Wednesday, March 18, 2020

অন্য রুকু সুকু





ব্যাগে বই ঢোকাতে ঢোকাতে সুকু ঘাড় ঘোরায় –
-       কি ব্যাপার, স্কুলে যাবি না?
-       নাঃ। পেটে ব্যথা যে!
-       পেটে ব্যথা তো তীর বানাচ্ছিস কি করে?
-       ব্যথা তো পেটে, হাতের কি?
-       তীর ছুলতে পারিস, আর স্কুল যেতে পারিস না?

-       তুই বেশি না বকে ইস্কুল যা তো। ইস্কুলে বারবার টয়লেটে যেতে দেবে? বকবে না?
-       ঠিক আছে, যাস না। সকালে বাবাকে বাজার থেকে হাঁসের ডিম আনতে দেখেছি। যাই, বেরোবার আগে মাকে বলে যাই, তোর জন্য যেন মাছের পাতলা ঝোল করে দেয়।
রুকু এতক্ষণ একবারও কঞ্চি ছোলা থেকে চোখ ওঠায়নি। এবার দাদার দিকে, যাকে বলে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে, সাধের তীরগুলোকে খাটের তলায় ঠেলে ঢুকিয়ে দেয়। তারপর ব্যাগ, বই, খাতাদের একটু নাড়াচাড়া করে আবার ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ে উদাস গলায় বলে –
-       তাই বলগে যা। একদিন ডিম না খেলে আর কি হবে। তুই বরং আমার ভাগেরটাও খেয়ে নিস
ভাইয়ের এতোবড়ো আত্মত্যাগে সুকু এবার একটু বিচলিত হয়ে ওঠে। রুকুর মাথায় হাত রেখে শুধোয় – কি হয়েছে রে?
চোখে গভীর সন্দেহ নিয়ে রুকু পাশ ফিরে শোয় – বললাম তো, পেটে ব্যথা।
-       বল না রে? আমি কাউক্যে বলবো না। মা কালির দিব্বি।
এইবার রুকু সোজা হয়ে বসে – তোর টেবিলে পট আছে না? ছুঁয়ে দিব্বি কর আগে।
-       আচ্ছা বাবা, তাই সই। বলবো না, বলবো না, বলবো না। হলো? এবার তো বল।
-       আজ ইস্কুলে গেলে তকাইরা আমায় মারবে।
-       কেন? তকাইদা তো অনেক বড়ো। তোকে মারবে কেন? কি করেছিস?
খুব উদাসী গলায় রুকু বলে – তেমন কিছু না। কাল টিকলুদার পিছনে তীর মেরেছিলাম। যদিও মুখটায় একটা রবারের ছিপি লাগিয়ে দিয়েছিলাম, তবু ভালোই ব্যথা পেয়েছে মনে হয়।
-       আরিব্বাস! গণ্ডগোলটা তো ভালোই পাকিয়েছিস। তকাইদা আবার টিকলুদার বেস্ট ফ্রেন্ড। মহা মারকুটে তো! তাহলে আজ আর তোর সত্যিই স্কুলে গিয়ে কাজ নেই। কিন্তু কাল? পরশু? হ্যাঁরে, রূপক স্যারকে বলি? মারতে গেলি কেন হঠাৎ?
-       কালকেই বলা হয়ে গেছে। মারার পরেই তো একদৌড়ে...
স্যারই বলেছেন আজ ইস্কুলে না যেতে। বাকিটা উনি সামলে নেবেন।
-       যা বাবা! এতোকিছু হয়ে গেল, আর আমি কিছুই জানি না? আচ্ছা, ঠিক আছে!
সুকুর গলা ধরা ধরা। আসলে যখন কিছুই ঠিক থাকে না, তখনই কারো মুখ দিয়ে, এই দুটি শব্দ গভীর অভিমানে উচ্চারিত হয়। সব সইতে পারে রুকু, পিটিস্যারের বেত পর্যন্ত, কিন্তু দাদার ভেজা গলা? রুকুর বুকের মধ্যে কেমন যেন উথাল পাথাল ঢেউ ওঠে। রুকু তাড়াতাড়ি দাদার দুহাত ধরে অনুনয়ের সুরে বলে ওঠে – সরি রে দাদা! রাতেই তোকে বলতাম। কিন্তু তুই বাবার কাছে অঙ্ক বুঝছিলি যে। আমি তোর জন্যেই জেগে শুয়েছিলাম। অপেক্ষা করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি রে।
-       হুঁ, ঠিক আছে, ঠিক আছে। এবার বলতো, টিকলুদাকে হঠাৎ মারতে গেলি কেন? তাড়াতাড়ি বল। নয়তো স্কুলের দেরি হয়ে যাবে।
-       টিকলুদার গুলতির খুব টিপআগে আম, জাম পাড়ত। এখন ব্যাঙ মারে, পাখি মারে।
-       সে কি? তুই জানলি কি করে?
-       সমীর বলেছেবোসেদের পুকুরের ধারটা নির্জন তো? ওখানে বড়ো গাছদুটোয় অনেক পাখি থাকে। সন্ধ্যার আগে পাখিদের ঘরে ফেরার সময়। তাই ওরা তখন ওখানে যায়।
-       তার পর?
-       বাড়ি এসে দেখলাম, তুই ফুটবল খেলতে চলে গেছিস। তখন আমার তীরধনুকটা নিয়ে সমীরের সঙ্গে পুকুরপাড়ের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রইলাম।
-       ওরা এলো?
-       হ্যাঁ তো। তারপর যেই টিকলুদা পাখির দিকে গুলতি তাক করেছে, অমনি আমি ঝোপের আড়াল থেকে অর্জুনের মতো..... হি হি হি।
-       হি হি। খুব চেঁচালো, না?
-       আঁক আঁক, গাঁক গাঁক!
আর আমরা থাকি? পাঁই পাঁই দৌড়।
-       তোদের দেখতে পায়নি?
-       সে তো পেয়েইছে পরে। আমরা একদৌড়ে রূপকস্যারের বাড়ি। স্যার বললেন- বেশ করেছিস। তবে কাল তোরা ইস্কুলে যাস না। বাকিটা আমি সামলে নেব।
-       স্কুলে কি হয় দেখি।
-       সাবধানে যাস। আমাকে না পেয়ে, ওরা তোকে আবার কিছু বলবে কিনা কে জানে?
-       আমার সঙ্গে দৌড়ে পারবে নাকি? গতবারের দৌড়ের মেডেলটা কার ছিল?
-       কিন্তু এবার তুই যা। পৌঁছাতে দেরী হলে প্রেয়ার লাইনে নীলডাউন করিয়ে দেবে পিটিস্যার।
-       হুঁ। টা টা।
-       কাউকে কিছু বলিস না। মা কালির দিব্বি কেটেছিস, মনে থাকে যেন।
-       মনে আছে। কাউকে বলবো না। কিন্তু তুই শুয়ে থাক। নইলে মা...
-       যা ভাগ।

তাই ভাগল সুকু। পিটিস্যারের কড়া মুখটা মনে পড়তেই ব্যাগ পিঠে ফেলে দে দৌড়। দূর থেকেই স্কুলের গেটের কাছে তকাইদের দেখতে পেল ও। সুকু চট করে বাঁদিকে ঘুরে গেল। সে জানে ওদিকে পাঁচিলের একটা দিক ভাঙা আছে। দলটা থেকে একজন তাড়া করে এলো। বাকিরা বোধহয় রুকু আর সমীরের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রাণপণ দৌড়ে একলাফে পাঁচিল ডিঙিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল  স্কুলের চ্যাম্পিয়ন অ্যাথলেট। সে ভালো করেই জানে, অতুলদা যতক্ষণে হাঁকপাঁক করে  এপাশে আসবে, ততক্ষণে ও ক্লাসরুমের নিরাপদ গণ্ডীতে পৌঁছে যাবে।

বেঞ্চিতে ব্যাগ রাখতে রাখতেই প্রার্থনার ঘণ্টা বাজল। সবার সঙ্গে মিলে শান্তভাবে মাঠের দিকে পা বাড়ালো সুকু। আজকের দিনটা সকাল থেকেই অন্যরকম। মধুস্যার প্রার্থনা শুরু করলেন – বিমল প্রভাতে মিলি একসাথে, বিশ্বনাথে করো প্রণাম। ছেলেরা একটু চকিত হয়ে গলা মেলালো। এই গান মানে, আজ কোনো স্যার ছেলেদের কিছু বলবেনতাই ছোট গান।

গান শেষ হতে হেডমাস্টারমশাই এগিয়ে এলেন। সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট, মাথার সাদা চুলে তাঁকে অলৌকিক মনে হয়। সে তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্য, নাকি মুখের সুন্দর হাসিটার জন্য – তা সুকু জানে না। কিন্তু স্যার সামনে দাঁড়ালে চোখ আপনি নত হয়ে আসে। সবকিছুকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। স্যার যখন কথা বলেন – মৃদু শান্ত সে স্বর। গম্ভীর। তখন যেন গাছের পাতাটিও নড়ে না।
-       ছেলেরা, আজ যা বলি, মন দিয়ে শোন। এই পৃথিবী, আমাদের চারপাশ বড়ো সুন্দর। এখানে আমরা সবাই সবাইকে ভালোবেসে মিলেমিশে থাকি। এই পৃথিবী শুধু আমাদের একার নয়। এর সমস্ত গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ – সবার বাঁচবার, আনন্দে থাকার সমান অধিকার রয়েছে। তাই আমোদ ততক্ষণই আনন্দের, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা অন্যের দুঃখের কারণ হয়। আজ আমাদের কিছু ছেলের আচরণে আমি, আমরা সবাই খুব দুঃখ পেয়েছি।
স্যার একটু থামলেন। গলাটা একটু ধরে এসেছিল কি? সুকু ঠিক বুঝতে পারছিল না। সে আড়চোখে একবার টিকলুদাদের দিকে তাকালো। ওরা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল।
-        আমারই কয়েকজন ছাত্র, অকারণে পশুপাখির উপর অত্যাচার করছিল। এ অন্যায়। ভীষণ অন্যায়। তবে অমি খুশি যে, আমাদেরই আরেক ছোট্ট ছাত্রের উপস্থিত বুদ্ধিতে একটি পাখির প্রাণ বেঁচেছে।
আমরা সবাই চাই, এই ঘটনা যেন আর না ঘটে। প্রথমবার বলে, দোষীদের আজ আমি কোনো শাস্তি বা লজ্জার মুখে ফেলবো না। শুধু আশা করব এই ঘটনা এখানেই শেষ হবে। এর পুনরাবৃত্তি হবে না। আমরা সৎ হবো। সুন্দর হবো।
স্যারের দুহাত জড়ো করা। চোখ বন্ধ। উদাত্ত গলার আর্তি ঝরে পড়ল –
অসতো মা সদগময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়...

সুকু দেখল নীল আকাশ নিয়ে বকের সারি উড়ে চলেছে। তাদের পাখায় পাখায় বেজে উঠছে –
ত্বমেব পিতা চ, মাতা ত্বমেব
ত্বমেব বন্ধুশ্চ সখা ত্বমেব.....

ক্লাসে ঢোকার আগে তকাইদা ওকে একবার ডাকলো – রুকুকে বলিস, আমাদেরই ভুল হয়েছে। কাল থেকে ও যেন ইস্কুলে আসে।

সুকুর মন আলোয় ভরে যাচ্ছে। সবাই ভালো থাক। পাখিরা ভালো থাক, গাছেরা ভালো থাক।  ভালো থাকুক টিকুলদারাও।
দোলা সেন||

No comments: