Friday, April 29, 2022

ইউ-টার্ন ||দোলা সেন||


কয়েক সেকেন্ড মাত্র উঠেছে, আচমকাই ছোট্ট একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল লিফট। কী হল? অফিসে টিমমেম্বারদের মধ্যে ঋদ্ধি বরাবরই ক্যাপ্টেন কুল বলেই পরিচিত। কোনও পরিস্থিতিতেই দিশাহারা হয়ে যায় না। কিন্তু এই মাঝরাত্তিরে এমন পরিস্থিতিতে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটলো ক্যাপ্টেন কুলের। ভরসার কথা একটাই। লিফটের আলো নেভেনি। অ্যালার্ম বাটনটা টিপে দিল ঋদ্ধি। কিন্তু সেটা কাজ করল না।

 

বহুবছরের পুরোনো অফিস। কিছুদিনের মধ্যেই হেরিটেজ বিল্ডিংয়ের খাতায় নাম উঠে যাবে হয়তো। জিভের ডগায় উঠে আসা গালাগালিটা অতিকষ্টে ফেরত পাঠালো ঋদ্ধিবিল্ডিংয়ের আগে এই মান্ধাতা আমলের লিফটটাকেই হেরিটেজের মর্যাদা দেওয়া উচিত। মাঝে মাঝেই বিগড়ে যায় ব্যাটাচ্ছেলে। সেজন্যেই নিচে একটা ফোনসহ লিফটম্যান থাকে। এসব ঝামেলা সামলাতে সে ওস্তাদ। কিন্তু এতো রাত্তিরে...।

 

ফোনটা বেজে গেল। স্বাভাবিক। লোকটার বা ওদের কারোরই এই সময়ে থাকার কথা নয়। তবু ওপর মহল থেকে হঠাৎ কিছু নির্দেশ আসায়, তাদের টিমটাকে রাত অবধি কাজ করতে হচ্ছে আর তাই তাকে ওভারটাইম দিয়ে থাকতে বলা হয়েছিল। কিন্তু...।

 

সাধারণত, রাতবিরেতে লিফট ব্যহার করে না ঋদ্ধিবসকে রিপোর্টটা জমা দিয়ে বাড়ি যাবে বলে, আজও সিঁড়ি দিয়েই উঠতে যাচ্ছিলকিন্তু রিমি রায়কে লিফটে ঢুকতে দেখে তার হিসেব গোলমাল হয়ে গেল।

 

রিমি রায়। মেয়েদের যে রূপ থাকলে পুরুষের মুণ্ডুটি দুশো তিরিশ ডিগ্রী ঘুরে যায় – রিমি রায় সেই রূপের অধিকারিনীওই জ্বলন্ত আগুনে কতোজন যে পুড়ে মরেছে, এই অফিসের করিডোর এবং কিউবিকলগুলো তার হিসেব জানেরিমি রায় কাউকে আলাদাভাবে আস্কারা দিয়েছে, এমন কথা কেউ বলতে পারবে না, কিন্তু তার মোহিনী হাসিতে, কথার কুশলতায় মুগ্ধ স্তাবকের সংখ্যায় ভাঁটা পড়েনি কখনো। ঋদ্ধিও পুড়েছে। তবে ক্যাপ্টেন কুল জানে এই মেয়ে তাকে পোড়াবেই শুধু। আলো দেবে না। যখন মিহির, বিবেক, সুমনের মতো উজ্জ্বল পাত্ররাই কলকে পায়নি, তখন সে তো ....। তাই আলাদা করে মেশার চেষ্টা করেনি কখনো। তবু রিমি রায় তার মুগ্ধতা খেয়াল করেছে। ‎তা নিয়ে সখীবৃত্তে হাসাহাসিও করেছে – “ভালো লাগলে, সে কথা বলার সাহসই জোটাতে যে পারে না, সে পুরুষ, না ল্যাবাকার্তিক?”  সেই সখীদেরই কেউ কেউ আবার, ওপরপড়া হয়ে ঋদ্ধিকে সে খবর দিয়ে গেছে। মনে যাই থাক, ক্যাপ্টেন কুল তার ডোন্ট কেয়ার হাসিটা ঝুলিয়ে সেই সখীকে বুঝিয়ে দিয়েছে, এসব কথাবার্তায় তার কোনোই আগ্রহ নেই। তবু, এই প্রায় মাঝরাতে, বিশাল উঁচু, লম্বা করিডোরের ম্লান আলোয় ঋদ্ধির সব হিসেব উল্টে গেল। প্রায় হনহনিয়েই রিমির সঙ্গে লিফটে ঢুকে পড়ল। তারপরেই এই বিপত্তি।

 

 

রিমি লিফটের দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঋদ্ধির কাজকর্ম কৌতুকভরা চোখে দেখে যাচ্ছিল। পথ পরিবর্তন করে ঋদ্ধির লিফটে ওঠা থেকে আটকে পড়া – পুরোটাই একটা মজার বিষয় যেন। ফোনটা কেউ ধরল না যখন, তখনও হাসিমুখেই বলল – দারোয়ানকে পেলেন না? ঘাবড়ে গেলেন নাকি?

 

হাসি দেখে রাগ হয়, এই প্রথম জানল ঋদ্ধিতবু হাসির জবাবে হাসিমুখেই মাথা নাড়ল – ওকে না পেলে, সারারাত এখানেই কাটবে। মাঝপথে দরজাও তো খুলবে না।

 

-       কিন্তু আপনার এবং আমার হাতের রিপোর্টদুটো? সেগুলো না পৌঁছালে তো...

 

ঈঙ্গিতটা ধরতে ঋদ্ধির অসুবিধে হলো না। বসের সেক্রেটারির নম্বর ডায়াল করতে গিয়ে, গলায় হতাশা ফুটে উঠল – আমার ফোনে টাওয়ার নেই। আপনি দেখুন তো?

 

লীলায়িত ভঙ্গিমায় রাজেন্দ্রানীর মতো ফোনটা বের করল রিমি। তার একটা কলে সারা অফিস দৌড়ে আসবে, এ বিশ্বাস তার আছে। কিন্তু ...

 

এতক্ষণে মন থেকে হাসতে পারল ঋদ্ধি – ঘাবড়ে গেছেন দেখছি। টাওয়ার নেই?

 

এবার রিমির কপালে ঘাম জমছে। প্রায় ধমকেই উঠলো – ফ্যাচ ফ্যাচ করে না হেসে, কী করা যায় সেটা ভাবুন।

 

আর সব ছাপিয়ে, মোহিনী রূপ ছেড়ে বেরিয়ে আসা এই সাধারণ রিমিকে বড্ডো ভালো লেগে গেল ঋদ্ধির। কিন্তু সে কিছু বলবার আগেই লিফটটা অন্ধকার হয়ে গেল! ভয়ে কাছ ঘেঁষে এলো রিমি – লোডশেডিং?

-       উঁহু, করিডোরের আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে, দেখছেন না? লিফটের ইলেকট্রিক্যাল কানেকশনেই হয়তো কিছু অসুবিধে হয়ে থাকবে।

মৃদু হয়ে এল রিমির কণ্ঠস্বর – আমার কিন্তু সত্যি খুব ভয় করছে। আজ আপনি সঙ্গে না থাকলে...

ঝড়াং করে ঝাঁকুনি দিয়ে লিফটটা চালু হয়ে গেল। উঠছে লিফট। তিন, চার, পাঁচ....

 

পাঁচেই নামার কথা ওদের। কিন্তু লিফট থামল না। ছয় পেরিয়ে সাত। টপ ফ্লোরে পৌঁছানোর আগেই আবার ঝড়ঝড়িয়ে নামতে লাগল। নেমে এলো আড়াই অবধি। তারপর আবার উপরে!  নাগরদোলার স্পিড বেড়ে যাচ্ছে  প্রতিবারেই নাকি মনের ভ্রম? কিন্তু ঝাঁকুনি যে বাড়ছে তাতে সন্দেহ নেই। ভয়ের চোটে প্রাণপণে ঋদ্ধিকে জড়িয়ে ধরল রিমি – আমার খুব ভয় করছে।

 

আর ঋদ্ধি? কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অপদার্থের মতো। মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটোকে সোজা করে রাখল জীবনের সমস্ত শক্তি সংহত করে। একযুগ পার করে, খুব শান্ত গলায় বলল – ছাড়ুন এবার।

 

চমকে উঠল মেয়েটি – ওঃ আমি... সরি। আ-আমি ভেবেছিলাম আপনিই বোধহয় আমায়...

-       ভয় পেলে অমন ভুল হতেই পারে। তবে কারো ভয়ের সুযোগ নেবার মতো পুরুষ হতে পারিনি আজও। ল্যাবাকার্তিক কিনা!

মেয়েটি লাল হলো কিনা অন্ধকারে বোঝা গেল না। ঋদ্ধি শান্তভাবে বলে চলল – আপনি বোধহয় খেয়াল করেননি, কোনো তলা পার হবার সময় একটা খুট করে আওয়াজ হচ্ছে। তার মানে, শ্যাফটটা খুব সামান্য সময়ের জন্যে হলেও কানেক্ট হচ্ছে। আমি ওই মুহুর্তটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে চাই। আপনার ছোট্ট ছাতাটা দিন তো। আর যদি দরজাটা খুলতে পারি, যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে আসবেন।

 

কোনো কথা বলল না রিমি। নিঃশব্দে ছাতাটা এগিয়ে দিল। ছাতাটা লিফটের দরজার গ্রিলের ফাঁকে ঢুকিয়ে ঋদ্ধি অপেক্ষা করছিল। বাঞ্ছিত খুট আওয়াজটার সঙ্গে সঙ্গে একসঙ্গে দুটো দরজাকেই হ্যাঁচকা টান দিল প্রাণপণে।

 

দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে বাইরে এসে পড়ল দুটি মানুষপ্রাণপণে দৌড়ে নেমে গেল সিড়ি ধরে। একেবারে  নীচে নেমে তবে দম নিল।

 

ধাতস্থ হয়ে কড়া গলায় ডাকল ঋদ্ধি – মানিক? ড্রাইভার বেচারি সিটেই গুটিশুটি হয়ে ঘুম দিচ্ছিল। এখন এই চড়া সুরে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। ঋদ্ধি ফাইলগুলো ওর হাতে দিয়ে বলল – এগুলো ওপরে পাঠাবার ব্যবস্থা করো, আর ম্যাডাম কে পৌঁছে দাও।

-       স্যার আপনি?

-       বিপুল আছে তো? ওকে ডাকো।

কথা শেষ করে ঋদ্ধি কোনোদিকে না তাকিয়ে, সোজা পায়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। আর ওই যাওয়া দেখতে দেখতে রিমি টের পাচ্ছিল, ক্যাপ্টেন কুল আর তার পিছনে পিছনে ঘুরবে না।

*

*

*

উলটে কাল থেকে রিমিই ......।

দোলা সেন||

 

No comments: