Friday, February 21, 2020

একটি দরজার সন্ধানে



-       তুর কুনুইটো অমন লিল হই গেল কেমনে?
-       পড়্যে গিলাম যি গো। উঠোনে পাটো পিছলাই গেল।
-       মরদটো যদ্দিন ছিলো, আমুও অমনি অনেক পিছলাইছি।
একটা হাসির হররা উঠলো। মালতী আঁচল দিয়ে হাতটা ঢাকার চেষ্টা করতে করতে ঝাঁঝিয়ে উঠলো –
-       সবার ঘরের লুকই খারাপ হয় না। তুর সোয়ামীটা তুকে মারথ্য বুলে...
আলতা দেখল, একটা ঝগড়া পাকিয়ে উঠছে। সে দুপক্ষকে থামাবার চেষ্টায় তাড়াতাড়ি করে বলে –
-       অমন কইরে বুলো না লক্খিদিদি। রাজু লুক খারাপ লয় গো। কিন্তুক ওই মদেই উয়াকে শেষ করল। লেশা করলি পরে উয়ার আর দিক হোঁশ থাকে না। তার উপর মালতীটারও রাগ খুব যি।
রতিয়া ওর ছোপধরা দাঁত নিয়ে একগাল হাসল – তুমাদের সবার বাত সহি আছে। মরে হুয়ে আদমিকো বুরা নেহি বোলনা চাহিয়ে। লেকিন হর হপ্তে মে উ চারদিন কে লিয়ে দুর্গাপুর যাতা থা। উ চারদিন ম্যয় বহুত খুশ রহতি থি। শান্তি মিলতি।
মালতী ঝপ করে ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
-       বাপ মায়ে শুধুই ছিলা চায় চায় কেনে গো? আমার বর, শসুর, শাউড়িকে তো আমুই খাওয়াই। উ তো যা পায়, সব ভাটিখানাতেই দিয়ে আসে। তবু আমার শসুরবাড়িতে, সবাই উয়ারই নাম করে।
লক্ষ্মী উদাস গলায় বলল – বংশ রাখতে গিলে ছিলা চাই যে। ছিলা না থাকলে, মরার সময় মুখে জল কে দিবে?
পার্বতী এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার সেও মুখ খুলল – এই আমাকেই দেখ। বরটা টগরের সাথে ভেগে গেল। কতো কষ্ট করে ছেলে মেয়ে বড়ো করলাম, পড়ালাম। কিন্তু কপাল যাবে কোথায়? ছেলেটা তো এরই মধ্যে বাপের মতোই মদ ধরেছে। নেহাত টিনাটা আছে, তাই সঙ্গেসাথে করে দেয়।
-       তুমার ননদটা, তুমার খুব করেছে ওই সময়।
পার্বতী এইট পাস। তার কথার টানটাও বাবুদের মতো। আলতার ভাষায়, ভালো বাড়ির মেয়ে। কম বয়েসের আবেগে ভুল লোককে বিয়ে করার খেসারত দিয়ে চলেছে জীবনভর।
*
*
সকালের কাজ শেষে এই দুপুর বেলাটুকু ওদের অবসর। শীতের রোদ পিঠে মেখে ফ্ল্যাটের ছাদে এইসময় ওদের একটা দ্বিপ্রাহরিক আড্ডা বসে। তিনটে, সাড়ে তিনটে বাজলে, আবার সব নীচে নেমে, বিভিন্ন ঘরের বৈকালিক কাজ সেরে, যে যার ঘরে ফেরে।

মালতীও ফিরছিল। রূপাবৌদি মানুষটা ভালো। তার হাতের অবস্থা দেখে, একটা ট্যাবলেট দিয়েছিল সকালেই। বিকেলেও হাতে কি যেন লাগিয়ে দিল। ব্যথাটা তাই একটু কম এখন।

ওষুধ লাগাতে লাগাতে বৌদি বলেছিল – ভাত দেবার কেউ নয়, কিল মারবার গোঁসাই। খাইয়ে পরিয়ে এমন আপদ পুষিস কেন?

কেন? বৌদি জানে না, মালতী জানে। ছোটবেলায় বাবা মরে গেছিল যে। দু দুটো কচি বাচ্চা নিয়ে মা লোকের ঘরে কাজ করে পেট পালত। কিছুদিন যেতে উপায় না পেয়ে, মা দাদাকে একটা মারওয়াড়ি বাড়িতে ঢুকিয়ে দেয়। দিনভর দাদা তাদের ঘরে ফাইফরমাস খাটত। বিকেলে ফিরত। দুপুরবেলা মালতী ঘর থেকে বেরিয়ে, চুপি চুপি সেই বাড়িটায় হাজির হতো। তখন দাদাকে ওরা খেতে দিত যে! ঘরের মধ্যে খাওয়ার নিয়ম ছিল না। দাদা খাবারটা নিয়ে বাগানে এসে বসত। মালতীও ভাগ বসাতো তাতে। হোক আধপেটা, খালিপেটের চেয়ে তো ভালো!

মা সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরত। একটা বাড়ির দিদা মাইনের বদলে রোজ খানিক ভাত দিত। মালতী তো সারাদিন ঘুরেই বেড়ায়। সে ঠিক জানে কোন পুকুরধারে শাক হয়েছে, কোথায় মেটে আলু। কখনো কখনো গেঁড়ি গুগলিও তুলে আনত। মা তাই রাঁধত। ভাত দিয়ে মাখলে অমৃতের মতো সোয়াদ।

মা হুড়োহুড়ি করে খাওয়া দাওয়া সেরে, ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকে খিল দিত। খিল মানে, বাবার সেই ভারি বাকসোটা। সেটা টানতে টানতে এনে দরজার গোড়ায় চেপে বসিয়ে দিত।
রাতে মাঝে মাঝেই দরজায় টোকা পড়ত। ঠেলাঠেলিও। মা চেঁচাত – বঁটিখানা হাতেই আছে। ধড় থিক্যে মাথাটো খসাই দিব – মনে থাকে যেন। তারপর, একসময় সেসব বন্ধ হতো। কাঁথার মধ্যে ছেলেমেয়েকে জাপটে ধরে মা ঘুমিয়ে পড়ত।

কিন্তু এভাবে আর কদিন চলে? মা নালিশ জানালো পঞ্চায়েতে। তারপর সেসব উৎপাত বন্ধ হলো ঠিকই, কিন্তু মালতীর খেলাধূলার দিন গেল। আটবছরের মালতীকে, প্রধানের তিনবছরের মেয়েটাকে দেখাশোনার কাজে লাগতে হলো। তা হোক। প্রধানের বৌ লোক ভালো ছিল। মালতীকে পেট ভরে খেতে দিত।

তাই মালতী জানে, বরটা যদি ঘরে না থাকে, তাহলে আজ না হোক, কাল ওর দরজাতেও ধাক্কা পড়বে। ওদের বাড়িতে, বাবার ভারি বাসকোটার মতো কোন বাসকো নেই। ওর খাপরার দরজা এমনিতেই নড়বড়ে। একটা জোরলো লাথিতেই ভেঙে পড়বে।

আর মালতী যে রাজুর এখনকার রাগের কারণটাও বোঝে না এমন নয়। সরকার থেকে গরীবদের জন্য ঘর বানিয়ে দিচ্ছে। পাড়ার কাউন্সিলর শিবুদা বিচক্ষণ লোক। ঘরটা মালতীর নামে করাবে বলেছে। রাজুর নামে করালে, দুদিন পরেই বেচে দিয়ে মদ খাবে। তাতেই বাবুর মানে খুব লেগেছে।

একটা তেতো হাসি উঠে এলো মালতীর ঠোঁটের ডগায়। এটা নয়তো ওটা। মোদ্দা কথা, বৌ পেটানোর অজুহাত কম পড়েছে, এমন অপবাদ রাজুকে কেউ দিতে পারবে না।

 স্বপ্ন দেখে মালতী। বহুদিনের লালন করা একটা স্বপ্ন। ওর নিজের একটা শক্ত দরজাওয়ালা ঘর হবে। ফ্ল্যাটের বাবুদের মতো ঘরের সঙ্গে বাথরুম থাকবে তার। যাতে রাতে বাইরে না বেরোতে হয়। ছোটবেলার আতঙ্ক সে ভোলেনি। রান্না? সেটা সে দাওয়াতেই করে নেবে আপাতত। পরে পয়সা জমলে নাহয় দাওয়াটার একধার ঘিরে নেবে।
তিল তিল করে পয়সা জমিয়ে যাচ্ছে তাই। পঞ্চাশ, একশো, দুশো... যখন যেটুকু পারে, প্রতি মাসে ব্যাঙ্কে জমা করতে থাকে। আর ভাবে, বরটা যা কামায়, সেটা যদি ঘরে আনে, তাহলে....

নাঃ, আজ আর মেজাজ খারাপ করবে না মালতী। আসলে শাশুড়ি যতই শেখাক না কেন, রাজু মারলে সেও তো আর চুপ থাকে না! একবার তো থানা পুলিস করে ছেড়েছিল। রাজু তখন রেললাইনে গলা দেবে বলে ভয় দেখালো বলেই না, সে তার নালিশ ফিরিয়ে নিল! এসবের জন্য পাড়ায় তার খুব বদনাম। সে হোক গে। মালতী অতো মার খেতে পারে না। ওর ব্যথা লাগে না বুঝি? মালতীর মুখে একটু হাসি আনাগোনা করে আবার। ফল কিছুটা হলেও হয়েছে। তারপর থেকে রাজুও ওকে একটু সমঝে চলে। আগের মতো রক্তারক্তি কাণ্ড করে না। চড়, থাপ্পড়, ঠেলে ফেলে দেওয়ার মধ্যেই ব্যাপারটা আটকে থাকে। তা যদি বলো,পুরুষমানুষের অতো দেখতে গেলে চলেও না।

নাঃ, রাজুকে আজ ভালো করে বোঝাতে হবে। পুরোটা না হোক, যদি রোজগারের কিছুটাও অন্তত দেয়! আজকেই একটা বাড়িতে মাইনে দিয়েছে। বাড়ি ঢোকার আগে কালুয়ার দোকান থেকে অল্প মাংস কিনল, মালতী। রাজু আর মেয়েটা দুজনেই মাংস ভালোবাসে। খাইয়ে দাইয়ে আজ রাতেই আরেকবার বুঝিয়ে দেখবে।

ইদানীং রাজুর পেটে একটা ব্যথা হচ্ছে। মালতী এই ব্যথা চেনে। ওদের পাড়ার কয়েকজন তো এই রোগেই মরল। রাজুকে দু-তিনবার হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। কিন্তু মদটা ছাড়াতে পারেনি। ডাক্তাররা যতই নিষেধ করুক, বাড়ি ফেরার পর, চার-পাঁচদিনের মধ্যে আবারও যে কে সেই।

মালতী তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা চালায়। একলা হয়ে যাবার আগে একটা শক্ত দরজাওয়ালা ঘর তাকে বানাতেই হবে। বাঁচতে গেলে একটা শক্ত দরজার আড়াল বড্ডো জরুরী যে।
দোলা সেন||

No comments: