সন্ধ্যেবেলায় হারিকেনের আলোটা উস্কে দিয়ে মা হাতে স্লেট পেনসিল ধরিয়ে দিল। তখন মন দিয়ে, অথবা মন দেবার ভান করে তাতে দু-একটা আঁচড় কাটতে কাটতেই চারপাশটা একবার মেপে নিল তিন্নি।
মা এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হয়ে রান্নাঘরে ভাত চাপিয়ে সবজি কুটতে বসেছে। অমনি সেও নিশ্চিন্ত হয়ে ঠাকুমার আঁচল ধরে টান মারে – “পুজোর আর কত দেরী গো ঠাম্মণি?” সন্ধ্যের ঝোঁকে একটু বোধহয় ঝিমুনি এসেছিল বুড়োমানুষটির। ‘পুজো’ আর ‘ঠাম্মণি’ ছাড়া আর বিশেষ কিছু কানে যায় নি তাঁর। নিজের ঝোঁকেই বলতে থাকেন,- “ও মণি, বাঙালীর বারো মাসে তের পাব্বন হলি কি অয়, পুজো বলতি ওই অ্যাকখানই – তার নাম দুগ্গাপুজো।“
কি প্রশ্নের কি উত্তর! মনে মনে বুড়িকে মুখ ভেঙিয়ে বেজার মুখে শেলেটে আঁক কষতে থাকে তিন্নি। নয়ত পিঠে মায়ের হাতের ডাঁটার বাড়ি পড়বে ঠিক! এদিকে ভাত ফোটার গন্ধের সাথে মিশে যায় শিউলির গন্ধ। অঙ্কে ভুল হয়ে যায় বেচারির।
কাজের কাজী ছোটভাইটাই। আসল খবরটা সেই এনে দিল চুপি চুপি। তাকে আবার খবরটা দিয়ে গেছে যদুদাদা; সকালবেলায় দুধ দুইতে আসার সময়। আর কি? বিকেল হতে না হতেই ভাই বোনে হাত ধরাধরি করে ছুট লাগায় গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে। সেখানে কুমোরজেঠুর হাতের চাপে একটু একটু করে তৈরি হয়ে ওঠে দুগ্গা মা আর তার দলবল।
তারপর তো ধূপের ধোঁয়া, দীপের আলো, ঢাকের কাঠি, নতুন জামা। শুক্লপক্ষের অষ্টমীর চাঁদের আলোয় মাখা পথটা বড় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওই পথ ধরে এগিয়ে চলে তিন্নি, ফ্রকপরা এক মেয়ে – ভাইয়ের হাত ধরে, মা-বাবার সাথে। গ্রামের স্কুলের মাঠে প্যাণ্ডেল, হ্যাজাকের আলোয় চকচকে ঘামতেল মাখা মায়ের মুখ। এই মুখ তৈরী হতে দেখেছি গত বেশ কয়েকদিন ধরে। একটু একটু করে চোখের সামনেই তো তৈরী হয়েছে। তখন তো কই এমন জীবন্ত মনে হয়নি আজকের মতো। ধুনোর ধোঁয়া, ঢাকীর নাচ – আরতিনৃত্য শুরু হয়ে গেছে।
বাড়িতে জমা হওয়া ভাইবোনদের দল মিলে হুল্লোড়। মা-কাকীমার গল্পের মাঝে ফাঁক বুঝে নাড়ু, সন্দেশ হাতিয়ে আনা। চারঘণ্টাতেই শেষ চারদিন! অন্যদিনগুলো কি করে যে এত লম্বা হয়!
শেষ দিনটায় ঢাকে কেমন এক মনকেমনের সুর। দলবেঁধে যাওয়া নদীতীরে। সেখানে জলেরা আঁকিবুঁকি কাটে দুগ্গাঠাকুরের মুখে। তারপর সব মিলিয়ে যায়। শুধু পড়ে থাকে চাঁদের আলোমাখা এক বালুচর। সেখানে এক ফ্রকপড়া মেয়ে দু হাত ছড়িয়ে নেচে যায়। মলিন জ্যোৎস্নায় অপার্থিব লাগে সবকিছু।
বিজয়ার পরে বাবা ঠিকানা লিখবে তাড়াতাড়া চিঠির
ওপর। লিখতে লিখতে তিন্নির হাত ব্যথা হয়ে যায়।
পুজোর পরে দীপাবলী। আমাবস্যার রাতে তারার আলোয় লাল মোরামের মাঠ এক অপার্থিব আলো
ছড়ায়। ঘরে ঘরে মোমবাতির কাঁপা কাঁপা আলো। শুধু মুখুজ্যেদের বাড়িতে রেড়ির তেলের
প্রদীপ জ্বলে। তাই ওদের আলোর দ্যুতি বেশি। সামনের মাঠটায় জড়ো হয়ে তারাবাতি,
কালীপটকা, মশাল ভাগ করে ফাটানো। তুবড়ির
আলোয় চারপাশটা কতদূর অবধি দেখা যায়!
তবু কেন যে তিন্নির মন
কেমন কেমন করে! দেওয়ালির পরেই ভাইফোঁটা। তার মধ্যেই নেপালী দাজু ভাউজুরা রঙিন জামা
পরে এসে নাচবে – ঝিলিমিলি ঝিলিমিলি ধেউসী রে!
একটু বড় হতে, এক পুজোর আগে পিসি তিন্নিকে নিয়ে গেল কলকাতায়। জামা কিনে দেবে বলে দোকানেও নিয়ে গেল। তিন্নি অবাক! দোকান বুঝি এতবড় হয়! আর কত্তোরকম জামা। পিসি জামা কেনে
না। বই দেখে। তার সাথে মিলিয়ে কাপড় কেনে। তাকে ফিতে টিতে দিয়ে মেপে ফেলা পর্যন্ত সহ্য করেছিল তিন্নি, কিন্তু এতকিছুর পরে পিসি খালি হাতে বেরিয়ে আসাটা ওর দুচোখে ধারা বইয়ে দিল। তাই দেখে সব্বার কি হাসি! ধ্যুৎ, ভাল্লাগে না ছাই!
পুজোর সময় কত আলো আর চোখ ধাঁধানো প্যাণ্ডেল সব। সারা সকাল ভাইবোনদের সাথে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখে তিন্নি, অঞ্জলি দেয়। রাত্রে পিসি পিসের সাথে গাড়ি চড়ে আরও দূরের ঠাকুর দেখা, রেস্তোরায় খাওয়া – পুজো মানে বুঝি এতো জাঁকজমক! তিন্নির মুগ্ধতার আর সীমা থাকে না। এবার থেকে ঠিক প্রতি বছর সে পিসির কাছে চলে আসবে পুজোর সময়।
এভাবেই বড় হয়ে যাচ্ছিল তিন্নি। গ্রামের ইস্কুল ছেড়ে সে চলে গেল শহরের হোস্টেলে। এই বারে সে বুঝল বাড়ির টান, নাড়ির টান কাকে বলে। এখন পুজো মানে তার কাছে একটা লম্বা ছুটিতে বাড়ি আসা। বাবা- মা- ভাইয়ের সাথে কাটানোর মত অনেকটা সময়। পুজো মানে এখন পুজোবার্ষিকী। শুকতারা বা কিশোর ভারতীতে মুখ ডুবিয়ে নতুন বইয়ের গন্ধ নেওয়া। বিকেলবেলা সবাই মিলে ঠাকুর দেখতে যাওয়া, একদিন রাতে বাইরে খেয়ে ফেরা। বড় একান্ত আপন পুজোর দিন।
এ চালচিত্রও পালটে যায়। তিন্নি থেকে তনুশ্রী। স্কুল থেকে কলেজ। বাবার চলে আসা গ্রাম থেকে মফস্বলে। তখন পুজোর সকাল মানে সেজেগুজে বন্ধুদের সাথে প্যাণ্ডেল হপিং। তারই মাঝে আড়চোখে পড়ে নেওয়া প্যাণ্ডেলে বিশেষ কারো চোখের মুগ্ধতার আলো। সেই সেকালের মফস্বলে এর চেয়ে বেশী সাহস দেখালেই ঝামেলা। তবু বেপাড়ার ছেলে অঞ্জলি দিতে এ পাড়ায় আসে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অঞ্জলি দেবার সময় হাতে হাত ঠেকে গেলে পুজোর রোশনাই হাজার ওয়াটের দীপ্তি ছড়ায়।
বিয়ের পরে পরেই আবার অন্যরকম। এখন বিশেষ লোকটির হাতে হাত রেখে ঠাকুর দেখতে যাওয়া যায়। দুটির মধ্যে কোনটি মুখ্য আর কোনটি গৌণ তার হিসেব কে রাখে! কিছুদিন বাদে এক টলমলো পায়ের শিশু তার চালচিত্র জুড়ে বসে। তখন পুজো মানে – রোজ রোজ অসুরকে মারতে থাকা ঠাকুরটি কেন ‘দুত্তু’ নয় – সে প্রশ্নের জবাব দিতে হিমশিম খাওয়া।
সময় তো নদী-ই। একূল ভেঙে ওকূল গড়তে গড়তে তার নিরবধি বয়ে চলা। ছেলে বড় হয়ে একদিন হুইইই করে চলে যায় তার নিজের আকাশ খুঁজতে। যেমন করে তনুশ্রী নিজে একদিন চলে গিয়েছিল, যেমন করে আর সব্বাই যায় – আর ফিরে ফিরে আসে।
আজও তার ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে শরতের সোনা রোদ্দুর উঁকি মারে, কিন্তু কোন আমন্ত্রণ জানায় না। পূজাবার্ষিকীগুলো পড়া হয় খুব ধীরে ধীরে। কোনটা হয়ত কেনাও হয় না। সন্ধ্যেতে তবু নিয়মমাফিক ঠাকুর দেখতে যাওয়া। ভীড় দেখলে আজকাল বড় ক্লান্ত লাগে। শুধু যখন দেখে, কোন ছোট ছেলে তার মায়ের হাত ধরে লাফাতে লাফাতে চলেছে, কিংবা একঝাঁক কিশোরী খিলখিলিয়ে হেসে লুটিয়ে পড়ছে এ ওর গায়ে, -
ঠিক তখনই পুজোর গন্ধটা ওর নাকে তীব্রভাবে ধাক্কা মারে। মনে পড়ে যায় কাল মুঠোফোনে
ভেসে আসা একটা ঝলমলে স্বর, - মা, আসছে পুজোয় আমরা আসছি কিন্তু!
দোলা
সেন॥
*******************************************
সবাইকে
শুভ
শারদীয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই।
No comments:
Post a Comment