আমার
ছোটবেলায় নববর্ষ অথবা নিউ ইয়ারস ইভ কোনোটাই ছিলো না জানেন? তার চেয়েও বড় কথা বোধহয়
এটাই যে সে ব্যাপার নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথাও ছিলো না। পাহাড় জঙ্গলে
থাকার সুবিধে কি কম? সকালের রোদ্দুর যখন ধুবি গাছের ফাঁক দিয়ে জানালায় উঁকি দিতো,
লেপের তলায় মুড়িসুড়ি, এক চোখ খুলে দেখতাম, রত্নবাহাদুরদাজু গরম জল দিয়ে গেল
বাথরুমে – তখনি টের পেতাম একটা নতুন দিন শুরু হলো আজ। চটপট উঠে গরম জামা গায়ে দিয়ে
মুখ ধুতে না ধুতেই মা হাজির একগ্লাস বোর্নভিটা মেশানো গরম দুধ নিয়ে। শোবার ঘরের
অন্যদিকের দরজাটা ভেজানো। তার মানে বাবার অফিস শুরু হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে
নিতে পারলে বাবার সাথে জলখাবার খাওয়া যাবে। বাবাই খাইয়ে দেবে নিজের থালা থেকে।
অতএব সেই খাবার তৈরি হবার আগেই পরিপাটি করে রোজকার কাজ শেষ। তারপরেই জুতো গলিয়ে
দৌড় দৌড়। কালকে কাঞ্ছাদের বাড়ীতে খেলাটা শেষ হবার আগেই সন্ধ্যা নেমে গিয়েছিল যে!
সেটা শেষ করতে হবে না? বনপথ দিয়ে খাড়াই চোরবাটো ধরলে পাঁচমিনিটে পৌঁছে যাওয়া যায়।
তা এমন সুন্দর করে যেখানে প্রতিটা দিন শুরু হয়, সেখানে কারই বা দায় পড়েছে, কবে কি
বার আর তারিখ মনে রাখার? তখন বাড়িতে ডেট ক্যালেন্ডার রাখার চল ছিলো। রোজ সকালে
সামনের তারিখের কার্ডটা একদম পিছনে চলে যেত। পরের তারিখ সামনে আসত। তাই যেদিন মা
ডেট ক্যালেন্ডারের মাসের নামটা বদলে দিতেন, সেদিন বুঝতাম একটা নতুন মাস এলো। আর
নতুন ক্যলান্ডার এলে নতুন বছর। আমার জীবনে ওই বদলে যাওয়া ছাড়া, তারিখগুলোর আর কোনো
মানে ছিলো না।
কিন্তু সব ভালো জিনিস শেষ হবার মতোই বাবার নর্থ
বেঙ্গলে থাকার কোটা ফুরিয়ে গেল। বদলি হযে যেখানে এলেন, তা যতই ফাঁকা হোক, আমাদের
ভাইবোনের কেবলি মনে হতো, এতো লোক কেন? ধুবি গাছের সরসরানি হাওয়া, রাতে ঝর্নায়
ভালুকের জল খেতে আসার গুবগাব আওয়াজ, রাতে অনেক নীচে শিলিগুড়ির আলো জ্বলা দেশলাই
বাক্সের মতো গাড়ির সারি, বাড়ি থেকে দুই পা এগোলে বরফের মুকুট পরা পাহাড় – সব কোথায়
যেন ম্যাজিকের মতো ভ্যানিশ হয়ে গেল। ওইসবের বদলে এলো পয়লা বৈশাখের নতুন জামা আর
পায়েস। ধ্যেত্তেরি! আর কি গরম কি গরম! আমাদের সারা গায়ে ফোস্কা। বলাই বাহুল্য,
বৈশাখকে এসো হে এসো বলে অভ্যর্থনা করার মতো মনমেজাজ আমার মোটেও ছিলো না।
তারপর
সবই সয়ে যায়। দু এক বছরের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, পাহাড়ে আর ফেরা হবে না। আস্তে
আস্তে এখানকার ভালো জিনিসগুলোও চোখে পড়তে শুরু করলো এক এক করে। মানে পোষ মেনে
গেলাম আর কি! হোস্টেলে থেকে স্কুলে পড়াটাও নতুন অভিজ্ঞতা।
নতুন
বছর, ষষ্ঠী, পুজো, আলোর সাজ...... ধীরে ধীরে অভ্যেস হয়ে গেল। পয়লা বৈশাখে হোস্টেলে
দুটো করে ক্ষীরকদম দেওয়া হতো। দুপুরে মাংস। বন্ধুরা নিজের হাতে কার্ড তৈরি করে এ ওকে দিতাম।
ছোটবেলার নববর্ষ বলতে এইটুকুই। কিন্তু তাতেই খুব আনন্দ ছিলো।
তারপর
কখন যেন বড় হয়ে গেলাম, বুড়োও হলাম বোধহয়। বাচ্চাদের জন্য নতুন জামা এখনো কিনি।
নিজেদের জন্য কিনলেই হয়, কিন্তু কেনা হয় না। কখনো কেনা হলেও পরা হয়ে ওঠে না।
এভাবেই চলছিলো। কিন্তু এবছরটা একটু অন্যরকম।
ফেসবুকে
হাবিজাবি লিখি। তারই একটা লেখা লেখিকা সর্বাণী মুখোপাধ্যায়ের নজরে পড়লো। তিনি সেটা
তাঁর পত্রিকার জন্য চাইলেন। আমি হতবাক। এমনও হয় বুঝি? পাঠিয়ে দিলাম। ততদিনে তাঁর
নিজস্ব স্বভাবগুণেই তিনি আমার দিদি হয়ে গেছেন। মার্চ মাসের উৎসব পত্রিকায় সে লেখা
প্রকাশিতও হলো। এই কিছুদিন আগে পত্রিকার সঙ্গে একটা চেকও পেলাম! অর্থমূল্য যাই হোক
না কেন, আমার কাছে এটাই প্রথম আর্থিক স্বীকৃতি। প্রথম মাইনে পাবার মতোই এর দাম
আমার কাছে অনেকখানি। কাজেই এবারের নতুন বছর আমার কাছে ভারী স্পেশাল।
কিন্তু
আরও একটি উপহার আমার জন্য রাখা ছিল। সেটা পেলাম গত পয়লা বৈশাখের দুদিন আগে।
নববর্ষের আগে সারাবাড়ি ঝকঝকে পরিস্কার করে না ফেললে আমার ভারি অস্বস্তি হয়। সেসব
সেরে রাজুকে ডেকেছি বাথরুম পরিস্কার করে দেবার জন্য। তা বাবু পকেটের মোবাইলে গান
বাজাতে বাজাতে এলেন প্রায় বেলা একটায়। মনে মনে আমি বেশ বিরক্ত। কিন্তু উপায় নেই।
অতএব মনে মনে গজগজ করতে করতেই দরজা খুলে দিলাম। তার পরিস্কার করার চোটে বেশ কিছুটা
সাবানজল ঘরের মেঝেতে ছিটকে পড়ল। আমার
মেজাজ সপ্তমে –
- এই সাবান ভেজা মার্বেলের মেঝে, এখুনি আছাড় খেয়ে আমায় উদ্ধার করো আর
কি....
আমার বকাবকিকে বিন্দুমাত্র
পাত্তা না দিয়ে হি হি করে হাসতে হাসতে নিজের কাজ নিশ্চিন্তে শেষ করে বাইরে বেরিয়ে
এলো। তারপর, হ্যাঁ তারপর একটা শুকনো ন্যাকড়া নিয়ে সারা জায়গা পরিপাটি করে মুছে বলে
গেলো –
- আমাকে
নিয়ে চিন্তা নেই। আমি সাবধানেই চলি। আমার চিন্তা তোমায় নিয়ে। সেদিন পড়ে গিয়ে কতো
ব্যথা পেয়েছিলে মনে আছে?
আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কিই বা করি ওর
জন্য? অথচ ও আমায় একবুক ভালোবাসা উপহার দিয়ে নির্বিকারমুখে গান শুনতে শুনতেই রওনা
দিল।
দোলা সেন||
No comments:
Post a Comment