[১]
২১৪২
সাল। জায়গাটা দেখলে একটা বড়োসড়ো গ্রামের কথা মনে পড়ে। বেশ ছড়ানো জায়গাটা। গাছপালা,
সবুজ মাঠ এমনকি একটা দীঘি পর্যন্ত রয়েছে। এদিক ওদিক ছড়ানো ছেটানো বেশ কিছু বাড়ি।
বাড়ির সামনে একচিলতে উঠোন। তবে সেই উঠোনে বাগান করতে দেখা যায় না কাউকে। কেমন যেন
একটা বিষণ্ণতা ঘিরে থাকে গ্রামটিকে। গ্রামের নামও জানে না কেউ। আসলে নাম দেবার মতো
উৎসাহও বোধহয় অবশিষ্ট নেই বাসিন্দাদের।
গ্রামের চারদিক ঘিরে মস্তো পাঁচিল। তার একদিক
লাল রঙের, বাকি তিনদিক সবুজ। তার ওপারে বাসিন্দাদের যাওয়া নিষেধ। অবশ্য যাবার
উপায়ও নেই তেমন। পাঁচিলের ওপারের জীবনধারার সঙ্গে এই গ্রমের কোনো যোগ নেই। উঁহু,
ভুল বলা হলো বোধহয়। একটা যোগ আছে। একদিকের
সবুজ পাঁচিলে যে দরজাটা আছে সেটার কথা বলতে তো ভুলেই গিয়েছিলাম। সপ্তাহে একদিন সেই
দরজা খোলে। একটা স্বয়ংক্রিয় গাড়ি এসে দাঁড়ায় সমবায় অফিসঘরে। রোবোটেরা নেমে দুধ
ডিম, শাকসব্জি ইত্যাদি ঠিক ঠিক কন্টেনারে ভরে দেয়। বাসিন্দারা নিজেদের কার্ড পাঞ্চ
করলে প্রয়োজনীয় রসদ পেয়ে যায়। সেই ঘরে একটা ফোন আছে। সেটা দিয়েই একমাত্র
কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলা যায়। নিকিতাদাদু সেই ফোনে ওদের খবর দেয়। অন্য কারো ফোন
করার নিয়ম নেই। কেউ অসুস্থ হলে বা মারা গেলেই একমাত্র ফোন করার নিয়ম। এরকম অনেক
নিয়ম মেনে চলতে হয় বাসিন্দাদের। ফোন পেলে অদ্ভুত পোষাক পরা কিছু লোক আসে। দরকার
মতো ওষুধ দেয়।
গ্রামের একদিকের পাঁচিলের রঙ লাল। তারই গা ঘেঁষে
কবরখানা। কেউ মারা গেলে রোবোটগুলো মাটি খোঁড়ে, কবর দেয়। অবশ্য ফোন না পেলেও ওরা
আসে কখনো সখনো। কবর খোঁড়ে। কফিন নামায়। তখন ঠিক বোঝা যায়, আগেরদিন যে মানুষটি
পাঁচিল ডিঙিয়েছিল, প্রহরীর চোখকে সে ফাঁকি দিতে পারেনি। এ নিয়ম ভাঙার একমাত্র
শাস্তি মৃত্যু। গ্রামের লোকেরা জানে, ওদের চোখ ফাঁকি দিতে আজ অবধি কেউ পারে নি।
অদ্ভুত পোষাক পরা লোকগুলো মাঝে মাঝে আসে, কাজ
শেষ হলেই গাড়ি করে ফিরে যায়। নিকোলাইদাদু বলে, তারাও নাকি মানুষ। এমনকি কর্তৃপক্ষেরাও
তাই!
কিশোর
ছেলেটি, যার নাম নাকি ইগর, শুধোয়, তাহলে ওরা এমন পোষাক পরে কেন দাদু? ওদের দেখাই
যায় না যে! ওরা কি আমাদের মতোই দেখতে?
চেহারার কথাটা এড়িয়ে যায় নিকোলাইদাদু। শুধু বলে, আমাদের শরীরে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব
আছে। তাই ওরা আমাদের আলাদা করে রেখেছে। নয়তো একসময় তো আমারা সবাই একসাথেই.....
সেই একসময়ের গল্প জানে বইকি আজকের ইগর,
ইয়েলেনা, সাশার দল। এই প্রজন্মের একঝাঁক কিশোর কিশোরী।
তারা দেখতে কেমন? এখানে সে প্রশ্ন কেউ জিজ্ঞাসা করে না। আমরাও করব না। আমাদের চোখে
যেটা বিকৃতি, ওদের চোখে সেটা স্বাভাবিক। জন্মে থেকে ওরা এটা দেখেই বড়ো হয়েছে। ওদের
চোখে ওরা সুন্দর। তার চেয়ে আমরা বরং জেনে নেব সেই একদিন কি ঘটেছিল।
[২]
২০৮৬
সালের সেই সকালটা অন্যান্য দিনের মতোই একদম স্বাভাবিক ছিল। আদ্রিয়ান কাশা খেতে
খেতে তিনশ একবারের মতো বউকে বোঝাবার চেষ্টা করছিল এই দুধে সেদ্ধ যবের চাইতে
একটুকরো হ্যাম ছড়ানো মাখন পাউরুটি খেতে ঢের ঢের ভালো। আর কাতিনাও লক্ষ্মী মেয়ের
মতো ঘাড় নেড়ে তাতে সায় দিয়ে একমনে বরের লাঞ্চপ্যাক গোছাচ্ছিল।
আদ্রিয়ান বউয়ের এই অতি বাধ্য ভঙ্গির সঙ্গে
বিশেষ পরিচিত। অতএব কাল সকালেও যে কাশাই জুটবে এ ব্যাপরে সে স্থির নিশ্চিত হয়ে
ডায়েটিশিয়ানের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে শুরু করল। কিন্তু বাইরে থেকে ওলেগ বেজায়
হাঁকাহাঁকি শুরু করায় ব্যাপারটা আর বেশিদূর গড়াতে পারল না। ওলেগ চেঁচাচ্ছিল –
বউয়ের সঙ্গে প্রেমালাপটা সন্ধ্যা পর্যন্ত মুলতুবি রাখ
হতভাগা। হাজিরা খাতায় লেট মার্ক পড়লে মহান ইভানোভিচের
গলা দিয়ে যে মধু ঝরবে, তাতে তোর, আমার – দুজনেরই একমাসের চিনির খরচ বেঁচে যাবে।
অগত্যা ব্রেকফাস্টের মীমাংসা ছেড়ে, ঝটপট ঝোলা
কাঁধে ফেলে সাইকেলের প্যাডেলে পা দেয় আদ্রিয়ান। একবিংশ শতাব্দীটা বুড়ো হলে কি হবে,
লোকজনের অবস্থা বিশেষ পাল্টায় নি। হ্যাঁ, ওই এসকালেটেড ফুটপাথ, ফোনে থ্রি ডি
ইমেজের সঙ্গে কথা বলা ইত্যাদি ব্যাপারগুলো জলভাত হয়েছে বটে। কিন্তু ওলেগ, কাতিনা,
আদ্রিয়ানদের জীবনযাত্রা মোটামুটি একইরকম আছে। যান্ত্রিক নির্ভরতা বাড়ার ফলে,
চাকরির আকাল আরও বেড়েছে। তাই আদ্রিয়ানদের তটস্থ থাকতে হয়। লেটের ভয়ে প্রাণপণে
সাইকেল চালাচ্ছিল দুই বন্ধু।
যেতে যেতেই ডানদিকের আকাশে, কোনো সতর্কবার্তা
ছাড়াই একশোটা সূর্য জ্বলে উঠল। তারপরেই একটা কানফাটানো আওয়াজ। তারপর আরো একটা, আরো
আরো...
ডানদিকের আকাশে যদি লাল আর কমলা রঙের হোলিখেলা
চলে তাহলে অন্যদিকের আকাশ ভরে গেছে কালো ধোঁয়ায়। আর আকাশ থেকে ফুটন্ত জলের চেয়েও গরম যে বস্তুটা নেমে আসছে, তাকে যদি
বৃষ্টি বলো, তাহলে তাও আছে।
অবশ্য এসব দেখার বা বিচার করার কোনো সময়ই পায়নি
আদ্রিয়ান। জ্বলন্ত চামড়া নিয়ে দৌড়তে গিয়ে সে যখন মুখ থুবড়ে পড়ল, তখন সে জানতেও
পারলো না, তার একটু দূরেই পড়ে আছে ওলেগ, পাভেল, অ্যালেক্সেইরা।
পুরোপুরি জ্ঞান হারাবার আগে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল মেয়ে নাতাশার মুখখানি।
[৩]
- বুড়ো খোকা একটা।
নিজের মনেই বলল কাতিনা। মাস তিনেক আগে
নিয়মমাফিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর ডায়েটিশিয়ান বলেছিল, আদ্রিয়ানকে মাংস খাওয়াটা
যথাসম্ভব কম করতে হবে। তা চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী।
মেয়েও হয়েছে তেমন! সেই
কখন থেকে স্নানে ঢুকে বসে আছে, বেরোবার আর নাম নেই। এদিকে স্কুলের বাস আসার সময়
হয়ে গেল। শেষবারের মতো মেয়েকে তাড়া দিতে যাবে কাতিনা, চোখটা ঝলসে গেল জানলা দিয়ে
আসা তীব্র আলোয়। হঠাৎ এতো গরম? দেখবার জন্য জানলার দিকে এগোতে গেল। তারপর সব
অন্ধকার।
* * * *
আগামীকাল চেরনোবিল
দুর্ঘটনার শতবর্ষপূর্তি। বারান্দায় বসে বক্তৃতা তৈরি করছিলেন প্রফেসর আফানাসি।
চেরনোবিল! ইউক্রেন ও
বেলরুশের সীমান্তে প্রিপেত শহরের কাছে পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র। এক কর্মীর ভুলে, ১৯৮৬ সালের এপ্রিল
মাসের রাত দেড়টায়, সেখানকার চার
নম্বর চুল্লীর বাষ্প বের হতে না পেরে গরম হয়ে ফেটে যায়। প্রায় দশদিন ধরে চলেছিল
অগ্ন্যুৎসব। তেজস্ক্রিয়তা
ছিল অনধিক পঁচিশটি পরমাণু বোমার সমান! কেমন ছিল সেই প্রদাহ? লিখতে গিয়ে তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠছিল সেই
দুর্ঘটনার বিবরণ।
জ্ঞান হারাবার
পূর্বমুহূর্তে তাঁর মনে হলো এই একশো বছরেও মানুষ একইরকম অসতর্ক আর ফাঁকিবাজ রয়ে
গেল। নাহলে আবারও....
ততক্ষণে বিশ্বের
সর্বত্র খবরে উঠে এসেছে বেলোজারস্কির – মানে সমুদ্রতীরের এই ছোটা শহরটির নাম।
ভাগ্যের এমনই পরিহাস, চেরনোবিলের শতবর্ষেই আরেকটা পারমণবিক চুল্লীর বিস্ফোরণ ঘটে
গেল। তফাত শুধু এইটুকুই যে, এবারের ভয়াবহতা ও ধ্বংসলীলা অনেক অনেক বেশি। সেটাই
স্বাভাবিক। কারণ পৃথিবী এখন মূলতঃ পারমাণবিক শক্তির উপরেই নির্ভরশীল। ফলে
রিয়্যাকটারগুলো আরো অনেক বড়ো।
[৪]
রোবোটের দল
উদ্ধারকার্যে নেমে পড়েছে। পথে ঘাটে মৃত মানুষ ও পশুপাখিদের তুলে সীসার বাক্সে
ভরছে। অসুস্থদের জন্য বিশেষ হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। যারা বেঁচে আছে, তাদের পুঙ্খানুপুঙ্খ
পরীক্ষা চলছে। যারা সুস্থ, তাদের পুনর্বাসনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর যেসব দুর্ভাগা
তাদের শরীরে তেজস্ক্রিয়তা বহন করছে, তাদের আলাদা করে রাখা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষেরা
সবাই একমত – যে এদের আলাদা রাখাই শ্রেয়। বেলোজারস্কির তেজস্ক্রিয়তার সীমার বাইরে
একটা বসতি তৈরি করে ওদের রাখা হবে। তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের জাপানের মতো
কয়েক প্রজন্ম বিকলাঙ্গ শিশু দেখতে হবে না কাউকে। আরও একটা সুবিধা আছে।
ফিসফিসিয়ে বললেন এক কর্তা – বাফার জোন। বুঝলেন
কিনা!
ঝটপট মাথাগুলো সায়
দেবার ভঙ্গীতে নড়ে উঠলো। সইসাবুদ হতে পাঁচ মিনিটও লাগলো না। আফানাসি বেঁচে থাকলে
হয়তো বলতেন, মানুষ আজও অমানবিকই রয়ে গেছে।
[৫]
তারপর... গড়িয়ে চলে
দিন; পেরিয়ে যায় বছর। শান্ত নিস্তরঙ্গ দীঘির মতোই বয়ে চলে গ্রামের জীবন। আর সেই
দীঘির মতোই শান্ত স্থির ইগর, ইয়েলেনাদের দিনযাপন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? একটু ভিতরে উঁকি মারলেই দেখা যায়,
চারপাশের ওই পাঁচিল, ওদের ঊনিশ-কুড়ির তারুণ্যকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। যেমন, ইগর
মাঝে মাঝেই ভাবে পাঁচিলটা ডিঙিয়ে যাবার কথা। সে দেখতে চায়, ওপারের দুনিয়াটা ঠিক কি
রকম। নিকোলাইদাদুর পাঠশালায় সে তার আভাস পায়, কিন্তু নাগাল পায়না। কিন্তু সে জানে,
কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে বড়ো নির্মম। তাদের দুনিয়াকে তারা যে কোন মূল্যে এই
তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে চায়। পাঁচিল পেরোনোর একমাত্র শাস্তি
মৃত্যু।
ইয়েলেনা অপেক্ষাকৃত
শান্ত। পাখি তার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। একমাত্র ওই জীবটাই এসব বাফার জোনের
তোয়াক্কা করে না। ওপার থেকে হামেশাই চলে আসে এপারে। পাঁচিলের তিনদিক থেকেই তারা
আসে। চার নম্বর দিকে আছে, না না, ছিল – বেলজারস্কি নামে একটা শহর। ইয়েলেনার মতো
পাখিগুলোও জানে, সেখানে কোনো প্রাণের স্পন্দন নেই। পরিত্যক্ত সেই শহরটা নাকি ছিল
ওদের পূর্বজদের বাসভূমি।
নিকিতা জেঠুর সঙ্গে কর্তৃপক্ষের
লোকেদের কথা হয় মাঝে মাঝে। তার মাধ্যমেই ওরা এদের খবরাখবর নেয়। তা সেই নিকিতা
জেঠুই ইগরের ঠাকুমাকে চুপিচুপি বলছিল কথাটা। কিন্তু ঠাকুমার কান্নায় ঘুম ভেঙে
গিয়েছিল ইগরের। চুপি চুপি কান পেতেছিল দরজায়। আর বোবা আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
অথচ ভেবে দেখতে গেলে
ব্যাপারটা সেরকম কিছু মারাত্মক নয়। অনেকদিন তো হলো। প্রায় পঞ্চাশ বছর। একটা
দুর্ঘটনার জের আর কতোদিন টানবে রাষ্ট্র? এর একটা শেষ স্বাভাবিকভাবেই হওয়া উচিত এবার। তাই কর্তৃপক্ষ
সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গণ নির্বীজকরণ করা হবে। যাতে এই ‘লটটা’ ( হ্যাঁ, ঠিক এই শব্দটাই ব্যবহার করেছিল
নিকিতা জেঠু) শেষ হয়ে গেলে রাষ্ট্রের দায় দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়।
সেদিন খেলার মাঠে খেলা
জমল না। ইগরের আনা খবরটার পরে জমা সম্ভবও ছিল না। খাঁচায় পোরা পাখির মতো ছটফট করছিল ছেলেমেয়েদের দল।
মিচেলের মাথা গরম চিরকাল। সে রাত্রির অন্ধকারে পাঁচিল ডিঙিয়ে পালাতে
গেল। বোঝাই যাচ্ছে, রোবোটদের কার্যক্ষমতার পরিমাপ সে ঠিকঠাক করতে পারেনি। কারণ
পরদিনই দুটো রোবোটকে একটা কবর খুঁড়তে দেখা গিয়েছিল।
[৬]
কয়েকদিন পর। বাদামগাছটার তলায় বসে এইসবই আলোচনা করছিল দুজনে। ইগর আর
ইয়েলেনা। ইগর বলছিল –
-
যেতেই হবে। এই
বন্দীজীবন, পাঁচিলের ওপারের বিবেকহীন নৃশংস জগত – সবকিছু থেকে অনেক দূরে চলে যেতে
হবে। একটা নতুন দুনিয়া গড়বো আমরা ...
কথার মাঝখানেইচেঁচিয়ে
উঠলো ইয়েলেনা –
-
দেখ,
দেখ ইগর, পাখিটা.... পাখিটা...
উত্তেজনায়
বেচারির মুখ থেকে বাকি কথা আর বের হয় না। ইগর রেগে ওঠে –
-
হচ্ছে একটা সিরিয়াস
কথা। এতোবড়ো সমস্যা সামনে। আর উনি বসলেন পাখি দেখতে!
-
তুই বুঝছিস না
ব্যাপারটা? পাখিটা...
-
চুপ করবি উজবুক
কোথাকার! কি করবি? পাখির পিঠে চেপে উড়ে যাবি? যত্তোসব!
-
আমি উজবুক, না তুই
অন্ধ? দেখলি না, পাখিটা এলো লাল পাঁচিলের ওপার থেকে?
-
লাল, নীল সাদা - যে রঙের পাঁচিলই হোক না কেন, তাতে কি যায়
আসে?...
.....
.....
দাঁড়া দাঁড়া, কি বললি?
লাল পাঁচিল? তার ওপারে তো সেই মৃত্যুপুরী? রেডিয়েশনে ভরা মৃত শহর। সেখান থেকে পাখি
আসে কি করে?
-
সেটাই তো বলছি। শুনছিস কোথায়? চিরকালের গোঁয়ার আর তড়বড়ে
কোথাকার!
-
সরি, সরি। কিন্তু কিভাবে এটা সম্ভব? তুই ঠিক দেখেছিস?
-
প্রিপেতের কথা ভুলে
গেলি? চেরনোবিল
দুর্ঘটনার তিরিশ বছরের মধ্যেই ওখানে গাছপালা, এমন কি পশুপাখিও এসে গিয়েছিল।
প্রকৃতি আমাদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী রে। এখানে পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে। ইগর, পাখি
যদি থাকতে পারে, তাহলে আমরা কেন নয়? যাবি ওদিকে? ইগর?
উত্তেজনায়
ইগরের গলা কাঁপতে থাকে – লাল পাঁচিলের ওপারে পাহারাও থাকে না। পাখি আছে মানে
গাছপালাও আছে। তবে কি অবস্থায়...
-
আমাদের তো হারাবার
কিছু নেই। - ক্লান্ত অথচ প্রত্যয়ী গলায় বলে ইয়েলেনা।
হারাবার কিছু নেই,
হারাবার কিছু নেই – মাথার মধ্যে তিনটে শব্দ পাক খেতে থাকে। গোল গোল ঘুরতে ঘুরতে
অবশেষে একটা চেহারা নেয়। দুটো মাথা থেকে চার মাথা হয়, চার থেকে ছয় .... তানিয়া
একটা একটা করে শব্দ গুণে গুণে বলে,
-
ওদিকেই গিয়ে দেখতে হবে। পাখি আছে যখন, গাছও আছে। তার মানে জল, ফল..
-
পশুও থাকতে পারে –
সাশার আশাবাদী গলা শোনা যায়।
-
কিন্তু রেডিয়েশন? –
মাতিশকার দ্বিধাজড়ানো স্বর।
-
রেডিয়েশনের ভয়
পাচ্ছিস? পাখিরা যদি সইতে পারে, আমরাও পারব। - সেরগেইয়ের আওয়াজ পাওয়া গেল
এতোক্ষণে।
-
যাবি কি করে? লাল
পাঁচিলের উপর হাই ভোল্টেজের কারেন্ট থাকে, ভুলে গেলি? – তাতিয়ানার চিন্তিত গলা।
সবাই চমকে উঠলো। এটা তো খেয়াল হয়নি! কালো হয়ে গেল মুখেরা। নীচু হয়ে এল জ্বলজ্বলে চোখগুলো।
-
একটাই পথ আছে। তবে
কতোটা ঠিক জানিনা। - তানিয়া খুব ধীরে ধীরে বলল।
সবকটা চোখ আবার ঝলসে উঠলো।
-
বল্ তো! তারপর ভাবা
যাবে।
-
বাবা আর দিমাকাকুকে
ডেকেছে নিকিতা জেঠু। লাল পাঁচিলের কিছু অংশ মেরামত করা হবে। কাল থেকে কাজ শুরু
হবে। ওরা যখন ওপরটা মেরামত করবে, তখন খানিকক্ষণের জন্য বিদ্যুত যোগাযোগ বন্ধ করতেই
হবে। একমাত্র সেই সময়েই যদি...
-
সেই সময়টা কখন?
-
জানিনা। খবর নিতে হবে।
-
খুব সাবধান। কেউ টের
না পায়।
শেষমেশ খবরটা আনলো অ্যালেক। শোনা গেছে ওই কাজটা
ওরা রোবোট দিয়ে করাবে। শনিবার রাত একটা থেকে দুটোর মধ্যে কাজ হবে। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের ফলে, পুরো এলাকায় যে
ক্ষোভের হাওয়া বইছে, তা ওদের নজর এড়ায়নি। তাই রাতটাই বেছে নিয়েছে কাজের জন্য।
মাথা নাড়লো মাতিশকা। বললো, তুই ভুল করছিস, সময় সাড়ে বারোটা থেকে দেড়টা।
ইয়েলেনার মাথা খুব
পরিস্কার। বললো, দেখ,
আমাদের হাতে দুটো পথ আছে। যাবো অথবা যাবো না। আমি ঠিক করেছি, এই রিস্কটা নেব। কমন
সময় রাত একটা থেকে দেড়টায়। হয় ওপারে যাবো, নইলে মরবো। তোরা কি করবি ভেবে দেখ।
ইগর হাত তুললো – ভাবার
কিছু নেই। আমি আসছি।
একে একে আরো ছয়টি হাত
সম্মতিতে উঠলো।
[৭]
শনিবারের রাত। জায়গা
আগেই বাছা হয়েছিল। এই ঝাঁকড়া গাছটার জন্য এদিকটা একটু ঝুপসি মতো। চট করে কারো নজরে
পড়বে না। বারোটার মধ্যেই একে একে আটজন জড়ো হলো।
নিঃশব্দে একে অন্যের হাত চেপে ধরে আছে। খবরে ভুল থাকলে এটাই ওদের শেষদিন। ঠিক
একটায় মানুষের পিরামিড বানালো বাকি সাতজন। তার উপর চড়ে, ঠিক একটা দুইয়ে আংটা
লাগানো দড়িটা ছুঁড়লো সেরগেই। আটজনের মধ্যে খেলাধূলায় সবচেয়ে দড় ওই। প্রথমে হলো
না। আর একবার। তিনবারের বার আংটাটা আটকে
গেলো পাঁচিলে। টেনে দেখলো সেরগেই। তারপর বাঁদরের মতো উঠে গেলো দড়ি বেয়ে। সে
বলেছিল, বেঁচে থাকলে দড়িটা ঝাঁকিয়ে সংকেত দেবে বন্ধুদের। তারপর সবাই উঠবে। মাথা
নেড়েছিল তানিয়া – নাহ্। যা হবার একসাথে
হবে।
ঝাঁকুনির অপেক্ষা কেউ করেনি। তার আগেই পরপর দড়ি
বয়ে উঠে গিয়েছিল। এখনো অবধি সব ঠিক আছে। দড়িটা তুলে ওপারে ফেলল সেরগেই। দ্রুত নেমে
এলো আটজনেই। সবাই ঠিকঠাক ভাবেই নামতে পেরেছে। এপারটা কেমন, তা এই জমাটবাঁধা অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না।
তারার হালকা আলোয় শুধু ঘন আঁধার আর হালকা আঁধার। এ ওকে ছুঁয়ে দৌড় শুরু করল ওরা। যত
দূরে চলে যাওয়া যায়।
প্রথমে দৌড়, তারপর
হাঁটা, অবশেষে ক্লান্ত হয়ে বসা। ইয়েলেনা বলল – আর বেশি গিয়ে কাজ নেই। দিক ভুল করে
আবার যদি পাঁচিলের কাছাকাছি গিয়ে পড়ি, তাহলে আর দেখতে হবে না। আগে একটু আলো ফুটতে
দে।
কথাটা সবার মনে ধরলো। বসলো ওরা গায়ে গা লাগিয়ে।
পাছে কেউ হারিয়ে যায়! তারপর? তীব্র উত্তেজনা ও শ্রান্তির পরে কখন যে দুচোখ জুড়ে
ঘুম নেমেছে, কেউ জানে না।
গায়ে রোদ পড়তে ঘুম
ভাঙলো। চারপাশ দেখে অবাক হয়ে গেল ওরা। এই জায়গাটা কোন একসময় বিরাট বাধানো চাতাল
ছিল। এখন তা ফাটিয়ে গাছ গজিয়েছে। পাশে একটা বিশাল বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। আর একটু গিয়ে
যেটা দেখল, সেটা বোধহয় কখনো চওড়া রাস্তা ছিল। এখন ঝোপঝাড়ে ঢাকা সুঁড়িপথ। আধিকাংশই
কাঁটাঝোপ। তবে বেশ কিছু বড় সবুজ গাছও আছে। এতো তাড়াতাড়ি প্রকৃতি তার কাজ শুরু
করেছে? ওদের অবাক হওয়া ক্রমশঃ বাড়ছিল।
রাস্তার দুপাশে বাড়ি।
তার দেওয়ালে মেঝেতে গাছ। মনে হচ্ছে অরণ্য যেন যতো তাড়তাড়ি সম্ভব, মানুষের চিহ্ন
মুছে ফেলতে চায়। তবু তারই
মধ্যে একটা মোটামুটি বাসযোগ্য ঘর খুঁজে পাওয়া গেল।
তানিয়া বলল – এবার?
ইয়েলেনা বলে – আমাদের
সঙ্গে যেটুকু খাবার আর জল আছে, তাতে দুদিন চলে যাবে। এর মধ্যে আমাদের খাবার আর জল
খুঁজে নিতে হবে।
তাতিয়ানা বলে – আমাদের
পালানোর খবর এতোক্ষণে সবাই জেনে গেছে। খোঁজ করতে ওরা হয়তো ড্রোন বা হেলিকপ্টার
পাঠাবে। কাজেই খোলা আকাশের তলে কেউ থেকো না। সাবধানে চলবে।
ইগর মাথা নেড়ে সায় দেয়
– এটা ভালো বললি তাতিয়ানা। এবার আমি একটা সুখবর দিই। সকালে আসবার সময়, আমি একটা
শেয়াল দেখতে পেয়েছি। তার মানে খাবার পাওয়া যাবে।
সাশা উৎসাহিত হয়ে উঠল –
শেয়াল আছে মানে খরগোস জাতীয় প্রাণী আছে। জলও পাওয়া যাবে তাহলে। আমার গুলতিটা কাজে লাগবে মনে হচ্ছে।
-
ঘরের মধ্যে আগুন
জ্বালালে কেউ টের পাবে না – খুশি হয়ে উঠলো অ্যালেক।
-
যে যেদিকে যাবি, চিহ্ন
দিয়ে যাবি। নয়তো হারিয়ে গেলে খুব মুসকিল – বুদ্ধি দিলো সেরগেই।
মাতিশকা, পাকা গিন্নি। সে চটপট সবার হাতে একটা করে রুটি ধরিয়ে দিল – খেয়ে নিয়ে বেরো
তোরা। আমি আর
তাতিয়ানা ততক্ষণে জায়গাটা একটু পরিষ্কার করে নিই।
সাবধানী
তাতিয়ানা বললো – কিন্তু রেডিয়েশন?
হেসে উঠলো
সাতমূর্তি। সাতরঙা রামধনুর আলো ছড়িয়ে পড়লো যেন। তানিয়া ওর মাথায় হালকা চাঁটি মেরে
বলল – ওরে আমাদের জিনেও তো আছে। মানে তোর ওই রেডিয়েশন? দেখাই যাক না। এমনিতেও
তো....
তাতিয়ানাও
হাসলো এবার – ঠিক রে। এমনিতেও তো – কিন্তু না, একথা আলোচনা করার সময় এটা নয়।
কর্তৃপক্ষের লোকেরা অন্ততঃ এখানে আসবার সাহস করবে না।
[৮]
তা খুঁজে পেলো
ওরা। জলাশয়, ফলের গাছ, কয়েকটা খরগোশ – এমনি অনেক কিছু। মাতিশকা একটা লাইব্রেরি
পেয়ে খুব উৎসাহিত হয়ে উঠলো।
তিন-চারদিন
কেটে গেছে। মাঝে মাঝে ড্রোনের আওয়াজ পায়। লুকিয়ে পড়ে তখন। তবে আস্তে আস্তে খোঁজা কমছে, বোঝা যায়। আসলে
হিসেবমতো ওদের তো বেঁচে থাকার কথা নয়। তবু বেঁচে আছে ওরা। শুধু বেঁচে নেই,
পরিত্যক্ত শহরটাকে আঁতিপাতি করে ঘুরে দেখছে। এমনিই ঘুরতে ঘুরতে একদিন তাতিয়ানা জল
চাইল ইগরের কাছে – তোর বোতলটা দে তো। তেষ্টা পেয়ে গেছে।
কোথাও কিছু
নেই ইয়েলেনা গম্ভীর হয়ে উঠলো হঠাৎ - এই তোর, আমার – শব্দগুলো অভিধান থেকে মুছে
ফেলতে হবে রে তাতিয়ানা। এই শব্দদুটো হচ্ছে যতো নষ্টের গোড়া। এই ওদের, আমাদের
ইত্যাদিদের ঝেড়ে ফেলে একটা নতুন দুনিয়া বানাই চল। যেখানে কেউ কাউকে ছেড়ে যাবো না।
কাউকে আলাদা করে দেবো না।
ফটাফট
হাততালির শব্দে কয়েকটা পাখি চমকে উড়ে গেল। তাতিয়ানাও হাসল। বলল – ইগর বোতলটা দে জল
খাই। এবার ঠিক আছে ম্যাম?
-
এতো বেশি হল্লা করিস
না। সার্চ পার্টির কথাটা মাথায় রাখিস।
ছয়দিনের মাথায়
ওরা সমুদ্র দেখতে পেল। কোবাল্ট নীল অথৈ জলরাশি। গল্পে শোনা সীগালদের দেখতে পেলো না
কিন্তু! নির্জন সৈকতে, মাথার উপর সাদা ফেনার মুকুট পরে, নীল ঢেউয়ের দল একের পর এক
এসে, তীরভূমিতে আছড়ে পড়ছে। ঢেউ ভাঙার আওয়াজ ছাড়া যেন পৃথিবীতে আর কোনো শব্দ নেই।
অনেক দূরে হালকা নীল আকাশ জলের সঙ্গে মিলে
সীমনার বিভ্রম তৈরি করছে। এই ওদের প্রথম সমুদ্র দেখা। এই বিশালতার সামনে ওরা নতজানু হলো। একে একে ওদের ভিতর
থেকে মন্ত্রোচ্চারণের মতো কথারা একে একে বের হয়ে এলো।
ইগর বলল –
আমরা এমন বিশাল হবো।
তানিয়া বলল –
এই বালুকার মতো মিশে থাকবো একে অপরের সাথে। কিন্তু কারো দম বন্ধ করে দেব না।
ইয়েলেনা বলল –
আমরা আকাশ হব। সব সীমা ছাড়ালেও নেমে এসে সমুদ্রের সঙ্গে মিলতে বাধা পাব না।
সেরগেই বলল – আমরা
প্রকৃতির অংশ হয়েই থাকব।
মাতিশকা শুধু
বলল – ওরা কি আমাদের বাধা দেবে না? ড্রোন পাঠিয়ে খুঁজে পায়নি। রোবোট নামায় যদি?
সবাই একসঙ্গে
বলে উঠলো – আমরা একসাথে প্রতিরোধ গড়ব। এ লড়াই বাঁচার লড়াই। পৃথিবীকে বাঁচানোর
লড়াই।
শুধু সমুদ্র
নির্বিকার রইল। তার নীল জল আগের মতোই ছলাত ছল শব্দে বেলাভূমিতে আছড়ে পড়তে থাকল।
সে অতীত
দেখেছে। বর্তমান দেখছে। ভবিষ্যৎও সে দেখবে। কেমন হবে সেই দিন? কে জিতবে এই অসম
লড়াই? সে জানে না। দেখতে চায়। আজ শুধু সে একটা বড়ো ঢেউ তুলে, ছেলেমেয়েগুলোর পা
ভিজিয়ে দিল।
||দোলা সেন||
No comments:
Post a Comment