকেন পকোড়ার অর্ডার দিয়েছে। প্লেট থেকে দুটো তুলে নিল মণিমালা। আজ খুব
হালকা লাগছে নিজেকে। সোনিয়া মেয়েটাকে যেমন ভেবেছিল তেমন নয়। কাউকে ভালো ভাবতে
পারলে মনের ভিতর একটা আনন্দ হয়। পকোড়ার সাথে সেই স্বাদ মিলে মিশে যাচ্ছিল।
ফোনটা তখনই
এলো।
-
হোপ উ আর
ফ্রি?
শক্ত হয়ে গেল
মণিমালা। বন্ধুদের ছেড়ে উঠে গেল একদিকে।
-
ইয়েস স্যার।
-
একটা নতুন
জার্নাল এসেছে আজ। রাওয়ের সঙ্গে কাল এই নিয়ে একটা মিটিং আছে। তুমি এলে একসঙ্গে বসে
নোটস বানিয়ে নিতাম। বিষয়টা তোমারও কাজে লাগবে।
-
আমি আসছি
স্যার।
মণিমালা সোহমের নম্বরটা ডায়াল করল।
*** *****
[অষ্টম পর্ব]
আজ গুপ্তা স্যারই দরজা খুলে দিলেন।
স্যার আপনি? ম্যাডাম নেই?
ভাইয়ের বাড়ি গেছে। কাল ফিরবে। আজ কফি খেতে চাইলে নিজে বানিয়ে নিতে হবে। তাতে আপত্তি থাকলে, সোজা স্টাডিতে চলে এসো।
মণিমালা হেসে ফেলল – কি যে বলেন না স্যার! কফিটা আমিও ভালো বানাই।
তাহলে একেবারে বানিয়ে নিয়ে এসো। চলো, আমি তোমায় কফি, দুধ, চিনিগুলো দেখিয়ে দিই।
********
সোহম একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল। ফোনটা বাজতে সচকিতে তুলে দেখল – বাবার ফোন।
হ্যালো বাবা, তুমি এমন সময়?
আর ইউ হিস সন?
ইয়েস। বাট হু আর ইউ?
হি হ্যাড অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট। কাম টু পালস হসপিটাল অ্যাট ওয়ানস।
পালস হসপিটাল? বাট হি ইজ নট সাপোসড টু বি ইন আমেদাবাদ নাও।
দ্যাট আই ডোন্ট নো। হি ওয়জ ব্যাডলি হিট বাই এ বাইক। আই অ্যাডমিটেড হিম হিয়ার। জাস্ট কাম অ্যাজ ফাস্ট অ্যাজ ইউ ক্যান। অ্যাকর্ডিং টু ডক্টরস, হি নিডস অপারেশন।
আই অ্যাম কামিং। প্লিজ হ্যাং অন।
সোহম বাড়ির নম্বর ডায়াল করল। রিং হয়ে গেল। কেউ ধরল না। আরেকটা কল করল মণিকে। সেটাও বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল। সোহম দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল – তার এখন আর কিছু করার নেই। সে বাইক স্টার্ট করল।
***********
মগ্ন হয়ে নোটস নিচ্ছিল মণিমালা। বিষয়টা সত্যিই খুব ইনটারেস্টিং। স্যার কাপগুলো নিয়ে রেখে আসতে গেলেন। ফিরে নিঃশব্দে দরজার ছিটকিনিটা তুলে দিলেন। মণিমালার পিঠে হাত রেখে সস্নেহে বললেন – অনেকক্ষণ ধরে কাজ চলছে। লেটস রিল্যাক্স।
মণিমালা মুহূর্তের মধ্যে মোবাইলে হাত দিতে গেল। টেবিলের ওপরেই মোবাইলটা রাখা ছিল। কিন্তু এখন নেই। হতভম্ব হয়ে জিনসের পকেটে হাত ঢোকালো। সেখানেও নেই। গুপ্তা হাসছিলেন – নিজেকে খুব চালাক মনে করো, তাই না? তোমার মোবাইলটা এখন রান্নাঘরে। অনেকদিন ধরে একটা খেলা খেলছ। ভাবলে কি করে, আমি কিছুই জানতে বা বুঝতে পারবো না? আই অ্যাম নট দ্যাট স্টুপিড।
আপনি কি বলতে চাইছেন স্যার? আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। দরজা বন্ধ করলেন কেন?
গুপ্তার গলা সাপের মতো হিসহিসিয়ে উঠল – কিছু বুঝতে পারছ না, তাই না? আস্ক সোহম আফটারওয়ার্ডস। ও তোমাকে বুঝিয়ে দেবে।
সোহম যে কোনো মুহূর্তে এখানে আসতে পারে কিন্তু। প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপনার ছাত্রী। আপনি এভাবে...
সোহম আসবে না। আর তুমি তো শুধু ছাত্রী নও, সুন্দরী ছাত্রী।
গুপ্তার হাসিতে শিকারির উল্লাস।
স্যার প্লিজ। আপনি আমার জামা থেকে হাত সরান। নাহলে ভালো হবে না।
খুব ভালো হবে। তুমি দেখ। এক্সপেরিয়েন্স নেই বলে এমন ভাবছ।
স্যার...
আচমকা ধাক্কায় গুপ্তা পড়তে পড়তে সামলে নিলেন।
ছেনাল শালী! ইতনী হিম্মত! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন....
সবল হাতের টানে মণিমালার জামার খানিকটা ছিঁড়ে নেমে এলো। এক ধাক্কায় তাকে ডিভানের ওপর ফেলতেই চেঁচিয়ে উঠল মণিমালা – শালা বুড়ো ভাম। তোর এতো বড়ো সাহস, যে তুই আমার জামা ছিঁড়িস? আমি রোমি নই বা...
একটা জোরালো চড়ে চোখে অন্ধকার দেখল মণিমালা। গুপ্তার গলা হিসহিসিয়ে উঠল-
রোমি বহুত অচ্ছী থী।। কোনো ঝামেলা করেনি। শুধু কান্নাকাটি করছিল। তুই তো দেখছি জংলি বিল্লি। তবে তোর সব তেজ এখুনি...
দ্বিতীয় চড়টা পড়ার আগেই সদর দরজায় অনেকগুলো ধাক্কা শোনা গেল। থমকে গেল পশুটা। মাথা ঘোরাতেই দেখল – টেবিলের ওপর প্যাঁচাটা পিছন ফিরে রয়েছে! দু পা পিছিয়ে গর্জে উঠল – ইয়ে ক্যায়সে?
সেটা পরে ভাববেন না হয়। আগে দরজা খুলুন। নয়তো ওরা দরজা ভাঙবে, পুলিশও ডাকতে পারে। - মণি ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে। হাত দিয়ে ঠোঁটের পাশের রক্তটা মুছে ফেলল।
লেকিন সোহম তো....
অল্টারনেট ব্যবস্থা থাকবে না, এতটা বোকা আমাদের কি করে ভাবলেন স্যার?
*******
দরজার ধাক্কা ক্রমশঃ বাড়ছে। অনেকগুলো গলাও শোনা যাচ্ছে। গুপ্তা মেঝেতেই বসে পড়েছে। মণিমালাই উঠে দরজা খুলে দিল। দীপ্তেশ, রঞ্জন, অ্যারন, রূপা আর সোনিয়া হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল। সোনিয়া মণিকে জড়িয়ে ধরল – তুই ঠিক আছিস?
কষ্ট করে হাসল মণি – বিলকুল! রঞ্জন জানতে চাইল – উ বাস্টার্ড হ্যায় কাঁহা?
স্টাডির মেঝেতে সব হারানো একটা মানুষ বসেছিল। তার দিকে কেউ তাকাচ্ছিল না। অ্যারন বলল – তোর মুখ কাটলো কি করে?
সোনিয়া চটে উঠলো – আবাল কাঁহিকা! এবার জিজ্ঞেস কর, জামা ছিঁড়লো কি করে?
মণিমালা এতোক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়েছে। পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করে বলল –
এটাতে সব রেকর্ড করা আছে। সোহমের গ্রুপ কল আর সেকেন্ড মোবাইলের বুদ্ধিটা খুব কাজে লেগেছে। কিন্তু সোহম কোথায়? এ বুড়োটা খুব কনফিডেন্টলি বলছিল সোহম আসবে না। এমন করে বলছিল যেন সোহম ওর লোক। সোহমের কোনো সমস্যা হয়নি তো?
অ্যারনের মাথা খুব পরিষ্কার। বলল – অব সমঝা। সোহমের বাবার ফোন থেকে কেউ ফোন করেছিল ওঁর অ্যাকসিডেন্টের খবর দিয়ে। সোহম হাসপাতালে গিয়ে দেখে ফলস কল। একটা ছেলে নাকি তার বাড়িতে ফোন করবে বলে ওর বাবার কাছ থেকে ফোনটা নিয়েছিল। ফোন বাড়িতে ফেলে এসেছে বা ওইরকম কিছু বলেছিল। ভদ্রলোক ভালো মনেই ফোনটা দিয়েছিলেন। ওঁরা দুজনে কোন মন্দিরে যেন পুজো দিতে গিয়েছিলেন।
মণিমালা হাঁ হয়ে গেল – কিন্তু ওর বাড়ি তো সেই...
সোনিয়া বলল – আমি তো তোকে আগেই বলেছিলাম, বুড়োর পলিটিক্যাল কানেকশন আছে। কিছু গুন্ডা বদমাসকেও সেই সূত্রে চেনে। আর এদের চেন যে কি বিশাল....
ওরা কথা বলছিল। গুপ্তা সেই যে চুপ করে বসে আছে, আর ওঠে নি। খানিক পরে দীপ্তেশ সচকিত হয়ে উঠলো –
সোহম সিসিটিভিকে বারে মে....
দীপ্তেশের কথা শেষ হবার আগেই মণি বলল – ওটাতে কোনো ছবি ওঠে নি। প্যাঁচার চোখ ফেরানো আছে। যদি কোনো কারণে তোদের দেরি হতো...। আমি ভিসুয়াল রেকর্ড রাখতে চাইনি।
তুই কি করে জানলি যে ওখানে...
জ্ঞানচক্ষু > জ্ঞানীর চক্ষু >জ্ঞানী > ওয়াইজ আউল > আইজ অফ দ্য আউল – সোহম ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল।
মানে?
মানে অত্যন্ত গভীর। ছোটবেলার বইদের ভুলে গেলে বোঝা যাবেও না। জ্ঞানের চোখ খুঁজতে গিয়ে মণিমালার মাঝরাতের
আবিষ্কার। ওসব কথা এখন থাক। আমি আসার আগে প্রিন্সিপাল ম্যামকে খবর দিয়ে এসেছি। উনি কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বেন। রঞ্জন, তুই বাঁটকু আছিস। তোর শার্টটা মণিকে দে। তুই আপাতত না হয় গেঞ্জি পরেই থাক।
একটা হাসির হররা উঠল।
সোনিয়া বাধা দিল - প্রিন্সি আসুক। তারপর পরিস। আপাতত ওটা ওপরে জড়িয়ে নে।
[নবমপর্ব]
কলেজ
কর্তৃপক্ষ কোনো কেলেংকারির প্রকাশ চায়নি। পরিবর্তে গুপ্তা রেজিগনেশন দিয়েছিল। পি
এফ আর গ্র্যাচুইটিটির টাকা স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার ফান্ডে দান করতে বাধ্য হয়েছিল।
এরপর সে আমেদাবাদ ছেড়ে চলে যায়। মিসেস গুপ্তার সঙ্গে মণির আর দেখা হয়নি কোনোদিন।
কলেজ তার আপন
ছন্দে ফেরে। শুধু ছন্দে ফিরতে পারেনি আসিফ। মণিমালার এই পদক্ষেপ
তার ভারি বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল। তাদের ব্রেক আপ হয়ে যায়।
*********
একটা তেতো
হাসি ফুটলো মনামির মুখে। রূপম, সঞ্জয়, আসিফ.....দ্য লিস্ট ইজ এন্ডলেস। গ্লেনফিডিকের বোতলটা
একবার তুলে দেখল। তারপর সোফার উপরেই কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। এই ভালো আছে সে।
মিতালিটা...
***********
কলেজের কোর্স
শেষ হলে যে যার পথ বেছে নেয়। রূপা, দীপ্তেশ আর রঞ্জন মিলে একটা বুটিক খুলেছিল। মণিমালার
কাছে ওই স্টার্ট আপে জয়েন করার মতো টাকা ছিল না। সে একটা বুটিকে চাকরি নেয়। আরো
কিছু কোর্স করতে সোহম চলে গেল বিদেশে । তারপর যা হয়। প্রথমে
খুব যোগাযোগ। তারপর ধীরে ধীরে যে যার জগতে ব্যস্ত হয়ে পড়া। মণিমালার ডিজাইন ক্রমশঃ জনপ্রিয় হচ্ছিল। কিন্তু কেন কে
জানে সে কিছুতেই একটা ব্রেক পাচ্ছিল না। সে আরো খাটছিল। নতুন নতুন ফিউশন তৈরি
করছিল। একটা সময় সে ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের সঙ্গে পূর্বভারতের ডিজাইন মেশাবার চেষ্টা
করে। এই কাজে তার সঙ্গী হলো কুশল। পূর্বভারতের পোষাক ও ডিজাইন সম্বন্ধে তার
পড়াশোনা প্রচুর। আর মণিমালা
ভিক্টোরিয়ান যুগের এক্সপার্ট। মণিমালার ফ্ল্যাটে দুজনে মিলে দিনরাত এক করে কাজ করে। দুজনের মধ্যে একটা সুন্দর বন্ডিং গড়ে উঠেছে। অনেক লম্বা পথ একসঙ্গে পাড়ি দেবার কথাও হয়ে গেছে।
কিন্তু সেদিন
এই নতুন ড্রেসটার গলার কাটিং কিছুতেই মানানসই হচ্ছিল না। কুশল সেদিন ফিরে যাবার পর
মণিমালা একাই বসেছিল ওটা নিয়ে। বারবার চেষ্টা করেও জিনিসটা ঠিক আশানুরূপ হচ্ছে না।
বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ল মণিমালা। এককাপ কফি বানিয়ে নিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসল। রাতের
হাওয়ায় জুঁইয়ের গন্ধ ভেসে আসছিল। মণিমালার আরাম লাগছিল। পাশের ফ্ল্যাটের
মানুষগুলোর গাছের শখ আছে। রোমি জুঁই ফুল খুব ভালোবাসত। রোমি থাকলে....
মণিমালার মনে পড়ল, রোমি সুইসাইড
নোটের পিছনে একটা ড্রেসের ডিজাইন এঁকেছিল। কেন? ও কি ইঙ্গিতে গুপ্তার দিকে আঙুল তুলতে চেয়েছিল? ছবিটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল। হঠাৎই সোজা হয়ে বসল
মণিমালা। গলার ডিজাইনটা ওদের এই নতুন ড্রেসের জন্য পারফেক্ট! কফির কাপ ঠেলে সরিয়ে, তখুনি ল্যাপটপের সামনে বসল। দ্রুত আঙুল চালাতে থাকল।
ঘন্টা দুয়েক পরে কাজটা দেখে নিজেই মোহিত হয়ে গেল। আনন্দের চোটে তখনই কুশলকে ফোন
করল।
কুশল শুনেই
বলল – এখনি আসছি।
-
একটু খাবার
নিয়ে আসিস। আমার ডিনার করা হয়নি।
-
শিওর। ইট নিডস
আ সেলিব্রেশন।
পিৎজা আর
চকলেট কেক। সঙ্গে ওরিও আইসক্রিম। চোখ বুজে আইসক্রিমের স্বাদ নিতে নিতে মণিমালা বলল
– এটা লেগে গেলে আমরা বাটারড পেকান খাবো একদিন।
কুশল
ল্যাপটপের মধ্যে প্রায় মিশে যাচ্ছিল। এটা সফল হলে ইউরোপের একটা নামী কোম্পানিতে
পাঠানোর কথা হয়ে আছে। মণিমালাই যোগাযোগ করেছিল। ওরা আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রাথমিক কাজ
দেখে কিছুটা ফান্ডিংও করেছে।
-
একদিন? এ যা হয়েছে, তাতে এটা ওদের
পাঠালে আমরা রোজই বাটারড পেকন খাব, বুঝলি?
-
সত্যি বলছিস
ওরা পছন্দ করবে?
-
তুই নিজে
বুঝছিস না? চল আরেকটু
ভালো করে দেখে নিই শেষবারের মতো।
আরো কয়েকঘণ্টা
গেল। তারপর মণিমালা পাঠাতে গেলে কুশল বাধা দিল।
-
এখনই নয়। চল, এবার একটু ঘুমোই। কালকে আর একবার ফ্রেশ মনে দেখে, তারপর পাঠাবো। হয়তো
কিছু ছোটখাটো এডিট করতে হতে পারে। তবে তুই চাইলে এখনো পাঠিয়ে দেওয়া যায়। দিবি?
যুক্তির
সারবত্তা বুঝল মণিমালা। বললো -
-
নাহ্। তুই ঠিক
বলেছিস। কালকেই পাঠাবো। কিন্তু আজ আর ঘুম হবে না। সকাল তো প্রায় হতেই চলল। তুই
বুঝতে পারছিস না, কি ভয়ঙ্কর
উত্তেজিত হয়ে আছি আমি। ডিজাইনটা কিভাবে পেলাম
শুনবি?
-
কাল শুনবো।
এখন ঘুম পাড়িয়ে দিই আয়। ইট নিডস আ সেলিব্রেশন।
মণিমালা
আপত্তি করেনি। দুজনের পার্টনারশিপ বহুদূর পর্যন্ত যাবে জানত। কিন্তু এমন মধুর
মুহূর্তে তাতে স্বাক্ষর পড়বে, সেটা জানত না।
উত্তাল আনন্দ আর ভরসায় নিজেকে সমর্পণ করল মণিমালা।
পরদিন ঘুম
ভাঙতে একটু বেলাই হয়ে গেল। রাতের সুখের আবেশ তখনও শরীরময় ছড়িয়ে আছে। মণিমালা চোখ
ভালো করে না খুলেই পাশের জনের জন্য হাত বাড়াল। বিছানা ফাঁকা।
-
এর মধ্যেই উঠে
পড়েছিস? কটা বাজে রে?
সাড়া না পেয়ে, আরো খানিকক্ষণ চোখ বুজে পড়ে রইল। সে একটা প্রিয়স্পর্শের
অপেক্ষা করছিল। না পেয়ে অবশেষে চোখ মেলল। ঘর ফাঁকা। স্লথ পায়ে বাথরুমে গেল। বেরিয়ে
ব্যালকনিতে এল। কুশল সেখানেও নেই। আদুরে হাসি ভাঙল মণিমালার ঠোঁটে। গণেশের দোকানের
জিলিপি সিঙারার নেশাটা ভালোই ধরেছে বাবুর! এ বাড়িতে এটাই ওদের বাঁধাধরা
ব্রেকফাস্ট।
কুশল ফেরার
আগেই চায়ের জল বসিয়ে দিল মণিমালা। এবার একটা ফোন করতে হয়। কিন্তু মোবাইলটা গেল
কোথায়? জায়গার জিনিস জায়গায়
না পেয়ে একটু বিরক্ত হলো মণিমালা। এদিক ওদিক তাকিয়ে
দেখল, মোবাইলটা ল্যাপটপের
পাশে পড়ে আছে! এতক্ষণে ভুরু কুঁকে উঠল মেয়েটার। দ্রুত হাতে ল্যাপটপ খুলল। তারপরেই
চমকে পাথর হয়ে গেল।
সকাল পেরিয়ে
দুপুর। মণিমালা বসেই আছে। তার মাথার মতো ল্যাপটপও পুরোপুরি ফাঁকা। তার এতোদিনের
পরিশ্রমের শেষে শুধুই মহাশূন্য। তার মোবাইলে যে ব্যাক আপ থাকে সেটাও নেই। ক্লাউড
থেকে নামানোর চেষ্টাও করল না ও। কুশল যে এমন করতে পারে, তা তার ঘুণাক্ষরেও মনে হয়নি। কাজেই এ বিষয়ে কোনো
সাবধানতাও নেয়নি। সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে, তার ঘুমের ছয় ঘণ্টার মধ্যে কী হয়ে
থাকতে পারে। বিকেলের দিকে মেলটা এল। ইউরোপের সেই কোম্পানি জানাচ্ছে, মণিমালার আগেই ঠিক এই বিষয় নিয়ে একজন কাজ জমা করেছে।
কোম্পানি সেই কাজে সন্তুষ্ট। কাজেই ওই একই বিষয় নিয়ে তারা আর ইনভেস্ট করতে চায় না।
মণিমালা নিজেও জানে, এই সব কাজে
সময়টা একটা খুব বড়ো ফ্যাক্টর। সে বুঝতে পারছিল না, কোনটার জন্য
তার বেশি কষ্ট পাওয়া উচিত। একই সঙ্গে সে তার কাজ এবং সাথীকে হারিয়েছে। একটা ধ্বংসস্তুপের মতো হাঁটুতে মুখ গুঁজে সে বসেই রইল।
[দশম পর্ব]
তিন চারদিন এভাবেই গেল। নেহাৎ বুড়ো পৃথিবীটা ঘোরা বন্ধ
করে না। তাই দিন যায়, রাত পার হয়।
মণিমালা কখনো উঠে কিছু খায়, কখনো খায় না।
যখন ক্লান্তি তার সর্বাঙ্গ অধিকার করে নেয়, তখন যেখানে
থাকে, সেখানেই শুয়ে পড়ে। তার
সোফায়, মেঝেতে, লোনা জলের দাগ শুকিয়ে থাকে। পাঁচ দিনের দিন, সে ঘুম থেকে উঠে দেখল দুপুরের গায়ে বিকেলের রঙ ধরেছে।
বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই জুঁই ফুলের গন্ধটা নাকে ঝাপটা মারল। চমকে উঠল মণিমালা। সে
কি তাহলে রোমির পথই বেছে নিচ্ছে? তবে কি
একইভাবে সেও হার মানবে? প্রতিবাদের
ভঙ্গিতে মণিমালা মাথা ঝাঁকালো কয়েকবার।
- ‘তাহলে এই ব্যাপার।‘ - সে নিজের মনেই বলে উঠল।
-
হাঁস যদি ডুবে ডুবে জল খেতে পারে, হংসী কেন নয়? ছেড়ে যাবার, ব্যবহার করার খেলাটা তোমাদের চেয়ে আমি ভালো খেলতে পারব
হে। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ!
-
ল্যাপটপটা
সেদিন থেকে খোলাই পড়েছিল। ঘরে ঢুকে সেটা বন্ধ করল মণিমালা। শাওয়ার চালিয়ে অনেক্ষণ
ধরে অঝোরে স্নান করল। স্নানের জলের সঙ্গে চোখের জল মিশতে দিল না কিন্তু! সব জল
আগুন করে, বুকের ভিতর জমা করে
নিল। খিদের অনুভবটা এতক্ষণে মাথাচাড়া দিচ্ছে। ফ্রিজ খুলে পুরোনো সব খাবার
ডাস্টবিনে ফেলে দিল। গ্যাস জ্বালিয়ে সেদ্ধ ভাত চাপিয়ে দিল।
খেয়ে উঠতে উঠতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল। জামাটা বদলে
মণিমালা লেকের ধারে গিয়ে বসল। জলের ওপর
দিয়ে আসা ভেজা হাওয়া, পাতার সরসর
আওয়াজে ওর আরাম লাগছিল। পাখিরা তাদের কোটরে ঢুকে গেছে খানিক আগে। জায়গাটা এখন
মোটামুটো নির্জন, কিছুটা
চুপচাপও। শুধু খানিক দূরে কয়েকজন বয়স্ক লোক দুহাত ওপরে তুলে একসাথে হাঃ হাঃ করে
হাসছে। ধীরে ধীরে রাত বাড়ছিল। আজ মণিমালার ওঠার কথা
মনে হলো না। অনেক রাত অবধি বসে রইল সেখানে। তারপর একসময় বাড়ি এসে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম থেকে যখন উঠল তখন তার মাথা খুব পরিষ্কার। সে জানে ওর
সামনে এখন একটা বিরাট লড়াই। এটা ওকে একাই লড়তে হবে। নিজের জন্য। নিজেকে প্রমাণের
জন্য। আর নিজেকে ব্যবহার করতে দেবে না ও। বরং দরকার হলে অন্যকে
ব্যবহার করবে। রণক্ষেত্রে নীতির দোহাই শুধু একপক্ষের প্রিভিলেজ হতে পারে না। সে
সমানভাবে লড়বে। জয় ছিনিয়ে নেবে। নেবেই।
***********
***********
চার বছর পর।
মণিমালাকে আজকাল খুঁজে পাওয়া যায় না। তার জায়গা নিয়েছে মনামি। ফ্যাশন দুনিয়ায়
মনামি ক্রিয়েশন একটা সুপরিচিত নাম এখন। এ ব্যাপারে মণিমালা রিপোর্টার, পত্রিকার সম্পাদক, বিভিন্ন
কোম্পানি সবার সাহায্যই পেয়েছে। তবে পেয়েছে বলার চেয়ে, নিয়েছে বলাই বোধহয় বেশি ঠিক। যাকে যতটুকু দেবার, সে তা দিতে কার্পণ্য করেনি। তার কথা, তার সঙ্গের
জন্য এই ফ্যাশন মহল উত্তাল। সুচারু বিভ্রমের মায়া রচনায় সে একজন শিল্পী। মৌ-লোভী
পুরুষের দল তার কাছে ভিড় করে থাকে। সকলের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক। সে
অনাসক্তভাবে, মঞ্চের শিল্পীর
দক্ষতায় স্নেহময়ী দিদি, বিশ্বস্ত
বন্ধু, প্রিয়া, মোহিনী – রমণীর বিভিন্ন রূপের ব্যবহার করে থাকে। তার সবচেয়ে বড় গুণ হলো, যার কাছ থেকে
যতটুকু পাওয়া যায় সেটা পাওয়া হয়ে গেলে, মনামি তাদের
ছুঁড়ে ফেলে দেয় না। নির্লিপ্ত থেকেও সম্পর্ক বজায় রাখে। বলা তো যায় না, কখন কাকে আবার দরকার হয়। ফলে তার উত্থানের রেখাচিত্র
সদাই ঊর্ধমুখী। তার কাজ ক্রমশঃ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও প্রশংসা কুড়োচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় তার শো দারুণ সাড়া জাগায়। বিদেশের দু একাট ফ্যাশন শোয়েও সে
আমন্ত্রণ পেয়েছে। এখনো কোনো পুরস্কার না পেলেও, তার কাজ
বিচারকদের উচ্চ প্রশংসায় অভিষিক্ত হয়েছে।
সম্প্রতি সে ফ্রেঞ্চ ফ্যাশন ফেডারেশনের একটা নিমন্ত্রণ
জোগাড়ের চেষ্টায় আছে। তার আগে তার ঝুলিতে কিছু বিদেশী পুরস্কার আসা প্রয়োজন।
মুম্বাইয়ের ‘সিসা বেলে’ ভীষন নামী
কোম্পানি। তার সাহায্য পেলে বাইরের অ্যাসাইনমেন্ট অনেক বেশি পাওয়া যাবে। মুস্কিলটা
হলো, ওরা চাইছে মনামি ওদের
ব্যানারে কাজ করুক। আর মনামি চাইছে সিসা বেলের সহযোগী হিসেবে কাজটা স্বাধীনভাবে
করতে। ওদের সর্বময় কর্তাটি
বড়ো খিটখিটে আর একগুঁয়ে। আপাতত মনামির প্রচেষ্টা হলো ওই বুড়োকে মানানো।
*********
**********
মিতালির ব্রেড
আর স্যুপ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। টেবিলে সাজিয়ে ডাকতে এসে দেখল মনামি প্রায় ঘুমিয়ে
পড়েছে। ওর ঠোঁটের কোণে একটু হাসি লেগে রয়েছে। হঠাৎ করেই মিতালির বুকের মধ্যে মায়ার
তুফান উঠলো। এই মানুষটাকে কেউ বোঝে নি। এই পৃথিবীতে সে বড়ো একা। মিতালি জানে, দিদির বুকের মধ্যে ভালবাসার সাগর আছে। কেউ খোঁজ পায় না।
শুধু মিতালির মতো কয়েকজন জানে। আর জানে ‘আলোর পথিক’ এর অনাথ ছেলেমেয়েগুলো। শুধু
পয়সা দিয়ে নয়, মন প্রাণ উজাড় করে
ভালোবাসা দিয়ে, সে আলোর পথিককে আগলায়।
এছাড়া আরও কতো....। মিতালির বুক থেকে
দীর্ঘশ্বাস উঠে এল। লোকের কথা শুনে, এই মেয়ের
সাথেও, তার বাবা মা যোগাযোগ
রাখেন না বললেই হয়। আস্তে করে সে তার দিদির মাথার কাছে হাঁটু গেড়ে বসল। খুব ধীরে
আলতো গলায় ডাকল – দিদি, খাবে চলো।
মনামি ভাবনা
ছেড়ে বর্তমানে ফিরে এল। আজ তিতলির সঙ্গে দেখা হয়ে যেন তার মনের আগল খুলে গেছে। অতীতের সব কথা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো একের পর এক, ওর উপর আছড়ে পড়ছিল। সে আলতো হাসল – ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, না রে? সত্যি, তুই না থাকলে আমার যে কী হতো?
-
এসব কথা পরে
বললেও চলবে। এখন খেতে চলো। স্যুপ ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
-
তুই চিকেন
স্যুপ বানিয়েছিস? গার্লিক ব্রেড? ডেসার্ট আছে কিছু?
মনামি শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। হাসিমুখে দিদিকে সার্ভ করে, মিতালি নিজেও প্লেট টেনে নিয়ে বসল। খেতে খেতে মনামি, মিতালিকে
তিতলির গল্প, স্কুলের দুষ্টুমির
গল্প বলছিল। মিতালির ভালো লাগছিল। সে দিদিকে এতো খুশি বহুদিন দেখেনি।
**********
[একাদশ পর্ব]
মনামির সময়টা
এখন ভালো যাচ্ছে। কদিনের মধ্যেই তার এক রিপোর্টার বন্ধু তাকে একটা খবর দিল। সিসা
বেলের কর্তা নারায়ণ চিত্রের এক নাতি আছে। তার মেয়ের ছেলে। বুড়োর নাতি অন্ত প্রাণ। কেডি, মানে সেই নাতি, কগনিজেন্টে কাজ করে। কখনো কলকাতায় থাকে, কখনো আমেরিকায়। আপাতত কলকাতায় আছে। কিছুদিন থাকবে বলেই
জানা যাচ্ছে। নিউটাউনের অফিসে বসে। মনামি যদি তাকে দিয়ে নারায়ণ চিত্রেকে সুপারিশ
করাতে পারে, তাহলে ফল হতে পারে।
মানমির কাজ
খুবই সিস্টেম্যাটিক। সে হড়বড় করে কিছু করে না। কেডির সব খবর তার চাই। তার কাজ, তার জীবন, ব্যক্তিগত
খুঁটিনাটি, পছন্দ, অপছন্দ... সব, সঅব। এ কাজের
জন্য তার লোক আছে। সে কেডিকে নানাদিক দিয়ে খোলা বইয়ের মতো পড়ে ফেলতে চায়। তারপর...
*****
সল্ট লেকের এই
লাইব্রেরিটায় বইয়ের সংগ্রহ খুব ভালো। বিশেষ করে কেউ যদি বিদেশি জার্নাল, ম্যাগাজিনে আগ্রহী হয় তাহলে তার নিরিবিলি পাঠের জন্য
আদর্শ পাঠাগার। বিশেষতঃ এর রিডিংরুমটা মনামির খুব পছন্দের। সে মাঝে মাঝেই এখানে
আসে। এই রবিবারে আসতে পেরে সে খুশিই হয়েছে। বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য
ও দামী পত্রিকা আর বই পাওয়া যায় এখানে। সে তার প্রয়োজনীয় বইটা নিয়ে রিডিং রুমে চলে
এলো। পাতা ওলটাতে ওলটাতে সে সোজা কোণের দিকে চলে এল। বড় টেবিলটায় একজনই পাঠক।
ম্যাগাজিনে নিমগ্ন। একটু গলা খাঁকারি দিল মনামি – আমি এই কোণে বসতে পারি?
চোখ তুলে দেখল
কেডি। চাঁপারঙের শাড়ি,কাঁধে ঝোলা, গলায় মুক্তোর একটা হার ছাড়া দ্বিতীয় কোনো গহনা চোখে পড়ল
না। এইটুকুতেই মেয়েটাকে খুব সুন্দর লাগছে। পারফিউমের গন্ধটা কেডির প্রিয়। মন অকারণেই প্রসন্ন হয়ে উঠল – বসুন না।
মেয়েটি সুন্দর করে হাসল – ধন্যবাদ।
বই, খাতা, পেনসিল
গুছিয়ে নিয়ে বসে পড়া শুরু করল মনামি। কেডি মনে মনে হাসল। সে লক্ষ্য করেছে, ওপাশে দু-চারটে টেবিল ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও মেয়েটি এসে
এখানেই বসেছে। সে জানে, সে সুপুরুষ, অর্থবান। তার চেহারায়, পোষাকে সেটা
স্পষ্ট। মেয়েদের এই আলাপ করার ভঙ্গিটি তার বহু পরিচিত। সে যথেষ্ট সফল ও বুদ্ধিমান।
ধুরন্ধর নারায়ণ চিত্রে তাকে এমনি এমনি এতো ভালোবাসে না! কেডি জানে একটু পরেই কিছু
আছিলায় কথা শুরু হবে। এইসব দেখতে দেখতেই সে জীবনের এতোগুলো বছর পাড়ি দিয়েছে। সে
আপাতত ম্যাগাজিনে মন দিল।
ঘটনাহীনভাবে
বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাবার পরে বোধকরি নিতান্ত কৌতূহলেই, কেডি ম্যাগাজিন থেকে চোখ তুলে, সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল। মেয়েটি অখণ্ড মনোযোগে বইটা
থেকে খাতায় সম্ভবত কোনো পোষাকের ডিজাইন কপি করছে। ছোট চুলগুলো মুখের অর্ধেকটা ঢেকে
ফেলেছে। নজর করে দেখল গলার মালাটা বেশ দামী। মনে হচ্ছে কোনো পোষাক ব্যবসার সঙ্গে
জড়িত। আবার নিজের বইয়ে মন দিল কেডি। মেয়েটি কিন্তু একবারও মুখ তুলে তাকায়নি! পুরুষের
অহমিকায় একটু খোঁচা লাগল কি? কেডি একটু
বিরক্ত হয়েই বইয়ে মন দিল ফের। মেয়েটি আঁকা শেষ করে পা ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল। কেডির
পায়ের সাথে পা লেগে যেতেই তাড়াতাড়ি পা সরিয়ে নিয়ে লজ্জিতভাবে বলল – সরি।
এবার মুচকি হাসলো কেডি – ইটস অলরাইট।
মেয়েটি উঠে
দাঁড়াল – থ্যাঙ্কস ফর শেয়ারিং দ্য টেবল।
বইখাতা গুছিয়ে
লাইব্রেরিয়ানের টেবিলের দিকে রওনা দিল। টেবিলে কিছু ফেলে যাবে আশা করছিল কি? ফাঁকা টেবিল দেখে রাগ হচ্ছে কেন, কেডি জানে না। নারীর এই অমনোযোগে অভ্যস্ত নয় বলেই হয়তো।
বিরক্তমুখেই ম্যাগাজিনটা টেবিলে রেখে বের হয়ে এল। বেরোবার মুখে কানে গেল – আমি
পরশু আসব। এই বইটা একটু আলাদা করে রেখে দেবে?
“দেবে?” তার মানে এখানে সে মাঝে মাঝেই আসে। কেডি বাইরে এল।
গাড়িতে উঠতে উঠতে দেখল, মেয়েটির হাতেও
একটা গাড়ির চাবি। কেডি গাড়িতে স্টার্ট দিল।
মঙ্গলবার
বিকেল হতেই কেডির পা লাইব্রেরির দিকে টানছে। নিজেকে শাসন করল কেডি। ওই মেয়ে তার
সাথে ভাব জমাবার জন্যেই এসেছিল, সন্দেহ নেই।
হয়তো সাহস পায়নি, কথা শুরু
করতে। গিয়ে আস্কারা দেবার কোনো মানে হয় না। কিন্তু ...
ও যখন কেডি
হয়নি, তখন কিশোর নামের এক
নরম দাড়িওয়ালা ছেলে তার প্রিয়ার উদ্দেশ্যে কবিতা লিখত। তার মানসীর পরনে থাকত চাঁপা
রঙের শাড়ি, আর গলায় দুলত মুক্তোর
মালা! সে সময় কিছু পত্রিকায় তার সেইসব লেখা ছাপাও হয়েছিল। সেদিন মেয়েটিকে দেখে তাই
সে ভীষণরকম নাড়া খেয়েছিল। আজও কি সে মুক্তোর মালা পরেছে?
দূর, দূর! এই উত্তর তিরিশে এইসব বোকা বোকা ভাবনার কোনো মানে
হয়? চেম্বারের মধ্যে
অস্থির পায়ে হাঁটাহাঁটি করল খানিকক্ষণ। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়েই পড়ল শেষমেশ।
ঝড়ের মতো ড্রাইভ করে লাইব্রেরির সামনে গাড়ি পার্ক করতে করতে তার মনে হলো – এই
যাহ্! মেয়েটি কখন আসবে তা তো ও জানে না! যদি এসে, চলে গিয়ে থাকে?
দ্রুত পায়ে রিডিংরুমে ঢুকে সেদিনের কোণার টেবিলের দিকে
তাকাতেই তার হৃদস্পন্দন প্রায় স্তব্ধ হবার উপক্রম করল। দুধসাদা টপ আর লং গাউন।
ক্লিপের শাসনে চুল আজ পিছনে লুকিয়েছে। কানে ঝোলা হীরের দুল। হাতে একটা ঘড়ি। ব্যস।
কেডি মেয়েটির পরিমিতি বোধের প্রশংসা না করে পারল না। এই মাত্রাজ্ঞানটি তার খুব
পছন্দের। এগিয়ে কথা বললে গায়ে
পড়া দেখাবে কি? খানিকটা
দ্বিধার সাথেই টেবিলের পাশে এসে মৃদুস্বরে বলল – মে আই?
[দ্বাদশ পর্ব}
রমণীর চোখে
মুখে বিস্ময়, আনন্দ আর কৌতুকের
সুচারু মিশ্রণ – হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ! প্লিজ...। কথাটা শেষ না করে হাত
দিয়ে চেয়ারটা দেখিয়ে দেয়। কেডির মনটা হালকা হয়ে গেল। হাসিমুখেই বলল – সারপ্রাইজ
বুঝলাম, প্লেজেন্ট কেন?
মনামি চোখ বড়ো
বড়ো করে বলল – ডিজিটাল ডাটা অ্যানালিস্ট
অফ কগনিজেন্ট – দ্য কেডি আমার সামনে, আর আমি খুশিও
হবো না?
ভুরুটা কুঁচকে
উঠলো কেডির – আপনি আমাকে চেনেন?
-
রবিবার পর্যন্ত চিনতাম না – মনামির মুখে শিশুর সারল্য ও খুশি –
-
আমার লাইন তো পুরোই আলাদা। কাল একজন আমাকে কয়েকটা পুরোনো
জিকিউ মার্ক করে পাঠিয়েছিল। আমি সেটা
ওলটাতে ওলটাতে আপনার ছবি দেখি। আমি তো আপনাকে মডেল ভেবে খোঁজ করছিলাম! তারপর
দেখলাম....
মনামির হাসিটা এতোক্ষণে কেডির মধ্যে সঞ্চারিত হয়। তার
মনে পড়ে, বেশ
কিছুদিন আগে সিসা বেলের এক মডেল ফোটোশুটে হাজির না হওয়ায়, দাদু তাকেই কাজটা
করে দিতে বলেছিল বটে! আর সেটা ম্যাগাজিনেও বেরিয়েছিল।
-
আপনি তার মানে
ফ্যাশন ডিজাইনিং এর সঙ্গে যুক্ত?
মনামি চোখ
তুলে দেয়ালের দিকে তাকায়। সেখানে বড় বড় করে লেখা – সাইলেন্স প্লিজ!
কেডি হেসে
ফেলল – সরি। কিন্তু আমি একটু কৌতূহলী হয়ে পড়েছি। আমরা কি একসাথে এককাপ কফি খেতে পারি?
-
ইট উড বি মাই
প্রিভিলেজ। আমাকে দু মিনিট সময় দেবেন, প্লিজ? এই ড্রয়িংটা একটুই বাকি আছে।
-
সিওর। কাজ
আগে। আই অ্যাম ওয়েটিং।
কেডি আরাম করে
বসে এবার। তার মনের মেঘ কেটে গেছে। এ মেয়েটা গোল্ড ডিগার
নয়। বরং ইন্টারেস্টিং।
বাইরে বেরিয়ে
এসে কেডি বলে – আপনি আমায় চিনে নিলেন, কিন্তু...
-
চেনা কি এতোই
সহজ? চিনতে সময় লাগে তো। নাম আর কাজটাই জেনেছি শুধু। আমি
মনামি। মনামি ক্রিয়েশন নামে একটা ছোটখাটো বুটিক চালাই।
-
নামটা কিন্তু
শোনা। কাগজে দেখেছি। খুব ছোটখাটো তো নয়?
-
ঠিকভাবে দাঁড়
করাবার চেষ্টায় আছি। এই পর্যন্ত।
-
এই
কাফেটেরিয়ায় কফিটা ভালো করে। আপনি খেয়েছেন?
***********
আলাপটা এরপর
দ্রুততালেই এগোল। বুটিকের কাজ যারা করে, তাদের প্রতি
কেডির একটু অবজ্ঞাই ছিল বলতে গেলে। কিন্তু মনামির বিভিন্ন বিষয়ের আগ্রহ ও জানার
পরিধি দেখে, সে তার মত বদলাতে
বাধ্য হলো। বিশেষত ফুটবলে তার আগ্রহ ও খবর রাখার বহর দেখে সে রীতিমতো মুগ্ধ। কেডি
নিজে ফুটবল পাগল, কিন্তু মেয়েরা
খেলধূলায় আগ্রহী নয় – এ জাতীয় একটা মনোভাব তার ছিল। আবার যে বিষয়টা সে জানে না, সেটা সহজভাবে স্বীকার করে নিতেও মেয়েটির কোনো সঙ্কোচ
নেই। কেডি যেন মনামির মধ্যে মনের মতো একজন বন্ধু আর প্রিয়সঙ্গী খুঁজে পাচ্ছিল।
মনামি তাকে একদিন আলোর পথিকেও নিয়ে গেছে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখিয়েছে। এই অনাথ
শিশুদের জন্য তার যে বিরাট পরিকল্পনা রয়েছে, তাও সে
বিস্তারিতভাবে বুঝিয়েছে। বাচ্চাদের দেখে, তাদের
ব্যবস্থাপনা দেখে কেডি উচ্ছ্বসিত। মোটা টাকার ডোনেশনও দিয়েছে।
আজকাল প্রায়ই
সন্ধ্যের পরে তাদের একসাথে দেখা যায়। আলাপ দিনে দিনে ঘনিষ্ঠ হয়েছে। মনামি নিজেকে
দেখে অবাক হয়। সেও কি কেডির উপর দুর্বল হয়ে পড়ছে? একান্ত ঘনিষ্ঠজন ছাড়া কাউকে তো সে আলোর পথিকে নিয়ে যায়
না! এমন কি প্রচারের আলো থেকেও তাকে সযত্নে দূরে সরিয়ে রাখে। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে
কেডির সাথে কখনো কোনো কথা হয়নি। কিন্তু সে তো জানে কেডি বিবাহিত। তবু সন্ধ্যে হলেই
যেন কিসের একটা আকর্ষণে সে কাফেটেরিয়ায় চলে আসে। নাহ্। কেডি অন্যরকম। তাই হয়তো
মনামি তাকে নারায়ণ চিত্রের ব্যাপারটা বলতে পারছে না।
কিছুদিন পরে
কেডির সিঙ্গাপুরে যাবার কথা। দেখা হবে না বলে, মনামির মন
খারাপ লাগছিল। তখনই কেডি তাকে একসাথে বেড়াতে যাবার প্রস্তাব দিয়ে বসল! সে কি মনে
করে বলেছিল, কে জানে! কিন্তু
মনামির অভিজ্ঞতার আয়নায় এ প্রস্তাব একদম অন্যরকম অর্থ নিয়ে হাজির হলো। তার কাছে
কেডি আর রবিন মেহতাদের কোনো তফাত রইল না। নিজের মনেই হাসল
মনামি। বিশ্বাসের শিকড় এখনো
বেঁচে আছে কেন? পুরুষ মানুষ
এবং বিশ্বাস? অট্টহাসিতে
ফেটে পড়াটা আটকাতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল তার।
কিন্তু সে
অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী। একটু ইতস্তত করে বলল – আসলে হাতে বেশ কয়েকটা কাজ...। তোমার
প্রস্তাবটা তো লোভনীয়। সিঙ্গাপুর দেখা হয়নি আমার। আমি দেখি, ম্যানেজ করতে পারি কিনা? তোমায় কাল বা পরশু জানাবো।
সে জানে, এই প্রতীক্ষা তাকে আরো কাম্য করে তুলবে। নারায়ণ চিত্রের
ব্যাপারটা ফাইনাল করতে এটা কাজে লাগবে। অসহিষ্ণু পুরুষের মুখের ভাবে তার ছায়া দেখে, মনামি মনে মনে খুশি হলো। এমনিতেও কেডি কিছুটা জেদী শিশুর
মতো। যেটা চায়, সেটা না পেলে তার
মেজাজ গরম হয়ে যায়।
পরদিন। দুপুরে
কেডিকে একটা ফোন করল মনামি – আজ দেখা করতে যেতে পারছি না। গলা অবধি কাজে ডুবে আছি।
খুব চেষ্টা করছি কাজগুলো এই দুদিনে বাগিয়ে নেবার। যদি শেষ করতে পারি, কাল সন্ধ্যেয় তোমাকে ফোন করে জানাবো। বাইইই....।
ফোনটা কেটে, সুইচ অফ করে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। তার মুখে এখন সফল
শিকারির তৃপ্তির হাসি। কিন্তু এই জয়ে কোথাও যেন একটা জ্বালাও মিশে রয়েছে। খানিকক্ষণ এ পাশ ওপাশ গড়াল ছটফট করে। তার পরে হঠাৎ গা ঝেড়ে উঠে পড়ল। ব্যাগ থেকে আরেকটা ফোন
বের করল। এটার নম্বর বিশেষ কয়েকজনই জানে। কেডিকে দিচ্ছি, দেব করেও দেওয়া হয়ে ওঠে নি। ভাগ্যিস! মনামি অধীর হাতে
নম্বর খুঁজছিল। একটু খোলা হাওয়ার জন্য তার মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।
****
[ত্রয়োদশ
পর্ব]
খানিক বাদে
আলিপুরের এক বিলাসবহুল আবাসনের সামনে গাড়ি থেকে সাদাসিধে জিনস আর টিশার্ট পরা যে
মেয়েটি নামল, সে মনামি নয়, মণিমালা। দারোয়ানকে বলাই ছিল।
দরজা খুলেই বন্ধুকে জড়িয়ে ধরল তিতলি।
-
আয়, আয়। এতোদিনে সময় হলো?
-
তোর সময়
হয়েছিল? - ঘুরে চোখ রাঙায়
মণিমালা।
-
আরে, আমি তো এখানে ছিলামই না। একটা মিটিং অ্যাটেন্ড করতে
দিল্লি গিয়েছিলাম। একটু আগে ফিরেছি। নয়তো এই মাঝহপ্তায় কি আমার বাড়ি থাকার কথা? খুব ভালো দিনে ফোন করেছিস রে।
-
ভালো দিনই
বটে! তোর কথা খুব মনে পড়ছিল। কাজের দিন, ছুটির দিন –
এতোকিছু ভাবিইনি।
-
ভাগ্যিস
ভাবিসনি। তাহলে তো আসাই হতো না।
-
সেদিন তোর
সঙ্গে এতো কথা হলো. আর তুই এখন কি করিস, কি বৃত্তান্ত
কিচ্ছু জানা হয়নি রে।
-
কম্প্যুটার
নিয়ে পড়লে, সফ্টওয়্যার
ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া আর কি করব? তুই?
-
ফ্যাশন
ডিজাইনিং নিয়ে পড়লে, বুটিক ছাড়া আর
কি করব?
যেন দুটি
কিশোরী। খিলখিল হাসিতে এ ওর
গায়ে গড়িয়ে পড়ে। মণিমালার মনটা হালকা হয়ে যায়। তুমুল আড্ডার মধ্যেই মণির প্রিয়
ফুলুরি আর কফি আসে।
-
তোর মনে আছে
এখনো? কি সুগৃহিণী হয়েছিস রে
তুই!
-
লিখে দিস।
সার্টিফিকেটটা বাঁধিয়ে ঘরের লোকটাকে দেখাব। ব্যাটাচ্ছেলে বিশ্বাসই করতে চায় না।
-
এইই দেখ! এখন
পর্যন্ত তার খবরই নিইনি। নাম কি? আলাপ করিয়ে
দিবি না?
-
দেবো রে বাবা!
কখন ফিরবে তো জানিনা। আপাতত ছবি দেখ।
ছবিটা হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় মণিমালা। আকাশ ভাঙছে। তার প্রবল শব্দে কান, মাথা ছিঁড়ে পড়ছে যেন। চোখ টান করে অতিকষ্টে তাকাল সে। তিতলি তখনও ছবিটার দিকেই তাকিয়ে আছে। শেষতম শক্তি দিয়ে, মণিমালা নিজেকে সামলাল। তিতলি চোখ তুলে তাকাল এবার – কিছু বলছিস না যে?
-
বাক্যি হরে গেছে! – হাসতেও পারছে এবার।
চোখ নাচাল মণিমালা –
-
এ তো বেশ স্মার্ট
অ্যান্ড হ্যান্ডসাম রে। কিন্তু...
-
হ্যাঁ রে।
অবাঙালি। কিশোর দেশপান্ডে। তবে সবাই কেডি নামেই চেনে। এত সুন্দর নামটার কি হাল করেছে দেখ। বাংলাটা যে কোনো
বাঙালির চেয়ে ভালো বলতে পারে। ঘাড় ধরে শিখিয়ে ছেড়েছি। বদলে আমাকেও মারাঠি শিখতে
হয়েছে অবশ্য।
রিতিকা দেশপান্ডের মুখে
তৃপ্তির হাসি। মণিমালা হাসিমুখে বন্ধুর আনন্দিত মুখ দেখছে। প্রিয়জনের খুশি দেখলে
এতো ভালো লাগে, জানতো না। রিতিকা জানতে চায় এবার –
-
তুই বিয়ে করেছিস?
-
নাঃ। এই বেশ আছি। বাঁধাধরা জীবন আমার জন্য নয় রে।
-
তুই বরাবরই সবার চেয়ে আলাদা। তুই খুশি আছিস তো?
আচমকা তিতলিকে
জড়িয়ে ধরে লুটোপুটি খায় মণিমালা – ভীষণ, ভীষণ, ভীষণ খুশি।
তিতলি হাসছিল
– তুই আর বদলালি না।
-
বদলালে তোর
ভালো লাগত?
এবার তিতলিই
বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে চকাস করে চুমু খায় – একদম না।
ঘড়ির দিকে
তাকিয়ে মণিমালা ব্যস্ত হয়ে পড়ে – এবার চলি রে। একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
-
শনি, রবিতে ফ্রি থাকিস? তাহলে একদিন তোর ফ্ল্যাটে যাব।
-
রবির সকালটা
আমি কোনো কাজ করি না। চলে আসিস।
-
ফোন করে যাব।
-
ওকে।
বাইইইই...
*******
মণিমালার মন
এখন স্থির। বাড়ি ফিরে সে কাজের ফোনটা চালু করল।
-
হাই কেডি।
একস্ট্রিমলি সরি। আমাকে একজন ক্লায়েন্টের সাথে পরশু শ্রীলঙ্কা যেতে হচ্ছে। তাই
এবার সিঙ্গাপুর যাওয়া হবে না গো।
-
ট্যুর? ক্লায়েন্টের সাথে? – কেডির
গলাটা হঠাৎই কঠিন শোনায়।
-
হুঁ। আসলে
একটা বড় ওপেনিং পাবার সুযোগ আছে।
মনামির গলা
একটুও কাঁপে না। বরং বাক্যের ঠিক জায়াগায় ঠিক জোর পড়ে। কেডি একটা লম্বা শ্বাস
চাপতে চাইলেও মনামির কান এড়ায় না।
-
বুঝলাম। ভালো থেকো।
গুড নাইট। -
কেডির এই ঠান্ডা, আবেগহীন গলা আগে কখনো শোনেনি মনামি।
-
গুড নাইট
কেডি।
ফোনটা কেটে নম্বরটা ব্লক করে দেয়। তারপর ডিলিট।
প্রলোভনের সব পথ বন্ধ করাই ভালো। সিসা বেলের ব্যাপারটা ভণ্ডুল হয়ে গেল। এবারে
অন্ততঃ তার প্যারিস যাওয়া হচ্ছে না। কিন্তু কোনো প্রজেক্ট ফেল করলেও যে এতো শান্তি
পাওয়া যায় সেটাই কি আগে জানতো মণিমালা নামের অদম্য মেয়েটা? মনামি ভার্সেস মণিমালা লড়াইটাতে মণিমালার জিত হওয়াতে আজ
তার ভারি ভালো লাগছে। হালকা লাগছে নিজেকে।
************
************
মিতালি
সন্ধ্যে থেকে বার তিনেক ঘুরে গেছে। দিদি অঘোরে ঘুমোচ্ছে দেখে তার আর ডাকতে ইচ্ছে
হয়নি। মণিমালা উঠল রাত বেশ কিছুটা গড়িয়ে যাবার পর।
-
আরে আটটা বেজে
গেছে। ডাকিস নি কেন?
-
খুব গাঢ়
ঘুমোচ্ছিলে। একবার আস্তে ডেকেছিলাম। সাড়া দিলে না। তাই ভাবলাম... একটু বিশ্রামই না
হয় নিলে।
-
আমার জন্যে
তুই খুব ভাবিস, না?
-
আর কার জন্যে
ভাবতে যাব? যত্তোসব।
মুখ ঝামরে মিতালি অন্য ঘরে চলে যায়। মণিমালা হাসতে থাকে।
একটু পরেই মিতালি আবার ঘরে ঢোকে – এই দেখ একটা কেমন অদ্ভুত মেইল এসেছে।
[চতুর্দশ
পর্ব]
ট্যাবটা হাতে
নিয়ে একটা ঝটকা খায় মণিমালা। আজ কি তার শুধুই চমক লাগার দিন? এতো দ্রুত বয়ে চলা ঘটনার স্রোতে সে কার্যতঃ দিশাহারা। সে
আর ভাবতে পারছে না। স্রোতে ভাসাই ঠিক করল। তিন লাইনের মেইল –
ইজ ইট মণিমালা? কল মি ইন দিস নাম্বার ...। ইটস আরজেন্ট - সোহম।
সোহম? এতো বছর পরে? কোথা থেকে উদয়
হলো? আরজেন্ট? কলেজের মধুর দিনগুলো মণিমালার স্মৃতিতে ভেসে এল। খেয়ে
উঠেই ফোন নিয়ে বসল –
-
সোহম? কোত্থেকে?
-
এত বছর পরে
এটাই সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন মনে হলো তোর? – সোহম হাসছিল।
-
আমার মাথা কাজ
করছে না। - মণিমালা আত্মসমর্পণ করল।
-
কবে করত? কিন্তু তুই নাম বদলে মনামি হয়েছিস কেন? তাই খুঁজে পাইনি।
-
খুঁজেছিলি?
-
রামছাগল কি আর
গাছে ফলে?
-
তুই এতদিন
পরেও ... ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।
-
ভালো হবে
কোত্থেকে? নামের কি ছিরি? বিশ্বশুদ্ধ লোক ডাকছে মন্ আমি! প্রিয়তমা!
-
কি আর করা
যাবে? একান্তে ওই নামে ডাকার
মতো কাউকে পেলাম না যে।
-
বাঁচা গেল।
অবশ্য, তোর মতো পেত্নীর সেটা
পাওয়ার কথাও নয়।
-
আবার?
-
ঝগড়া পরে
করিস। আগে কাজের কথাটা শুনে নে। সুজামেন – এই নামটা শুনেছিস?
-
ফ্যাশন
ডিজাইনিংয়ের কাজ করব, আর জার্মানির
অন্যতম বড়ো প্রতিষ্ঠানের নাম শুনবো না? আমাকে কী ভাবিস বলতো?
-
সেটা দেখা হলে
বলব। এখন শোন। আমি ওখানেই
কাজ করি। ওরা এশিয়ার কিছু নতুন প্রতিভার সঙ্গে কাজ করতে চায়। তাতে তিনটে নাম
সিলেক্ট হয়েছে। একটা ইরানের, একটা জাপানের
আর একটা ভারতের - মনামি ক্রিয়েশন।
মণিমালার
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে – ক্কীইই?
-
হ্যাঁ রে
ছাগল। এই ডিলটা ফাইনাল করার ভার আমার ওপর। আমি মনামি ক্রিয়েশনের ডেটা দেখতে গিয়ে, মনামির ছবি দেখে থ।
-
মানে আমি...।
সত্যি বলছিস?
-
আমি তোকে
অফিসিয়াল মেইলটা পাঠাচ্ছি। তুই উত্তরের ড্রাফ্টটা রেডি কর। কাল তোর বাড়ি আসব।
দুজনে বসে ফাইনাল করব। হড়বড় করিস না।
-
কাল আসবি?
মানে কি? তুই কোথায়
আছিস?
-
দিল্লি। গতকাল বাড়ি এসেছি। কালকের ফ্লাইটে কলকাতা
পৌঁছাবো। ঠিকানাটা বল।
-
আমি
এয়ারপোর্টে থাকব।
-
ওকে। কাল কথা
হবে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে।
-
স্বাভাবিক।
জেট ল্যাগ গাধাদেরও হয় তাহলে?
-
বাকিটা কাল।
বাই।
-
বাই।
মণিমালার মনে
হচ্ছিল সিন্ডারেলার পরী যেন তার চারপাশে জাদুর ছড়ি ঘোরাচ্ছে। এমনও হয় বুঝি? সে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। সুজামেনের মেইলটা বার তিনেক
দেখল। মিতালিকে ডাকল। সংক্ষেপে সব বুঝিয়ে বলল। মিতালির বিস্ময় আর খুশির বহর দেখে
ওর খুব ভালো লাগছিল।
*******
এয়ারপোর্ট
থেকে ফেরার পথে সোহম বলল – আগে হোটেলে চল।
একটু ফ্রেস হয়ে, তারপর তোর বাড়ি যাব।
মণিমালা গিয়ার
বদলে স্পিড বাড়াল শুধু।
-
আরে কি হলো?
-
আমার
ফ্ল্যাটেও ওয়াশরুম আছে।
-
অগত্যা।
- সোহম সিটটা হেলিয়ে আরাম করে বসল – খেতে
দিবি তো?
-
লুচি, আলুর দম আর পায়েস।
-
তোর রাঁধুনি
ভালো রাঁধে?
-
আমার চেয়ে
বেটার। তবে পায়েসটা আমি সকালে নিজে বানিয়েছি।
সোহম সোজা হয়ে
বসল – ক্কীইই? আমি কি চলন্ত
গাড়ি থেকে লাফ দেব? তোর বানানো
পায়েস মানে তো সেই সাদা ইট?
হাসির চোটে
মণিমালার স্টিয়ারিং ঘুরে যাবার দশা। কোনোমতে বলল – সেটা ছুঁড়ে মারলে মাথা ফাটার
চান্স ছিল। আমি এখনো ভেবে পাই না, ওরকম
বানিয়েছিলাম কি করে?
সোহমের সন্দেহ
যায় না – এখন বানাতে শিখেছিস?
গাড়ি থামিয়ে নেমে এলো মণিমালা – নিজেই খেয়ে
দেখিস। এখন চল।
*************
খাওয়া, মেইল পাঠানো, সব শেষ হলে, দুজনে
ব্যালকনিতে এসে বসে। সোহম দোলনা চেয়ারটায় বসে পা দোলাতে দোলাতে বলে – এতদিনেও
কাউকে জোটাতে পারলি না? ছ্যা ছ্যা!
মণিমালা চটে
ওঠে – তুই জুটিয়েছিস তো? তাহলেই হবে।
জার্মান না ইন্ডিয়ান?
-
কিছুদিন পরে
জবাব দিতে পারব। হয়তো ইন্ডিয়ানই হবে।
-
কাকিমা
সম্বন্ধ দেখছেন?
-
উঁহু, আমি নিজেই।
-
এনি হেল্প?
মণিমালা হাসছিল।
-
ইয়েস। তোর
কনসেন্ট না পেলে...
-
সোহম? – মণিমালা প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে।
-
গাধার মতো
চেঁচাচ্ছিস কেন? কিছুই বুঝিস
নি বলতে চাস? সেই কবে থেকে
তোকে খুঁজে খুঁজে...। কারো সঙ্গে যোগাযোগ
রাখিস নি। কেউ বলতে পারে না।
মণিমালার মুখ
উজ্জ্বল হয়ে উঠেই আবার নিভে যায় – তা আর হয় না রে।
-
কেন হয় না, বোঝা আমায়।
মণিমালার চোখে
রাজ্যের ক্লান্তি।
-
ইয়েস। আমাকে
বোঝাতে হবে। নিজের ক্রশ যখন, নিজেকেই তা
বইতে হবে। সোহম, এই লাইনে এতো তাড়াতাড়ি
এতটা উঠে আসতে হলে, হয় নিজে
ব্যবহৃত হতে হয়, অথবা অন্যকে ব্যবহার
করতে হয়। আমি দ্বিতীয়টা বেছে নিয়েছি।
সোহমের পা
দোলানো বন্ধ হয় না। সে একমনে টবের সাদা ফুলটা দেখতে দেখতে খুব অবহেলাভরে জবাব দেয়
– বেশ করেছিস। এবার যা, স্নান করে আয়।
-
মানে?
-
কেন, তুইই তো বলেছিলি, চামড়ার জিনিস
ধুলেই পরিষ্কার?
-
সে তো শরীরের
কথা। কিন্তু মন?
সোহম এবার মণিমালার চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করে।
-
কেন অযথা বিষয়টা জটিল করছিস বলতো? এই সিস্টেমে, ছেলেদের জন্য কি আলাদা নিয়ম? আমিও তো ব্যবহার
করেছি, ব্যবহৃতও হয়েছি। তোর কাছে আসবার আগে স্নান করেই এসেছি। বোঝ
ব্যাপারটা। প্লিইইজ।
মণিমালা
এতক্ষণে সোহমের চোখে চোখ মেলায়। তাদের মধ্যে সময় থমকে থাকে। শব্দেরাও ছুটি নেয়।
কতোযুগ কেটেছে কেউ জানে না। হঠাৎ কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই মণিমালা সোহমের বুকের উপর
আছড়ে পড়ল – আমাকে কষে একটা চিমটি কাটবি?
কোনোমতে টাল
সামলে, সোহম ওকে বুকের মধ্যে
মিশিয়ে নিতে নিতে ওর কানে একটা ছোট্ট কামড় দেয় – পাগলি!
একটু পরে
ফিসফিসিয়ে বলে – আয় না, একবার চেষ্টা
করে দেখি এই পচাগলা সিস্টেমটাকে পাল্টাতে পারি কিনা? কোথাও থেকে তো শুরু করতেই হয়। তাই না?
একজাড়া
পুরুষালি ঠোঁটের তীব্র নিষ্পেষণে মণিমালা ভেসে যাচ্ছিল। আলোর এক ঝর্ণাধারায় সে
আশিরনখ ভিজছিল। হারিয়ে যেতে যেতে
একসময় সচকিত হয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। একটা চোখ মটকে খোলা গলায় গেয়ে উঠল – তুম যো
পকড় লো হাত মেরা, দুনিয়া বদল
সকতি হুঁ ম্যায়!
ওদের যৌথ হাসির
ছটায় আকাশটা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
|| শুরু হোক
পথ চলা ||
4 comments:
Completed at a stretch....liked it very much.
এক নিঃশ্বাসে পুরোটা পড়লাম। অ সা ধা র ণ......!!!!
Thank you so much
Kono ekta group e golpota porchilam.Tarpor r dekhte pelam na. Tarpor apnar profile theke pelam. Khub valo legeche. Kintu mone holo ses ta boddo taratari hoye galo.
Post a Comment