আমাদের বড়দি ছিলেন আরতি গুহ। অদ্ভুত
ছিল তাঁর পরিচালন দক্ষতা। কোনদিন জোরে কাউকে বকতে শুনিনি। বোধহয় তার দরকারই হয়নি
কখনো। অথচ হঠাৎ ডেকে পাঠালে বুক ধুকধুক, পা ঠকঠক করত না যার, সে কখনো বিনোদমঞ্জরীর
ছাত্রীই ছিল না।
আমরা পাস করে বেরোনোর দু এক বছর পরেই শিক্ষকদিবসে রাষ্ট্রপতির
দেওয়া সম্মানে ভূষিত হন।
হবেন না? আমাকে বিনা বকুনিতে টেন পাস
করিয়েছিলেন যে! আদ্যন্ত যুক্তিবাদী এই মানুষটির সাথে আমার একটা নিঃশব্দ চোর
পুলিসের খেলা চলত। ছাত্রী হিসবে আমি ছিলাম অত্যন্ত বাধ্য এবং নিয়মানুবর্তী।
ইস্কুলের নিয়ম খুব ভালো করে পড়ে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে আমার জুড়ি ছিল না। কিন্তু
নিয়ম রচনায় যদি কোন ফাঁক মানে লুপহোল থাকে, তাইলে আমার আর কি দোষ বলুন! আমাদের
জ্বালায় বড়দি নোটিশ পালটেছেন কয়েকবার, কিন্তু তার জন্য কক্খনো বকুনি দিতে দেখিনি।
আজও তাই এই নামটি নিতে শ্রদ্ধায় মাথা নীচু হয়ে আসে।
এইটে পড়ার সময় মে দিবসের বক্তৃতায় তিনি
বললেন ছাত্রীরা যখন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীদের
কাজে সাহায্য করে তখন তাঁর মনে হয় এরা প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠছে। ছাত্রীরা
মাঝে মাঝেই টিফিন বাহকদের গামলা বয়ে আনতে সাহায্য করত – সে প্রসঙ্গেই একথা বলা।
সরকারি স্কুলে তখনও (সত্তরের দশক) টিফিনটাইমে টিফিন দেওয়া হত। মাসের মাইনের বইয়ে
পাঁচটাকা টিফিন বাবদ বরাদ্দ ছিল। বাকিটা সরকারি অনুদান। আমাদের হোস্টেলের খরচার
সিংহভাগও কিন্তু সরকারের তহবিল থেকেই আসত। বেশ ভালো টিফিন ছিল। লুচি তরকারি,
ডালিয়া, চিঁড়ের পোলাও...। স্কুলের পিছনদিকে রান্নার দিদিরা রান্না করে টিফিনরুমে
পৌঁছে দিতেন। ভারি সুস্বাদু সেইসব রান্না। হোস্টেলের ঠাকুরভাইয়ের ‘বিড়ি লাগা’ ঝোল
মোটেও নয়! আমরা টিফিনকৌটো হাতে ক্লাস অনুযায়ী লাইন দিতাম। বাক্স আনতে প্রায়ই ভুলতাম।
ছোটরা কেউ কৌটো বা তার ঢাকনা দিয়ে উদ্ধার করত কিম্বা উদ্ধৃত হত!
কিন্তু আমার মাথায় অন্য কথা। ক্লাসঘরের
টানা পাখার কথা আগেই বলেছি। এবার সেই পাখাটানা দিদির কাজ ৫০% কমে গেল। বাকীরাও বেশ
উৎসাহী হয়ে উঠল। টানাটানির চোটে পাখার প্রাণান্ত। কিছুদিন বাদে নতুন নোটিশ এল –
ক্লাসের সময়ের বাইরেই একমাত্র অন্যকে
সাহায্য করা যাবে! ব্যস,হয়ে গেল!
এই সময়ের একটি মেয়ের কথা খুব মনে পড়ে।
১৯৭৪ সালে সে পড়ত ক্লাস নাইনে। আমাদের চেয়ে একবছরের সিনিয়র। দিব্বি গাছকোমর বেঁধে
হা ডু ডু খেলছিল আমাদের সাথে, হঠাৎ তার বাবা তাকে নিতে এলেন। তার নাকি বিয়ে! ওদের
পরিবারে মেয়েদের নাকি এই বয়েসেই বিয়ে হয়! বীণাদিকে তখন দেখেছি একেবারে অন্য রূপে।
তিনি বদরাগী মানুষ। মেয়েটির বাবাকে তো বকেঝকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। সে বেচারি তো এই
আকস্মিক বিপৎপাতে কেঁদে আকুল হচ্ছে। আমরা সবাই হতচকিত। ব্যাপারটা এখানেই মিটল না।
তার বাবা টি সির আবেদন করে বসলেন। তখন বড়দি, গায়ত্রীদি,বড় অণিমাদিরা অনেক বুঝিয়ে
মেয়েটির পড়া বন্ধ না হওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করলেন বটে, কিন্তু বিয়েটা আটকানো গেল
না! ব্যাপারটা এখানেই মিটল না। ওর বরটি খুব ভালো ছিল, মেয়েটি মাধ্যমিকও দেয়।
কিন্তু তার পরে পরেই রাতে মশারি টাঙাতে গিয়ে কিভাবে জানি মশারির স্ট্যান্ডটা ওর
ঘাড়ে পরে এবং তাৎক্ষণিক মৃত্যু! শ্বশুর বাড়ির লোকেরা কুলক্ষণা মেয়েটিকে বাপের বাড়ি
পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হয়। তারপরেও তার পড়া চালানোর ব্যাপারে দিদিরা খুব উদ্যোগী ছিলেন,
তবে তার ফলাফল জানতে পারি নি। আমি তখন কলকাতায় এগারো বারো পড়ছি।
যাই হোক, সেসব তো পরের কথা। এইটের
প্রথম দিকে দোলা-বনানী-সুবর্ণাকে বন্ধুরা থ্রী মাস্কেটিয়ের্স বলত। কিন্তু সেই
সেলাইয়ে ফেল করার ফলাফল হিসেবে ক্লাসের শেষদিকে তাতে তাপসীরও যোগদান ঘটল। আমাদের
মধ্যে সুবর্ণা ছিল সবচাইতে শান্ত আর লক্ষ্মী মেয়ে। কিন্তু তখন আমাদের লেজ
গজাচ্ছিল। আজ রচনা তো কাল এক্সটেম্পো তো পরশু...। গায়ত্রীদি মাঝে মাঝেই দু একটা
করে বই হাতে তুলে দিয়ে বলছেন এগুলো পড়ে এসো। ফাঁকা সময়ের অনেকটাই এসবে চলে যায়।
আমি তো মাঝে মাঝে মাঠেও পালাতাম! আর এসবের মাঝে পড়ে, পাশে বসেও সুবর্ণা আস্তে
আস্তে দূরে সরে যাচ্ছিল। অভিমানী মেয়েটা অনেক সময়ে অন্য সীটে গিয়ে বসত। ধরে পাকড়ে
ফেরত আনতাম ঠিকই, কিন্তু...। আসলে আমরাও তো তখন ছোটই ছিলাম! ওই উত্তেজনা, মঞ্চে
গিয়ে পুরস্কার – ফলে আমরা তিনজন অবসর সময়ে রচনা বা ডিবেটের পয়েন্ট ঝালিয়ে নিতেই
ব্যস্ত থাকতাম বেশি। এর মধ্যে ওর চশমার পাওয়ার বেড়ে যাচ্ছিল, চলাটা যেন আরো কমনীয়
হয়ে উঠছিল। হাসতাম – ‘ন্যাকামি শিখছিস?’ মোটা চশমার ওপারে চোখ ছলছল করত – ‘আমি তো
ন্যাকাই। যা গে, ভালো মেয়েদের সাথে মেশ গে যা।‘ আমার আবার এই জাতীয় সেন্টিমেন্টাল
কথা কোনদিনই সহ্য হয় না। চটে মটে চলেও যেতাম. আবার ফিরেও আসতাম। ছুটির পরে
বনানী-সুবর্ণা আগের মতোই একসাথে বাড়ি ফিরে যেত।
রেজাল্ট বেরোনোর পর ছুটি শেষে আবার
ক্লাস। নবম শ্রেণী মানেই শাড়ি। হোস্টেল থেকে কলকল করতে করতে স্কুলে এলাম। বাকিরা
কেমন যেন চুপচাপ। – কি রে, শাড়ি পরে সবার
গ্র্যাভিটি বেড়ে গেল নাকি?
– তুই কিছু শুনিস নি? কবে এসেছিস হোস্টেলে?
– আজ সকালে, কেন?
– সুবর্ণা মারা গেছে।
হাত থেকে ঝরঝর করে বইখাতা পড়ে যায়। কী
বলছে ওরা? কেনই বা বলছে? মণিকা এসে বই তুলে জায়গায় রাখে। আমার পিঠে হাত রেখে মৃদু
ধমক দেয়।
– এভাবে কেউ বলে!
প্রেয়ার
লাইনে একমিনিট নীরবতা। আমি তো সেই কখন থেকেই চুপ করে আছি। শুনলাম লিউকোমিয়া
হয়েছিল। ধরা পড়ার পর সাতদিনও.....। সেই প্রথম লিউকোমিয়ার নাম শুনি। তাই বুঝি ওর
চোখের পাওয়ার বেড়ে যাচ্ছিল? হাঁটতে অসুবিধা হত বলেই কি......। আমি কি ভয়ঙ্কর স্বার্থপর!
কখনো জানতে চাইলাম না – কেমন আছিস? আজও, এতদিন বাদেও একলা ঘরে মাঝে মাঝে চুপি চুপি
জিজ্ঞাসা করি – ‘কেমন আছিস সুবর্ণা?’ – শুনতে কি পাস? আজও কি তুই অভিমানী? (ক্রমশঃ)
No comments:
Post a Comment