একটি
বাল্যবিবাহ এবং একটি অকালমৃত্যু আমায় জীবনের দুটো বড় শিক্ষার পাঠ কান ধরে শিখিয়ে
দিল। প্রথমটি
হল, নিজের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে নিজের দায়িত্বে নেওয়া। এরপরে জীবনে সিদ্ধান্ত
নিতে গিয়ে কখনো ঠিক করেছি, কখনো ভুল – কিন্তু তার পূর্ণ দায়িত্ব একান্ত আমারই।
কোনদিন কাউকে দোষ দিই নি।
ঐ মেয়েটি যদি না কেঁদে শুধু বলতে পারত – আমি এ বিয়ে
কিছুতেই করব না – তাহলে তার জীবন হয়তো অন্যরকম হত। আর মৃত্যুটি আমায় বলে যায়
বর্তমান মুহূর্ত বড় দামী। জীবনের সার্থকতা তার দৈর্ঘ্যে নয়, তার আনন্দময়তায়।
যেটুকু বাকি ছিল, গায়ত্রীদির একদিনের কথায় সেটাও পুরো হয়ে গেল। পড়াতে পড়াতেই
বলেছিলেন, জীবনের যে কোন মোড়ে দাঁড়িয়ে কখনো যদি একটিকেই বেছে নিতে হয়, তাহলে ভালো
কর ভেবে নেবে কোনটা তোমার প্রেয়। আর একবার বেছে নেবার পরে অন্য পথটির জন্য মনে যেন
কোন আপশোষ জমা না থাকে। - ক্লাসে কত শত ভালো কথাই তো বলেন দিদিমণিরা, কিন্তু
একথাটা যেন আমার কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশে একদম পাক্কা সীলমোহর লাগিয়ে দিল!
নাইনে ওঠা মানেই শাড়ি, সরস্বতীপুজো,
নতুন বিল্ডিং, ক্লাস করিডোরের ওপারে লাইব্রেরি – শুধু টানাপাখার বদলে ইলেকট্রিক
ফ্যানটাই একমাত্র রসভঙ্গ করল।
আমাদের ক্লাসে চারটি হাউস – সাম্য,
মৈত্রী, স্বাধীনতা, প্রগতি। সদ্য ফরাসী বিপ্লব পড়ে আসা মনে নামগুলো ভারি দোলা দিয়ে
যেত। ওয়াল ম্যাগাজিন বের হবে। ইতিহাস নজরুল ঘেঁটে নাম দিলাম সাম্যবাদী। সবার লেখা
জোগাড় করে সম্পোদকীয় লিখে গায়ত্রীদির কাছে গেলাম অ্যাপ্রুভালের জন্য। তিনি
উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বললেন, বাদী শব্দটা ঢেকে একটা ডিজাইন করে দিতে। সি পি এম,
কংগ্রেস তখন বহুদূরের বাসিন্দা। সরকারি স্কুল হোস্টেলের চৌকাঠ পেরিয়ে তাদের ভিতরে
আসার অনুমতি ছিল না। তাই অবাক হয়ে জানতে চাইলাম – কেন? কি দোষ?
আর এই প্রথম ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দিদির
গলায় কষ্ট ফুটে উঠল – ‘নামে কোন দোষ নেই, লেখাতেও নয়। তবু সরকারি স্কুলে ঐ নামে
পত্রিকা বের করা চলে না। তুমি এ নিয়ে জোর করো না। আমার হাত পা বাঁধা।‘
জোর করিনি। কিন্তু নিজের অজান্তেই এই বোধহীন রাজনীতির উপর সেই যে
বিতৃষ্ণা জন্মে গেল, আজীবন তা বহন করে চলেছি।
স্কুলটা আরো বড় হয়ে যাচ্ছিল। এগারো বারোর জন্য
নতুন বাড়ির সাথে সাথে প্রাথমিক বিভাগও খুলে গেল। অতটুকু বাচ্চাগুলোকে দেখতে, তাদের
আদর করতে কি মজাই যে লাগত! ভাগ্যিস তখনো গুড টাচ ব্যাড টাচ শিখি নি, তাই
দিদিমণিদের চোখ এড়িয়ে হামেশাই ওদের কোলে নিতাম। ওরাও খুব খুশি হত। দিদিরা দেখলে
অবশ্য বকতেন – তোমরা কি স্কুলটাকে বাড়ি বানিয়ে ফেলতে চাও? – এই বিভাগে অনেক
কমবয়েসী দিদি এলেন। তারা আমাদের দিদিমণি কম, বন্ধু বেশি হয়ে উঠলেন। এদের মধ্যে শুক্লাদি, দ্যুতিদি আর দেবযানীদির নাম বিশেষ
করে মনে পড়ে।
হোস্টেলের
পরিবেশ দিন দিন অসহ্য হয়ে উঠছিল। দুটি মেয়েকে একসাথে
বসে গল্প করতে দেখলেই বীণাদির চেঁচামেচির আর অন্ত থাকত না। হোমো, লেসবি এইসব
শব্দের সাথে পরিচিত হয়ে চারপাশটা কেমন যেন ক্লিষ্ট হয়ে উঠছিল। প্রিয় বান্ধবীর হাত
ধরতেও ভয় লাগত। কোন এক ছেলে হোস্টেলের দিকে তাকিয়ে পথ দিয়ে চলে যায়। সেই অপরাধে
বীণাদি পাখাহীন ঘরগুলির জানলার নীচের অংশে কাঠ আটকে বন্ধ করে দিলেন! কিন্তু এসব
করে কি কিছু হয়? সেই ছেলে আর মেয়েটি এখন সুখে সংসার করে – তাদের জন্য আমাদের
অকুণ্ঠ ভালোবাসা। ওইসব গরম টরম কোন ব্যাপারই নয়!
এসবের শোধ
তুলেছিলাম এক বিচিত্র উপায়ে। আমর বন্ধুদের বলতেই তারা সোৎসাহে রাজি হয়ে গেল। কার
মাথা থেকে বুদ্ধিটা বেরিয়েছিল মনে নেই, কিন্তু বীণাদির গ্রামার ক্লাসটা মনে আছে। প্রিপোজিশনের
ব্যবহারের পড়া ধরা চলছে। আমাদের টেবিলে গ্রামার বইয়ের পাশে অন্য বই বন্ধ করেই রাখা
আছে। বনানী, তাপসী আর আমি গুজুর গুজুর করছি। বীণাদির চোখে পড়বে না তা কি হয়?
হোস্টেলে থাকি বলে আমার ওপরেই কোপটা আগে পড়ল।
- কি বলেছি এইমাত্র? – মাথা নীচু করে থাকলাম।
– টেবিলে কি?
আরো আস্তে বলি,
– গ্রামার আর ভূগোল।
– বাকীরা কি করছিলে?
চুপ করে উঠে
দাঁড়ায় আরো দুই অপরাধী।
- তিনজনেই ক্লাসের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাক।
মাথা তেমনই
নীচু করে বাইরে দাঁড়ালাম। একা একা এই প্রথম শাস্তি পাওয়া। এর আগে পুরো ক্লাসের
সাথে দাঁড়িয়েছি অনেকবার। তবু ফিক ফিক হাসি চেপে
রাখা যাচ্ছে না। ভেতরে সবাই চুপ করে পড়ছে। আর বাইরে আমরা তিনমূর্তি – ক্লাসের
প্রথম তিনজন ছাত্রী! দিদিরা যেই যাচ্ছেন, একবার অবাক হয়ে দেখছেন। বীণাদির ক্লাস
বলেই বোধহয় কেউ কিছু বলছেন না। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় – করিডোরে বড়দি। থমকালেন
একটু – কি ব্যাপার, তোমরা এখানে?
মাথা নীচু,
গলাও – পড়া পারিনি।
-
হুম, তিনজনেই?
কার ক্লাস?
পাগল নাকি যে
এ কথার জবাব দেব? আর কিছু না বলে ক্লাসের পাশ দিয়ে গম্ভীর ভাবে চলে গেলেন। কি
হয়েছিল জানা নেই, তবে বীণাদির বকুনি বেশ কিছুদিন খেতে হয় নি এটাই পরম আনন্দ।
তবে সবসময় কি
আর পার পেতাম? একবার গায়ত্রীদির হোমটাস্ক করার সময় পাইনি। কোন রচনা বা
চরিত্র-চিত্রণ লিখে আনার কথা ছিল। ঘণ্টা পরার একটু আগে আমার পালা এল। স্কুলের এক
পূর্বসুরীর পথ ধরে সাদা খাতা খুলে পড়ে গেলাম অলিখিত রচনা। গালে হাত দিয়ে
নিবিষ্টমনে শুনলেন। ভাবলাম ফাঁড়া কেটে গেল। ও হরি, টিফিনটাইমে ডাক পড়ল। খুব আস্তে
করে বললেন – ‘পরদিন থেকে লিখে এনো।‘ কান
মাথা লজ্জায় আগুনবরণ। হতভম্ব ভাবটা দেখে দয়া হল – ‘পাতা ওল্টানোটা সমান সময়ে হয়
নি।‘
বুঝলাম,
চালাকির দ্বারা মহৎ কর্ম হয় না।
No comments:
Post a Comment