আমাদের স্কুল হোস্টেলের দিনগুলো ছিল
ঘণ্টা আর ঘড়ির কাঁটার সাথে বাঁধা। তাতে একটা উপকার এই হয়েছিল যে রোজকার জীবনধারণে
একটা নিয়মানুবর্তিতা মজ্জায় গেঁথে গিয়েছিল। কষ্ট আর সমস্যা? ওই বয়েসে
প্রাণপ্রাচুর্য এত বেশি থাকে যে তা থেকেও মজা খুঁটে নিতে বিশেষ অসুবিধা হত না। বরং
এসবের মধ্যে দিয়ে বড় হয়ে উঠেছি বলেই হয়ত পরে সংসারে বা কর্মক্ষেত্রে অনেক কঠিন সময়
হাসিমুখে পার করতে পেরেছি।
ছায়াদি ছিল বীণাদির একমাত্র প্রিয়
ছাত্রী। একটা মেয়ে আপাদমস্তক ওরকম ভালো এবং নিয়মানুবর্তী হয় কি করে, তা আমার কাছে
আজও রহস্যই থেকে গেল! তা সেই ছায়াদি কোনরকম অ্যালার্ম ছাড়াই রোজ ভোর পাঁচটায় একটা
পুজোর ঘণ্টা টিং টং করে অনেকক্ষণ ধরে বাজাত। আমি উঠেই আবেগ দিয়ে গাইতাম – মোরা
ঘণ্টা শুনে ঘুমিয়ে পড়ি, ঘণ্টা শুনে জাগি..... নাঃ তারপরের লাইনগুলো কোনদিনও গাইতে
দেয় নি আমার বেরসিক রুমমেটরা! কত ভালো ভালো সৃষ্টি যে এইভাবে কুঁড়িতেই ঝরে যায়, কে
আর তার খবর রাখে! চোখের ঘুম ভালো করে ছাড়বার আগেই বিছানা তুলে, মুখ ধুয়ে ফেলা। কারণ
আবার ওই ঘণ্টা! এবার লক্ষ্য আমাদের স্টাডিরুম। ওখানে ততক্ষণে একটা টুল পেতে মালা গলায়
দিয়ে বসে পড়েছেন শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব! আমরাও অমনি চটপট বসে হাতজোড় করে চোখ
বুজে বা খুলে গাইতে শুরু করি – বিমল প্রভাতে মিলি একসাথে, বিশ্বনাথে করো প্রণাম
অথবা মাতৃদেবো ভব পিতৃদেব ভব। সাতদিনের সাতটা আলাদা গান। ধুপের ধোঁয়া অথবা
সামগ্রিক প্রার্থনা কিসের জন্য কে জানে মনটা বেশ শান্ত হয়ে যেত কিছুক্ষণের মতো।
শেষ হলেই আবার দৌড় একতলায়। সেখানে
অপেক্ষা করছে কাঁচা হলুদ আর গুড়। জানকিদি – আমাদের হোস্টেলের কর্মী – সেখানে কড়া
পাহারায়। আগে গেলে ছোট পিস তোলা যাবে। সেটা খেলে তবে একপীস মাখন-পাউরুটি উইদাউট মাখন পাওয়া যাবে! তাই কি
শান্তিতে সময় নষ্ট করে ধীরে ধীরে খাবার জো আছে? ছায়াদির হাতের ঘণ্টা বেজে উঠল –
স্টাডি আওয়ার! অতএব চলো সেই দোতলায়। টেবিলে বসে শেষ করে ফেল আগের রাতের না হওয়া
হোমটাস্ক। পড়া না পারলে সন্ধ্যায় এসে ঝাড় নিশ্চিত। এই রিপোর্টটা সব দিদিমণিরাই
অত্যন্ত নিষ্ঠাভরে বীণাদিকে দিতেন। উনিও খোঁজ করতেন নিশ্চয়ই। তার মাঝেই লিস্ট ধরে
স্নান। বোঝা গেলো না?
তাহলে একটু বুঝিয়ে বলতে হয়। হোস্টেলে
চারটে বাথরুম। প্রতি বাথরুমে চার বা পাঁচজন স্নান করবে। কে কোন বাথরুমে যাবে তার
লিস্ট বানানো আছে। সেই অনুযায়ী পরপর যেতে হবে। পনেরো মিনিট সময়। স্নান এবং কাপড়
কাচা সমেত। ঘণ্টা এবার জানকীদি কিংবা সুমিত্রাদির হাতে। পনেরো মিনিট পরপর ঘণ্টা
বাজবে। হপ্তা শেষে লিস্টটা রোটেট হবে। প্রথম জন চলে যাবে শেষে।
এইসব সারা হতে হতে একটা টানা ঘণ্টা
বেজে উঠল। চারজন ছুট লাগালো একতলায়। দলের ছোটটি টেবিলে রাখা থালা সোজা করে নুন
দিয়ে যাচ্ছে। এরপর দেবে জল। একজনের হাতে নিমবেগুন বা ঐ জাতীয় কিছু। একজন ভেতরের
টেবিলে বাটিতে বাটিতে মাছ আর ঝোল দিতে ব্যস্ত। সবচেয়ে এক্সপার্টের হাতে সব্জির
থালা। সবাইকে সমান দিতে হবে আবার সব্জিও শেষ হতে হবে! প্রসঙ্গত বলি এটারও লিস্ট
ছিল। শরৎচন্দ্র এমনি এমনি মেজদা লেখেন নি! এরপরে খাবার ঘণ্টা আর তার কিছু পরেই
স্কুলে যাবার ঘণ্টা!
সবাই লাইন করে দাঁড়িয়ে পড়, মাথা গুনতে
হবে। কয়েদী গোনা শেষ। এবারে স্কুল। সঙ্গে যাবে রামলালদাদা, কোমর বেঁধেছে! ফেরার
পথেও এরই রিপীট টেলিকাস্ট। দুঃখ দুঃখ মুখ করে দেখতাম, বন্ধুরা গটগটিয়ে এ ওর সাথে
কথা বলতে বলতে কেমন বিন-পাহারায় পথে নেমে পড়ল! তবে এই দুঃখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হত না।
কোনক্রমে জামা পালটে বিকেলের টিফিন খেয়েই মাঠে দিতাম দৌড়। ঐ বন্ধুদের মতো কোনদিনও
শুনতে হয় নি, বড় হয়ে গেছ, এখন আর মাঠে খেলতে হবে না। বরং প্রাণভরে খেলতাম কবাডি,
বুড়ি বসন্ত, টেনিকয়েট। সন্ধ্যাবেলায় হাতপা ধুয়ে আবার প্রার্থনা। এবার গানের সংখ্যা
দুই। দিনে তিনবার (একবার স্কুলে) প্রার্থনা করার পরেরও মগজে কি করে যে কুবুদ্ধির
পোকা কিলবিল করত কে জানে! বোধহয় জন্মপাপী-তাপী গোছের কিছু ছিলাম অনেকেই। রাত নটা
বাজলে আবার পরিবেশন আর খাবার ঘণ্টা। এবার তাড়া দিতে হত না, চটপট খেয়ে বিছানা তৈরি
করে সেকেন্ড আওয়ারের পড়ার জন্য যাওয়া। দশটা বাজলে তবে ছুটি। নাইন টেন হলে সাড়ে দশ।
তা আমার আবার শরীর স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো ছিলো না। বেশির ভাগ দিনেই মাথাব্যথা ,
পেটব্যথার মতো বিবিধ উপসর্গ শুরু হত। কাজেই বীণাদির কাছে ছুটি নিয়ে ঘুমোতে চলে
আসতাম। কিন্তু ক্রমশঃ রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে আমাকে বাধ্য হয়েই সুস্থ হতে হল!
নিখাদ আনন্দ
আর অনাবিল সুখের সময় ছিল বার্ষিক পরীক্ষার পর। রেজাল্ট আউট হবার আগে বাড়ি যাওয়ার
অনুমতি মিলত না। আমাদের কারো সে নিয়ে মাথাব্যথাও ছিল না। এই সময় স্কুল থেকে নিয়ে
আসা হত অজস্র খেলার সরঞ্জাম আর গল্পের বই। হোস্টেলের সিনিয়র দিদিরা কেউ লাইব্রেরি,
কেউ খেলার জিনিসের দায়িত্ব নিত। দেরি করে ওঠা, ঢিলেঢালা চানের সময়, অসংখ্য গল্পের
বই, সারাদিন খেলা, আড্ডা, গান, বিছানায় গড়ানো......... স্বাধীনতার চরম যাকে বলে!
সারাবছর নিয়মের নিগড়ে থাকা জীবনে এ যে কতবড় প্রার্থিত অমূল্য সময়, তা কি করে যে
বোঝাই!
এরপর রেজাল্ট।
খুব মন দিয়ে বীণাদির মেজাজ লক্ষ্য করা হত। মুড ভালো মানে হোস্টেলের রেজাল্ট ভালো।
সবাই পাস করেছে। আর মেজাজ গরম মানে ফিসফাস হিসেব – অমুক মনে হচ্ছে ডোবালো!
রেজাল্টের দিন
আমসি মুখে ইস্কুল। আমাদের পরের ব্যাচে পড়ত ভারি চশমা চোখে ছোট্ট রোগা দেবশ্রী।
সেদিন আমার পাশ ছেড়ে নড়ত না! মাঝে মাঝে জানতে চাইত – ও দোলাদি, এবারও ফার্স্ট হবো
তো? অদ্ভূত কুসংস্কার। আদ্যিকালের ছেঁড়া জুতো, পুরোনো লাকি ব্যাগ,আরও কত কী যে ছিল
ঈশ্বরই জানেন! অথচ প্রতি বছর ওর প্রাইজ ধরার জন্য লোক লাগত। সত্যি! কিন্তু ওই ভয়!
ক্লাস টিচারের
সঙ্গে আসতেন বড়দি। তিনটে খাম নিয়ে ডাকতেন – প্রথম ___ , দ্বিতীয় ____ , তৃতীয়
_____ । এরপরে ঘোষণা – আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি এই ক্লাসের সবাই পরের ক্লাসে উত্তীর্ণ হয়েছ! খোলা খামে রেজাল্ট পাবার সে যে কী আনন্দ
আর স্বস্তি! আর বড়দি যখন শুধু ওই তিনজনের নাম ডেকে চুপচাপ চলে যেতেন, তখন নিস্তব্ধ
ক্লাসে থমথমে মুখে দিদি রোল নম্বর ডেকে সীলবন্ধ খাম হাতে ধরিয়ে দিতেন। তিন
ভাগ্যবান ছাড়া সবাই দুরুদুরু বুকে খাম নিয়ে বসে থাকত। গার্জেন ছাড়া খোলার হুকুম
ছিল না। দিদিমণি বেরিয়ে গেলেই জল্লাদের মতো ঢুকত টেনের এক দিদি। গম্ভীর গলায় ডাক
দিত হোস্টেলের মেয়েরা? করুণ মুখে বন্ধ খামটা এগিয়ে দিতাম। সবাই পাস করলে হোস্টেলে
ফিরে বীণাদি রেজাল্ট খুলে আমাদের দিতেন। অবশ্যই বকুনিসহ। নয়ত
বসে থাকো। একটু পর থেকেই বাবা কিম্বা মা আসবেন বাড়ি নিয়ে যেতে। তাঁর আসা অবধি
অপেক্ষা। (ক্রমশঃ)
No comments:
Post a Comment