Monday, June 3, 2019

পরবাসে – ২


সেলাই পরীক্ষার রি টেস্টে পাস করলাম। করব জানা ছিল। কারণ এত অপদার্থ ফার্স্ট গার্ল বিনোদমঞ্জরী আগে পায়নি। নিয়মের কিছু অদল বদল হয়ে থাকবে। এরপর থেকে গান সেলাই আর আঁকায় আমার নম্বর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে ৪০। মানে পাসমার্ক আর কি!

নয়ত আমায় গানে ৪০ দেবে এমন ক্ষমতা দেবী সরস্বতীরও ছিল না। পরীক্ষার সময় মোট্টে এক লাইন গাইতে দিতেন সুচরিতাদি। ইন্দ্রাণীদি আবার আধা লাইন পরেই ৪০ বসিয়ে দিতেন। এই অসুরকে তার চেয়ে বেশি সহ্য করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না!কিন্তু এদিকে যতই গোল্লা পাই না কেন, অন্য সব দিকে আমার, যাকে বলে বিবিধ প্রতিভা বিকশিত হতে লাগল। হোস্টেলের চার দেওয়াল থেকে বের হবার একটাই রাস্তা ছিল – প্রাণের দায়ে সেটাকেই আঁকড়ে ধরলাম। আজ রচনা লেখা তো কাল বিতর্ক, নাহলে বিজ্ঞান প্রদর্শনী। সেটাও হাতের কাছে না থাকলে কবাডি, খো খো আর যা সব। প্রাইজ পেতাম অল্পই।  বীণাদির রাতের ঘুম ছুটে গেল। একেই আমি “বাঁদর দি গ্রেট” – ওনার ভাষায়, তাহে এসবে ছেলেদের সাথে একজোটে কাজ হতেই থাকে। বিশেষ করে খেলাধূলার মাঠে। আমার সৌভাগ্য, উনি কাউকে পাশে পাননি। না আমার বাবাকে, না স্কুলের দিদিমণিদের। এব্যাপারে আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ আমার গায়ত্রীদি আর নীহারদির কাছে। তাঁদের ভালোবাসার প্রশ্রয় না থাকলে আমি অন্ধকূপের বন্দী হয়েই দিন কাটাতাম।
গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো আরও দুজন “প্রতিভাবান” ছিল হোস্টেলে। মধুশ্রী দত্ত আর বুনু মানে সুলতা শতপথী। মধুশ্রীদি দারুণ আবৃত্তি করত, কবিতাও লিখত। বুনু বেশ ভালো খেলত। বিশেষতঃ টেবিল টেনিস। কুবুদ্ধিতে তিনজনেরই ভালো মাথা খেলত। বীণাদিকে উৎপাত করাটা ছিল আমাদের ধর্ম।
হোস্টেলের খরচা কমাবার জন্য বীণাদি শুরু করলেন কিচেন গার্ডেনিং। সেখানে সবকিছু ছেড়ে চালকুমড়ো ফলানো হল। আর সে কী চালকুমড়ো রে বাবা! তারা ফলতেই থাকল, আর আমাদের থালায় রোজ দুপুরে এবং রাতে সগৌরবে বিরাজ করতে থাকল। দিন দশেক পরে খেতে বসলেই বমি পেতে থাকল। কিন্তু সব্জি ফেললে শাস্তি আছে। কাঁহাতক আর রোজ রোজ স্টাডিরুমে কান ধরে দাঁড়ানো যায়! মধুশ্রীদি বুদ্ধি দিল নখ দিয়ে খুঁচিয়ে দিলে ফল পচে যাবে! অগত্যা রামলালদা, গঙ্গাভাইয়ের চোখ এড়িয়ে অতিকষ্টে তাই করা হল। হলে হবে কি? হুঁ হুঁ বাবা, হল গে বিনাবুরির ইস্পেশাল চালকুমড়ো! তারা দিব্বি নখের বিষ হজম করে বাড়তে থাকল। আমরা মুষড়ে পড়লাম। শেষে চুপি চুপি এক দিদিমণিকেই ধরে পড়লাম। তাঁর বয়েস কম। আমার সাথে বন্ধুর মতো মিশতেন। দয়াপরবশ হয়ে উপায় বলে দিলেন। কিছুই না। যেতে আসতে গাছের গোড়ায় একমুঠো চিনি ছড়িয়ে দাও। বাকি কাজ পিঁপড়েরা করে দেবে। তা এরপরে দুতিনদিন মধুশ্রীদির হাত ফস্কে খেলার বল মাচার তলায় গড়িয়ে গেল! আমি আর বুনু ওকে বকতে বকতে সেটা উদ্ধার করে আনলাম। মুক্তি এল ঐ পথ ধরেই
লীলাদি পড়াতেন অঙ্ক। তিনি সবার জন্য পাঁচটা অঙ্ক দিলে আমাকে দিতেন খান আষ্টেক। যাতে ক্লাসে মাথা না তুলতে পারি। কিন্তু আমি তো আগের দিন ওই চ্যাপ্টারটা করে রেখেছি! অতএব ধাঁ ধাঁ করে অঙ্ক শেষ করে স্কেল দিয়ে প্রিজম বানিয়ে লাল নীল লীলাদি দেখতাম। এটা ওনার কাছে অস্বস্তির ব্যাপার ছিল, আর আমার ওটাই মজা। আজ বুঝি ওইটুকু অভিনয় করে আমাকে দিয়ে প্রচুর অঙ্ক করিয়ে নিয়েছেন।
নীহারদির ইতিহাস ক্লাস তো গল্পদিদার আসর ছিল। এমন রোমহর্ষকভাবে রেনেসাঁস, বাস্তিলের গল্প বলতেন যে চোখের সামনে সিনেমার ছবির মতো সব ফুটে উঠত। আজও যেটুকু ইতিহাস মনে আছে তা ওনার জন্যই।
বীণাদির ক্লাসে বসতাম পিছনের দিকে। কেউ অন্যমনস্ক হলেই বলতেন পাঁচিলের ওপাশ দিয়ে কটা ছেলে গেছে তা তো ঠিক টের পাও এদিক থেকে, আর গ্রামারে মন থাকে না? মুখ ফস্কে একবার বলে ফেলেছিলাম, – ক্লাসে কে কে পেরিস্কোপ এনেছে সার্চ করব? ফল? বিকেলে হাস্টেলের বারান্দায় কান ধরে.....
বীণাদির সন্দেহের তালিকায় আমার নামটা প্রথমদিকেই থাকত। তবু স্টাডিরুমের টেবিলে পড়ার বইয়ের ওপর খোলা থাকত গল্পের বই। দিদি রাউন্ডে এলে তারা জায়গা বদল করতে একটুও দেরি করত না। কত অন্যমনস্ক সময়ে যে বুনুর সতর্কবাণী আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
হোস্টেলে আমাদের কোন ঘরেই ফ্যান ছিল না। খুব গরমের সময় আমারা ছাদে শুতে যেতামসে যে কি আনন্দ সে আর কি বলি! আকাশের চাঁদ আর তারা যে এত সুন্দর তা ওই মুক্তির ছাদে না উঠলে কোন দিন জানতেই পারতাম না!
হোস্টেল থেকে লাইন করে স্কুলে যেতাম। সঙ্গে পাহারাদারিতে রামলালদা। কালেভদ্রে সিনেমা দেখতে গেলেও একই দৃশ্য। শুধু ইউনিফর্মের জায়গায় রঙিন জামা। আর রাস্তায় যদি কোন ছেলে পরপর কদিন দাঁড়িয়ে থাকে? তাহলে রামলালদা এসে ঠিক রিপোর্ট করবে বীণীদিকে। আর উদ্দিষ্ট মেয়েটির কপালে বকুনির আর অন্ত থাকবে না।
একবার কুন্তলাদি বিনাদোষে এরকমই এক বকুনি খেয়ে কেঁদে ভাসাচ্ছিল দেখে আমি তড়পাচ্ছিলাম – ‘পরদিন ছেলেটাকে পাকড়ে জিজ্ঞাসা করবে তো – কার জন্য, আর কেন দাঁড়াচ্ছেন? আমাকে বকলে আমি তো তাই করব। ইয়ার্কি নাকি?’
কুন্তলাদির বিস্ফারিত ফোলা চোখ অনুসরণ করে দেখি, বীণাদি পিছনে দাঁড়িয়ে আমার বাক্যসুধা থ হয়ে পান করছেন! খুব রেগে ছিলাম বলেই হয়ত পালাই নি। ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আর কি আশ্চর্য! এই প্রথম বকবার এতবড় সুযোগ পেয়েও কিচ্ছু বললেন না! পরেও দেখেছি ছেলে দাঁড়ানোর জন্য অনেকে বকুনি খেলেও আমাকে কোনদিন এসব নিয়ে কথা বলেন নি। (ক্রমশঃ)

No comments: