Wednesday, August 14, 2019

পরিচয়


হাত ফসকে বাটিটা পড়ার আওয়াজকে ছাপিয়ে সুমনার গলা ঝনঝনিয়ে উঠলো
-       একটু সামলে কাজ করতে পারোনা? অতো দামী বাটিটা...
এরপর একটু আস্তে কিন্তু শ্রুতিযোগ্য স্বরে,
-       ভাঙলে ভাঙুক লোকের জিনিস। নিজের হলে কি আর...।  অবশ্য দামী সস্তা আর বুঝবে কোত্থেকে? বাপের জম্মে দেখেছে এসব জিনিস? নেহাৎ রান্নাটা ভালো তাই, নইলে.......


অন্যদিন এসব কথার জবাব দিতে রাজির মা মোটেই পিছপা হয় নাকিন্তু আজ যে কি হলো তার! কথাগুলো যেন কানে ঢুকেও ঢুকছে না। বাপের জন্মে সত্যিই কি ওসব জিনিস হাতে করেছে রাজির মা? না করারই কথা খালপাড়ের বস্তিতে তার বাস। এর ওর বাড়িতে রান্না করে পেট চালায় বই তো নয়!

কিন্তু তাহলে ওই গোলাপী ফ্রকপড়া বেণীঝোলানো ছোট্ট মেয়েটা কে? কী যেন নাম ছিল তার? আর গোলগাল চেহারার আর দুগ্গাঠাকুরের মতো মুখের ওই মহিলা? তার হাত নাড়ার সঙ্গে একটা মোটা বালা ঝিকিয়ে উঠছে – ওই কি সেই মেয়েটার মা? আবছা হয়ে যাওয়া এই ছবিটা কে জানে কেন খুব ঘষে ঘষে পরিস্কার করার চেষ্টা করতে থাকে রাজির মা। বহুদিন অব্যবহারে আবছা হয়ে যাওয়া স্মৃতিতে শুধু একটা গাড়ি চড়ে যাবার কথা ফুটে ওঠে। হালকা নীল রঙের শার্ট পড়ে যে লোকটা গাড়ি চালাচ্ছিল, সে যে ওর বাবা, তা সে পরে কাকু কাকিমার কথা শুনে বুঝতে পেরেছে। ওর শুধু মনে আছে একটা প্রবল ঝাঁকুনি আর তারপরের ঘন অন্ধকারের কথা তারপর অনেকগুলো দিনের কথা মনে করতে পারে না ও। যখন থেকে আবার মনে পড়ে তখন সে একটা বাড়িতে। না না, এ তার সেই স্বপ্নে দেখা আবছা বাড়িটা নয়। সেখানে যারা থাকে তাদের ও কাকু কাকিমা আর রণিদাদা বলে ডাকে। আর ওরা ওকে ডাকে তমা বলে। কাকিমার কাছেই শুনেছে তমা, তার বাবা মা এক গাড়ি দুর্ঘটানায় মারা যায়। পিছনের সিটে ছিল বলে কেমন করে যেন তমা বেঁচে গিয়েছিল। যদিও সুস্থ হতে তার অনেকদিন লেগেছে।

তমা জানে সে এ বাড়ির আশ্রিত। প্রথমদিকে একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল ওরা। তারপর কবে থেকে যে সেসব বন্ধ হয়ে সবার হাতে হাতে কাজ করা শুরু হয়ে গেল – সেটা আজ আর ওর স্পষ্ট করে মনে পড়ে না। তবে সেই বাড়িতে তো দু’ দুজন কাজের আর রান্নার লোক। তাই তমাকে ঘর ঝাঁট দিতে বা বাসন মাজতে হয় না। কিন্তু
-       তমা, আরেক কাপ চা দিবি মা?
-       তমা, কাকুকে চা দেওয়া হলে চিকেনটা ম্যারিনেট করে, পেঁয়াজটা গোল গোল করে কেটে রাখ।
-       ডাস্টিং শেষ হলে রণিদাদার পড়ার টেবিলটা একটু গুছিয়ে রাখিস।
-       গাছগুলোতে জল দেওয়া হয়েছে?
– এসব কে করবে তমা ছাড়া? পরের দিকে কাকিমার ওই শখের রান্নাটাও তো সেই করত! রণিদাদা একবার তাকে চুপি চুপি বলেছিল –
এ বাড়ির সব ফুটানি তোর বাবার টাকায় – বুঝলি? তুই নেহাত বোকা বলেই...

চালাক হয়েই বা কি করতো তমা? চোদ্দ বছর হতে না হতেই তো কাকিমা তার বিয়ে দিয়ে দিল। তমার শ্বশুরবাড়ি অনেক দূরের এক গ্রামে। মোটামুটি সম্পন্ন গৃহস্থঘর। গোয়ালে গরু, কিছু ক্ষেতি জমি। ঘরে শ্বশুর, শাশুড়ি, দেওর, ননদ। তমা গরু দেখে ভয় পেত, গোবরে ঘেন্নাএ নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে তাকে কম কথা শুনতে হয়নি। ধীরে ধীরে কবে যেন সেসবও অভ্যেস হয়ে গেল। এখন তার শাশুড়ি সগর্বে বলে –

শহরের বিটিছানা এখন গাঁয়ের বৌ বটে। কেমন গইড়্যে লিয়েছি দেখ!

চোখের জলে বালিশ যদি নোনতা হয়েও গিয়ে থাকে, তমা ছাড়া তার খবর কেউ জানে না। সে যে জানে তার আর কোথাও যাবার জায়গা নেই। ওর বর মাঝে একবার কি কাজে যেন শহরে গিয়েছিল। ভেবেছিল রাতটা শ্বশুরবাড়িতে কাটাবে। কিন্তু সেখানে গিয়ে শোনে, তমার কাকু বাড়ি বিক্রি করে চলে গিয়েছেন। কোথায় যে, সে খবর কেউ দিতে পারেনি।

তমা বড়ো হয়ে যাচ্ছিল। বৌমা, বউদি, বড়বৌ থেকে রাজির মা হয়ে উঠছিল। তবু নিশ্চিন্ত সুখ বোধহয় ওর কপালে লেখা নেই। নাহলে শ্বশুরমশাই মারা যেতে না যেতেই ছবিটা পালটে যেত না। হাতে কাঁচা পয়সা আসা শুরু হতে রাজির বাবা দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। মদ, বন্ধু, মেয়েমানুষ। তারপর স্বাভাবিকভাবেই অনাদর থেকে তমাকে মারধোর অবধি গড়ালো ব্যাপারটা। তমা এতদূর অবধি দাঁতে দাঁত দিয়ে সহ্য করছিল, কিন্তু দিনে দিনে সেই মহিলার দাবি বাড়তেই থাকল।

সেরকমই এক রাত। তমাকে মেরেধরে, তার কান ছিঁড়ে দুলজোড়া নিয়ে চলে গেছে বীরপুরুষ স্বামী। সেদিন মদের নেশা বেশি থাকাতেই বোধহয় ঘরটা রোজের মতো তালাবন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল। তমার জ্ঞান ফিরল জলের ছিটায়। শাশুড়িমাকে দেখে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। জানে, বাড়ির এই একটি লোকই তাকে ভালোবাসে। কিন্তু সে কি করে...

-       বেশি কথার সময় নাই রে বৌ আমি শুনিছি ওই মাগী আমার ছিলাটারে বিয়া করতে চায়। তোকে কুনোদিন মাইরে ফেলাবে রে। বিটিছানাটারে নিয়ে তু পলায়ে যা। আজ ঘর খোলা আছে। আঁধার থাকতি থাকতি যেদিকে দুচোখ চায় পলায়ে যা রে মা।

তাই গেল তমা। যাবার সময় শাশুড়ির দেওয়া কিছু টাকা আর আঁচলে বাঁধা মুড়ি সম্বল করে নিরুদ্দেশে বেরিয়ে পড়লো হতভাগী।

টলোমলো পায়ে উঠোন পেরোলো। অন্ধকারে দিক ঠাওর হয় না। তবু ঘুমন্ত মেয়ে কোলে করে দূরে আরও দূরের দিকে চলতে থাকে। একটা বোবা ভয় তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়

একসময় ভোরের আলো ফোটে। চারপাশে অচেনা পরিবেশ তাকে খানিকটা স্বস্তি দিলো। ঘোমটা টেনে রক্তমাখা কান আড়াল করে পথচলতি এক বুড়োকে বড়ো রাস্তার দিশা শুধোয়।
-       হুই দিকে ইগায়ে গেলে স্টিশান। তা বাদে ডানহাতে বড় রাস্তা। কিন্তু তুমি কুথাকার মানুষ গ? কুথাকে যাবে?

বুড়োর প্রশ্নমালার জবাব না দিয়ে তমা স্টেশনের দিকে পা বাড়ালো সেখানে তখন একটা ট্রেন যেন তমারই জন্য এসে দাঁড়ায়। কিচ্ছু না ভেবে সে মেয়ের হাত ধরে উঠে পড়ে। স্টেশন পেরিয়ে গাড়ি যখন আবার মাঠঘাট দিয়ে ছুটতে লেগেছে, একমাত্র তখনই তার বুক থেকে এতক্ষণের চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা বের হয়ে আসে। মেয়েটার মুখের দিকে তাকালো এতোক্ষণে। সে বেচারা ঘুম ভেঙে রক্তাক্ত মুখে মাকে পথ চলতে দেখে কী বুঝেছে কে জানে, একদম চুপ করে গেছে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে আঁচলে বাঁধা মুড়ি এগিয়ে দেয় তমা

এরপরের দৃশ্যপট এতো দ্রুত বদলায় যে রাজির মা আর তাল রাখতে পারে না। ট্রেনে আলাপ হওয়া বৌটার সঙ্গে যে নেমে পড়েছিল সে তমা নয়, রাজির মা। তমাকে সে ফেলে এসেছে অনেক পিছনে। ওই বৌটাই তাকে ইঁটভাটার কাজটা জুটিয়ে দিয়েছিল। তারপর কখনো রাজমিস্তিরির যোগাড় দেওয়া, কখনো কয়লা চুরির দলে ভিড়ে কয়লা চুরি করা, কখনো বা চায়ের দোকানে চপ বেগুনী ভাজা – কতোরকম কাজ যে আছে দুনিয়ায়!

 এইসব করতে করতে কবে থেকে যে লোকের বাড়ি রান্নার কাজে থিতু হলো, তা আজ আর ঠিক মনে করতে পারে না রাজির মা। তবে এতোসবের মধ্যেও সে মেয়ের পড়াশোনাটা ঠিক চালিয়ে গেছেতাতে বস্তির লোক থেকে মনিববাড়ি কারো বাঁকা কথাই সে কানে নেয় নি এটা মনে পড়তেই সে একবার কেঁপে উঠলো। তার মনে পড়ে গেল এবছর রাজির বইগুলো এবাড়ির দাদাবাবু কিনে দিয়েছেন।

অতএব সে বৌদির কথার ধারালো জবাবটা গিলে ফেলে মাথা নীচু করে সুমনাবৌদির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নম্র কণ্ঠে বলে – দোষ হয়ে গেছে গো বৌমণি। এবারের মতো মাপ করে দাও। আর হবে না।

চোখ দিয়ে ঝরঝরিয়ে জল গড়ায়। সুমনা ভাবে অনুতাপের। খুশিই হয়। আর অবজ্ঞার,অপমানের অশ্রুজল ঝরাতে ঝরাতে রাজির মা ভাবে, তার রাজিকে সে এমনভাবে বড়ো করবে, যাতে এ জল ওর চোখে কখনও না আসে। সে যেন নিজের নামে, নিজের পরিচয়ে বাঁচতে পারে। ওর মতো নামহীন হয়ে নয়।

No comments: