||দোলা সেন||
দিনকাল বড়োই খারাপ যাচ্ছে ঋতির। বেশ
কিছুদিন ধরেই যা ঘটছে, সেগুলো যে খুব একটা ভালো ঘটছে না – সেটা পরিষ্কার।
আজকের সকালবেলার কথাটাই ধরা যাক। দ্রিঘাংচু
কি এমন মহামূল্যবান জিনিস চেয়েছিলো শুনি? যেটা নিয়ে এমন মহাভারত তৈরি করতে হবে?
রান্নাঘরে সকালে সবার জলখাবার আর টিফিনের জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি রুটি বানায় মলিনাদি। সেখান থেকে আজ একখানা মাত্তর একখানা রুটি
নিয়েছে বলেই... ছ্যা ছ্যা, এমন বাড়িতে মানুষ থাকে? নেহাত বাড়িতে ভগবান থাকে, তাই
এখনো এ বাড়ির মায়া ছাড়তে পারছে না ঋতি। নইলে কবেই..
হ্যাঁ, ভগবান। ছোটো থেকেই ঋতি যা চায়,
তাই এককথায় পূরণ করে, বা করার চেষ্টা করে বলে, ঠাম্মিই একদিন বলেছিল, ‘ভগবানও
ভক্তের সব প্রার্থনা শুনে উঠতে পারে না। তুমি তো দেখছি তারও বাড়া হয়ে উঠছ!’ সেই
থেকে ঋতি দাদু ছেড়ে ভগবান ডাকা শুরু করেছে। রাগ হলেই ঠাম্মিও তাই ডাকে। তবে ঋতি
দেখেছে, বাড়ির সবাইকে সামলাতে পারলেও ঠাম্মি রাগলে ভগবানেরও কিছু করার থাকে না।
ঋতির আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে
গিয়েছিল। আসলে চাকরির পরীক্ষা, ইন্টারভিউয়ের জন্য আজকাল অনেক রাত জেগে পড়ে তো। তা
সংসারে আর কোন কাজটা ওর জন্য আটকে থাকে? সেদিনও মলিনাদি অন্যান্য দিনের মতোই রুটি
বানিয়ে বানিয়ে বাটিতে রাখছিল। হঠাৎই জানলা দিয়ে ঢুকে, একটা রুটি তুলে দ্রিঘাংচু
হাওয়া হয়ে গেল। পুরো হাওয়া হলেও বা হতো, কিন্তু রান্নাঘরের সামনের পাঁচিলে বসে পরম
নিশ্চিন্তে রুটিটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে থাকল, আর মলিনাদির চ্যাঁচামেচির জবাবে খাওয়া
শেষ করে একটা লম্বা কঃ বলে উড়ে গেল।
স্বভাবতঃই মলিনাদি বেজায় অপমানিত বোধ
করেছে। আর বলতে গেলে তার চেঁচামেচিতেই ঋতির ঘুম ভেঙেছে।
-
এমন বাড়ি দেকিনি বাপু। অনেক কিচু পুষতে
শুনিচি। তাই বলে কাক? আমি পারবুনি কাজ কত্তে। শেষটায় কি কাকের কাচে হেনত্তা হতি
হবে?
আর ‘হেনত্তা’! কোথায ছিল ঠাম্মি, দৌড়ে
এসেছে –
-
কি বললি মলিনা? কাক পুষছে? কার এমন ভিমরতি হলো? ওরে
তোরা কেউ খাঁচাটা বাইরে করে ছেড়ে দে রে। সাত জাতের এঁটো খায়, ঘরে লক্ষ্মীর ঘট আছে
যে! হায় হায় হায়!
-
সকাল সকাল তুমি আর চিল্লোনি, বড়োমা।
বলি খাঁচা কোতায়, যে খুলে দেব?
-
আমি চেঁচাই? এমন অপবাদ আমার শত্তুরেও
দিতে পারবে না। পুরোনো হয়ে তোর বড়ো মুখ বেড়েছে দেখছি। দেবো ছাড়িয়ে, তখন বুঝবি।
-
আমারে ছাড়ালে কে তোমারে লুইক্কে নসোগোল্লা
এনে দেবে শুনি?
-
আহা, রাগের মাথায় মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে
বই তো নয়। আর বুড়োমানুষের সব কথা ধরতে নেই।
কথাটা চাপা পড়ে যাচ্ছে দেখে ঋতি চুপি
চুপি পড়ার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল। মা এসে দাঁড়ালো।
-
কাক পুষেছিস?
-
কোথায়? তুমি যে কি বলো না মা? খাঁচা
থাকলে তুমি দেখতে পেতে না? সবসময় যতো দোষ, ঋতি ঘোষ!
বেশ পাশ কাটানো গিয়েছিল। গোল বাঁধালো
পুচু। মলিনাদির ভাইপো। এবাড়িতেই থাকে, পড়াশোনা করে নাকি। পড়াশোনা কি করে ঋতি জানে
না। তবে সবার উপর গোয়েন্দাগিরি করে, সেটা ভালোই জানে। সেই বলে বসলো –
-
ও জেঠিমা, ওটা তো দিদির ছাড়া-পোষা কাক।
-
মানে?
উপায় না দেখে ঋতিই প্রাঞ্জল হয় - কি করবো, তোমরা তো আর কিছু পুষতে দেবে না। তাই
ওটাকে পুষেছি। কিন্তু ও ছাড়াই থাকে। রোজ আমার হাত থেকে বিস্কুট খায়, রুটি খায়। আজ
আমার উঠতে দেরি হয়ে গেছে। দ্রিঘাংচুর নিশ্চয়ই খিদে পেয়ে গিয়েছিল। একটা রুটির জন্য
তোমরা যা শুরু করেছ না!
হড়বড়িয়ে কথা বলে ঋতি। ধরলে কথা, থামায়
কে স্টাইলে। কিন্তু কথা শেষ হবার পরেও মায়ের মুখের হাঁ আর বন্ধ হয় না – তু-তুই কাক পুষেছিস? ছাড়াপোষা
কাক? তার নাম দি-দ্রিঘাংচু?
গর্বের সঙ্গে ঋতি ঘোষণা করে – হ্যাঁ
তো। ওকে ডাকলে ও সাড়াও দেয়।
মা মাথা চাপড়ায়। আর ঠাম্মি ভগবানকে
নিয়ে পড়ে – এই তোমার আহ্লাদেই এই মেয়ের অবুঝপানা দিন দিন বাড়ছে। এতো বড়ো হয়ে গেল,
তবু ছেলেমানুষি গেল না! একটু যদি কন্ট্রোল থাকে?
ভগবান এতোক্ষণ খবরের কাগজের আড়ালে মুখ ঢেকে
বসেছিল। এখন আক্রান্ত হয়ে, মিনমিন করে বলে – ছাড়া কাককে কি করে কন্ট্রোল করব?
ধুপধাপ আওয়াজ করে ঠাম্মি চলে যায়।
এবেলা আর লক্ষ্মীর মতোন মৃদু চলনের কথা মনে থাকে না তার। আপাতত ঝামেলা মিটেছে দেখে
ঋতি হাঁকাড় পাড়ে – সেই কখন থেকে খিদে পেয়েছে।ও ঠাম্মি.....
ধীরে ধীরে দ্রিঘাংচুর আদর আহ্লাদ বাড়তে থাকল।
ঋতি যখন কলেজে যায়, তখন
সেও তার সঙ্গে বাসস্ট্যাণ্ড অবধি যায়! এরপর ছুটির দিনে ঋতির
বদান্যতায় মাছ লাগানো কাঁটা,
কিম্বা মাংসলাগানো হাড়ও জুটতে লাগলো তার। দিব্বি চলছিল। মা,
ঠাম্মিও কি করবে ভেবে না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিল একরকম। কিন্তু এতো ভালো কপালে সইলে
তো! গোল বাঁধলো ঋতির জন্মদিনের
পর থেকে। বাবার সন্ধ্যেতে ট্যুরে যাবার ছিল। তাই দুপুরবেলাতেই ঋতির বন্ধুবান্ধব, আর কিছু আত্মীয় এসেছিল। সবার হাতেই ঋতির জন্য উপহার। দ্রিঘাংচু খুব মন দিয়ে গোটা ব্যাপারটা
লক্ষ্য করছিল। সেদিন দুপুরে সেও তার আত্মীয় স্বজন নিয়ে পেটপুরে খেয়েছে বৈকি! গোলমালটা
সেদিনের পর থেকেই শুরু হয়েছে। কেন কে জানে তারপর থেকে দ্রিঘাংচুর মনে হয়েছে, ঋতিকে
তারও কিছু উপহার দেওয়া উচিত। অতএব সে দুনিয়া ঘেঁটে ঋতির জন্য উপহার খোঁজায় লেগে
পড়ল।
প্রথম দিন ঋতি তার টেবিলে একটা আধখাওয়া
মাছের টুকরো দেখে আঁতকে উঠেছিল। চেঁচাবার মাঝপথেই অবশ্য থেমে যেতে হয়েছিল মৃদু কঃ
আওয়াজে। দ্রিঘাংচু! সে খুব মনোযোগ দিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকেই দেখছে। চোখাচোখি হতেই
আবার একটা নরম করে ডাক ছাড়ল।
-
এটা তুই এনে
ফেলেছিস? ইঃ....
ঋতি একটা কাগজ দিয়ে দু আঙুলে তুলে সেটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলে
দেয়। সঙ্গে সঙ্গে একটু জোরে কঃ করে উড়ে চলে যায় দ্রিঘাংচু। হঠাৎ করে ওর রাগের
কারণটা বুঝতে না পেরে ঋতি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে থাকে।
পরদিন। এবার টেবিলের ওপর একটা গোটা মরা
টিকটিকি। দ্রিঘাংচুর নরম ডাকে তার গদগদ ভাবটা বেশ স্পষ্ট। ভাবটা – দেখ, আমি একটুও
খাইনি। গোটাটাই তোমার জন্য এনেছি।
-
এগুলো তোর
গিফ্ট?
ঋতির মাথায় হাত – মা বা ঠাম্মি দেখতে পেলে তোকে, আমাকে
দুজনকেই বাড়ি থেকে বের করে দেবে। একদম আনবি না এসব।
দ্রিঘাংচু কি
বুঝল, কে জানে। কিন্তু এরপর থেকে ঋতি মাঝে মাঝেই গিফ্ট পেতে থাকল। কখনো
ইঁদুরের লেজ, কখনো বা আধখাওয়া পেয়ারা। টেবিল থেকে বইপত্র সরিয়ে রাখতে হয়েছে। মা
খুব খুশি। এতোদিনে মেয়ের সুবুদ্ধি হয়েছে। ঋতির যে কী জ্বালা, তা যদি কেউ বুঝত!
এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটলো। কলেজ পাস করে, ঋতি একটা রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে চাকরি
পেয়ে গেল। কিছুটা দূরে। সেখানেই থাকতে হবে। মাসে দুটো শনি রবিবারে বাড়ি আসতে পারবে
অবশ্য। বাড়ির সবাই খুব খুশি। যাবার আগে ঠাম্মি একটু আঁচলচাপা দিয়ে কেঁদেও নিল। মার
চোখও ছলছলে। তার জন্য মা, ঠাম্মির এতো মায়া! আগে কেন বুঝতে পারেনি ঋতি? তাহলে হয়তো
একটু কম জ্বালাতন করতো ওদের। তার গলাটা ব্যথা ব্যথা করে ওঠে।
মুশকিল হলো দ্রিঘাংচুর। সে কিছুতেই
বুঝে উঠতে পারছে না তার প্রিয় বন্ধু গেল কোথায়। প্রথম দু একদিন হাঁকাহাঁকি করল।
তার পর ঘরের মধ্যে মাঝে মাঝে হানা দিতে লাগল। বাড়ি সুদ্ধ লোক তটস্থ। ভগবান তার
দুঃখ বোঝে। তার বড়ো মায়া। সে মাঝে মাঝে দ্রিঘাংচুকে বিস্কুট খাওয়ায়। যদি তাতে ওর
মনোকষ্টটা কমে। কিন্তু উল্টা বুঝিলি রাম। দ্রিঘাংচু বোধহয় ভেবেছিল, এই দয়ালু
মানুষটিকে খুশি করতে পারলে সে তার বন্ধুকে ফিরিয়ে আনতে পারবে। অতএব সে এবার মাঝে
মাঝেই কলাটা, মূলোটা – থুড়ি থুড়ি, কাঁটাটা, হাড়টা ভগবানের ঘরে পৌঁছাতে শুরু করল।
ভগবান তটস্থ থাকে। দেখতে পেলেই সরিয়ে
ফেলে। জানে, ঠাম্মির চোখে পড়লে অনর্থ বাঁধবে। তবুও একদিন অঘটন ঘটেই গেল। সেদিন
নীলের পুজো করবে বলে, ঠাম্মি স্নান করে, লালপাড় সাদা তাঁতের শাড়ি পরে, রেকাবিতে
ফল-মিষ্টি সাজিয়ে, ধূপ-ধুনো-দেশলাই রেখে, তার উপর সাদা লেসের ঢাকনা দিয়ে, যেই না
বেরোতে যাচ্ছে, অমনি মনে পড়েছে – এই রে, দক্ষিণার পয়সাটা নেওয়া হয়নি! তখন ঠাম্মি
তো ভগবানের টেবিলে রেকাবিটা নামিয়ে, লাল বটুয়া খুলে পয়সা বের করতে লেগেছে। ওদিকে
ঠিক সেই সময়....
সেই সময়
দ্রিঘাংচু একটা নেংটি ইঁদুরের মাথা এনেছে ভগবানকে দেবার জন্য। অতো সুন্দর সাজানো
ট্রেটা দেখে তার কী মনে হলো তা সেই জানে। সে খুউব সাবধানে ট্রের ওপরে উপহারটা
নামিয়ে রাখল!
তারপর ঠাম্মি
যে চিক্কুরটা ছাড়ল, সেটা নিশ্চয়ই এপাড়া ছাড়িয়ে বড়ো রাস্তা অবধি পৌঁচেছিল। ভগবান
সবে সকালের চায়ের কাপে চুমুক দিতে যাচ্ছিল, বিষম খেয়ে পরণের সাদা পাঞ্জাবীতে চা
ছলকে পড়ল।
সেটা দেখে
মায়ের মাথা চাপড়ানি শুরু হয়ে গেল – হয়ে গেল! গত হপ্তায় কিম্বদন্তী থেকে কতো শখ করে
কিনে আনালাম। প্রথম দিনেই... ও বাবা, আর তো ব্যবহার করা যাবে না। ফোস্কা পড়ে নি
তো? মার আবার কী হলো? আমি এখন কোনদিকে যাই? ও পুচুউউউ...
পুচু মন দিয়ে
অঙ্ক কষছিল। তিন চোদ্দং সাতচল্লিশের সাত নামাতে গিয়ে চল্লিশ নামিয়ে ফেলল। হাতে কতো
রইলো, সে হিসেব মুলতুবি রেখে, সে এক দৌড়ে ঠাম্মির ঘরে হাজির হলো।
ব্যাপার এতো
ঘোরালো হবে, দ্রিঘাংচু বোঝেনি। সে অনেকক্ষণ আগেই পগার পার হয়েছে। পুচু ঘরে ঢুকে
কোমরে হাত দিয়ে যাকে বলে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা, তাই করছিল। সব দেখেশুনে সে রায়
দিল, - এ নির্ঘাত দিদি আর দাদুর পোষা কাকের কীর্তি। ও রোজ দিদিকে এইসব এনে দিত।
আমি দেখেছি।
-
অ্যাঁঃ, ঋতি
এইসব খায়? আমি কোথায় যাবো গোওও...
মায়ের হাউমাউ
কান্নায় পুচু একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সে একটু চিন্তা করে দেখল – দিদি তো ওটা
নিয়ে বাথরুমে যেত। পুচু ভাবত, ফ্লাস করে ফেলে দেয়। কিন্তু খেতো কিনা, কে জানে?
গোয়েন্দাগিরিটা ফুলপ্রুফ হয়নি দেখে পুচু মুষড়ে
পড়ল। তাড়াতাড়ি দাদুকে ধরে পড়ল – ও দাদু, তুমিও তো দ্রিঘাংচুর গিফ্ট নিয়ে বাথরুমে
যাও। খাও, না ফ্লাস করো গো?
অল্পশোকে
কাতর, অধিক শোকে পাথর হয়ে ঠাম্মি শুধু বলল – আজ শনিবার না? আসুক ঋতি
বাড়িতে!
ঠাম্মি যখন দিদিভাই না বলে ঋতি বলে,
তখন ব্যাপার বেশ গুরুচরণ। হাওয়া খুব গরম দেখে একে একে সবাই কেটে পড়ল।
ঋতি এতো
কিছু জানে না। সে খুব ফুর্তিতে বাড়ি ঢুকছিল। দরজা থেকেই হাঁক পাড়ে – ও ঠাম্মি, আমি
এসে গেছি। দুটো গোকুল পিঠে – শিগগির!
তারপর যা হলো, সে আর ছাপার অক্ষরে
প্রকাশিতব্য নয়। হাজার হোক ঋতি এখন ইস্কুলের দিদিমণি। তাকে যদি কান...
জগৎ সংসারের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে রাতের
খাবারের পরে সে ঘুমোতে গেল। ছ্যা ছ্যা, এই জন্য মানুষ বাড়ি আসে? দ্রিঘাংচুর সঙ্গেও
তার এবার দেখা হলো না। সে যে কোথায় লুকিয়ে রইলো তা কে জানে? সোমবার একরাশ মনখারাপ
নিয়ে কাজের জায়গায় যেতে যেতে ঋতি ঠিক করে নিল, তার ছাত্রীদের সে ছোট থেকেই জীবে
প্রেম শেখাবে। নাহলে পৃথিবীটা মা আর ঠাম্মির মতো জীববিদ্বেষীতে ভরে যাবে। কাজেই সে
ক্লাসে ঢুকে ‘পরিবেশ ও জীবপ্রেম’ এর উপর রচনা লিখতে দিয়ে উদাস নয়নে জানলা দিয়ে
বাইরে তাকিয়ে রইল।
-
অঙ্ক ক্লাসে রচনা কেন – মণিকার এহেন
প্রশ্নের উত্তরে ঋতি এমন কাতর মুখ করে তাকালো, যেন এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে।
-
বোস তো তুই। একদিন অন্যরকম হলে অসুবিধে
কোথায়? – আত্রেয়ী মণিকাকে চেপে বসিয়ে দিল।
- দেখছিস না দিদির মন খারাপ?
তা উদাস মনেই স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল
ঋতি। রাস্তায় কলার খোসার উপর পা পড়ে একেবারে ধপাস। এই ঝকঝকে ক্যাম্পাসে কলার খোসা
আসে কোত্থেকে? এদিক ওদিক তাকাতেই চোখে পড়ল বাড়ির ছাদের উপর হনুমান। তাহলে এই
ব্যাপার। প্রচুর গাছ আছে বলে, এখানে তাদের সংখ্যার কমতি নেই। তবে মানুষের সঙ্গে
তারা মিলেমিশে থাকে বেশ।
পরীদি পাশেই ছিল। ঋতিকে হাত ধরে ওঠাতে
ওঠাতে মুচকি হেসে বললো – জীবপ্রেম, জীবে প্রেম! রাগ করতে নেই।
টিফিনটাইমে পরীদিকে সবকথা, মায় রচনার কথাটাও
বিশ্বাস করে বলেছিল পরী। তার এই ফল? মনে মনে গজগজ করতে করতে ঋতি নিজের কোয়ার্টারে
ঢোকে। তার
উঠোনময় হনুমান। রোজই প্রায় থাকে। এটা ওদের দুপুরের অবসরের সময়। অন্যদিন ঋতির ভালোই
লাগে। কিন্তু আজ তার মন খারাপ। পড়ে গিয়ে অবধি কোমরটা টনটন করছে। তাই রাগের চোটে
মুখ ভেঙিয়ে বলে উঠলো –
আড়ি, আড়ি, আড়ি।
কাল যাব বাড়ি,
পরশু যাব ঘর।
হনুমানের লেজ ধরে
টানাটানি কর।
বলতে বলতেই তার চোখের সামনে জানালায়
একটা লম্বা হনুর লেজ। শিকের ওপারে টুকটুক করে দুলছে। মুহূর্তের খেয়াল। কি মনে হলো
ঋতির, হাত বাড়িয়ে লেজটায় দিল এক টান! জানালার কার্ণিশে বসা হনুমানটা এমন উপদ্রব
আশা করে নি। প্রথমটায় সে হকচকিয়ে ক্রিঁইইইচ করে ছাদে উঠে গেলেও একটু পরেই ঘটনাটা
বুঝতে পেরে নীচে নেমে এল।
বেজায় রেগে ক্রিঁইচ, হুউপ, চিকিচিকিচি ইত্যাদি
ভাষায় চেঁচাতে চেঁচাতে সারা উঠোন দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। বেশ ল্যাজ উঁচু করেই। দলটার
আরো কয়েকজনের চোখেও পড়েছে ব্যাপারাটা। এ তোমার অপমান, এ আমার অপমান – ভঙ্গিতে সারা
উঠোন জুড়ে তাদের সে কি নাচ! দু একটা ধেড়ে আবার জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে ঋতির নাগাল
পেতে চায়। না
পেরে একটা বাচ্চাকে শিক গলিয়ে ভিতরে গলিয়ে দেবার চেষ্টা করে। তা ঋতি কি অতোই বোকা?
সে তাদের নাগালের বাইরে খাটের ওপর গুটুসুটি হয়ে বসে আছে, আর ভাবছে ভাগ্যিস ওর সব
দরজা এখন বন্ধ! কিন্তু ওরা চায় কি? অপমানে হতে হবে উহাদের সবার সমান? কিন্তু ঋতির
তো লেজ নেই? তাহলে কি ওদের ল্যাজে প্রেস্টিজ? মানে ল্যাজ ইকুয়াল্টু কান? উঃ,
ভাবতেই ঋতির কানটা টনটনিয়ে উঠলো। পরশুই মা...
এটা বাড়তে দেওয়া চলবে না। একটা সন্ধি স্থাপনা
করতেই হবে। অগত্যা খোঁড়াতে খোঁড়াতে সে ফলের ঝুড়ি নিয়ে এল। ছুঁড়ে দিতে গিয়েও থমকে
গেল। নকল করে পাথর ছোঁড়ে যদি? একটা একটা করে ফল আস্তে করে নামিয়ে রাখল জানলায়।
ওদের হাতের নাগালে। সারা সপ্তাহের ফল! মা সাজিয়ে দিয়েছিল! যাই হোক ঘুষ পেয়ে খানিক
পরে শান্ত হয়ে ওরা চলে গেল। যাবার আগে ঋতিকে কলা দেখিয়ে ভেংচি কেটে যেতে ভুললো না
অবশ্য।
তিন সপ্তাহব্যাপী বন্ধুত্বের এই পরিণাম?
রোজ যে ঋতি ওদের কলাটা আলুটা দিত, সেকথা ভেবে একটু ঠাট্টাও নিতে পারলো না?
অকৃতজ্ঞ, নেমকহারাম বলে শান্তি হলো না ঋতির। তার এখন হ্যাডকের মতো বিলিয়নস অফ ব্লু
ব্লিস্টারিং বার্নাকলস বলতে ইচ্ছে করছে। আর এদেরই বা দোষ দিয়ে কি হবে? এতোদিনের
ছাড়াপোষা কাকের ব্যবহারটাই দেখো! ঋতির কপালে এবারে একটুও পিঠে পায়েস জুটলো না।
উল্টে মা, “কি না কি খেয়েছিস, মুখ্যু কোথাকার” – বলে একটা বিশ্বতেতো পাঁচন
খাইয়েছে।
ঢের হয়েছে জীবপ্রেম। এবার থেকে ঋতি জীব
দেখলেই শতহস্ত দূরে থাকবে। আর যদি কারো সঙ্গে ভাব জমিয়েছে তো ওর নাম ঋতিই নয়। মন
খুব কঠোর করে প্রতিজ্ঞা করল ঋতি।
পরদিন স্কুল থেকে ফিরছে। ফিরবার পথে
বাজার করেছে। দূর থেকে একটা দুটো হনুমান উঁকি দিচ্ছিল। সম্ভবতঃ রোজকার প্রাপ্য
আলুর আশায়। কোনো দিকে না তাকিয়ে ঘাড় গোঁজ করে হাঁটছিল ঋতি। ঢের শিক্ষা হয়েছে তার।
হঠাৎ কুঁই কুঁই শব্দে মুখ তুললো। বড়ো নালিটার পাশে তিনটে কুকুরছানা কাঁদছে কেন?
কাঁদুক গে! চলেই যাচ্ছিল ঋতি। তবে একটু দেখলে আর কি এমন ক্ষতি? সে তো আর তাদের
উপকার করতে যাচ্ছে না! নিতান্ত কৌতূহল, আর কিছু নয়।
এইসব দোনামনা করতে করতে কখন যেন নালার
পাশে হাজির হয়েছে। কি মুস্কিল! বড়ো নালাতে মা কুকুরটা পড়ে গিয়ে কেমন করে জানি আটকে
গেছে। উঠতে পারছে না। ঋতির সব ভুল হয়ে গেল। সে পাশে ব্যাগ নামিয়ে একটা লাঠি জোগাড়
করে কুকুরটাকে তুলবার চেষ্টা করতে থাকল। তার এখন অনেক কাজ। তুলতে তুলতে বিড়বিড়
করছিল ঋতি – এটাকে সুস্থ করেই তার জীবে প্রেম পর্ব শেষ। আর নয়। একদম নয়!
দোলা সেন||
No comments:
Post a Comment