Saturday, June 15, 2019

পরবাসে – ৬


ছোট ছোট মেয়েগুলো শুধু স্কুলেই এল না, চার পাঁচজন গুটি গুটি এসে হোস্টেলে ডেরা বাঁধল। একদিন বীণাদি আমাদের ডেকে বললেন, একটি ছোট মেয়ে ভর্তি হয়েছে, তাকে যেন আমরা যথাসাধ্য সাহায্য করি।
সব ফীস মকুবের পরেও এই সাহায্য তার প্রয়োজন হবে। সেদিন এই বীণাদির যে মানবিক মুখ দেখেছিলাম, তার কথা না বললে অন্যায় হয়ছোট্ট মিষ্টি মেয়েটি একটি শতরঞ্চিতে কয়েকটি জামা জড়িয়ে হাজির হল। সুপারের ঘর থেকে বালিশ আর তোষক এল। হোস্টেলে তিরিশজন থাকতে কি আর বাকি জিনিসের অভাব হয়? ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই তার সবকিছু সাজানো গোছানো কমপ্লিট। এরপর সবার হাতে উলকাঁটা। জানুয়ারি মাস যে! দুটো সোয়েটার হাতে হাতে বোনা হচ্ছে। যখন যে ফাঁকা আছে সেই বুনে ফেলছে। আমিও বুনছিলাম। বীণাদি দেখতে পেয়েই এক ধমক – দোলাকে বুনতে হবে না। অমনি সব্বাই আমার হাত থেকে বোনা কেড়েকুড়ে নিয়ে বললে, যা ভাগ! কেন রে বাবা, হাতে কুরুশ তো বিঁধিয়েছিলাম সেই গত বছর! তারপরে বড় হই নি নাকি?
আমি সেলাইয়ে পণ্ডিত বলে আমার সেলাই হোস্টেলের সবার হাতে হাতে বোনা হয়ে জমা হত। বীণাদির চোখে পড়তে সে সুখ ঘুচল। অগত্যা কুরুশের লেস বুনছিলাম বসে বসে। টিফিনের ঘণ্টা পড়তে সবাই নীচে গেল, আর আমি লেসের মধ্যে কুরুশটা ফুটিয়ে রাখতে গিয়ে হাতের তেলোতে গেঁথে ফেললাম! এরপর যতই টানি সে আর বের হয় না। বসে বসে বের করার চেষ্টা করছি, এদিকে দেরি দেখে বীণাদি একজনকে পাঠিয়েছেন আমায় ডেকে আনতে। সে এসে তো অ্যায়সা হাঁউমাউ জুড়ল যে মনে হল প্রলয় বেঁধেছে। খানিক বাদে মাসীমাসহ আধা হোস্টেল উপরে। বীণাদি তো রক্ত পড়ার বহর দেখে মাথা ঠুকছেন – কি কুক্ষণে যে ওকে সেলাই করতে বলেছিলাম! এক মাসীমারই ঠাণ্ডা মাথা – হেইখান যখন সইতে পারসো, আট্টু সইয়া থাহো। দেহি কি করন জায়! বলে  একহাতে কুরুশটা ধরে ঘ্যাঁক করে আরেকটু ঢুকিয়ে কি এক কৌশলে মোচড় দিয়ে সেটা বার করে ফেললেন! আহা, বীণাদির তখনকার মুখের যা অবস্থা! মাসীমাই ফার্স্ট এইড দিয়ে বকতে বকতে নিয়ে চললেন টেটভ্যাক দেওয়াতে! এসে দেখি সুস্মিতাদি নাকি পুস্পাদি – আমার লেসটা গড়গড় করে বুনে চলছে। শুনলাম আমার বেলায় “নিজের সেলাই নিজে কর” – হুকুম রদ হয়ে গেছে। ব্যাণ্ডেজবাঁধা হাতটাকে চুমু খেয়ে একপাক নেচে নিলাম। এর অনেক দিন পরে সংসার করতে গিয়ে ট্যাংরা মাছ হাতে কাঁটা ফুটিয়ে ঝুলেছিল। তখনও পাড়ার এক কাকীমাকে দেখেছি মাসীমার পদ্ধতিতেই মাছ আর আমাকে আলাদা করেছিলেন।
তা এই যে কুচোকাঁচার দল এসে পড়ল, ওদের সামলায় কে? এমনিতে তো ওদের কাজ জানকীদি সুমিত্রাদিরাই করবে, তবু বীণাদি বাচ্চাপিছু আমাদের ক্লাস থেকে একজন করে মেন্টর ঠিক করে দিলেন। কেন জানি না আমার ভাগে পড়ল দুজন – ফোরের পিউ আর থ্রীর অতসী।  বেশ ফুটফুটে দুটো মিষ্টি মেয়ে।  আমার সাথে ওদের বেশ জমে গেল। ওদের নাম করে লজেন্স, বিস্কুট কিনে জমা করি। ওদেরও দি, নিজেও খাই। নিজস্ব খাবার কেনা মানা ছিল এমনিতে! সন্ধ্যাবেলায় বিশেষত লোডশেডিং হলে হারিকেনের আলোতে ওদের বোধহয় ভয় করত। আর একজন কাঁদতে শুরু করলেই বাকিরাও শেয়ালের মতো হুয়া হুয়া করে কাঁদতে থাকত। সে এক বিভীষিকা। তাই কেউ একজন কাঁদলেই তার মেন্টর পড়িমরি ছুটত তাকে থামানোর জন্য।
তা কিছুদিনেই বুঝলাম, এ হল আলাপ মাত্র। আসল রাগিনী বাকি আছে। ওদের ছিল মর্ণিং ক্লাস। আমাদের যখন যাওয়া, তখন ওদের ফেরা। সুমিত্রাদিরা ওদের স্নান করিয়ে খাইয়ে শুতে পাঠাত। কথাটা যত সহজে বললাম, ব্যাপারটা তত সহজে মিটত না। সারা উঠোন আর ঘর জুড়ে তারা দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করত। ফল? সারাদিন ক্লাস করে এসে দেখতাম সকালের পাতা বিছানা লণ্ডভণ্ড, চাদরের ওপর কাদামাখা ছোট ছোট পায়ের ছাপ!
তবে এসব ছাড়িয়েও বাচ্চাগুলো যে বড্ড বেশি আদরকাড়া ছিল, সেটা না বললে নিতান্ত অধর্ম হয়। অজস্র প্রশ্রয় যেমন দিতাম, তেমনি ওদের আঁকাবাঁকা হাতে লেখা কার্ড আর পথে যেতে তুলে আনা বনফুল উপহারও তো পেতাম প্রায়ই? সে বেলা?  তো এমনই এক রবিবারের দুপুরে দুই মূর্তি – মানে অতসী আর পিউ হাজির – বোধহয় কোন আঁকা অথবা খাতায় পাওয়া গুড দেখাতে। কখনো যা করি না, কাঁচা ঘুম ভাঙানোতে তাই করলাম। এক ধমক দিয়ে ভাগিয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম। খানিক পরে দেখি আরেক কুচি – অলকা, ভয়ে ভয়ে আমায় ডেকে তুলছে – কি হল আবার?
 – পিউ তোমায় এই চিঠিটা দিতে বলল।
 – চিঠি? কেন?
 – ওরা গলায় দড়ি দিয়েছে তাই....
আঁতকে উঠে হাতের কাগজ খুলে দেখি, বড় বড় করে লেখা – দোলাদি তুমি বকলে। আমাদের কসটো হয়েছে। তাই আমরা গলায় দরি দিছি – পিউ অতসি
সর্বোনাশ! – কোথায় ওরা?
 – স্টাডিরুমে।
দৌড় দৌড়। গিয়ে দেখি টেবিলের উপর দুটিতে বাবু হয়ে বসে আছে। চোখ বন্ধ। দুজনের গলায় দুটি লাল রঙের চুল বাঁধার ফিতে ফাঁস দেওয়া। একেবারে মরে শক্ত হয়ে আছে। দেখে ধড়ে প্রাণ এল। খুব গম্ভীর হয়ে অলকাকে বললাম – আমার লকার থেকে নাড়ুর কৌটো নিয়ে আয়। মা আজ দিয়ে গেছে। মরা লোকে তো আর নাড়ু খায় না। আয় তুই আর আমি খাই।
সেদিন একটা নতুন জিনিস জানলাম। নাড়ু আর সঞ্জীবনে বটিকা একই বস্তু।

No comments: