Sunday, May 10, 2020

আলোর পিছনে



-       এই মুহূর্তে আপনার অনুভূতিটা যদি একটু বলেন..

আসপাশ থেকে ধেয়ে আসা প্রশ্নের ঝড়কে উপেক্ষা করে, চুপচাপ মাথা নীচু করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছিলেন অগ্নীশ। ঘরের দরজার ওপারে একান্ত অবকাশটার জন্য এমন মর্মান্তিক আকূতি আগে কখনো বোধ করেননি। তবু, এই প্রশ্নটা তাঁর চলন থমকে দিল।
 ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্নকর্তার মুখোমুখি হলেন। ছেলেটি উদ্গ্রীব উজ্জ্বল মুখে তাঁর দিকে মাইক এগিয়ে দিল। চারপাশ থেকে ফ্ল্যাশের আলোর ঝলকানিতে তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে গেল। চোখ খুললেন যখন,তখন তাঁর নুয়ে পড়া শরীরটা তীরের মতো সোজা। প্রশ্নকর্তার চোখে চোখ রেখে খুব শান্ত গলায় প্রতিটি শব্দ ধীরে ধীরে স্পষ্ট উচ্চারণ করলেন –

-       সেটা তো আপনি এখন বুঝতে পারবেন না মিস্টার জার্নালিস্ট। বরং কোনোদিন যদি আপনার সন্তানের মৃত্যু হয়, সেদিন বরং এককাপ কফি নিয়ে বসে দুজনে মিলে বিষয়টা আলোচনা করব, কেমন? তখন – হ্যাঁ, একমাত্র তখনই আপনি বুঝতে পারবেন এই মুহূর্তের অনুভূতিটা ঠিক কিরকম হয়।

অগ্নীশের চোখে আগুন ছিল। তাতেই অথবা কথার অভিঘাতে গুটিয়ে গেল পল্লব। হাত তুলে সহযোগী চিত্রকরকে ইঙ্গিতে আর ছবি তুলতে বারণ করল। তারপর মাথা নীচু করে অন্যদের ভীড় ঠেলে ফিরে চলে গেল। কে জানে কেন, অন্য সাংবাদিকরাও কেউ ধেয়ে এলো না অগ্নীশের পিছন পিছন। ক্যামেরা, মাইক গুটিয়ে যে যার মতোন ফিরে গেল তখনকার মতো।

অগ্নীশ এসবের কিছুই খেয়াল করেননি অবশ্য। পল্লব চোখ নামিয়ে নেবার সঙ্গে সঙ্গেই পিছন ফিরে ঘরের দরজার দিকে রওনা দিয়েছিলেন।

শ্রীময়ী দরজা খুলতেই অগ্নীশ ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন একবার। তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে সোফায় বসে পড়লেন। দু হাতের ফাঁক দিয়ে বয়ে যাওয়া গরম জলের স্রোত তাঁকে পুড়িয়ে দিচ্ছিল। তবে সেটা দেখার মতো কেউ ছিল না। ঘরের দ্বিতীয় ব্যক্তিটিও তখন বাহ্যজ্ঞানরহিত।

বড়ো আনন্দে, বড়ো গর্বে ছেলেকে ডাক্তারি পড়িয়েছিলেন অগ্নীশ। তাঁর অভিও ছিল সোনার টুকরো ছেলে। তার চিকিৎসার, রোগীর প্রতি দরদের কথা ফিরত লোকের মুখে মুখে। এই বছরের শেষের দিকেই তার বিয়ে হবার কথা। তার আগেই সারা পৃথিবী জুড়ে এক আতঙ্কের মহামারী শুরু হয়েছে। শ্রীতমা ভয় পেয়েছিলেন। বিশেষতঃ ওদের হাসপাতালটা কোভিডের জন্য নির্দিষ্ট হওয়ার পর বারবার ছেলেকে বলতেন কাজ ছেড়ে দিতে। বলতেন, মহত্ত্ব দেখিয়ে কাজ নেই। অভি হাসত। বলতো, - “এর মধ্যে মহান কিছু নেই মা। সব পেশারই একটা দায়বদ্ধতা থাকে। এতোদিন সরকারের মাইনে নিয়েছি, আজ পালালে চলবে কেন? তুমি চিন্তা করো না। আমরা যথাসম্ভব সাবধানতা মেনে চলি”
-       “তোর যে ডায়বেটিস আছে বাবা!”\
-        
-       “তার জন্য যখন ডাক্তারি পড়া আটকায়নি, তখন এটাও আটকাবে না। আমার লক্ষ্মী মা, এতো চিন্তা করে না। তাড়াতাড়ি টিফিনটা দাও তো।“
-       “কি করে চুপ থাকি বলতো? কালও খবরে বলছিল তোদের নাকি প্রপার পিপিই নেই?”
-       “শুধু শুধু লোকের চিন্তা বাড়ানো ছাড়া খবরওয়ালাদের কি আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই?”
-       “তোর তো সবকিছুতেই হাসি। আমার হাসি পায় না।“
-       “এসে কথা বলি? এবার কিন্তু আমার সত্যি দেরি হয়ে যাচ্ছে।“

শ্রীতমা চুপ করে যেতেন। চোখের জলে টিফিন গোছাতেন। বারবার গুগল সার্চ করে দেখতেন, কোভিড ১৯ ডায়বেটিস রোগীদের পক্ষে কতোখানি মারাত্মক; কী কী সাবধানতা নেওয়া যেতে পারে। ছেলের রক্তে মধুর পরিমাণ যে একটু বেশির দিকেই!

পাড়ার লোকে আপত্তি করেছিল। অভির মাঝে মাঝে বাড়ি আসাটা বন্ধ করার জন্য চেষ্টা চলছিল। নেহাত শ্রীতমার দাদা প্রভাবশালী লোক। তাই ব্যাপারটা সামলে নেওয়া গিয়েছিল। অভির আসা বন্ধ হয়নি, কেবল পরিবারটা একঘরে হয়ে গিয়েছিল।

তারপর, সেই একদিন। জ্বর নিয়ে ফিরল অভি। তারপর সব কিছু কেমন ঝড়ের গতিতে হয়ে যেতে থাকলটেস্টে পজিটিভ আসার পরেই বদলে গেল চারপাশ। আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি ছেলেটাকে চোখের দেখাও দেখতে পেতেন না অগ্নীশ-শ্রীতমা। প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন সকলেই বিষবৎ পরিত্যাগ করল তাদের।
-       ফোনেও কি ভাইরাস ছড়ায়?
তেতো হাসেন অগ্নীশ – তুমি বুঝছো না শ্রী। যদি কোনো সাহায্য চাই? যদি ওদের আসতে হয়?
-       তবু একবার মুখের কথাও জিজ্ঞাসা করবে না?
-       না করবে না। স্বার্থপরতার এতো সুন্দর একটা মুখোশ পাওয়া গেছে। ব্যবহার করবে না লোকে?
-       অথচ ওদের জন্য আমরা.....
-       তখন তো ওরা রিসিভিং এন্ডে ছিল। এখন ব্যাপারটা উলটে গেছে।
-       তুমি এতো নির্বিকার কি করে গো? কষ্ট হচ্ছে না তোমার?

হাসেন অগ্নীশ। এর পরেও হাসতে পারেন তিনি। শুধু তাঁর এতোদিনের সঙ্গীর চোখে সেটা কান্নার চেয়েও কালো মনে হয় কেন কে জানে! শ্রীতমার চোখের জলে ভেসে যাওয়া মুখটা দেখে অগ্নীশের ভিতরটার রঙ আগুনের মতো লাল হয়। নিঃশব্দে পুড়তে থাকেন। আর আজ তো ছেলেকে পুড়িয়েই ফিরলেন। হ্যাঁ একাই। পুলিস এবং অভির  দু একজন সহকর্মী ছাড়া আর কেউ ছিলো না। শ্রীকে তো ওরা হাসপাতাল থেকেই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল।

বুড়ো পৃথিবীটা থেমে থাকে না। তাই দিন হয়, রাত কাটে। শুধু একটা ঘরের ভিতর দুটি মানুষের সময় একজায়গায় আটকে থাকে। ওরা বারবার রি-ওয়াইন্ড করে দিনগুলোকে দেখে। প্রাণপণ চেষ্টা করে এডিট করার। হয় না। আবার দেখে। আবার এডিট করে। তারপর আবারও আবিষ্কার করে ছবিটা যেমন ছিলো, তেমনই আছে!

তিনদিন পরে ফোনটা বাজলো। ঘটনাটা এমনই অপ্রত্যাশিত যে মানুষদুটি চমকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন। এমন এক বীর সন্তানের জন্ম দেবার জন্য পাড়ার কাউন্সিলরটি প্রথমেই তাঁদের অভিনন্দন জানালেনতার সঙ্গে এও বললেন, আজ সন্ধ্যায় এলাকার বাসিন্দারা মোমবাতি জ্বালিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে অভিরূপকে সম্মান জানাবে। মিত্রদম্পতি যেন বারান্দায় এসে অভিরূপের তরফে এই অভিনন্দন গ্রহণ করেন।

একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না দুজনের কেউইমুখোমুখি বসে রইলেন অনন্তক্ষণ। সন্ধ্যাবেলায় যখন চারপাশ মোমবাতির আলোকমালায় সেজে উঠেছে, ঘন ঘন শঙ্খধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছে পাড়া – তখন শুধু দুটি মানুষ দরজা জানলা বন্ধ করে, পর্দা টেনে, দুকানে হাতচাপা দিয়ে এক শব্দহীন অন্ধকার জগতে ডুবে যাবার চেষ্টা করতে থাকল।
দোলা সেন||





No comments: