Saturday, June 1, 2019

পরবাসে – ১


বাবার ছিল বদলির চাকরি, তায় আবার বনবিভাগে। দিব্বি দিন কাটছিল আজ এখানে কাল ওখানে করে। দু’-তিন বছর পরে পরেই নতুন জায়গা, নতুন ইস্কুল, নতুন বন্ধু! কিন্তু বাকিদের সেটা সহ্য হলে তো! দেখা হলেই দীর্ঘশ্বাসের ঝড় বয়ে যেতমেয়েটাকে কি এমনি জংলি করেই রাখবে অশোক / সেজদা / জামাইবাবু?
তা এইসব শুনতে শুনতে যখন ক্লাস সেভেন হল, তখন বাবারও মনে হল যথেষ্ট হয়েছে, এইবার তাহলে
তাহলে আর কি? বাবা, মা, ভাই রইল বেলপাহাড়ীতে; আর আমি ১৯৭৩ সালের এক জানুয়ারি মাসে, ঝাড়গ্রামের রানী বিনোদ মঞ্জরী রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয়ের ভর্তির পরীক্ষা টপকে, বাক্স-বেডিং কাঁধে করে একদিন পৌঁছে গেলাম হোস্টেলে। দোতলা বাড়ীটায় পা রেখেছি কি রাখিনি, একজন সাদা থান পরা মোটাসোটা মহিলা কাংস্যকণ্ঠে হাঁক পাড়লেন রামলাল, দলা আইছে। বাসকোখান লইয়া যাও দেহি! পরে জেনেছিলাম, তিনি আমাদের মেট্রন ওরফে মাসীমা তা ওই তাড়ার চোটে হোস্টেলে ঢোকার আগে ভালো করে মায়ের হাতটা ধরা হল না। দোলা থেকে দলায় রূপান্তরিত হয়ে হোস্টেলে ঢুকে গেলাম।
দোতলা বাড়ি। জনা তিরিশেক আবাসিক। প্রতি ঘরে পাঁচটা খাট, দুটি খাটের মাঝে দেড়জন যাওয়ার মতো ফাঁক। এককোণে সাইজ অনুযায়ী একের উপর এক ট্রাংক রাখা। আমারটাতে মায়ের ভালোবাসা ভরা ছিল। তাই বেচারি সবচেয়ে নীচে জায়গা পেল। দরকারের সময় আমাকে দুটো ট্রাংক কারো খাটে নামিয়ে, আবার কাজ হয়ে গেলে তাদের স্বস্থানে তুলে রাখতে হবে। ঘরে দুটো জানলা একটা দরজা। দোতলার বারান্দায় একটা মস্ত টেবিল। তার চারপাশে চেয়ার বেঞ্চি। ফাইভ থেকে এইটের পড়ার জায়গা। এককোণে খোপবিশিষ্ট আলমারি। আমিও একটি খোপ পেলাম বইখাতা রাখার জন্য।
এসব দেখেশুনে মনটা কেমন যেন দমে যাচ্ছিল, পিঠে একটা নরম হাত এসে পড়লবাড়ির জন্য মন খারাপ লাগছে? তাকিয়ে দেখি রোগা পাতলা এক দীঘল চোখের মেয়ের মায়াভরা মুখ। স্মৃতিদি মানে স্মৃতিকণা শতপথী। আমার কোন দিদি ছিল না। এক মুহূর্তেই বড্ড ভালোবেসে ফেললাম। জীবনে চলতে চলতে পরে কখন যেন হারিয়েও ফেলেছি। অনেক খুঁজেও পাইনি। সে কথা থাক। স্মৃতিদি আলাপ করিয়ে দিল কোঁকড়া চুলের মিষ্টি মুখের রূপালির সাথে। সে আমার আগে থেকেই হোস্টেলে আছে। হোস্টেলের তৎকালীন কণিষ্ঠতম সদস্যটির মুখে খুশি ফুটল না। একমাত্র ছোট বলে যে আদর এতদিন পেয়ে এসেছে তাতে ভাগ বসলে কেই বা আর খুশি হয়? ফলে প্রথম বছরটা বেশির ভাগ আড়ির উপর আড়াাড়ি করেই কেটে গেল। দ্বিতীয় বছর থেকে অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হল। ততদিনে আমিও পুরোনো হয়েছি এবং নানাবিধ উৎপাতে সুপার বীণাদির প্রাণ ঝালাপালা করার পরম ব্রতে আত্মনিয়োগ করেছি।
এইখানে বীণাদিযিনি হোস্টেল সুপারের সাথে সাথে ইস্কুলের ইংরাজি দিদিমণিওসুন্দর ব্যবহারের জন্য ছাত্রীমহলে তাঁর নাম ছিল বিনাবুড়িতাঁর পরিচয়টা দেওয়া যাক। ইংরাজি আর সংস্কৃত দুটোতেই তাঁর ভালো দখল ছিল। হোস্টেলের মেয়েদের পড়ার ব্যাপারে সাহায্য করতে কখনো ক্লান্তি ছিলো না। বস্তুতঃ টেনের মেয়েদের পিছনে লেগে থেকে টেস্ট পেপার সল্ভ করাতেন। হোস্টেলের বহু দুর্বল ছাত্রীই ওনার জন্য পাস করেছে। কিন্তু এখানেই যদি শেষ হত! অসম্ভব সন্দেহবাতিকগ্রস্ত এই দিদিমণিটির সর্বদাই মনে হত ছাত্রীরা সর্বদাই প্রেমে পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। শুধু একটি ছেলের মুখোমুখি হবার যা দেরি! আর কে না জানেপেরেমহল গিয়ে দুনিয়ার জঘন্যতম অপরাধ। বকাবকি করতে গিয়ে প্রায়ই শালীনতার সীমা লঙ্ঘিত হত তাতে মেয়েদের রাগ এবং ফিকফিক হাসি দুই- বেড়ে যেত। তাঁর কৃপায় হোস্টেলটা একটা জেলখানার চেহারা নিয়েছিল।
আমাদের স্কুলটা কিন্তু খুব ভালো ছিল। ছাত্র-শিক্ষক-পরিবেশ সবের এত সুন্দর মেলবন্ধন জীবনে আর একটিও দেখলাম না। আজও চোখ বুজলেই লাল টিনের ছাদওয়ালা বড়দির ঘর, স্কুলের বাগান,  প্রিয় কুলগাছটি চোখের উপর ভেসে ওঠে। ফাইভ থেকে এইটের ক্লাসে ছিল টানা পাখা। দুই ক্লাসের মাঝে সেটায় দড়ি টানতে যে কী আনন্দ!গরমকালে টিফিনে জল ছিটিয়ে দিতাম তার ঝালরে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় মন জুড়িয়ে যেত। দিদিরা কী সুন্দর করে পড়াতেন! ক্লাসের বাইরে অন্য সাহায্যের দরকারই হয় নি কোনদিন। নন্দলাল বসুর একটা বই দেখে আঁকতে হত আঁকার ক্লাসে। আমি সবচেয়ে সোজা ছবিটি বেছে নিয়ে চৌখুপি অংকের খাতায় তার ম্যাপ আঁকতাম। পরীক্ষায় অরিজিনালের মতো নিঁখুত এঁকেও কেন যে পাস নম্বরটাই পেতাম, সেটা তখন বুঝতাম না। তবে তাতেই খুশি ছিলাম। আমার বেএস্ট ফ্রেণ্ড বনানী কিন্তু সব বিষয়েই চৌকস ছিল।
আরেক দুঃখের ক্লাস ছিল সেলাইয়ের। নির্ধারিত সময়ে রুমালে হেম করে ফুল তোলা আমার সাধ্যাতীত ছিল। ফলে সেভেনে সেকেণ্ড ইউনিট টেস্টে ফেল করলাম! শুধু আমি একা নই, ক্লাসের আরও কয়েকজন। দেখা গেল, টেস্টের প্রথম, তৃতীয় এবং পঞ্চম ছাত্রী কোন প্লেস পাবে না! সেলাইয়ে পাস করাটা আবশ্যিক ছিল যে! এবার মুখ দেখাই কি করে? অতএব দল বেঁধে কাঁদতে বসলাম। সে কী কান্না!  টিফিনের পরে মায়াদি এসে তো হতভম্ব। ততক্ষণে চোখের জলে শার্ট ভিজে চুপচুপ। ভারি নরম মনের মানুষ ছিলেন। দৌড়ালেন স্টাফরুমে। কিছু পরে ফিরে এসে বললেন – সেলাইয়ের রি টেস্ট হবে। তখন জলের উপর ঝিকমিক হাসি! এর পর সারা স্কুল জীবন সেলাইয়ে টায়ে টায়ে পাস করে গেছি। সেলাইয়ের জন্য প্রাইজ পাওয়া আটকায় নি!
স্কুলে নতুন ঢুকেছি। তাপসীর সাথে কিঞ্চিত রেষারেষি ছিল ক্লাসে পোজিশন পাওয়া নিয়ে। কিন্তু সেলাইয়ে যুগ্মভাবে ফেল করায় তাপসী হোতাও আমার প্রিয় বান্ধবী হয়ে উঠল।

No comments: