ঘাটটাকে প্রায়ই স্বপ্নে দেখি। নদীটাকে
কিন্তু দেখতে পাই না জানো? এমন কি তার কলকল ছলছল আওয়াজও কানে আসে না। তবে কি ওটা
নদী নয়, পুকুর? উঁহু, পুকুর নয় বোধহয়। কারণ কালো জলের ওপারে অন্য পাড়টা দেখতে পাই
না। দূরে একঢাল কালো মেঘের ছায়াভরা আকাশ বরং জল ছুঁয়ে অলসভাবে শুয়ে থাকে। তাহলে
হয়তো দীঘিই হবে ওটা।
দীঘি কিংবা শান্ত দুকূল ছাপানো নদী যাই
হয়ে থাকুক না কেন, তার ঘাটের চকচকে বাঁধানো সিঁড়িতে আমি বসে থাকি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলে একটা বড়ো চওড়া
কালো পাথর। মেয়েরা সেখানে বসে গায়ে সাবান ঘষে, তারপর টুপটুপ ডুব দেয় পানকৌড়ির মতো।
দু একজন আবার সাঁতরে গভীর জলে চলে যায়। আমারও খুব ইচ্ছে করে ঐ কালো জলে ঝাঁপান
জুড়তে। চারটে ধাপ নামলেই জল। পায়ে জল লাগলেই সারা শরীর আতঙ্কে হিম হয়ে যায়, যেন কি
এক ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেছে, নাকি ঘটবে – বুঝতে পারি না। হাঁকাপাঁক করে বিছানায় উঠে
দেখি, নীল চাদর কুঁচকে গিয়ে ঢেউয়ের মতো আলপনা এঁকেছে। জল খাই। বাথরুম থেকে ঘুরে এসে চাদর টানটান করে
স্বপ্ন তাড়াই। তারপর ঘুমিয়ে পড়ি।
এভাবেই বারবার ফিরে ফিরে আসে স্বপ্নটা।
ঐ কালো জলে যে কিসের ভয়, তা আর জানা হয় না কিছুতেই। আজকাল তো কেমন নেশার মতো হয়ে
গেছে। সপ্তাহখানেকের বেশি হয়ে গেলেই ছটফটানি লাগে। ফুলতোলা চাদর. বালিশের ওয়াড়
বদলে মীনামাসিকে ঘননীল চাদর পেতে দিতে বলি। মাসী গজগজ করতে করতে চাদর বদলায়।
অথচ এই ঘাটটা আমি দেখিনি কখনো। আমাদের
এখানে নদী, পুকুর কিচ্ছুটি নেই যে! বড়দের বললে সবাই হাসে। লিপি বলেছে পরীক্ষা শেষ
হলে ওর মামাবাড়ি নিয়ে যাবে আমাদের। আমাদের মানে আমরা চারজন – লিপি, রুমি, টিনা আর
আমি মিলি। সেখানে নাকি দীঘি, নদী, পুকুর সব আছে। কিন্তু বাড়ির লোক অনুমতি দিলে তবে
তো! তা সেই পারমিশন আদায় হলো টুয়েলভের পরীক্ষা দেবার পর। এতো পড়াশোনার পরে দিন
পনেরোর ছুটি তো বনতাই হ্যায়, না? তাছাড়া এরপর কে কোথায় ছিটকে যাব – এসব ভেবেও
বোধহয় বাড়ির বড়োরা একটু নরম হয়েছিলেন। সে যাকগে। অতোকথা ভাবার দরকারই বা কি? মতটা
বদলে যাবার আগেই ঝটপট ব্যাগ গুছিয়ে ট্রেনে চড়ে পড়ি। ভুবনপুর নামটার মধ্যে কেমন যেন
একটা রাখালিয়া বাঁশির টান। সেটা বলতেই টিনা হেসে গড়িয়ে পড়ল – দেখিস, আবার অন্য
কোনো টানে জড়িয়ে পড়িস না যেন।
লিপি হঠাৎ অভিভাবকের ভূমিকা নেয় – তোকে
নিয়েই বেশি চিন্তা রে মিলি। তোর তো আবার বেশি বেশি সাহস!
-
তোদের মতো অতো আতু আতু পুতু পুতু করতে
পারব না, বুঝলি? সবেতে এতো ভয় যে তোরা পাস কি করে সে তোরাই জানিস।
লিপির মামারা বেশ অবস্থাপন্ন। দোতলা
বাড়ি। গাছপালা ঘেরা বিরাট উঠোন। আমাদের থাকার ব্যবস্থা একটা বিরাট হলঘরে। বিকেলে
পৌঁছেছি। লিপির ভাই রুপু সটাসট গাছ থেকে ডাব পেড়ে আমাদের খেতে দিল। আমরা তো রীতিমতো
ইমপ্রেসড! উঠোনের পিছনে একটা ছোটো পুকুর। তাতে নাকি অনেক মাছ। লিপির মামাতো দাদা,
শুনলাম তার নাম রাজু, সে একটা ছোট্ট জাল নিয়ে আমাদের জন্য সেই পুকুর থেকে মাছ ধরতে
গেছে। খানিক পরেই সে ফিরল। তার জালে বেশ কয়েকটা মাঝারি সাইজের রুই মাছ। একটি মেয়ে
এসে সেগুলো নিয়ে কাটতে চলে গেল। তা
রাজুদা আমায় দেখে অমন চমকে উঠলো কেন কে জানে! আরেকটু হলেই তো মাছগুলো হাত থেকে পড়ে
যেত। আলো আঁধারিতে আমাকে পেত্নীর মতো দেখতে লাগছিল নাকি? কে জানে, হবেও বা!
তা এ নিয়ে
বেশি ভাববার অবকাশ পাওয়া গেল না। লিপির মামা, মামি, দিদা, রুপু, রাজুদা সবাই দারুণ
আড্ডাবাজ। দাদুমণির ঝুলি তো মজার মজার গল্পে ঠাসা। হইচই গল্প হাসির মধ্যে দিয়ে কখন
যে খাওয়ার সময় হয়ে গেল কে জানে! খাওয়ার পর এক জম্পেশ ঘুমে রাত কাবার।
সকালবেলায়
লিপির সঙ্গে গ্রাম দেখতে বের হলাম। কোথায় সেই গল্পে কবিতায় পড়া মেঠো পথ? একটু সরু
হলেও আঁকাবাঁকা পিচরাস্তা চলে গেছে ছোট ছোট বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে। তবে লোকজন খুব
ভালো। অনেকেই লিপির বাড়ির সবার খোঁজখবর নিল। দুএকজন তো জোর করে গাছের ফল, ঘরের
নাড়ুটাড়ু খাইয়েও দিল। রোদ চড়ে যাচ্ছিল। তাই ফিরে এলাম। ঠিক হলো বিকেলে এখানকার
জমিদারবাড়ি দেখতে যাব। সেই শুনে রাজুদা বলল, ওদিকে গেলে সেও সঙ্গে যাবে। আমাদের
ইচ্ছে ছিল নিজেরা বন্ধুরা বন্ধুরা ঘুরে আসব। কিন্তু দাদুমণি বলে বসলেন – রাজা ছাড়া
রাজবাড়ি? তা কি করে হয়?
কাজেই বিষয়টা
ওখানেই ধামাচাপা পড়ে গেল।
বিকেলে
দলবেঁধে বেরিয়েছি। রাজুদা বলল – পাকারাস্তা দিয়ে গেলে অনেক ঘুরপথ হবে, তার চেয়ে
চল. মাঠটাকে আড়াআড়ি পেরোই। তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাওয়া যাবে।
-
তাই চলো তবে – বলে লিপি তড়বড়িয়ে মেঠো পথে নেমে যায়। আল পথের
ওপর নরম বিকেলের আলো। ক্ষেতের শেষে বড় আমবাগান। যতো কাছে
আসছি, ততোই একটা অস্বস্তি চেপে বসছে বুকের ওপর। এতো চেনা লাগছে কেন সবকিছু? অথচ
সত্যিই তো আর চিনি না। ঘোরের মধ্যে ডানদিকে বাঁক নিতেই লিপি চেঁচিয়ে উঠল – এই
ট্যলাকার্তিক, ওদিকে নয়। বাঁদিকে।
বাইরের লোকের সামনে এহেন সম্বোধন? রেগে লাল হয়ে রাজুদার
দিকে তাকাই। আশ্চর্য! লোকটার চোখ জ্বলজ্বল করছে, মুখের হাসিটাও কেমনধারা যেন। তবে
সেটা লিপির অসংস্কৃত শব্দের এফেক্ট নয় – এটা বুঝতে ব্যোমকেশ হতে লাগে না। এসে
থেকেই দেখছি রাজুদা আমায় একটু বিশেষ নজরে দেখছে। তবে সেই বিশেষটা যে কি সেটাই বুঝে
উঠতে পারছি না। আমাদের চেয়ে অনেকটাই বড়ো রাজুদা।
ধুত্তোর! বলে
মাথা ঝাঁকিয়ে দলের সঙ্গে মিশে গেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম জমিদারবাড়ি।
খুব সুন্দর স্থাপত্য। দেখলেই কেমন যেন ভীষণ আপন মনে হয়। মনে হয়, আমি যেন জানি ওই
বাড়ির কোন কোণায় কি আছে। বহুদিন সেখানে কেউ থাকে না। ফলে এতো সুন্দর বাড়ি আর বাগান
ঘাসে, আগাছায় ভরে গেছে। প্রায় সন্ধ্যার মরা আলোয় ভিতরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। অন্য
কোনোদিন দিনের আলোয় এসে জায়গাটা ভালো করে দেখতে হবে। এতো সুন্দর একটা বাড়ি এভাবে
নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সেকথা বলতেই রাজুদা কেমন
স্বগোতোক্তির মতো করে বলল – কে জানে! হয়তো এভাবেই সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। যদি না –
যদি না টা যে কি, সেটা আর খুলে বললো না রাজুদা। রুমি
হঠাতই গলা ছেড়ে গেয়ে উঠল –
-
কেউ তো জানে না কখন যে কার কি হয়....
আমরাও কোরাসে গলা মেলালাম – জীবন তো বদলায় না, শুধু বদলে
যায় সময়।
হাসতে হাসতে গাইতে গাইতে ফিরে এলাম। আর আমাদের এতো খুশি
দেখে রাজুদা কেমন যেন মুষড়ে পড়ল বলে মনে হলো।
রাতের মেনুতে
ভাত, আলুপোস্ত, বিউলির ডাল, মাংস আর চাটনি। এতো ভালো রান্না কক্খনো খাইনি।
খেয়ে দেয়ে আমাদের সেই স্পেশাল হলঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছি, এমন সময়ে দরজার বাইরে
রাজুদার গলা শোনা গেল – আসতে পারি?
রুমি আর টিনা এরই মধ্যে রাজুদার বিশাল ফ্যান হয়ে গেছে।
আজ দুপুরেই রাজুদা বলেছে এই ছুটির মধ্যেই সে নাকি আমাদের সাঁতার শিখিয়ে দেবে! এমন
কথা যে বলে, তাকে – “আরে বলার কি আছে”, “আস্তেজ্ঞা হোক”, “মোউস্ট ওয়েলখাম” –
ইত্যাদি ভাষায় অভ্যর্থনা করতে হয়। এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হলো না। রাজুদা ঘরে ঢুকে
একটা মিষ্টির ঠোঙা লিপির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল – খেয়ে দেখ।
-
গোপালের মনোহরা? লিপির জ্বলজ্বলে চোখটা দেখে যে কেউ
বুঝতে
পারবে মিষ্টিটা খুব ভালো খেতে। অনেকটা পান্তুয়া আর চমচমের মাঝামাঝি দেখতে।
মুখে দিয়েই কেমন একটা ঝটকা খেলাম। এ স্বাদ যে আমার খুব প্রিয় আর পরিচিত! আবেশে চোখ
বুজে এলো। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই হাত বাড়িয়ে বললাম – তিনটে খাবো কিন্তু।
ঘরের অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা আমায় চোখ খুলতে বাধ্য করল।
রাজুদার মুখ হাঁ হয়ে আছে। চোখটা কি এক অপার্থিব আনন্দে চকচক করছে। আর বাকিরা বোধহয়
এরকম এক্সপ্রেশন দেখেই কেমন জানি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ করে গেছে। এ রাম! এভাবে
হ্যাংলামি করা একেবারেই ঠিক হয়নি। আমতা আমতা করে পরিস্থিতি সামাল দিতে বলি – আরে
না, না। আমি তো জাস্ট ঠাট্টা করছিলাম। তবে মিষ্টিটা সত্যিই খুব ভালো।
রাজুদাও নিজেকে সামলে নিয়েছে ততক্ষণে – গোপালের মনোহরা
একটা খেলে ঠাকুর পাপ দেয়। সবার জন্যই এক্স্ট্রা আনা হয়েছে। লজ্জা না করে খেয়ে ফেল।
আমি এবার আসি। গুড নাইট।
আর গুড নাইট! বাঁদর, থুড়ি, বাঁদরীবাহিনী তাহলে আর আছে কি
করতে? শুরু হয়ে গেল!
-
রাজুদা, সবসময়ে মিলিকে এস্পেশাল অ্যাটেনশন দেয়। খেয়াল
করেছিস টিনা?
-
কি কেস গুরু? এমনিতে কেউ এভাবে অ্যাটেনশন দিলে তো তুমি
তার ব্যান্ড বাজিয়ে ছাড়ো। এবেলা দেখেও দেখছো না যে?
-
কি বুদ্ধি? কারো বাড়ি এসে তাদের বাড়ির লোকের পিছনে
লাগবো? তোরা কি রে? – একটা দুর্বল প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করি।
-
ওরে দ্যাখ দ্যাখ, মিলিও নরমভাবে কথা কইতে জানে! লিপি,
তুই বরং এখন থেকেই বৌদি বলা প্র্যাকটিস করতে থাক। হি হি হি.....
-
আমার কিন্তু এমন বৌদি হেব্বি পছন্দ। আমি রাজি। মিলি তুই
একদম চাপ নিস না। মামা মামীর কাছে তোর হয়ে জম্পেশ ব্যাটিং করবো। দেখে নিস।
-
ঘুমোতে দিবি তোরা? এবার সবকটার মাথায় জল ঢেলে দেবো
কিন্তু।
চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ওদের হি হি হা হার মাত্রা
কমার বদলে বেড়ে গেল। যা খুশি করুক গে। খেয়েদেয়ে সত্যিই তো কারো কোনো কাজ নেই এখন!
কিন্তু আমার রাজুদার উপর একটুও বিরক্তি আসছে না কেন কে জানে। বরং একটা খুব
স্নেহভরা ভালোবাসা পাবার মতো অনুভূতি হচ্ছে। মন শান্ত করা অনুভূতি।
এরপরে কয়েকটা দিন চাঁদমারির বিল, সাঁতার, গোপালের মনোহরা
ইত্যাদি নিয়ে মেতে রইলাম। রাজবাড়ির দিকে যাবার ফুরসতই পেলাম না। তবে সাঁতার শিখতে
খুব মজা লাগছিল। লিপি আগে থেকেই সাঁতার জানতো। টিনা আর রুমিটা সত্যি ক্যাবলা। ওদের
হাত পা ছোঁড়ার মধ্যেই আমি দিব্বি সাঁতার কাটতে শিখে গেলাম। রাজুদা সত্যিই ভালো
সাঁতার শেখায়। কিন্তু চারদিনের মাথায় আমি যখন পুকুর এপার ওপার করে ফেললাম, তখন
লিপির চক্ষু চড়কগাছ। রাজুদা শুধু বলল – আমি তো আগেই বলেছিলাম মালা খুব তাড়াতাড়ি
সাঁতার কাটবে।
-
মালা নয় দাদাই, মিলি।
লিপি দুপুরে খুব ফলাও করে আমার কৃতিত্ব বর্ণনা করল। সবাই
অবাক। শুধু দিদুন আমার মাথায় হাত রেখে বললো – আগের জন্মে তুই নিশ্চয়ই খুব ভালো
সাঁতারু ছিলি দিদিভাই।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা। লিপি হঠাৎ ধরে বসলো – কতোদিন তোমার
বাঁশি শুনিনি দাদাই। আজ একটু শোনাবে?
মামিমা দুঃখের সাথা মাথা নাড়লেন – ওকে বলে লাভ নেই রে।
কি যে মাথায় ঢুকেছে! কতোবার বলেছি কিন্তু কিছুতেই বাজাতে চায় না। অথচ কী ভালোই না
বাজাতো! টিনা চুপিচুপি আমায় ঠেললো – তুই বল না। তুই বললে নিশ্চয়ই...
তাকিয়ে দেখি মিচকেগুলোর মুখে মিচকি হাসি। তার মানে প্রি
প্ল্যানড! এরপর বাড়াবাড়ি করলে বড়োদের চোখে পড়বে। এগুলোর কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই।
অগত্যা প্রাণ বাঁচাতে – রাজুদা প্লিজ....
কথা ভালো করে শেষ হবার আগেই রাজুদা ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেল।
সবাই কেমন অপরাধী মুখ করে বসে রইলাম। কিরকম হলো ব্যাপারটা?
একটু পরে বাগানের পেয়ারাতলা থেকে বাঁশির সুর ভেসে এলো।
মনে হলো যেন একটা অব্যক্ত কান্না মাঠের কুয়াশায় গলে গলে মিশে যাচ্ছে। দিদু আর মামি
হাতজোড় করে কপালে ছোঁয়ালেন। কার উদ্দেশ্যে কে জানে। সে রাতে আর গল্প জমল না। কি
যেন এক ভার নিয়ে আমরা চুপচাপ খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। জানলার বাইরে ফাটাফাটি জ্যোৎস্না।
নীল আকাশ থেকে নরম আলোর ঝর্নায় চারিদিক
ধুয়ে যাচ্ছে। কোথা থেকে একটা মিষ্টি ধূপের গন্ধ ভেসে আসছে। কেউ আমায় ডাকছে।
অনেকদিন ধরে যেন তার এই রাতেরই অপেক্ষা ছিল। চুপি চুপি চটিটা পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে
আসি। দরজা, উঠোন সব পার হয়ে রাস্তায় এসে পড়ি। এই আলোয় মোড়া মেঠো পথটা আমার খুব
চেনা। আমি নিশ্চিত পদক্ষেপে এগিয়ে যাই। কিন্তু পাশ দিয়ে কি একটা ছায়া সরে গেল?
চারিদিকে তাকাই। কেউ নেই। মেঠো পথের ধারে
ধানক্ষেত, তারপর আমবাগান। আমি ডানদিকে বেঁকে যাই। আমবনের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ।
পথের শেষে আমার চিরচেনা স্বপ্নে দেখা ঘাটখানি! লাল টুকটুকে পৈঠায় বসি। কালো ছলছলে
জলের গায়ে হাত বোলাই – এতোদিন দেখা দাও নি কেন?
জল তার টুলটুলে গলায় জবাব দেয় – সময় হয়নি যে! তোমার
জন্য সব কথা জমিয়ে রেখেছি। শুনবে না? এসো এসো।
ঘাটের পাশে বসার বেদী ডাকে – মালা, এসো।
ঘাটের পাশ দিয়ে পায়ে চলার পথ। সেও ডাকে – আয় আয়। কোনদিকে
যাই?
ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠি। পায়ে পায়ে পথ ধরে চলি।
হঠাৎ করে স্তব্ধতা নামে। রাতচরা পাখির ডাক, ঝিঁঝির গুনগুনানি, পাতার সরসরানি কিচ্ছু
নেই। গরমের রাত হঠাৎ এতো ঠাণ্ডা কেন? কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে – নাই বা গেলে? কিন্তু
না গিয়ে যে উপায় নেই একথা বোঝাবো কাকে? জমিদারবাড়ির বাগানে এসে পড়েছি। আগাছা কই?
কি সুন্দর বাগান! মরশুমি ফুলে বাগান ছেয়ে আছে। রঘু মালি খুব যত্ন করে গাছ লাগায়।
পাথরের পরীর মাথা দিয়ে ঝরঝরিয়ে ফোয়ারার জল পড়ছে। সযত্নচর্চিত ঘাসের লনে কাঠের
চেয়ার টেবিল। বড়ো ছাতা।
পাশ কাটিয়ে বাড়ির দিকে এগোই। কেউ কি আমায় নজরে রাখছে?
আবার ঘুরি। নাঃ, মনেরই ভুল। বাড়ির সিঁড়িতে পা রাখি। চওড়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলে
ডানপাশের ঘরটা মায়ের। তার পাশের ঘরটা আমার। আট বছরের মণিমালার। আস্তে করে নিজের
ঘরের দরজা খুলি। ঐ তো নাচুনি মেম পুতুলটা! কাঠের রকিং হর্সটা টুকটুক করে দুলছে।
কেউ কি দুলছিল এখুনি? খাটের উপর শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছি আমি – ছোট্ট মণিমালা! মা
ঘরে ঢুকল। একটু একটু হাঁপাচ্ছে। মুখখানা ফ্যাকাশে। বাইরের আলো কমে এলো হঠাৎ। মেঘ
করেছে। মা ডাকছে –
-
মালা উঠে পড়। আমাদের এখুনি পালাতে হবে।
আমি জানতাম। মা আমাকে আগেই বলে রেখেছিল। কাকাইয়ের হাবভাব
নাকি ভালো নয়। মা আর আমাকে সরিয়ে সেই নাকি সবকিছুর মালিক হতে চায়। এখানে থাকলে
আমাদের খুব বিপদ। বাবা মারা যাবার পর থেকেই কাকাইয়ের ব্যবহারের বদলটা আমারও চোখে
পড়েছিল।
চট করে উঠে রুমাালে বাঁধা মার্বেলগুলো নিয়ে নি।এগুলো
বাবাই আমায় এনে দিয়েছিল। ভীষণ ঝলমলে আর রঙিন সব মার্বেল। মাও দেখলাম একটা
কাগজ প্লাসটিকে মুড়িয়ে নিয়েছে। মার হাত ধরে বাইরে আসি। নিকষ কালো আঁধার। সারা বাড়ি
ঘুমন্ত। অন্যদিনও কি এমন নিস্তব্ধই থাকে? কে জানে? চেনা পথ। আন্দাজেই ঘাটে এসে
পৌঁছাই।
-
সেদিন বলছিলি না এখানে তোর একটা গোপন কুঠরি আছে?
-
আছেই তো। সেটার কথা কেউ জানে না।
-
একটা জিনিস লুকিয়ে রাখতে পারবি? পথে যদি কেউ কেড়ে নেয়?
-
হ্যাঁ অ্যা অ্যা। কী জিনিস মা?
মা হাতের প্যাকেটটা দেখায়। ওঃ এইটুকু? বসার বেদীটার
পিছনের একটা পাথর আলগা। সেটা সরাতেই যে ছোট্ট ফোকরটা বেরোল, তাতে মায়ের প্যাকেটের
সঙ্গে আমার মার্বেলের প্যাকেটটাও রেখে দিই। মা যে বললো পথে কেউ কেড়ে নিতে পারে!
পাথরটা আবার ঠিক করে রেখে দিই।
ঘাটে বাঁধা নৌকা। নৌকায় মাঝিদাদা আমাদের তুলে নেয়। বাবার
খুব বিশ্বাসী লোক নাকি সে। নৌকা চালাতে
চালাতে আশ্বাস দেয়। দীঘির পরে নালা। সেই নালা দিয়ে একবার চাঁদমারির বিলে পড়তে
পারলে আর ভয় নেই। বিল গিয়ে মিশেছে ডুংরি নদীতে। সেখানে পৌঁছাতে পারলে আর কেউ
আমাদের ধরতে পারবে না। আমি জানি। এই পথ দিয়েই তো মামাবাড়ি যাই। আজও তাই যাচ্ছি।
মাঝিদাদা কথা বলে আর মাঝে মাঝে নীচু হয়ে নৌকায় কি সব কাজ করে। অন্ধকারে দেখাও যায়
না ভালো।
আমরা যখন মাঝদীঘিতে, তখন মেঘ কেটে আবার জ্যোৎস্না উঠল।
পায়ের তলাটা ভিজে ভিজে ঠেকছে না? মাঝিদাদার মুখে কাকাইয়ের মতো হাসি কেন? দেখ না
দেখ, মাঝিদাদা নৌকা ছেড়ে একলাফে জলে ঝাঁপ দিল। ভুক ভুক করে জল উঠছে নৌকায়। আমার
মনে পড়ল মা সাঁতার জানে না। আমি জানি। রাজাদাদা আমাকে সাঁতার শিখিয়েছে। একথা কেউ
জানে না। মার খুব জলে ভয়। তাই লুকিয়ে লুকিয়ে শিখিয়েছে। আমি পারবো না মাকে বাঁচাতে?
মাকে বলতেই মা একেবারে আমায় বুকে জড়িয়ে ধরল।
-
চল, তাহলে জলে ঝাঁপ দে। তুই আগে। তারপর আমি।
আমি লাফালাম। কিন্তু মা উল্টো দিকে লাফালো কেন? হাউমাউ
করে কেঁদে উঠলাম আমি। আর মুখের মধ্যে জল ঢুকে গেল। প্রাণপনে সাঁতার কাটি। মণিমালা,
নৌকা, মণির মা কোথায় মিলিয়ে যায়। একা আমি জলে সাঁতরাতে থাকি। পাড়ের কাছে আসতে একটা
বলিষ্ঠ হাত আমাকে ডাঙায় ওঠায়।
-
রাজাদাদা?
-
হ্যাঁ মালা, আমি তোমার রাজাদাদা। আমি তোমাকে রাতে বেরোতে
দেখেই পিছু নিই। মাঝখানে কি করে যে হারিয়ে ফেললাম!
-
কিন্তু, রাজুদা তুমি....আমি মিলি....
-
আমি নিজেও জানিনা। কিন্তু তোমার কোঁকড়া চুল, কানের নীচের
বড় তিল – আমায় চমকে দিয়েছিল। তারপর তোমার তিনটে মনোহরার দাবি, তাড়তাড়ি সাঁতার
শেখা, রেগে গেলে চুল ঝাঁকিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরা – সবকিছু আমায় বারবার বলছিল আমার
মালা, মলি হয়ে ফিরে এসেছে। মলির সময়ে বারো বছরের রাজা তোমাকে খুঁজে পায়নি, এবার
তোমাকে সে আর হারিয়ে যেতে দেবে না।
ধীরে ধীরে রাজাদা নাকি রাজুদাকে
সব কথা খুলে বলি। খুব নিশ্চিন্ত লাগছে আজ। ছেলেবেলার একটা আশ্রয় খুঁজে পাওয়ার
নিশ্চিন্ততা। রাজাদা জানতে চায় –
-
মালার কি হলো তারপর?
মাথা নাড়ি আমি – জানি না।
-
জানতে হবে। আমার মন বলছে জানা যাবে। কিন্তু সে জানায়
বিপদ থাকতে পারে। মালার কাকাই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল কেন জানিনা। হয়তো অপরাধবোধ।
হয়তো অন্যকিছু। বিক্রি করার চেষ্টা করেছিল। হয়নি। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে ঐ
কাগজটা বাড়ির দলিল ছিল। পায়নি বলে বিক্রিও করতে পারেনি।
-
দেখবো?
-
না। এখন বাড়ি চলো। সকাল হয়ে আসছে। তুমি একদম ভিজে গেছ।
পরে আসা যাবে। তবে কথা দাও একা আসবে না।
-
একসঙ্গেই আসব। কথা দিলাম।
-
কাল রাতে। সবাই ঘুমোলে পর।
-
ঠিক আছে।
সবাই জেগে ওঠার আগে বাড়ি ফিরে আসা গেছে। রাজুদা – নাকি
রাজাদা না থাকলে সম্ভব হতো না। এখনকার অলিগলি আমার চেনা নয়। একটাই কথা মাথায় ঘুছে
এখন। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। বরফের মতো ঠাণ্ডা। অনেকদিন আগে এক শিশুর সঙ্গে কী
হয়েছিল জানতেই হবে। সে কি আমিই ছিলাম? জানতে হবে।
দুপুরে একটা
ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোলাম। এটাও রাজাদার বুদ্ধি। কাল শরীর ফিট রাখতে হবে। টিনারা
আমার গম্ভীর মুখ দেখে একটু কৌতূহলী। শরীর খারাপ বলে এড়িয়ে গেছি।
রাত এসেছে আবার। গতকাল পূর্ণিমা ছিল। তাই আজও চারধার আলোয়
আলোময়। রাজাদা বললো আলাদাভাবে যাওয়াই ভালো। ও আড়াল থেকে আমার
উপর নজর রাখবে। আমি ঘাটের কাছে গেলাম। বেদীর নীচে পাথরটা ঘাস মাটিতে আটকে আছে।
একটা লোহার শিক এনেছিলাম। সেটা দিয়ে খোঁচাতে পাথারটা আলগা হলো। কাঁপা হাতে ভিতরে
হাত ঢোকাই। মলিন কয়েকটা নুড়ি বাইরে গড়িয়ে পড়ল। হতাশায় মন ভরে গেল। তার মানে সবই
আমার মনের কল্পনা? কি করে বোকার মতো এইসব পূর্বজন্ম পরজন্মের গল্পে বিশ্বাস
করেছিলাম আমি? নিজেকে ভেঙিয়ে বলি – মিলি তোর আর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে কাজ নেই।
কুসংস্কারে আচ্ছন্ন বেকার গাধা কোথাকার!
পাথরগুলো ঘাটের জলেই ফেলে দেব। এই বোকামির এখানেই ইতি
হোক। তবু সব বুঝেও বড্ডো মন খারাপ করছে আমার। নুড়িগুলো জলে ছেড়ে দেবার আগে
একটুক্ষণ হাতে ধরে থাকি। আরেঃ! জলে ধুয়ে ওপরের মাটি গলে গিয়ে এ কি রঙের বাহার!
আমার হাতের মধ্যে উজ্জ্বল রঙিন মার্বেলগুলো নিয়ে সিঁড়িতে অবশের মতো বসে থাকি।
চোখের সামনে যেন একটা ছায়াছবির দৃশ্য ফুটে উঠতে থাকে। সিঁড়ির তলার ধাপে মণিমালা
অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। মাঝিদাদা ওপরের ধাপে। তার বুক থেকে গড়িয়ে পড়ছে গরম রক্তের
ধারা। পাশে বন্দুক হাতে কাকাই দাঁড়িয়ে। দাইমা জলের ছিটে দিচ্ছে মালার চোখেমুখে।
দাইমা – তুমিও? মালার জ্ঞান ফিরেছে। কাকাই বলছে – বদমাস মাঝিটা ওদের মা মেয়েকে জলে
ডুবিয়ে মারতে চেয়েছিল গয়নার লোভে। তাই তাকে শাস্তি দিয়েছে কাকাই। দাইমা ওকে কোলে
তুলে বাড়ি নিয়ে গেল। মালা খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবু ও ছটফট করছে। কাঁদছে
অবিশ্রান্ত। বিছানায় শুইয়ে দাইমা জোর করে ওকে একগ্লাস দুধ খাইয়ে দিল। কি ছিল ওই
দুধে? মালা অগাধে ঘুমিয়ে পড়ল। এরপর.....
আমার মাথা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে
ভীষণ। কারণটা এখন আমার জানা। এর বদলা নিতেই হবে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলাম। ফোকরে হাত ঢুকিয়ে
প্লাস্টিকে মোড়া কাগজটা বের করলাম। শার্টের ভিতর গলিয়ে নিলাম। আমি সবসময় শার্ট গুঁজে
পড়ি। ওটা ওখানেই নিরাপদ। এবার কোথায় যেতে হবে আমি জানি। স্থির লক্ষ্যে বাড়ির দিকে
এগিয়ে যাই। আজকের পথ আগাছায় ঢাকা। কিন্তু আমার পথ ভুল হয় না।
সিঁড়ি বেয়ে চিলেকোঠার ঘরে পৌঁছে যাই একদমে। অন্য একটা পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি। নিশ্চয়ই রাজাদা। একটা দেওয়ালে একটা ছোট্ট অবয়বের
ছায়া। পরম মমতায় হাত রাখি। এইবার আমার নিঃশ্বাস সহজ হয়। আমি এতোক্ষণে সবটুকু বুঝতে
পেরেছি।
আমার পিঠের ওপর আরেকটা ছায়া এসে পড়ে। দরজা জুড়ে যে লোকটা
দাঁড়িয়ে আছে, তার সঙ্গে মালার কাকাইয়ের মুখের খুব মিল।
-
হরি ঠিকই
বলেছিল তাইলে। তোর খুব কৌতূহল, না? অনেক কিছুই জেনে গেছিস দেখছি। কি করে বুঝছি না,
তবে....
ওই নিষ্ঠুর
দৃষ্টি আর সাপের মতো শীতল চোখের একটাই মানে হয়। আমি একটু পিছিয়ে দেওয়ালে হাত রেখে
দাঁড়াই।
-
হা হা হা।
একদম ঠিক জায়গাতেই দাঁড়িয়েছিস। যে কাগজটা বের করে আনলি, সেটা ভালোয় ভালোয় দিয়ে দে।
নয়তো মালার মতো তোকেও ঐ দেওয়ালে গেঁথে দেব।
-
কিসের কাগজ?
-
তোকে অনেকক্ষণ
ধরে ফলো করছি। বাড়ির দলিলটা যে এবার চাই খুকুমণি।
-
এই বাড়ি, জমির
অনেক দাম না?
লোকটার ধৈর্যচ্যুতি
হচ্ছে। আমি এটারই অপেক্ষা করছিলাম। এগিয়ে আসছে পশুটা। দুটো চোখ ধকধক করে জ্বলছে।
আমি ঠিক সময়ে আধপাক ঘুরে পা টা সোজা চালালাম। লোকটা এটার আশঙ্কা করেনি। মুখ চেপে
শুয়ে পড়েছে। রক্ত গড়াচ্ছে হাতের ফাঁক দিয়ে।
-
মালা আট ছিলো।
আমি আঠেরো। ক্যারাটের ট্রেনিংটা ভালোই পেয়েছি – কি বলেন?
-
সেটা দিয়ে কি
রিভলবারের সঙ্গে লড়া যায়?
দ্বিতীয়জন
এবার সামনে এলো। বেশ কিছুটা দূরে। হাবভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে পাকা প্রফেশনাল। কাছে
আসছে না। রাজাদা কোথায়? কাকাইও ধীরে ধীরে উঠে বসছে! এবারও কি তাহলে ওরা...
-
হ্যান্ডস আপ!
হুইশল! তার
মানে পুলিস! মুহূর্তে গুলি চালাল লোকটা। সঠিক সময়ে সরতে পেরেছি। তাও কাঁধের ওপরটা
ছিঁড়ে গেল গরম সীসের ছোঁয়ায়। আরেকটা আওয়াজ। লোকটা মাটিতে বসে পড়েছে। পুলিসেরা
ভিতরে আসছে। রাজাদা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। ওর কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে উঠি –
-
রাজাদা, ওরা
মালাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে ওই দেওয়ালের মধ্যে......
-
পুলিস পুরোটা দেখবে এবার। আর কোনো ভয় নেই। আমি পুলিসকে রাস্তা দেখাতে না গেলে তোমার এতো কষ্ট হতো না। সেকেন্ড লোকটাকে আমি দেখতে পাইনি আগে। ও একটা
পেশাদার খুনী। ওকে পুলিস অনেকদিন ধরে খুঁজছে।
পরম মমতায়
আমার মাথায় হাত বোলাতে থাকে রাজাদা। এক পুরুষ – যার প্রতীক্ষা একজন্ম ছাড়িয়ে
অন্যজন্মেও প্রসারিত, তার বুকের চেয়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয় আর হয় না। দুহাতে ওকে আঁকড়ে
ধরে ফিসফিসিয়ে বলি –
-
আমি তোমার
কাছে ফিরে এসেছি রাজাদা। আর আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না।
রাজাদা যেন
একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। একথাটায় কেমন যেন চমকে উঠলো। খুব যত্ন করে আমায় দুহাত ধরে দাঁড় করালো –
-
চলো বাড়ি যাই
এবার। ড্রেসিং করতে হবে না?
-
তারপর? –
দুষ্টুমি ভরা হাসিটা এসেই গেলো ঠোঁটের ডগায়। কিন্তু রাজাদার গলাটা যেন দূরাগত এক
কান্নার মতো শোনালো –
-
সময়সারণির
পিছনে যাওয়া কি অতোই সহজ মালা? আমার এ জন্মের ভালোবাসা, তোর নতুন জন্মের দাবি –
হিসেবটা বড়ো জটিল হয়ে গেছে রে! আমার মালা,আজকের মিলিকে সে সময়টা তো দিতেই হবে তাই
না?
-
আমি কিচ্ছু
শুনতে চাই না। আমি এখানেই থাকব। ব্যস।
-
তার আগে তোকে
তোর বাবা মায়ের কাছে যেতে হবে। তারপর যদি ফিরতে পারিস...
-
ফিরবোই। দেখে
নিও।
-
কাঞ্চনজঙ্ঘা
দেখেছিস মলি? সত্যজিত রায়ের?
মনে হলো ঠাস
করে আমার গালে কেউ একটা চড় কষিয়ে দিল! হিসেব মেটানো সত্যিই এতো সহজ নয়। তবু জেদী
ঘোড়ার মতো জপতে থাকি –
-
মেলাবো। ঠিক
মিলিয়ে দেবো একদিন। তুমি দেখো রাজাদা। তোমার এই যদির নদীকে পার করতে পারি যদি.....
তাহলে ঠিকই ফিরে আসবো।
দোলা সেন||
No comments:
Post a Comment