Wednesday, July 5, 2023

বাঁক ||দোলা সেন||‎‎‎

 পাহাড় চিরে লাল স্করপিও ছুটে চলছিল। দুই ধারে ঘন বন। বনের নীচের অংশে ঝোপ আর লতায়-পাতার সাদর জড়াজড়ি। তার মধ্যে দিয়ে নজর চলে না। ঢালের দিকে জমি সোজা নেমে গেছে।  শ্রী জানালার কাচে মুখ ঠেকিয়ে, অবাক চোখে এই প্রায় অগম্য জঙ্গল দেখছিল। পাশ থেকে ছোট ভাইয়ের প্রশ্ন ভেসে এল – তখন থেকে অমন করে কী দেখছিস রে দিদি?

-       ওই কলাগাছগুলো দেখ। এত লম্বা কলাগাছ আমি কক্ষণো দেখিনি। প্রায় দশফুট লম্বা তো হবেই।

-       ওখানে কে গিয়ে গাছ পুঁতলো রে? আর পুঁতলোই যদি, পাড়বে কী করে? – তিলুর গলায় অবিমিশ্র বিস্ময়

ছেলেমানুষের কথায় চালকের মুখে মুচকি হাসিহিন্দি মিশ্রিত বাংলায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করল – এই কলাগুলো জংলি আছে ভাই। বান্দর টান্দর খায়। কভি কভি বাঁশসে আদমি ভি কেটে নেয়।

 

শ্রী চমকে গেল – রামসিং ভাই, তুমি বাংলা জানো?

রামসিং হেসে ফেলে – হামি তো এক বাংগালী বাবুর কাছে দশ বরস কাজ করলাম। তো ওখানে থোড়া বহুত শিখে নিলাম। তবে গলত বললেও সব সমঝতে পারি।

 

গৌতমবাবু মেয়ের চমকানিটা উপভোগ করছিলেন তিনি জানেন, অরুণাচলে অনেক বাঙালি এবং অহমীয়া কাজ করে। মুখে বললেন – রাস্তাটা দেখেছিস?

 

শ্রী উত্তর দিল – হ্যাঁ বাবা, এখানে তো একেবারেই জনবসতি নেই। দু-আড়াই ঘণ্টা পরে যাও বা এক আধটা গ্রাম আসছে, তাতে পাঁচটা থেকে আটটার বেশি বাড়ি চোখে পড়ল না। সেখানে এইরকম ঝকঝকে ডবল লেনের রাস্তা – মনে হচ্ছে বিদেশে আছি।

 

মীনাক্ষি ঠোঁট বেঁকালেন – লোকজনের জন্য থোড়াই। বর্ডার স্টেট। পাশেই চীন। আর্মির যাতায়াতের জন্য বানাচ্ছে।

 

রামসিং মৃদু আপত্তি জানাল – তা হোক ম্যাডাম, আম আদমিরও অনেক সুবিধা হলো। পহেলে এই রাস্তা যেতে দো দিন  লেগে যেত। মিট্টির পাহাড়, সংকরী সড়ক, বহুত অ্যাকসিডেন্ট হতো। এখন সাত আট ঘন্টায় পহুঁচে যাবে। এই রোয়িং সে আনিনি রুটেই পাঁচ ছটা  শেয়ারের জিপ চলে। মালপত্র, লোকজন –সব যায়

তিলুর এসবে মন ছিল না। তার মুগ্ধ দৃষ্টি, সামনের এক মোটরবাইক আরোহীর উপর আটকে ছিলদিদিকে ঠেলে দেখাল – দিদি রে! কি ভালো চালাচ্ছে দেখ।

শ্রী অনেকক্ষণ আগেই খেয়াল করেছিল। আরোহী একজন নয়, দুইজন। পালা করে চালাচ্ছে। নিশ্চিত দৃঢ় চলার ভঙ্গিমায় আরোহীদের বাইকেরই এক অংশ মনে হচ্ছে। এই স্বচ্ছন্দ দ্রুতগতির চলনকে লেপার্ডের সঙ্গে তুলনা করে সে খুশি হয়ে উঠল – কেমন চিতাবাঘের মতো লাগছে, না বাবা?

 

গৌতম হাসলেন। মোটরবাইকের উপর ছেলেমেয়েরর প্রবল আসক্তির কথা তিনি জানেন। অতীতের অনেকখানি সময়, তাঁর বাইকের উপরে বসেই কাটত। কিন্তু এক দুর্ঘটনার পরে মীনাক্ষির প্রবল আপত্তিতে তাকে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। শ্রীর কথায় একটু চঞ্চল হয়ে উঠলেও চুপ করে থাকাটাই নিরাপদ মনে হলো তাঁর।

 

মীনাক্ষি বললেন - টিঙটিঙে বাইকের উপর দুইটি লিঙপিঙ। তবে ভালো চালাচ্ছে।

 

বলতে বলতেই মায়োডিয়া পাস এসে গেল। রাম সিং গাড়িটা একধারে দাঁড় করাল।

 –তাড়াতাড়ি ছবি খিঁচে নিন। অনেকটা পথ বাকি। গেট পড়ে যাবে।

 

কিসের গেট জিজ্ঞাসা করা হলো না। ভাই বোনে নেমে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। সবুজ পাতারা বরফের চাদর জড়িয়ে, একটুখানি মুখ বের করে, সকালের কুসুম কুসুম রোদের তাত নিচ্ছে। এরপর বেলা বাড়লে সাদা চাদর খুলে পড়বে। তখন, পথের পাশের তুলোর পাঁজার মতো বরফ গলে কাদা মাটির পিছল মিশ্রণ। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে, বরফ আর রোদ জুটি বেঁধে বনদেবীকে হিরের গয়না পরাতে ব্যস্ত।

 

   শ্রী আড়চোখে চেয়ে দেখল – মায়ের সেই লিঙপিঙও বাইক থামিয়ে ছবি তোলায় মগ্ন। তারা যখন গাড়িতে উঠল, তখনও ওরা নিশ্চিন্তমনে রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে চা খাচ্ছে। শ্রীয়ের একটি নিঃশ্বাস পড়ল। বাইকের আরোহীরা পিছনে পড়ে রইল। দেখতে বেশ লাগছিল কিন্তু!

 

ঘণ্টা দুয়েক চলার পরেই গাড়ির সামনে গাড়ি। এই নির্জনেও জ্যাম! রামসিং বলল - গেট পড়ে গেছে। আভি এখানেই রুখতে হবে। আপলোগ গাড়ি সে উতার সকতে হো। গেট খুললে হামি ডেকে নেবে। তবে দূরে যাবেন না।

 

শ্রীরা নেমে এল। সামনে পাহাড় ফাটিয়ে রাস্তা তৈরি হচ্ছে। সদ্য ব্লাস্টিং করা হয়েছে। এখন মস্ত মস্ত আর্থ মুভার দিয়ে পাথর ভাঙা ও সরানোর কাজ চলছে। কর্তব্যরত ইঞ্জিনিয়ারদের প্রশ্ন করায় জানা গেল একঘণ্টারও বেশি অপেক্ষা করতে হবে। শুধু তাই নয়, সামনে আরেকটা জায়গা পড়বে, সেখানেও হয়তো এভাবে অপেক্ষা করতে হতে পারে। তিলু বাবার সঙ্গে  রাস্তা তৈরির কর্মকাণ্ড দেখতে এগিয়ে গেলশ্রী ব্যাগ থেকে চকোলেট বের করে খেতে গিয়ে উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল – মা, ওই দেখ, তোমার লিঙ পিঙ! সত্যি সত্যিই ছেলে দুটি এসে দাঁড়িয়েছে। খানিকক্ষণ এদিক ওদিক দেখে বাইক নিয়ে, হাসতে হাসতে, টুক করে গেটের তলা দিয়ে গলে গেল! ইঞ্জিনিয়ার প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন – ইয়ে দো লড়কা বহুত বদমাশ! হামেশা এইসাই..

 

 লিঙ পিঙ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায় বাইক দাঁড় করিয়ে, কনট্রাকটর আর কুলিদের সঙ্গে সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলতারপর ওরা  যখন রাবিশ সরাতে ব্যস্ত, তখন পাশের সরু জায়গা দিয়া টুক করে গলে গেল! শ্রী অবাক হয়ে দেখে যাচ্ছিলতার কিশোরীমনে ভালোলাগা ছড়িয়ে যাচ্ছিলনিয়মভাঙা হাসিখুশি তরুণদুটি কিন্তু বেশ! সে মনে মনে বলল - কালো হেলমেটের নাম লিঙ আর লাল হেলমটওয়ালার নাম বেশ পিঙ। নিজের নামকরণে সে অকারণেই খুশি হয়ে উঠল।

 

লিঙ আর পিঙও যে, বালিকাকে খেয়াল করে নি, এমন ভাবলে ভুল হবে। মায়োডিয়ায় বরফের ছবি তোলার সময়, তারা মেয়েটির ছবিও তুলেছে। কিশোরীর ঝকঝকে শহুরে সৌন্দর্য তাদের চোখে মুগ্ধতার কাজল পরিয়ে দিচ্ছিল। এখন মেয়েটির উচ্ছ্বাসে তাদের তরুণ রক্তে দোলা লাগল। কিছুদূর যাবার পর লিঙ জিজ্ঞাসা করল – ওই মেয়েটা কোথায় যাচ্ছে বল দেখি?

পিঙ উত্তর দিল –  ইয়াজার বাবার গাড়ি। তার মানে, রোয়িং থেকে আসছে।  ট্যুরিস্ট যখন, তখন আনিনিতেই যাবে।

লিঙ খুশি হলোমেয়েটি দেখতে বেশ। বলল – কোথাও দাঁড়িয়ে খেয়ে নিই, চল।

প্রস্তাবটি পিঙেরও মনোমতো হলো। পথের ধারে একটা ছোট দোকান। আরাম করে বসাই যায়।

ঈপ্সীত গাড়িটি পার হয়ে গেলে, ওরাও বেরিয়ে পড়িল। কিছুক্ষণ পরেই আবার গেট! ব্লাস্টিংয়ের প্রস্তুতি চলছে। শ্রীদের গাড়ির পাশে বাইক রেখে, তারা চুপ করে খাদের পাশে এসে দাঁড়াল।

 

লিঙ পিঙের পরণে কোমরে কারুকাজ করা তলোয়ার ঝুলছিল। তিলু ও শ্রী অবাক হয়ে তাই দেখছিল। তিলুই এগিয়ে এসে হিন্দিতে প্রশ্ন করল – তোমরা তলোয়ার নিয়ে ঘুরছ কেন?

লিঙ হাসল – আমরা মিসমি। তলোয়ার না। একে বলে দাও। এর হাতলে যে কাজ আছে, তা আমাদের গোষ্ঠীর প্রতীক।

-       পাঞ্জাবীদের মতো?

-       নাহ্। অরুণাচলে অনেক উপজাতি আছে। প্রত্যেকের হাতলের আলাদা ডিজাইন। দাওয়ের শেপও আলাদা। যে জ্যাকেটটা পরে আছি, এটার ডিজাইনও একেক গোষ্ঠীর একেক রকম। মাথার টুপিও থাকে, কিন্তু বাইক চালাবার সময় হেলমেট..

বলতে বলতে তিলুর দিকে চেয়ে চোখ মটকাল।

 

  তার মানে এটা র্নামেন্টাল? – ইংরাজী শব্দ উচ্চারণ করেই শ্রী মনে মনে জিভ কাটল। হিন্দিতে আরেকবার বলার আগেই পিঙ সামনের বনের দিকে আঙুল তুলল – “ নাহ্। বনে অনেক জানোয়ার থাকেচিতা, বরা, ভালুক। শর্টকাটে যাবার সময় এটা প্রাণ বাঁচায়।“

এতক্ষণে মীনাক্ষি কথা বললেন – তোমরা এখানেই থাকো?

পিঙ উত্তর দিল – আমরা ডিব্রুগড়ে কলেজে পড়ি। এখন ছুটিতে বাড়ি এসেছি।

তিলু অবাক হয়ে জানতে চাইল – তোমরা কলেজেও এই পোষাকে....

পিঙ হেসে ফেলল – না, না। ওখানে তোমার মতোই টিশার্ট আর জিনস...

 

বলতে বলতেই পিঙ হঠাৎ সচকিত হ‎‎য়ে সামনের ওভারসিয়ারেরে দিকে এগিয়ে গেলশ্রী ধীরে ধীরে লিঙকে প্রশ্ন করল – তোমরা সবাই হিন্দি জানো কিভাবে?

লিঙ বলল – এখানে স্কুল লেভেলের পড়াশোনা হয় রাজস্থান বোর্ডের আন্ডারে।

-       রাজস্থান?

লিঙ উত্তর দেবার আগেই পিঙ হন্তদন্তভাবে এসে পড়ল – ওভারসিয়ারকে পটিয়ে এলাম। ব্লাস্ট করার আগে তিন চারটে গাড়ি ছেড়ে দেবে।

তারপর গৌতমের দিকে ফিরল - আপনাদের গাড়িটা তো দু নম্বরে আছে, তাই না? তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসুন। বলে নিজের বাইকে স্টার্ট দিল।

 

গাড়িতে বসে গৌতম স্বস্তির শ্বাস ফেললেন – ছেলেদুটো কাজের আছে যা হোক। অন্ততঃ দেড়ঘন্টা বাঁচল।

 

আনিনির পথে রাস্তার কিছু অংশ বেশ বিপজ্জনক। সরু, কর্দমাক্ত ও পিছল। দুরুদুরু বুকে পার করে এসে, সকলের চোখ জুড়িয়ে গেল। তিলু বলল – ইংরেজী সিনেমার মতো রাস্তা আর সিনারি, না বাবা?

শ্রীর এসব বিষয়ে মন ছিল না। তার চোখ সতর্কভাবে লিঙপিঙকে খুঁজছিল। কিন্তু তাদের দেখা পাওয়া গেল না।

 

অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা হয়ে গেল দুদিন পরে। শ্রীরা একটি কিউয়ি বাগান দেখতে গিয়েছিল। সেখানে এই দুর্মূল্য ফল, গাছে ঝুলতে দেখে, ভাইবোনে নিতান্ত উত্তেজিত হয়ে উঠলপিছন থেকে আনন্দ ও বিস্ময়ভরা স্বর বেজে উঠল – আপলোগ, ইঁহা?

তিলু জবাব দিল – কিউয়ি গাছ দেখতে এসেছি। তুমি?

পিঙের মুখ কৌতুকহাস্যে ভরে উঠল – এই বাগানটা আমাদের। তোমরা ফল কিনবে? আমার সাথে এসো।

 

পিঙ বাগান থেকে এক ব্যাগ পাকা কিউয়ি পাড়িয়ে দিল। মীনাক্ষি বলল – এতো? দাম কতো? পিঙ হাসল – বেচবার কিউয়ি পাঠানো হয়ে গেছে। এগুলো আমাদের খাবার জন্যে রাখা ছিল।

-       তবু...

-       আচ্ছা। তাহলে নানীকে একশো টাকা দিয়ে যান।

-       সেকি? আমাদের ওখানে তো একটারই দাম তিরিশ থেকে চল্লিশ টাকা?

-       আমরা এরকমই দাম পাই। নানীইই....

 

এক লোলচর্ম বৃদ্ধা চালার ভিতর থেকে বাইরে এলেন। মীনাক্ষি ও গৌতম সেদিকে যেতেই, পিঙ বলল – এই ওপরটায় এসো। এখান থেকে নিচের দৃশ্য খুব সুন্দর।

 

তিলু ও শ্রী পিঙের পিছু পিছু গেল। উপত্যকাটি সত্যিই সুন্দর। তিলু মোবাইলে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শ্রী নিচুস্বরে জিজ্ঞাসা করল – সত্যিই তোমরা এতো কম দাম পাও?

পিঙ চোখ কৌতুকে নেচে উঠল – হুউউউম্। বলেই হেসে ফেলল।

-       তাহলে?

পিঙ সরলভাবে জবাব দিল – তোমাকে ভালো লেগেছে তাই।

 

শিউরে উঠল শ্রী তাড়াতাড়ি নেমে যেতে চাইল কিন্তু ঝুরো মাটির ঢাল বড় বিশ্বাসঘাতক। তবে পড়ল না। তার আগেই আগেই পিঙের সবল রুক্ষ হাত তাহাকে ফের দাঁড় করিয়ে দিল। প্রথম ভ্রমরগুঞ্জন আর প্রথম স্পর্শের রেশ মিলাতে না মিলাতেই মীনাক্ষির ডাক শোনা গেল – তাড়াতাড়ি নিচে এসো। এবার যেতে হবে।

 

যেতে হবে! নামটাও জানা হয় নি! তিলুর কান বাঁচিয়ে শ্রী বলল – নাইন ফোর এইট....। গোপন করল কেন, সে জানে না। তার মনের মধ্যের কুঁড়িটি সবে ফুটতে শুরু করেছে। তাকে সে এখনো চেনে না।

পিঙ মাথা নাড়ল – তার মনে থাকবে।

 

সন্ধ্যা নেমেছে। চালাখানি চাঁদের আলোয় ভাসাভাসি। বুড়ি এসে নাতির পাশে বসল – লড়কী অচ্ছী লগী? আহ্রু খো?

পিঙ চমকে উঠল – তুই বুঝলি কী করে?

-       বাল এইসাই সফেদ হুয়া কেয়া?

-       কার কাকে ভালো লাগলো রে নানাী?

লিঙ কখন যেন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। নানী হেসে উঠে‎‎ গেল। পিঙ হাসতে হাসতে পুরো ঘটনা বলছিল। সে খেয়াল করে নি, চালার ছায়াখানি কখন যেন লিঙের মুখে মাখামাখি হয়ে গেছে

-       তোর সাথে দোস্তি খতম!

পিঙ হকচকিয়ে গেল – কী হয়েছে?

-       লড়কীর সঙ্গে আমার আলাপ হলো, গল্প হলো। আর তুই চুপি চুপি তাকেই ... ছিঃ!

পিঙ হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল – তুই তো কিছু বলিস নি? আর আমরা তো একসাথেই ওকে দেখেছিলাম। তুই না ইনসাফি করছিস কিন্তু! মেয়েটা আমাকে ফোন নং দিয়েছে। তোকে না।

 

দুই বন্ধুর মধ্যে খামোকা ঝগড়া হয়ে গেল।

 

শ্রী ফিরে গিয়েছে। পিঙের মন ভালো নেই। সে কি পিঙকে মনে রেখেছে? পিঙ ভাবতে থাকে। কয়েকবার শ্রীকে ফোন করতে গিয়েও থমকে গেছে। লিঙের সঙ্গে তার আবাল্য বন্ধুত্ব। সেদিনের পর থেকে লিঙ তার সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ করেছে। পিঙ কয়েকবার চেষ্টা করে হার মেনেছে। সেদিন বিকালেও মনে মনে এইসব নিয়েই নাড়াচাড়া করছিল। শেষে ধুত্তোর বলে, বনপথ ধরে নানীর বাগানের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। অনেকটা শর্টকাট হবে। বাগান পরিষ্কার করতে হবে। কিছুদিন বাদে নানীর বাড়ি বদল হবে। তার জন্যে জায়গা চাই। সারা গাঁয়ের লোক হাত লাগাবে। সবাই মিলে বাড়ির সব কাঠ বাঁশ খুলে ফেলে একটু দূরে আবার সেগুলো দিয়ে নতুন ঘর বানাবে। পচা বাঁশ ফেলে দিয়ে দরকারমতো নতুন বাঁশ, কাঠ লাগাতে হবে। বাড়ি বলতে সামনে, পিছনে দুটো চালার মতো বারান্দা, মাঝে একখানি বড় ঘর। সেখানেই রান্না, খাওয়া,  শোওয়া। সমস্যা একটাই ঘর ভাঙা থেকে গড়া পুরোটা করতে হবে একই দিনে। ছেলেরা ঘর বাঁধার কাজ করবে। মেয়েরা সবার জন্যে রাঁধবে, ছেলেদের জোগাড় দেবে। দু- তিন বছর পরপর সবাইকেই এভাবে বাড়ি বদল করতে হয়। ঐতিহ্য বলো, উৎসব বলো – এই নিয়েই সবার সঙ্গে সবার জুড়ে থাকা।

 

এইসব ভাবতে ভাবতেই সে একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল। হঠাৎই তার বনচারী মন তাকে সতর্ক করে বলল – সাবধান! মুহূর্তে সে পিছন ফিরেই বুঝল, মানসিক দোলাচলে সে মারাত্মক ভুল করে বসেছে। তার সর্বক্ষণের সঙ্গী ‘দাও’কে সে ঘরেই ফেলে এসেছে! কালো রঙের জন্তুটি ততক্ষণে চার পা ছেড়ে দুই পায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। আক্রমণের প্রস্তুতি। পিঙ বুদ্ধি হারাল না। অসম প্রতিরোধ হবে জেনেও দ্রুত একধারে সরে একটি ডাল কুড়িয়ে তুলে হুঙ্কার ছাড়ল। মনে আশা, যদি ভল্লুকটি মত পরিবর্তন করে। কিন্তু ফল হলো সম্পূর্ণ উল্টো। হয়তো, তার বাচ্চারা ধারেপাশে ছিল। সে পিঙের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ফালাফালা করার জন্যে তৈরি হলো।

ঝাঁপাবার ঠিক আগে দ্বিতীয় গর্জন ও  একটি তীক্ষ্ণ আঘাত তাকে পিছু হটতে বাধ্য করল। তার গলায় তীর বিঁধেছে।  বিস্মিত পিঙ পিছু হটার আগেই আরো একখানি তীর এসে ভালুকের কাঁধে বিঁধে গেল। তীরের ডগায় তীব্র বিষ মাখান। ভালুক লুটিয়ে পড়ল।

 

পিঙ দুই পা পিছিয়ে রুদ্ধস্বরে বলল – তুই?

লিঙ গম্ভীরভাবে উত্তর দিল – রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম তুই গাধার মতো খালিহাতে বনে ঢুকে গেলি! তাই ...। ভাগ্যিস আজ তীরধনুক সঙ্গে ছিল।

 

নানীর ঘরের বারান্দায়, আবার দুই বন্ধু পাশাপাশি বসেছে। নানী কিকিতো রান্না করেছিল। লিঙ ধীরে ধীরে আলাপ শুরু করল – সরি ভাই। তোর সঙ্গে ঝগড়ার করার জন্যে সরি। ভালুকটা যখন.... খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

পিঙ বন্ধুর হাত ধরল – আমারও অন্যায় হয়েছে। অন্যমনস্ক হওয়া উচিত হয়নি। আসলে তুই রাগ করেছিলি...

লিঙের মুখে অকৃত্রিম হাসি – আর রাগ নেই। মেয়ে অনেক পাব। কিন্তু তোর মতো বন্ধু আমার আর একটিও নেই। তোর ওপর আমার কোনো রাগ নেই। মেয়েটাকে ফোন করেছিলি? কি বলল রে?

পিঙ হাসল – ফোন করা হয়নি।

-       কেন?

পিঙ জবাব দিল না। ফোন বের করে সেদিনের তোলা ছবিগুলি বন্ধুকে দেখাল। তার পর একটু নিঃশ্বাস ফেলে, একটা একটা করে ডিলিট করতে লাগল। লিঙ এতো অবাক, যে বাধা দেবার কথাও মনে এল নাসবশেষে ফোন নম্বরটি ডিলিট করে, পিঙ, বন্ধুর দিকে তাকিয়ে হাসল। নির্মল স্বচ্ছ হাসি। লিঙ কোনোমতে জিজ্ঞাসা করল – কেন এমন করলি? আমি যে বললাম...

পিঙ আবারও হাসল – বন থেকে শহর অনেক দূর। ভালোলাগা দিয়ে সেটা পার করা যায় না রে। তার চেয়ে আমাদের বন্ধুত্বটা অনেক বেশি সত্যি।  আমরা দুজনেই এই সহজ কথাটি ভুলেছিলাম।

 

অনেক দূরে, এক শহরের সাততলার এক জানলায় এক কিশোরী আনমনে নিচের চলমান জনস্রোত দেখছিল। সবুজ বনে, তার মন এক নরম ভালোবাসার আলোয় ভরে গিয়েছিল। সে টের পায়, শহরের উজ্জ্বল আলোয় তা রোজই মলিন থেকে মলিনতর হয়ে যাচ্ছে। সে রাস্তার দিকে চাইল। পিঙ যেন এই ভিড়ে বড়ো বেমানান! তাহলে? পিঙ, নাকি তার প্রিয় শহর? তার কেমন যেন কষ্ট হচ্ছিল। সে চোখ তুলে আকাশের দিকে চাইল। এই চাঁদ কি আনিনিতেও...? আচ্ছা, সে  কি বড় হয়ে আনিনিতে চাকরি পেতে পারে না? সেই কিউয়ির বাগান, সরল সবুজ জীবন, পিঙের হাসিমুখ... নীরব ফোনটার দিকে তাকাল সে – ফোন কি বাজবে? বাজলে কী বলবে সে এখন?  

 

সে জানে না, এই কষ্টবোধ, এই বোধের বদল - তাকে ছোটবেলার তোরণ পার করে বড়বেলার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

 

 

সেই সময়, সেই সবুজ আদিম বনে, নানীর দাওয়ায়, দুই বন্ধু হাত জড়াজড়ি করে বসে ছিল। আর পঞ্চমীর চাঁদ মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে এইসব রঙ্গ দেখে, একটু ফিক করে হেসে নিল

দোলা সেন||

1 comment:

Anonymous said...

ভালো লাগলো।