বছরে তিনটে বড় ছুটি। তার আগে আমাদের উত্তেজনার
সীমা থাকত না। একটা খোলা আকাশ, বাড়ীর স্নেহময় পরিবেশ যে কতটা দামী, তা বোধহয়
হোস্টেলে না থাকলে বোঝা যায় না। যে কোন ছুটির আগে অবশ্যকর্তব্য ছিল প্রতি ঘরে
কাগজে ১ থেকে ৩০ অবধি লিখে দেওয়ালে
সাঁটিয়ে দেওয়া। যে আগে উঠবে সে একটা একটা করে দিন কাটবে।
পরীক্ষার আগের ছবিটা কিন্তু একেবারে অন্যরকম।
সবাই সিরিয়াস। খুব মন দিয়ে পড়া চলছে। দুপরের কচুশাকের ঘণ্ট, যার আদরের গোপন নাম
সবুজ গোবর, কিংবা ঝোলে পড়লেই অর্ধচক্রাসন করতে থাকা ল্যাটা মাছ, যার ব্যায়ামবীর
অভিধায় বীণাদির প্রবল আপত্তি – তারাও কেউ আমাদের মনোযোগ বিঘ্নিত করতে পারে না এই
সময়। টেবিলের কোণে মধুশ্রীদি দুলে দুলে কবিতা মুখস্ত
করছে। হঠাৎ কবিতা গান হয়ে গেল – “ সবুজ গোবরে মরিনি আমরা, বীণা নিয়ে ঘর করি / আমরা
হেলায় মাসীমা নাচাই.......” আর যায় কোথায় হি হি, হা হা, টেবিল ধুপধাপের চোটে পড়ার
দফা রফা। বীণাদি তেড়ে এলেন। তিনি গান শুনতে পাননি বটে, কিন্তু এই হল্লা না শুনে
যাবেন কোথায়? অপরাধী সনাক্ত করতে না পেরে চিরকাল যা করে এসেছেন তাই করলেন।
মধুশ্রী, দোলা এবং আরও দুএকজনকে বই হাতে দরজার কাছে দাঁড় করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
শান্তি স্থাপনা হয়ে গেল।
এই সব করতে করতেই কবে যেন টেস্ট পরীক্ষাও হয়ে
যায়। তিনমাসের জন্য বাড়ি। বীণাদিকে প্রণাম করতেই বললেন, - “বাড়ি গিয়ে তো সাপের পাঁচ পা দেখবে। রেজাল্টটি গোল্লায় পাঠিও না
আবার।“ ভদ্রমহিলা যে বাকসিদ্ধা সেটা রেজাল্ট বের হলে জানতে পারেছিলাম।
তিনমাস পরে আবার হোস্টেল। এবার বোর্ডার নয়
গেস্ট হিসাবে। স্টাডিরুমে নয় ঘরে বসে পড়ি। সেটার জন্যেও মন কেমন করতে পারে এই অবাক
করা খবরটা আমার কাছে ছিল না। কত কিই যে না জানা থেকে যায়! পরীক্ষার আগে ছোটরা কেউ
না কেউ এসে পেনে কালি ভরে দেয়, বেরোবার আগে ঘর গুছিয়ে দেয়, বারবার জিজ্ঞাসা করে আর
কিছু করে দেবে কিনা। মাসীমা দরজার বাইরে মঙ্গলঘট বসান, বেরোবার আগে কপালে দইয়ের
ফোঁটা দিয়ে আশীর্বচন উচ্চারণ করেন। কে বলবে এতদিন এই মুখ থেকে বকুনিই শুনেছি
অধিকাংশ সময়? প্রণাম করে পরীক্ষা দিতে যাই। দুটো করে পেপার। টিফিনে রামলালদা আর
গঙ্গাভাই আসে ডাব আর ক্ষীরকদম নিয়ে। তবু অকৃতজ্ঞ চোখ দেখে মণিদীপার মা ওকে টিফিন
খাইয়ে দিচ্ছেন, আর ও শেষমুহূর্তে বইয়ের পাতা উল্টে দেখে নিচ্ছে। চোখ সরিয়ে অন্য
দিকে তাকাই। কৃষ্ণার মা ওর কপালের ওপর এসে পড়া চুলটা সরিয়ে দিয়ে বলছেন – ভালো করে
পরীক্ষা দিস কেমন? এতদিনের হোস্টেলে থাকা কড়কড়ে চোখদুটো কেমন যেন জ্বালা করে ওঠে।
তাড়াতাড়ি হলে ঢুকে পড়ি।
পরীক্ষা শেষের পরদিন স্কুলে গিয়ে সব দিদিদের
সাথে দেখা করি। এতদিনের দুষ্টুমি ভুলে তাঁদের অনেকেরই চোখ
ছলছলে। ছাড়তে গিয়ে টের পাই শিকড় বহুদূর ঢুকে আছে। রেজাল্ট বেরোনোর পর নতুন স্কুল
নতুন হোস্টেল। স্কুল হোস্টেলরা তো একে অন্যের রেপ্লিকাই হয়। তবে চমক এল যখন শুনলাম
ক্লাস টুয়েলভের এস্কার্শন হবে ঝাড়গ্রামে। আর দুটো স্কুলই সরকারি হবার সুবাদে
আমাদের রাত কাটবে আর বি এমের স্কুল বিল্ডিংয়ে! উত্তেজনায় কয়েক রাত ভালো করে ঘুমই
হল না।
অঞ্জলিদি স্টেশনে এসেছিলেন আমাদের নিতে। স্কুল
ছাড়ার পরেও এই দিদি এবং আরো দুতিনজনের সাথে চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। স্কুল যাবার পথে
বড়দির বাড়ি। বেথুনের কৃষ্ণাদি তাঁর সাথে দেখা করবেন। আমি তো যাবই। বড়দি আমায় দেখে
অবাক – তুই?
– মানে
আমি এখন..... বেথুনের ছাত্রী কথাটা মুখে কেমন যেন আটকে গেল।
-
তুই আসছিস আগে বলবি তো? তাহলে অঞ্জলি দোতলার
হলটাও খুলিয়ে দাও। আর শোন, তুই সকলের খেয়াল রাখবি। যেন কোন অসুবিধা নাহয়। সাড়ে
নটার পরে কেউ যেন স্কুলে ঘোরাঘুরি না করে। দশটা থেকে স্কুল আছে কিন্তু।
সোজা হয়ে দাঁড়াল RBM
এর স্কুল প্রিফেক্ট – ক্যাম্পাস
ডিসিপ্লিনের দায়িত্ব আমার।
সবাই
এগিয়ে গেছে। আমাকেও যেতে হবে। কাঁচুমাচু মুখে বলি – আমি একটু দিদিদের সাথে দেখা
করতে পারি?
হাসলেন এবার – “কলকাতায় গিয়ে বুদ্ধিটা কমে গেল
কি করে? ও নিয়মটা তো আউটসাইডারদের জন্য।“ মনে মনে লম্বা জিভ কেটে এবার এক দৌড়ে বন্ধুদের
সঙ্গ ধরি। এ আমার স্কুল, চিরকাল আমারই থাকবে। এ আমার পরবাস নয়, কোনদিনও হবে না।
মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে ওঠে –
এই আমাদের আনন্দধন
এই আমাদের জীবনসাধন
এই আমাদের পরম গরব – বিনোদ মঞ্জরী
No comments:
Post a Comment