ভোরের লালচে আলোটা এখনো সাদা হয়নি ভালো
করে। কিন্তু ভোরের এই হালকা শিরশিরে আমেজে চাদর টেনে ঘুমোবার বিলাসিতা আর যার
জন্যেই হোক, তিত্তিদের জন্য নয়। সে এর মধ্যেই চা বানিয়ে ফেলেছে। নানকুকে একগ্লাস
চা আর বাসি রুটি ধরিয়ে নিজের গেলাসটি নিয়ে দাওয়াতে আয়েস করে বসল। নোনা ভিজে হাওয়ায়
ওর অগোছালো চুল আরোই এলোমেলো। সেটা ঠিক করতে গিয়ে আঁচলটা একটু সরে গেল। নানকু
বউয়ের দিকে চোখ মটকে একগাল হাসল। তিত্তি কাপড় ঠিক করতে গিয়ে ভুরু কোঁচকালো। - শরম
নাই?
ঘরের মধ্যে ঘুমন্ত ছেলেমেয়েদের দিকে
তাকিয়ে, লোকটার উপর আরেকবার
ঝাঁঝিয়ে উঠতে গিয়েও পারল না। বরং গালে লালের আভা লাগল। এই মুহূর্তে তিত্তির চেয়ে
সুখী মানুষ দুনিয়ায় আর নেই।
এই সকালটুকুই যা সময়। ওদের চা খাওয়া
শেষ হতে না হতেই আসপাশের বাড়ির উনোনেও আগুন পড়ে গেছে। মাছের আঁশটে গন্ধের সঙ্গে
কয়লার ধোঁয়ার কটু গন্ধটাও মিলেমিশে যাচ্ছে। তবে এতে অসুবিধে হলে জেলেপাড়ার লোকজনের
চলে না।
চা খাওয়া শেষ। তিত্তি উঠে আরেকবার
আড়মোড়া ভাঙল। কেটলির চাটা আরেকবার গরম করে উনোনে এক ডেকচি আলু সেদ্ধ বসিয়ে দিল।
ছেলে মেয়েদের জন্য কিছুটা রেখে বাকিটুকু ছোট একটা ঘটিতে ঢেলে নিয়ে চলল। গেলাসের
গরম হাতে মাখতে মাখতে নানকু বৌকেই দেখছিল। সারাদিনের এতো খাটাখাটনির পরেও বৌটার এখনো
কেমন সরু কোমর, চলার ঠমক – ওর নেশা নেশা লাগছিল। চলতে চলতেই এই নজরটা টের পেল
তিত্তি। ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসিমুখেই ঝামরে উঠল – বইস্যে বইস্যে তাকলে চইলব্যে? ছিলা
মেয়্যা গুলাকে উঠাও এবার। চা রুটি খায়্যে লিতে বুলো।
চারটে ঘর পেরিয়ে একটা ঝুপড়ি। তিত্তি
এদিক ওদিক তাকিয়েও পানিবুঢ়াকে দেখতে পেল না। এই সাতসকালে সে গেল কোথায়? অন্যদিন তো
এই দাওয়ায় বসেই তিত্তির আনা চায়ের জন্য অপেক্ষা করে। ঘরের ভিতরটা একবার উঁকি মেরে
দেখে নিয়ে হাঁক পাড়ল তিত্তি – বুঢ়া, তুই কই গেলি?
ঝুপড়ির পিছন থেকে একটা লাউ হাতে বেরিয়ে
এল পানিবুঢ়া। তার ফোকলা মুখে একগাল হাসি – পিছগাদায় হইছিল রে। নে যা।
পানিবুঢ়ার আসল নাম কেউ জানে না। কে যে
ওর এই নাম দিয়েছিল, এতোদিন পরে পানিবুঢ়া নিজেই মনে করতে পারে না। কিন্তু নামটা যে জব্বর দিইছিল, তা
সব্বাই একবাক্যে স্বীকার করে। সাগরজলের রং, গন্ধ ওর মতো কেউ চেনে না এ তল্লাটে। এই
পাড়ার কোনো মাঝি ওকে না বলে নৌকা ভাসায় না। তবে শুধু এই নয়, বিপদে আপদে সবাই
পারামর্শ নিতে পানিবুঢ়ার কাছেই আসে।
বুঢ়াকে চা দিয়ে তিত্তি মেঝেতে পা ছড়িয়ে
বসে – কাল দামু এইছিল?
সুড়ুৎ করে ঘটিতে একটা লম্বা চুমুক দেয়
বুঢ়া – এইছিল তো। কাল ডাল, ভাত আর আচার পাঠাইনছিল। তা বুইলি নাতিন, দামুর বৌটা বড়
ভালো রাঁধে হে!
আরেকটা লম্বা চুমুক দিয়ে সে উদাস চোখে
আকাশ দেখে।
তিত্তি ফোঁস করে ওঠে অমনি – জিভে খুব সোয়াদ লাগিছে, তাই না? দুপুরের
ব্যাঞ্জনে এমন নুন দিব যে, জিভ পুইড়ে যাবে। সোয়াদ লাগা ঘুচি যাবে।
ঢক ঢক করে মাথা নাড়তে থাকে বুঢ়া। ওর
কোঁচকানো মুখটা অনাবিল হাসিতে ভরে যায়। এই বকুনিটা খাবার জন্যেই তো কথাটা বলা।
তিত্তির এই ঠোঁট ফোলানো, ঘাড় বাঁকিয়ে চাওয়া, ধুপ করে হাতের জিনিস দাওয়ায় নামিয়ে
দেওয়া – এই সব কিছুই তাকে বিজলির কথা মনে পড়িয়ে দেয়। সেই ছোট্ট মেয়েটার আধভাঙা
হাসি, কথার সঙ্গে তিত্তির বড়ো মিল।
- মেয়্যাটা থাকলি পরে এতোদিনে হয়তো তর
মতোই ডাগর হইত – একটা দীর্ঘশ্বাস তার পাঁজরটাকে ভেঙে দিয়ে বেরিয়ে আসে।
তিত্তি জানে। তাই পরম মমতায় বুঢ়ার
মাথায় হাত বোলায় – উসপ কথা থাক না বুঢ়া। বুললে তোর কষ্ট হয়, দুখ জাগে। তার
চেয়ে আমার সাথকে চল, আমি রান্না কইরব, তু
বস্যে দেখবি। সব্জিটো, চালটো ধুয়্যে দিবি।
সেসব কথা পানিবুঢ়ার কানে ঢোকে না। তার
চোখ থেকে জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে। এতো জল যে কোথায় জমিয়ে রাখে বুঢ়া?
-
একটুস আরামের
লুভ, ভালোমন্দটা খাবার লুভ, খুব দুষের কি?দুষ যদি হয়, তবে তা এই অভাবের, এই দুখান
হাতের রে নাতিন। সারাদিন জাল ফেইল্যে যিটুক আনতম, তার বেশিটাই মহাজন লিয়ে লিত।
মুরুলীর ঘরে ভাত ছেলো। একবার মেয়্যাটাকে একটা রেশমী শাড়ি কিনে দিইছিল। মা-মরা
মেয়্যা আমার। বাধা দিতে লারলম। মুরুলীরে আমার কুনোদিনও ভালো লাগে নাই। তবু
ভেবেছিলম, বিহা হল্যে টুকু শুধরে যাবে।
তিত্তি উঠতে
গিয়েও বসে পড়ল। তার এখন ঘরে যাওয়া দরকার। নানকু এতক্ষণে দোকানে চলে গেছে।
ছেলেমেয়েদুটো উঠে কি করছে কে জানে? ছিষ্টির বাসি কাজ পড়ে আছে। তবু বুঢ়াকে ফেলে
যেতে মন চাইল না। একঘেঁয়ে ঘ্যানঘেনে সুরে বুঢ়া বলেই চলছিল – বিহার পরে ছিল্যাটা
কিছুদিন ভালো ছিল জানিস? উয়াদের একটা চাঁদের পারা বিটি হলো। আমি বলি বিজলির পারা।
নাম রাখলম বিজলি। মতির মেয়্যা বিজলি। তারে নিয়্যে মা-বাপের কতো সুহাগ। তারপর.....
পানিবুঢ়ার চোখ
এখন তিত্তিকে ছাড়িয়ে, নৌকাগুলা ছাড়িয়ে বোধকরি সমুদ্রটাকেও ছাড়িয়ে আরো দূরে উধাও
হয়ে গেছে – এতো সুখ কি সয়? একদিন সকালে মেয়্যাটা দেখে বিছানা খালি, তোরঙ্গের মধ্যি
জমানো টাকার থলি খালি। শুনা গেল গঙ্গার
বিটিটাকেও পাওয়া যাচ্ছে না – মেয়্যাটার জীবনটাই খালি হইয়ে গেল রে নাতিন। মতিকে আবার
ঘরে আইন্যে রাখলম। কিন্তুক আমার অমন হাসিখুশি মেয়্যাাটা জানি কেমনপারা হইয়্যে গেল।
তারপর তো সেই ঝড়ের রাতে –
হাঁটুর মধ্যে
মুখ গুঁজে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে পানিবুঢ়া। তিত্তি জানে ও এখন অনেকক্ষণ কাঁদবে।
সে লাউ আর ঘটি নিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে রওনা হয়। ছেলে মানুষ নয় তিত্তি। ও জানে
কিছু কান্না মানুষকে একাই কাঁদতে হয়।
সেই ঝড়ের
রাতের সমুদ্র একটু বেশিই ফুঁসেছিল। জল আর হাওয়ার আওয়াজে ওদের ঝুপড়িগুলো কেঁপে
কেঁপে উঠছিল। আকাশ চেরা বিদ্যুতের আলো ছাড়া দেখা যাচ্ছিল না কিছুই। সকাল হতে সবাই
সবার খোঁজ নিতে বেরিয়েছিল। তখনই দেখা গেল, মতি আর বিজলি নেই। নেই মানে কোথাও নেই!
অনেক খুঁজেও তাদের কোনো চিহ্ন কেউ দেখতে পায়নি। সেই থেকে পানিবুঢ়া জলে যাওয়া ছাড়ল।
ওর ঘরের পিছনে একফালি জমি আছে। সেখানে এটা সেটা লাগায়। তিত্তিকে দেয়। তিত্তি ওকে
সকালের চা, দুপুরে ভাত খাওয়ায়। রাতের খাবার নিয়ে আসে ওর শালা দামু। বুঢ়া ওর জাল,
নৌকা ওকেই দিয়ে দিয়েছিল তো! সেই কৃতজ্ঞতাতেই বোধকরি। তিত্তি হাসল। বুঢ়া সবজির
যোগান না দিলেও ও তাকে ভাত দিত। বুঢ়া যে তিত্তির মধ্যে দিয়ে ওর নাতনিকে দেখে, সে
খবর তার জানা।
কিন্তু আর না।
সুজ্জি জল ছাড়িয়ে অনেকটাই ওপরে উঠে এসেছে। তিত্তি তাড়তাড়ি পা চালাল। নানকু বাজার
করে এসে গেল কি?
বাড়িতে এসে
নিশ্চিন্ত। নানকু এখনো ফেরেনি। ছেলেটা খেলতে বেরিয়ে গেছে। বড্ডো বাইরে বাইরে মন
হয়েছে ওটার। মেয়েটা ঘর ঝাড়পোঁছ করে আলু নামিয়ে চাল বসিয়ে দিয়েছে। তিত্তি স্নেহের
হাসি হাসল। রতিয়াটা বড়ো হয়ে যাচ্ছে!
হাত পা ধুয়ে
তিত্তি আলুগুলো ছাড়াতে বসে। রতিয়া পাশে চুপটি করে বসে থাকে। তিত্তি ওর হাতে দুটো আলু দিতেই ওর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে
ওঠে। বড়াভাজা তার খুব প্রিয়। সে কুচি কুচি করে পেঁয়াজ লঙ্কা কাটতে বসে। বাবা এলে
বেসন দিয়ে ভাজবে। মুড়ি মেখে খাবে সবাই মিলে।
এই সময়টা
সুখের সময়। এবার অনেক মাছ ধরা পড়েছে। নানকু পানিবুঢ়ার হাতে তৈরি জেলে। সে নির্ভুল
বলতে পারে কোনদিকে গেলে বড়ো মাছের ঝাঁক পাওয়া যাবে। তাই মহাজনের কাছে তার আলাদা
খাতির। পয়সাও পায় একটু বেশি।এখন কিছুদিন সে বাড়ি থাকবে। ভাবতেই তিত্তির গালে একটু
লালের ছোপ লাগল আবার। রতিয়ার দিকে চাইল চুপি চুপি। রতিয়ার অবশ্য কোনোদিকে খেয়াল
নেই। সে একমনে আলুমাখায় বেসন মেশাচ্ছে।
ওই নানকু এল।
কোথায় ছিল জগন, দৌড়ে এসে বাপের হাত থেকে থলেটা নিয়েই চেঁচিয়ে উঠল – মা বাপু মাংস
লিয়ে এয়েচে গো। ও মা দ্যাখ, দ্যাখ!
তিত্তিও একটু
ভুরু কোঁচকায় – ব্যাপারটা কি গো রতিয়ার বাপু? মুখখান আজ য্যান একটু বেশি খুশি?
নানকু দাওয়ায়
বসে গামছা দিয়ে ঘাড় মোছে।
-
আজ বড়ো খুশির
খবর রে তিত্তি! আগে মাংসটা রাঁধ দিকি জমিয়ে।
খাবার জলের
ঘটিটা এগিয়ে দিয়ে ঝামটা দেয় তিত্তি – হেঁয়ালি রাখ্যে বলো দিকি কি হইছে?
-
অধরের সাথে
বাজারে কথা হলি যি গো। আজ বিকেলেই উয়াদের বাড়ি যাব।
-
আবার হেঁয়ালি
করে?
এপাশ ওপাশ দেখে টুক করে বৌয়ের থুতনিটা নেড়ে দেয় নানকু। রেগে উঠতে
গিয়েও হেসে ফেলে তিত্তি – ইঃ, খুব যে রসের বান ডাকিছে। বলি, কথাটো কি?
-
অধর রতিয়ার
কথা শুধাচ্ছিল। বেটার বিহা দিবার লগে।
-
কে পরান?
-
হ। ছিল্যাটা
ভালো। পালটি ঘর বটে। তু কি বলিস?
-
হলি তো ভালোই
হয়। জানা বর, ভালো ঘর বটে।
বলতে বলতেই
তিত্তির মুখে চিন্তা ঘনায় – হাঁ রে, উয়ারা অনেক পণ লিবে নাই তো। ঘরে যিটুক আছে....
-
আগে আগে এতো
ভাবিস নাই। আজ বিকেলে যায়্যে কথা বুলবো তো! আর বিটিছানা পারাইতে পয়সা তো লাগবেকই।
তা কথা হলো।
পরানের বাবা নগদ কিছুই নেবে না। মেয়ের হার, চুড়ি, দুল। বরের সোনার আংটি আর একটা
মটর সাইকেল – ব্যস!
তা তিত্তি
খুবই সুগৃহিণী বলতে হয়। সে অনেক দিন ধরে পয়সা জমিয়ে মেয়ের জন্য হার আর চুড়ি গড়িয়ে
রেখেছে। যেটুকু পয়সা আছে, তাতে আংটি, দুল আর বিয়ের খরচ উঠে যাবে। কিন্তু মটর
সাইকেল?
করুণ মুখে
আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে তিত্তি – ছাইড়্যে দে রে জগনের বাপ। অতো পয়সা কুথায় পাবো!
ছিল্যাটা ভালো ছিল বটে। কিন্তুক ... তু মন
ছুট করিস না রে। রতিয়ার জন্য অন্য ছিল্যা দেখবো আমরা।
নানাকু কোনো
জবাব দেয় না। অধরের ঘর দুয়ার ভালো। মাছ ধরা ছাড়াও একটা চালু মুদীর দোকান আছে ওদের।
অধরের বৌটাও বেশ হাসিখুশি আর শান্ত মনে হলো।
-
মেয়্যাটা বড়ো
সুখে থাইকতো গো!
কাল সে একবার
মহাজনের কাছে যাবে। যদি কিছু ধার পাওয়া যায়। অধরের সাথেও কথা বলবে আবার। যদি একটু
কমে রাজি হয়ে যায়! পরানের নাকি আবার রতিয়াকে খুব পছন্দ! তাই বাবাকে ধরে পড়েছে।
হাসতে হাসতে অধরই বলছিল সে কথা। সেটুকুই আশা নানকুর।
কিছুদিন দৌড়াদৌড়ি,
দরাদরির পর একটু আশার আলো দেখা গেল। অনেক চাপাচাপির পরে অধর মটর সাইকেলের বারো আনা
দাম নিতে রাজি হয়েছে। বাকি চার আনা না হয় সেই দেবে। ছেলের বাপের এহেন উদারতায়
নানকুর হৃদয় বিগলিত হয়ে যায়। তবুও, বারো আনা দামটাও যে অনেক!
এরই মধ্যে
মহাজনের কাছে তার ডাক পড়ে। সে নাকি একটা বড়ো বরাত পেয়েছে। তাই নানকু যদি এর মধ্যে
ট্রলার নিয়ে সমুদ্রের যেতে পারে, তাহলে সে নানকুর মটর সাইকেলের সমস্যা মিটিয়ে
দেবে। প্রায় দিন পনেরো কুড়ির ধাক্কা।
আশাতীত
সৌভাগ্যের আনন্দে নানকু প্রায় নাচতে নাচতে বৌকে খবরটা দিয়েছিল। পরদিন তিত্তি
পানিবুঢ়াকে সে কথা বলতেই তার মুখে চিন্তার রেখা দেখা দেয় – এ সময়টা ভালো লয় নাতিন।
পনেরো কুড়ি দিন? দুদিন আগেই কতগুলা কছুয়া ইদিকে আসেছিল। পরশুও এসিচে। লক্ষণ ভালো
লয় রে নাতিন।
নানকুকে বলতে
সে হেসে উড়িয়ে দিল। বুঢ়ার আজকাল বেশি ভয় হইনছে রে বৌ। আকাশ একদম সাফা।
-
পানিবুঢ়া কছুয়ার কথা বুলছিল রে জগনের বাপ!
-
আমি জানি। উ তো
একটা না দুটো এইচে। হয়তো পথ ভুলে। পানিবুঢ়া আজকাল বেশি ভয় পায়।
কথাটা অবশ্য
সত্যি। যতো বয়েস বাড়ছে, তত ভয় বাড়ছে পানিবুঢ়ার। ওর সব কথা শুনতে গেলে নৌকা ভাসানো
বন্ধই করে দিতে হয়। সমুদ্রে যেতে গেলে অল্প বিস্তর ঝুঁকি যে নিতেই হয়, সেটা বুঢ়া
আজকাল বুঝতেই চায় না। তবু তিত্তির মন খুঁতখুঁত করে। নানকু সান্ত্বনা দেয় – একটু
ভিতর বাগে গেলি বড়ো মাছের ঝাঁক পেইয়্যে যাব। বরাতের মাছ হলিই ফিরি আসব। তালি তো
হপে? যতো তাড়াতাড়ি পারি কাজ শেষ কইরে আসি যাব।
মুখে যতই বলুক
নানকু, গভীর সমুদ্রের জীবদের হঠাৎ ডাঙার দিকে আসা তারও ভালো ঠেকে নি। তবে ওরা ওই
দুদিনই এসেছিল। তারপর আর আসেনি। যেতে আরও একদিন দেরি আছে। রেডিওতেও কোনো আশঙ্কার
খবর নেই। কালও যদি কোনো সতর্কবার্তা না থাকে, তাহলে সে যাবেই। মেয়েটার জন্য বাপ হিসেবে
এটা তার কর্তব্য।
নানকু আর তার
সেথো মেছুরেরা পুজো পাঠ সাঙ্গ করে দরিয়ায় ভাসলো। ঝলমলে দিন, নিদাগ আকাশ। পানিবুঢ়াও
বলল – মনে লয়, মিছাই ভয় পাইছিলাম রে নাতিন। ভালোয় ভালোয় ফিরে আসুক সবাই।
*
*
*
*
সাত, আট, নয়,
দশ.... দিন পার হয়। এগারো দিনের দিন জলের রঙ কেমন যেন কালো দেখায়। জলে কিসের যেন
গন্ধ পায় পানিবুঢ়া। দু হাত তুলে প্রার্থনা করে, বিড়বিড় করে। তেরো দিনের মাথায়
ইথারে সতর্কবার্তা ভেসে আসে – সমুদ্র থেকে নাবিকদের ফিরে আসতে বলা হচ্ছে। একটা
ঝড়ের পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে। তিত্তিদের মুখ শুকায়। থেকে থেকে জলের ধারে এসে দেখে,
দিকচক্রবালরেখায় কালো বিন্দুগুলি দেখা যাচ্ছে কিনা। তা বিন্দুগুলো ধীরে ধীরে নৌকা
হয়ে ফেরে বৈকি। এক দুই করে ফিরছে জেলের দল। ফেরার খুশি আর না- ফেরার চিন্তায় ভারি
হয়ে উঠছে তীরের বাতাস। তিত্তিও রোজ যায়। নানকু তো এখনো ফিরল না! এদিকে ঘন কালো
হচ্ছে সাগরের জল। আকাশও থমথমে। পা থেকে একটা ভয় তিরতির করে মাথার দিকে ওঠে। ষোলদিনের
দিন দানোর মতো আছড়ে পড়লো ঝড়। কয়েকঘণ্টা ধরে ছিনিমিনি খেললো জল, নৌকো, ঘরদুয়ার
নিয়ে। তারপর হঠাৎ যেমন এসেছিল, তেমনই চলে গেল।
রোদ উঠলো। জল আবার নীল হলো। ভাঙা বাড়ির ছাদ, দেয়াল
মেরামত শুরু হলো। নানকু তখনো এলো না। তিত্তি রোজ সন্ধ্যে হলেই বড়ো পাথরটার উপর আলো
জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাতিঘরটা ভেঙে গেছে। নানকুকে আলো দেখাতে হবে না? সে পাকা
মাঝি। তিত্তি ঠিক জানে, একদিন সে ঠিক ফিরবে ঝড় পার করে। ফিরবেই। সে তাই অপেক্ষা
করে আলো হাতে। সারারাত থাকে। সকাল হলে নেমে আসে। রাত হলে আবার যায়। আলোর প্রতীক্ষা
তার আজীবন।
*
*
*
*
এ যদি আমার গল্প হতো, কিম্বা সিনেমা – তাহলে নানকুকে আমি
ঠিক ফিরিয়ে আনতাম। তিত্তির গল্পের শেষটুকু আমি জানি না। তার প্রতীক্ষাটুকুই জানি।
নানকু তো পাকা মাঝি। পারবে না সে ঝড়কে জয় করে ফিরে আসতে? আসেও তো কেউ কেউ। বলুন
না, আপনারা, নানকু ফিরবে তো?
||দোলা সেন||
No comments:
Post a Comment