[১]
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে....
চোখ না খুলেই মোবাইলে আঙুল বোলালেন দেবী। ঘুম জড়ানো
গলাতেই প্রশ্ন করলেন –
-
আটটা বেজে গেল?
-
তুমি এখনও
ঘুমোচ্ছ? আমার অফিস যাবার সময় হয়ে গেল এদিকে। সেটা জানো?
-
আমি তার কি করব?
আমার তো আর অফিস নেই।
-
বুঝলাম। কাল
রাতেও দেরি করে ঘুমিয়েছো।
-
সবাই শার্লক
হোমস হয়ে উঠলে আমি বাঁচি কি করে বল তো?
-
আর তুমি যে
আমার ছোটবেলাটা মিস মার্পলগিরি করে অতিষ্ঠ করে তুলেছিলে, তার বেলা?
-
আহা, শোনই না।
আমি ভাবছি আমার ফোনের রিংটোনটা এবার বদলে দেব।
-
মানে?
-
‘তুমি সুর
শুনায়ে যে ঘুম ভাঙাও’ – গানটা বেশ অ্যপ্রোপ্রিয়েট হবে, কি বলিস?
-
ইউ আর
ইনকরিজিবল মা। সবসময় ইয়ার্কি।
-
কি করি বল?
সিরিয়াস হলে তো সেই এক কথাই বলতে থাকবি।
-
তুমি বোঝ না।
আমার খুব চিন্তা হয়।
-
বুঝি রে। এই
চিন্তাটুকুই তো সারাদিন চেটেপুটে খাই।
-
তবু আমার এখানে এসে থাকবে না?
-
ওরে, কেন
বুঝতে চাস না – এই যে নিজের মতো করে আছি, এ বাড়ির আনাচে কানাচে তোর শৈশব, বড়ো হয়ে
ওঠা, তোর বাবার স্মৃতি – এসব ছেড়ে নতুন করে বসত বসাতে ইচ্ছে করে না রে।
-
আমি ছেলে হলে
এমন কথা বলতে পারতে?
-
তুই আমার
একমাত্র। ছেলে না মেয়ে ভাবিইনি কোনোদিন। জানিস কাল আলমারি গোছাতে গিয়ে তোর বাবার
সেই হারিয়ে যাওয়া আংটিটা বের হলো।
-
এতোদিন বাদে?
সেই হলদে পাথর দেওয়াটা?
-
তাই তো
দেখলাম। শাড়ির ভাঁজে কিভাবে যেন আটকে রয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু আর না। তোর দেরি হয়ে যাবে। খেয়েছিস তো?
-
হ্যাঁ গো। সব
সেরে বেরোবার আগে তোমাকে রিং করলাম।
-
ভালোভাবে
সারাদিন কাটুক তোর। সন্ধ্যায় ভিডিও কল করিস। এখন আয়।
-
হুঁ, তুমিও
মুখ ধুয়ে কিছু খাও এবার।
এবার উঠতেই হয়। সত্যিই অনেক বেলা হয়েছে। রিনি জানে তার
মা রাতে নামমাত্র খায়। তাই রোজ সকালে নিয়ম করে ডেকে তুলে খেতে বলে। দেবী নিজের
মনেই একটু হাসেন। সেই হাসিতে অনেকটা তৃপ্তি আর ভালোলাগা মিলেমিশে থাকে। জানলার
পর্দাটা সরিয়ে দিতেই ঝলমলে রোদ ঘরের মেঝেতে লুটোপুটি খায়।
গতকাল ঘুম আসতে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। বয়েস বাড়ার এও
এক লক্ষণ। অথচ ঘুমকাতুরে বলে এককালে খুব বদনাম ছিল তাঁর। রাত নটা বাজতে না বাজতেই
দুচোখের পাতা আঠার মতো একে অপরের সঙ্গে জুড়ে যেতে চাইত। অথচ এই নিশ্ছিদ্র অবসর
জীবনে সে যে কোথায় লুকিয়ে পড়লো কে জানে!
প্রথম প্রথম অনেক রাত অবধি বিছানায় শুয়ে ছটফট করতেন
দেবী। অস্থির লাগত। একাকাীত্বের যন্ত্রণা শরীরে মনে চেপে বসত। তারপর নিজেই এ থেকে
মুক্তির উপায় বের করলেন। রাতের খাওয়া সেরে সারা ঘর অন্ধকার করে বারান্দায় এসে বসেন
এখন। পাঁচতলার বারান্দাটা থেকে রাতের শহরের রূপ উপভোগ করেন। রাতদুপুরে
মধ্যমগ্রামের মতো একটা আটপৌরে জায়গা যে এমন মোহময়ী চেহারা ধারণ করতে পারে, এতোটা
বয়েস পর্যন্ত সেটা তাঁর জানাই হয়ে ওঠেনি। যেমন ধরুন, সারাদিন ছোটবড়ো বাচ্চাদের
কলকলানিতে মুখর ফুটবল মাঠটা রাতের আধাঁরে কেমন নিস্তব্ধ নিঝুম। গত দু তিনদিন ধরে
সেখানে একলা একটি মানুষ সেই মাঠে হাঁটেন। রাত একটার সময় রোজ চার-পাঁচ পাক ঘুরে
আবার কোথায় যেন চলে যান। হয়তো বা নিজের ঘরেই। মাথা নীচু করে একমনে সামান্য পা টেনে
টেনে হাঁটা মানুষটার গল্প জানতে খুব ইচ্ছে করে দেবীর।
আবার কখনো রাস্তার উল্টোদিকের আবাসনের ফ্ল্যাটগুলোর
জানালায় জীবনের একটুকরো ছবি ধরা পড়ে। সেটাকে নিয়ে গল্প বুনতে বুনতেই কখন যেন চোখে
ঘুম জড়িয়ে আসে। তখন বিছানার গর্ভে আত্মসমর্পণ।
দিনের বেলায় এসব সমস্যা নেই। দেবী নিজের জন্য হাজারো কাজ
জুটিয়ে নিয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান কাজ হলো, সকালে পাড়ার ক্লাবঘরে বসে
দরিদ্র শিশুদের পড়ানো। তাতে বেশ কিছুটা সময়
খুব ভালো কাটে। এই বাচ্চাদের সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে চারপাশের মানুষজন সম্পর্কে কতো
কথাই যে জানতে পারেন! মাঝে মাঝে এইটুকু ছেলেমেয়েদের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গী এবং
জীবনদর্শনের গভীরতা তাঁকে বিস্মিত ও চমকিত করে।
কিন্তু আপাততঃ কিছুদিন ধরে একটি বিশেষ ফ্ল্যাট তাঁর নজর
কেড়েছে। ঘটনাক্রমে ওই বাড়ির শোবার ঘরের জানালা এবং ফ্ল্যাটে ঢোকার দরজার কিছুটা
তিনি দেখতে পান। এমনিতে দেখা যাবার কথা নয়। নেহাৎ আজকাল করিডোরে কাঁচের দেওয়াল
লাগানো ফ্যাশন হয়েছে, তাই। আর এই ফ্ল্যাটের দরজাটা দেওয়ালে পাশেই। রাত্রিবেলা আলো
জ্বললে ভেতরটা মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যায়। দেবী জানেন এভাবে অন্ধকারে লোকের বাড়িতে
চোখ পাতা ঠিক নয়। তবু ইদানিং এটা যেন তাঁর নেশা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ফ্ল্যাটে এক নিঃসন্তান কমবয়েসী দম্পতি থাকে। নিঃসন্তান –
কারণ দিনের বেলাতেও ওদের বারান্দায় কখনো বাচ্চাদের জামাকাপড় শুকোতে দেখেননি দেবী।
তিনি এদের নাম দিয়েছিলেন টুন আর টুনি। ওদের খুনসুটি, আর একটা হাসিখুশি সংসারের ছবি
দেখতে ভালোই লাগত তাঁর।
ভালো লাগতো। দেবী অতীতকালটা ভেবেচিন্তেই ব্যবহার করলেন।
বাইরে থেকে চিত্রটা না বদলালেও তিনি জানেন, তাতে ফাটল ধরছে। ব্যাপারটা কয়েকমাস হলো
শুরু হয়েছে। মাসে একবার অন্ততঃ টুন তিন-চার দিনের জন্য কোথাও যায়। সম্ভবত অফিসিয়াল
ট্যুর। আর সেই অনুপস্থিতির এক রাতে একটা ছোটো লাল গাড়ি এসে ফ্ল্যাটের নীচে
দাঁড়ায়। স্যুটেড বুটেড চালকটি গাড়ি থেকে নেমে সোজা পায়ে ব্লকের ভিতরে ঢুকে যায়।
কিছুক্ষণ পরে টুনটুনিদের দরজায় তাকে আবার একঝলক দেখতে পান দেবী। এরপরের ঘটনা
দ্রুত। শোবার ঘরের জানালায় ধরা পড়ে একটি তীব্র আশ্লিষ্ট আলিঙ্গন। তারপরেরই পর্দা
টেনে দেয় মেয়েটি। এক দেড় ঘণ্টা বাদে লোকটি বেরিয়ে আসে। ওপরে তাকায়। টুনি জানালায়
দাঁড়িয়ে হাত নাড়ে। তারপরেই সে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়।
দিনের পর দিন একই ঘটনা। একচুলও এদিক ওদিক হয় না। দেবী
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আজকালকার প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের খুশি য কিসে, তা তাঁর কাছে
ক্রমশই দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছে। যাকগে, যে যার মতো ভালো থাকলেই ভালো।
অন্যবারের মতো আজও লাল গাড়ি এসেছে। ইদানিং গাড়িটা চলে না
যাওয়া অবধি দেবী শুতে যান না। আজও তাই বসে ছিলেন। এটা কি একধরণের নীতিপুলিশগিরি?
দেবী খানিকটা জোর করেই এইসব অস্বস্তিদায়ক ভাবনা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলতে চাইলেন।
আপাতত কাল তিনি জামসেদপুর যাচ্ছেন। মামাতো বোনঝির ছেলের পৈতে। তিনদিন পর ফিরবেন।
তাই মোবাইলে এলার্ম দিয়ে শুয়ে পড়লেন। সকাল সকাল বেরোতে হবে। কেন জানি না, মনটা আজ
একটু খচখচ করছে। কি যেন একটা বাদ পড়ে গেছে মনে হচ্ছে। একবার উঠে গ্যাসের নব,
মাইক্রোর সুইচ সব চেক করে এলেন। সবই ঠিক আছে। তাহলে? ভাবতে ভাবতেই ঘুমের দেশে
তলিয়ে গেলেন।
পৈতেবাড়ি খুব ভালো কাটলো। অনেক আত্মীয়-বন্ধু এসেছিলেন।
এই সব অনুষ্ঠানবাড়ি ছাড়া আজকাল তো সবার সঙ্গে দেখা হবার সুযোগই হয় না। তাই দেবী এই
সুযোগ হারান না খুব একটা। কিন্তু এবারে ফিরে এসেই সুমিতার ফোন পেয়ে আনন্দটা খান
খান হয়ে গেল। সুমিতা রিনির এক বান্ধবীর
মা। এখন তাঁরও বান্ধবী। মেয়েদের স্কুলে দিয়ে নিয়ে আসর সময় যে বন্ধুত্বের সূচনা
হয়েছিল তার ধারা আজও দুজনেই বয়ে চলেছেন। কৃতিত্বটা অবশ্য সুমিতারই বেশি। সেই সবার
খোঁজখবর রাখে। মাঝে মাঝে একটা গেট টুগেদারের আয়োজন করে। ভালোই লাগে সবার। এজন্য
সুমিতার কাছে দেবী কৃতজ্ঞ। কিন্তু সুমিতা যে খবরটা দিলো তাতে দেবী একাধারে বিষণ্ণ
ও চমকিত হলেন। প্রগতি মারা গিয়েছে এবং মৃত্যুটা নাকি স্বাভাবিক নয়।
[২]
প্রগতির মুখটা দেবী চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন।
নীলসাদা চেক চেক স্কার্ট, ঘিয়ে রঙের শার্ট পরা মেয়েটা, রিনির হাত ধরে দৌড়ে দৌড়ে
আসছে –
-
আন্টি, আজকের আলুর পরোটাটা জাস্ট অসাম ছিল।
-
কালকেও টিফিনে তাহলে এই পরোটাটা
বানিয়ে দেবো। আর তার সঙ্গে যদি সেই মিক্সড আচারটা থাকে..
-
ধ্যাৎ, একঘেঁয়ে হয়ে যাবে না? নতুন কিছু ভাবো প্লিজ।
প্রগতির মা মেয়েকে থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। কিন্তু
ওই মেয়ে ধরলে কথা থামায় কে? দেবী তার মাথায় হাত রেখে হাসিমুখে বললেন –
-
তাই হবে। কাল একটা সারপ্রাইজ পাবে।
-
ওঃ আন্টি, ইউ আর গ্রেট।
চকাস করে আন্টির গালে চুমু খেয়ে আবার দৌড় লাগায়। পরীর
মতো সুন্দর আর ছটফটে সেই মেয়ে! কবে? কিভাবে?
ফোনের ওপারে সুমিতা অবশ্য থেমে নেই। তার কথা থেকেই জানতে
পারলেন, প্রগতির বিয়ে হয়েছিল পুনেতে। বিনয় – ওর বর এদিকে বদলি হয়ে আসায় ওরা এই
মধ্যমগ্রামেই ফ্ল্যাট কিনেছিল। অফিসের কাজে বিনয়কে প্রায়ই বাইরে যেতে হয়, তাই বৌকে
তার পরিচিত জায়গাতেই রাখা নিরাপদ ভেবেছিল। কে জানত যে সেখানেই......
দেবীর কানে কথাগুলো অস্পষ্ট হতে হতে হারিয়ে যেতে থাকে।
ক্লান্ত লগছে তাঁর। আস্তে করে একসময় ফোনটা নামিয়ে রাখলেন। বিন্তির মা বোধহয় কিছু
আঁচ করেছিল। জল এগিয়ে দেয়। একগ্লাস, দুই গ্লাস... রাজ্যের তৃষ্ণা যেন দেবীর বুকে
বাসা বেঁধেছে।
প্রগতি – রিনির বেস্ট ফ্রেন্ড – চঞ্চল, হাসিখুশি,
অ্যাডভেঞ্চারাস। সেই প্রগতি। বাবাকে তো সেই কোন ছোটোবেলতেই হারিয়েছিল। দেবী সেই
ক্লাস ফাইভের মেয়েটার আকুল কান্না চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন। মেয়েটার কপাল এসব
দিকে সত্যিই খারাপ। ওর বিয়ের কিছুদিন পরে ওর মাও মারা গেলেন। এর পরে এখানকার সঙ্গে
সব সম্পর্ক চুকিয়ে ওরা চলে গিয়েছিল। তারপর যা হয়। ধীরে ধীরে যোগাযোগের সুতো আলগা
হতে শুরু করে। ওরা আবার এখানে ফিরে এসেছিল? তিনি এসবের কিছুই জানতেন
না।
পরদিনই ঘুরে সুমিতাকে ফোন করলেন। একবার প্রগতিদের বাড়ি
যাওয়া দরকার।
-
হ্যালো সুমি? প্রগতিরা কোথায় বাড়ি কিনেছিল জানিস?
-
জানতাম না। এখন সবার মুখে শুনছি। সাগরিকা আবাসন।
-
ক্বীই? আমার ফ্ল্যাটের উল্টোদিকেই তো!
-
হ্যাঁ রে। ওরা তো ফিরে এসে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
-
কার সঙ্গেই বা করবে? ওর বন্ধুরা, মানে আমাদের সবার মেয়েই
তো এখন বাইরে। হয় চাকরি, নয় বিয়ে।
-
জায়গাটা এতো কনজেস্টেড হয়ে গেছে যে, আজকাল রাস্তাঘাটেও
চেনা লোকের দেখা পাওয়া, বিরল ঘটনা হয়ে যাচ্ছে।
-
তবুও। এতো কাছাকাছি থেকেও –
-
সবই কপাল রে দেবী।
-
আসবি একবার? ওদের বাড়ি যেতাম একটু।
-
এখন আর গিয়ে কি লাভ? তবু তুই বলছিস যখন –
-
দেখ না রে সুমি। মনটা বড্ডো টানছে।
-
শুনছিলাম কাল ওর বর একটা স্মরণসভার আয়োজন করেছে। ওদের
ফ্ল্যাটেই। সেখানে যাওয়া যেতে পারে। আমি ঠিকানাটা যোগাড় করছি, দাঁড়া।
বিন্তির মা বোধহয় দেবীর মন খারাপটা বুঝতে পারছিল। সেদিন
তাই জানতে চাইল-
-
কি হয়েছে গো কাকিমা? দুদিন ধরি তোমারে খুব অস্থির দেখাচ্ছে।
কুনো খারাপ খবর?
-
সামনে ফ্ল্যাটে একটা বৌ মারা গেছে, জানিস? সে দিদির
ছোটবেলার বন্ধু ছিল।
-
ও মা, তা আর জানবু নি? আমাদের আশা তো ওই ফ্যালাটেই কাজ
করে গো! দিদির বন্ধু ছেল? বৌটা কিন্তু ভালো ছেল না জানো।
-
মানে?
-
বরটার আড়ালে পরপুরুষের সাথে ফষ্টিনষ্টি করতো গো। তাই উয়ার
সাথে আজকাল অন্য বৌরা মিশত না। সবারই তো আপন ঘর সামলাতে হবে, তাই না? বলো তুমি?
-
বরটা কেমন?
-
এইসব বৌয়ের বর যেমন হয়। ম্যাদামারা।
দেবী আর সুমিতা
স্মরণসভায় গিয়েছিলেন। আর গিয়ে দেবী স্তব্ধবিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। এ তো সেই
টুন-টুনির ফ্ল্যাট! তার মানে টুনিই প্রগতি? মেয়েটাকে যেটুকু চিনতেন, তার সঙ্গে লাল
গাড়িটা কিছুতেই মেলাতে পারছিলেন না দেবী। মানুষ এতো বদলে যায়! পরিচয় দিতে বিনয় খুব
যত্ন করেই ওঁদের বসাল। স্বাভাবিকভাবেই সে খুব ভেঙে পড়েছে। বরাবরের মতোই এবারও
ট্যুরে গিয়েছিল। তবে এবারের ট্যুরটা একটু লম্বা ছিল। দরজা বন্ধ থাকায় সবাই ভেবেছিল
প্রগতি কোথাও বাইরে গেছে। তারপর গন্ধ বের হতে –
হাউহাউ করে কাঁদছিল বিনয়। দেবী জানতে চাইলেন, এতোদিন ফোন না পেয়ে তোমার কোন চিন্তা হয়নি?
-
ও খুব মুডি ছিল আন্টি। মাঝে মাঝেই ইচ্ছে
করে ফোন সুইচ অফ রাখত। কিছু বললে হাসত। বলত, চিন্তা করা ভালো। এতে টান বাড়ে।
দেবী মাথা নাড়লেন। প্রগতি এরকমই খামখেয়ালি ছিল বটে।
-
পুলিস কি বলছে?
-
প্রগতির পেটে খুব অল্প পরিমাণে ঘুমের ওষুধ পাওয়া গেছে।
মৃত্যুর কারণ বোঝা যাচ্ছে না। প্রথমে ভেবেছিল গলা টিপে মারা হয়েছে। কিন্তু কোনোরকম
দাগ বা ধস্তাধস্তির চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কোনো কারণে দমবন্ধ হয়ে বা হার্ট
অ্যাটাক..... কি যে হলো! হয়তো আরও দু একটা
পরীক্ষা হবে।
-
আসলে মাঝে অনেকটা দেরীও তো হয়ে গেছে।
বিনয় নিঃশব্দে কপালে হাত রাখে।
ছোট্ট শোকসভা। কিছু আত্মীয়স্বজন
এসেছেন। দেবীরা আরও একটু বসে চলে এলেন। শরীর ও মন কোনোটাই ভালো লাগছিল না। এককাপ
চা নিয়ে বারান্দার চেয়ারটায় এসে বসলেন। স্বভাবতই চোখ চলে গেল টুনি মানে প্রগতিদের জানালায়।
খোলা জানালার ওপারে কিছু লোকের চলাফেরা। দেবী হঠাৎ আপাদমস্তক শিউরে উঠলেন। তাঁর
মনে পড়ে গেছে।
জামসেদপুরে যাওয়ার আগের রাতে ওই
শোবার ঘরের জানালা সরিয়ে কেউ দাঁড়ায়নি। ছেলেটিরও জানা ছিল কেউ দাঁড়াবে না। তাই সেও
নিত্যদিনের মতো ওপরে তাকায়নি। সোজা গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। সেই অসংগতিটুকুই
অবচেতনে গেঁথে ছিল। তাই তাঁর বারবার মনে হয়েছিল কি যেন বাদ পড়ে গেছে।
তবে কি ছেলেটি জানত – আজ কেউ
দাঁড়াবে না? কারণ সে দাঁড়াবার অবস্থায় নেই! কিন্তু মোটিভ? দেবী নিজের মনেই মাথা
নাড়েন। একঘণ্টা আগেই যাদের তীব্র আশ্লেষ আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় দেখেছেন, তারা এতো
দ্রুত একজন আরেকজনকে হত্যা করতে যাবে কেন? আকস্মিক আবেগ? মাথা নাড়লেন আবার। সেই
মৃত্যুর পদ্ধতি এমন নয়। ছুরি, মাথায় বাড়ি, গলা টেপা – এই সব হতে পারত। কিন্তু
হালকা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে, তারপর খুন – নাঃ, হিসেব মিলছে না। হয়তো
সাধারণ ঝগড়া বা রাগারাগি – দেবী বড়ো অসহায় বোধ করেন। তাঁর আরও কিছু খবর দরকার।
কিন্তু কার কাছে?
ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল। সাগরিকায়
মৃদুলার ছেলে থাকে না? বউটার নাম যেন কি? মনে পড়েছে। নীলা, নীলা মিত্র। এখানকার
গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা। এখানে আসার পর ওদের বাড়ি একদিন নিমন্ত্রণ করেছিল। সেই যা
গিয়েছেন। তারপরে আর যাওয়া হয় নি। পরশু স্কুল ছুটি আছে। তাঁর পাশের
ফ্ল্যাটের মেয়েটি ওই স্কুলে পড়ে। তার কাছেই শুনেছেন। কিন্তু অফিস খোলা। দেবী এই
দিনটাই বেছে নিলেন। তিনি নীলার সঙ্গে একা কথা বলতে চান।
নীলা দেবীকে দেখে একটু অবাকই হয়েছিল।
বেশি ভণিতা না করে দেবী সরাসরি বললেন, মৃতা প্রগতিকে তিনি চিনতেন। তাঁর মেয়ের
ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই মৃত্যুটা তিনি মেনে নিতে
পারছেন না। কিভাবে কেমন করে এসব হলো, সে বিষয়ে নীলা কি কিছু বলতে পারে?
-
কি বলবো বলো তো মাসী? এসব নিয়ে কথা বলাও তো বিপদ। আর আমি
জানবোই বা কি করে?
-
জানার কথা তো নয় কারোরই। তবু তুমি একজন স্মার্ট
বুদ্ধিমতী মেয়ে। তোমার নজরে কিছু পড়েনি কখনো? বাই দ্য ওয়ে, প্রগতিকে চিনতে নাকি?
মোটামুটি তোমাদের বয়েসী তো। তাই মনে হলো।
-
চিনতাম। একসময় খুব ভালো করেই চিনতাম। মিশুকে
আড্ডাবাজ মেয়ে ছিল তো। ওদের বাড়িও গিয়েছি কতোবার। খুব ঘর গোছানোর শখ ছিল জানো?
সবসময় এতো সুন্দর, টিপটপ, যে দেখলে অবাক হতে হয়।
-
চিনতাম বলছো। ইদানিং কি কিছু বদলে গিয়েছিল?
-
প্রগতি একটা এক্সট্রা ম্যারিটাল সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিল।
বিনয়দা বাইরে গেলে সে আসত শুনেছি।
-
শুনেছ? দেখোনি?
-
নাহ্। লোকটা নাকি রাত্রে আসত। গার্ডরা হাসাহাসি করত। তাই
থেকে কাজের লোক, তারপর ফ্ল্যাটের মহিলারা...। জানোই তো এসব ব্যাপার চাটনি আচার
দিয়ে পরিবেশনা করার লোকের অভাব হয় না।
নীলার মুখে ঘৃণা, অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্যে মাখামাখি একটা হাসি
ফুটল। মনে মনে বলল, আজ যেমন তুমিও আমার
কাছে সেই চাটনির উপাদান নিতে এসেছ। যত্তোসব নাকগলানে বুড়ির দল! মুখে আবশ্য বলল –
চা খাবে মাসী?
-
শুধু লিকার। চিনি ছাড়া।
দেবী অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। নীলার মনোভাব না বোঝার মতো
অনভিজ্ঞ তিনি নন। এভাবে হুট করে আসাটা যে দৃষ্টিকটু সে বোধ তাঁরও আছে।
নীলা চা করে নিয়ে এসে বসল। দেবীর দীর্ঘ নীরবতা তাকে
কোথাও একটা অপরাধী বোধ করাচ্ছিল। মনে পড়ল, প্রগতি, দেবীর মেয়ের ছোটবেলার বন্ধু।
হয়তো তাঁরও স্নেহের পাত্রী ছিল। তাই হয়তো বয়স্ক মানুষটি দৌড়ে এসেছেন। এবার তাই
নিজে থেকেই কিছুটা হড়বড়িয়ে বলতে থাকে –
-
ইদানিং বিনয়দার সঙ্গে প্রগতির বোধহয় একটু মন কষাকষি
চলছিল।
-
কি নিয়ে?
-
বিনয়দা বাচ্চাদের যে কি অসম্ভব ভালোবাসে, তা না দেখলে
বিশ্বাস করা যায় না। অথচ ভগবান ওদের....
দেবী আস্তে করে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন –
-
আজকাল তো অনেক চিকিৎসা হয়েছে। তাছাড়া অ্যাডপ্টও তো করা
যেত।
-
এখানেই তো গণ্ডগোল গো। প্রগতি ছোট বাচ্চাদের সহ্যই করতে
পারত না। ওরা নাকি নোংরা চিল্লানোসোরাস একেকটা! ঘরদোর তছনছ করতে ওদের নাকি জুড়ি
নেই। টিপটপ সাজানো বাড়ি প্রগতির একটা অবসেশনের মতো ছিল।
-
তাই হয়তো ভগবানও ওদের কোলে কাউকে পাঠালেন না।
-
জানো মাসী, প্রগতি নাকি কয়েকমাস আগে কনসিভ করেছিল।
কিন্তু মিসক্যারেজ হয়ে যায়।
-
কি করে জানলে?
-
আশা নামে যে মেয়েটি ওদের বাড়ি কাজ করতো, সে আমার বাড়িতেও
কাজ করে। ওই বলছিল।
-
করতো? এখন করে না?
-
কিছুদিন আগে আশার হাত লেগে কি একটা ফুলদানি ভেঙে যায়।
প্রগতি ওকে মারতে বাকি রেখেছিল। খুব ঝগড়া হয়। আশা ওদের বাড়ির কাজ চেড়ে দেয়। ওর বরও
পরে এসে নাকি শাসিয়ে গিয়েছিল।
-
লোকটার সাহস তো খুব। কমপ্লেক্সে এসে...
-
প্রায়ই ওদের বাড়ি আসতো যে। প্রগতির অনেক কাজ করে দিত।
দোকান, বাজার....
-
তাহলে তো ভালোই বলতে হবে।
-
লোকটা খুব একটা ভালো না গো। কেমন করে যেন তাকায়। খারাপ
পাড়ায় নিয়মিত যাতায়াত আছে শুনেছি। আমি তো বাড়িতে ঢুকতে দিই না।
-
প্রগতির সাহস চিরকালই বেশি।
-
আবার হেসে হেসে বলত, একটু মিষ্টি করে হেসে কথা বললেই
নাকি অনেক কাজ করে দেয়।
-
অথচ ছোটবেলায় মেয়েটা খুব ভালো ছিল জানিস? মন মুখ আলাদা
ছিলো না।
বোধহয় স্মৃতির আবেগেই তুই তুমি গুলিয়ে গেল। নীলাও কেমন
যেন বিচলিত হয়ে উঠলো –
-
মাসী, তুমি কষ্ট পেয়ো না। প্রগতি ইদানিং বদলে গিয়েছিল। বেশ
জোরের সঙ্গে মিথ্যে বলতো।
-
মানে?
-
মানে আবার কি? আমার সঙ্গে তো ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতোই মিশতো। তাই
ওর বদনাম শুনে খারাপ লেগেছিল। বলেও ছিলাম, বিনয়দার মতো বর থাকতে তোর অন্য কারোকে
দরকার হচ্ছে কেন? উলটে আমার ওপরেই ঝাঁঝিয়ে উঠলো। বলে কিনা – বাজে বকিস না তো!
-
তাই?
-
হুঁ। অথচ আমি নিজে দেখেছি।
-
সে কি? এই যে বললে....
-
সে তো তার রাতের অতিথির কথা। আমি মাঝে মাঝে সিঙ্গুর যাই।
আমার বোনের বাড়ি সেখানে। ওখানকার কফিশপে আমি ওকে একটা লোকের সঙ্গে বেশ কয়েকবার
ঘনিষ্ঠভাবে গল্প করতে দেখেছি।
-
কিছু বলনি?
-
এমন মিথ্যবাদীকে আর কি বলব? তারপর থেকে এড়িয়েই চলতাম।
ইদানিং তো দেখাসাক্ষাতও হতো না বিশেষ ।
-
আরও কারো সঙ্গে দেখা যেত নাকি?
-
এমন মেয়েকে কোন ভদ্রলোক পাত্তা দেবে? ঢলানি মেয়ে একটা!
শুধু লোককে এক্সপ্লয়েট করার তাল।
নীলা একটু উত্তেজিত হয়ে উঠল। দেবী আর কথা বাড়ালেন না। বাইরে
আকাশ কালো করে এসেছে। গুমোট গরম। ঝড়বৃষ্টি হবে নাকি? দেবী ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে
রওনা হলেন। বাড়ি পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ঝড় শুরু হয়ে গেল। তার সঙ্গে বড়
বড় ফোঁটায় বৃষ্টি। ভাগ্যে কোথাও বেরোবার আগে, সব দরজা জানালা বন্ধ করে বেরোনো
অভ্যাস তাঁর! টেবিলের ওপর বিন্তির মা রাতের রুটি তরকারি বানিয়ে রেখে গেছে। দেবী
জামাকাপড় ছেড়ে, এককাপ চা বানালেন। চেয়ার টেনে, জানালার পাশে বসে, বৃষ্টিভেজা
গাছেদের লুটোপুটি দেখতে থাকলেন। ঘাসপাতার এই জলে ধোওয়া সবুজ রঙটা তাঁর খুব প্রিয়।
একটা দীর্ঘশ্বাসও বেরিয়ে এল। নীলার কাছ থেকে যা জানা গেল, তাতে এটুকু বুঝলেন
প্রগতি ভীষণভাবে বদলে গিয়েছিল।
[৩]
দেবী দু’দিন ধরে
ভাবলেন। কিন্তু মেয়ের বকুনি সত্ত্বেও শুক্রবারের বন্ধ জানালাটাকে মন থেকে সরাতে
পারলেন না। অবশেষে জোর করে দ্বিধা দ্বন্দ্ব সরিয়ে অরূপকে ফোনটা করেই ফেললেন। অরূপ
সিনহা তাঁর বোনঝি-জামাই। পুলিশের একটু উঁচু পদেই আছেন। দেবীর বিচারবুদ্ধি
ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার উপর শ্রদ্ধাশীলও বটে। দেবীর কাছ থেকে ব্যাপারটা শুনে বললেন
খবর নিয়ে জানাবেন। কয়েকদিন বাদে জানালেন, সমর রায় নামে এক পুলিশ অফিসার বিকেলে
দেবীর কাছে আসবেন। দেবী যেন তাকে সব কথা খুলে বলেন।
সমর রায় মানুষটি একজন নিপাট ভদ্রলোক। তবে তাঁর উজ্জ্বল
চোখদুটি বলে দেয় যে কোনকিছু এঁর নজর এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল। দেবীর কাছে সব শুনে তিনি
বারান্দা ও প্রগতিদের ফ্ল্যাটটির অবস্থান বেশ ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলেন।
-
আপনার পর্যবেক্ষণ শক্তি তো দুর্দন্ত ম্যাডাম। আরো কিছু
নজরে পড়লে আমাকে জানাবেন। এই আমার ফোন নম্বর। স্যর আপনার কথা
এতো কেন বলছিলেন, বুঝতে পারছি।
-
দুয়েকটা কথা জানতে পারি?
-
নিশ্চয়ই ম্যাম।
-
ঠিক কবে মারা গেছে প্রগতি?
-
বডি তো আমরা অনেক দেরিতে পেয়েছি। তাই এখুনি নিশ্চিত করে
বলা যাচ্ছে না। আরো কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন।
-
কিছু কি চুরি গেছে?
-
কুটোটুকুও নয়।
-
ওই লাল গাড়িটার কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে?
সমরের ভ্রু কুঁচকে উঠল।
-
ভারি অদ্ভুত ব্যাপার ম্যাম। গাড়িটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে
গেছে। গার্ডদের সঙ্গে কথা বলে এই আগন্তুকের কথা ও গাড়ির নম্বর জেনেছিলাম।মনে হচ্ছে
নম্বরটা ভূয়ো। তাছাড়া মডেল ও রং এতোটাই কমন যে কেউ কিছু বলতেই পারছে না।
-
মালিকের বর্ণনা?
-
সেও খুব সাধারণ। দাড়ি, চশমা, গাড়ির ভিতরের
আলো-আঁধারি – নাঃ, তাকেও ঠিকভাবে আইডেন্টিফাই করা যাচ্ছে না।
-
কিন্তু হাতের লেখা? আবাসনে ঢুকতে হলে রেজিস্টারে সই করতে
হয় না?
-
হয়, আবার হয়ও
না। ডিউটির গার্ড একশো টাকা পেত। লোকটির নাম ও গাড়ির নম্বর লিখে ছেড়ে দিত।
-
কি নাম?
-
প্রকাশ বসু। তবে এরও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো নকল
নাম। চেহারাটাও নকল হতে পারে।
-
সিসিটিভি?
সমর ক্রমশঃ অবাক হচ্ছিল মহিলার ভাবনার স্বচ্ছতায়। কথা
বলতে আগ্রহ বোধ করছিল। নিজেও আরেকবার ঝালিয়ে নিচ্ছিল তথ্যগুলো।
-
ছবি খুব আবছা। তবু তার উপর বেস করে পুলিশের আর্টিস্টকে
দিয়ে ছবি আঁকিয়েছি। দেখুন তো আপনার দেখার সঙ্গে মেলে কিনা?
-
আমি তো রাতে অনেক দূর থেকে দেখি। খুব ভালো তো বোঝা যায়
না।
আচ্ছা, বিনয়ের অ্যালিবাই আছে?
-
একদম পাক্কা অ্যালিবাই। বুধবার বিনয় অফিস ট্যুরে
দুর্গাপুরে গিয়েছিল। সেই অফিস থেকে তাকে শুক্রবারে সাঁতরাগাছি পাঠানো হয়। সেখানে
বিকেল নাগাদ অফিস থেকে বেরিয়ে এক শপিং মলে গিয়ে বৌয়ের জন্য কিছু কেনাকাটা করে।
সঙ্গে এক বন্ধুও ছিল। তারপর দুজনে একটা হোটেলে ওঠে। রাতটা সেখানে কাটিয়ে, শনিবার
আবার দুর্গাপুরে ফেরত আসে। সেখানে দুদিন ছিল। সেখানেই খবর পেয়ে, বাড়ি আসে।
-
হুঁ। ও প্রতিমাসেই ট্যুরে যেত। রুটিন ব্যাপার তাহলে।
-
ট্যুরে গেলে ওকে
সাঁতরাগাছি একবার আসতেই হয়। ওর অফিসই পাঠায়। আর প্রতিবারই কিছু না কিছু কেনে বলে
মলের অনেকেই ওকে চেনে। হোটেলের লোকজনও ওর পরিচিত। কাজেই তার গতিবিধি অনেকেই
কনফার্ম করেছে।
-
কোন দ্বিতীয় সম্পর্ক?
-
নাঃ। এসব দিকে ভদ্রলোকের রেপুটেশন ভালো।
-
রাতের অতিথির কথা জানতো?
-
দু একবার লোকে বলেছে। কিন্তু বিনয় বিশ্বাস করতো না।
বউয়ের প্রেমে অগাধ আস্থা ছিল নাকি।
-
প্রগতির অন্য কোনো সম্পর্ক?
-
কলেজে পড়াকালীন, অমিয় বসু নামে একটি ছেলের সঙ্গে প্রগতির গভীর প্রেম ছিল।
কিন্তু ছেলেটির সেটল হতে দেরি হওয়ায় প্রগতির বাড়ি থেকে এই বিয়ে দেওয়া হয়। তখন
প্রগতি মেনে নিয়েছিল। তবে কিছুদিন হলো..
-
কি?
-
ফেসবুক মারফত আবার দুজনের যোগাযোগ হয়েছিল। প্রায়ই
ইনবক্সে কথা হতো। কয়েকবার দেখাও করছে। তার সাক্ষী আছে।
-
সে কি বলছে?
সমরের হাসিটা স্পষ্টতঃই ক্ষুব্ধ –
-
যা বলে থাকে লোকজন। বিশুদ্ধ বন্ধুত্ব। প্রত্যাশা মাফিকই
লুকিয়ে আসাটা অস্বীকার করছে।
-
অ্যালিবাই?
-
সে ভারি গুণধর ছেলে। বলছে, সেই রাতে বেশ্যাবাড়ি ছিল। সেই
মেয়েটি কনফার্ম করছে। তবে অন্য কেউ অমিয়কে সেখানে দেখেনি।
-
অমিয়ের লাল গাড়ি আছে?
-
নাহ্। তাতে অবশ্য কিছু প্রমাণ হয় না। ভাড়ার গাড়িও
ব্যবহার করতে পারে।
-
কোথায় থাকে?
-
সিঙ্গুর। গাড়িতে মোটামুটি ঘণ্টা খানেক লাগে। আমরা নজর
রাখছি।
আজ
চলি ম্যাম। নতুন কিছু মনে পড়লে ফোন করতে যেন ভুলবেন না।
সমর চলে গেলে দেবী অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। রহস্যের
জট খোলার বদলে আরও যেন পাকিয়ে যাচ্ছে। খানিকক্ষণ ভেবে অজিত বা তোপসের কায়দায় পরপর
তথ্যগুলোকে লিখতে লাগলেন।
১) বিনয় ও প্রগতির সম্পর্ক বাইরে থেকে আর পাঁচটা দম্পতির
মতোই। জানলা দিয়ে যেটুকু দেখেছেন, তাতেও এরকমই মনে হয়।
২) প্রগতির ঘর গোছানোর শখ ছিল।
৩) বিনয় বাচ্চা ভালোবাসত। প্রগতি নয়।
৪) বিনয়ের ট্যুরের সময় প্রগতির একজন প্রণয়ী আসত। প্রগতি
বা বিনয় দুজনের কেউই ব্যাপারটা স্বীকার করত না। (স্বাভাবিক। কেই বা পারিবারিক
কেচ্ছা বাইরে বলতে চায়?)
৫) প্রণয়ীটি তার নাম ও পরিচয় গোপন রাখার বিষয়ে যত্নবান।
(গাড়ির নম্বর ও নাম নকল মনে হয়।) অমিয় হতে পারে?
৬) বিনয় কি অমিয়র কথা জানতো?
৭) তপেন কি প্রগতির প্রতি আসক্ত ছিল? ওর এতো কাজ করে দিত
কেন?
৮) নীলা ওকে
ঢলানি বললো কেন? প্রগতি কাকে এক্সপ্লয়েট করছিল?
৯) প্রগতি ঠিক কবে মারা গেছে?
১০) মারা যাবার আগে সে অল্প ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল।
১১) সেদিন ছেলেটি ওপরে তাকায়নি কেন? সে কি করে জানল যে
প্রগতি জানালায় থাকবে না?
১২) যেই মারুক, মোটিভ কি হতে পারে?
লিস্টটা পড়ে দেবী মাথা নাড়তে থাকেন। কিছুই বোঝা যাচ্ছে
না। বরং মাথাটা আরও জ্যাম হয়ে গেল।
[৪]
আজকের সকালটা খুব সুন্দর। পুজোর রোদ্দুর মাখা এই দিনের
কোথাও মৃত্যুর গন্ধ লেগে নেই। দেবীর মনে পড়ল, এই ক’দিন এইসব নিয়ে ব্যস্ত থেকে তাঁর
ক্লাস যাওয়া হয়নি। বাচ্চারা এসে ফিরে যাচ্ছে। এরপর তো পুজোর জন্য ছুটি থাকবে
কিছুদিন। একটু অপরাধী বোধ করলেন দেবী। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলেন। বিন্তির মাকে
প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে রাস্তায় বেরোলেন।
ক্লাবে ঢুকতে না ঢুকতে ছেলেমেয়েগুলো ছেঁকে ধরল ওঁকে।
উত্তেজিত অথচ বিমর্ষ মুখগুলোতে আজ শুধু বিনয়ের কথাই। বড্ডো ভালো ছিলো ওই কাকুটা।
কিন্তু ওর বউটা মরে গেছে, জানো দিদা? বিনুকাকু কি এইবার চলে যাবে? তাহলে কে আর
ওদের ভালোবেসে এতো এতো জিনিস এনে দেবে? শুনতে শুনতে দেবীর খেয়াল হলো, তাই তো? এই
বিনুকাকুর নাম তো আগেও বাচ্চাদের মুখে শুনেছেন বহুবার। মাঝে মাঝেই ওদের
বই, খাতা, কলম, বল কিনে দেয় বিনুকাকু। ভদ্রলোক বিকেলের দিকে আসতেন বলে দেবীর সঙ্গে
দেখা হয়নি কখনো। আজ বুঝলেন ওরা প্রগতির বরের কথাই বলতো। যাই হোক, কথা থামছেই না
দেখে, তিনি তাঁর শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলেন –
-
শুধু তো পাবার গল্পই করছিস। এতো যে ভালোবাসতি কাকুকে, তা
তাকে কিছু দিয়েছিস কখনো?
ভেবেছিলেন এবার ওরা থমকাবে। মুখ বন্ধ করে নতমুখে ফিরে
এসে বসবে নিজের নিজের জায়গায়।হলো উল্টো প্রতিক্রিয়া। দেয়নি মানে? নরু একবার একটা
সাদা বেড়ালছানা দিয়েছিল। দীপু দিয়েছিল নেড়ি কুকুরের ছোপ ছোপ বাচ্চা। আর লোটন? সে
তো গাছ থেকে একটা টিয়াপাখি ধরে এনেছিল। কিন্তু কাকু তো আর সারাদিন ঘরে থাকতো না!
কে আর দেখবে ওদের? বউটা তো ভালোবাসতো না এইসব। ফলে সেগুলো হয় মরে গেছে নয় হারিয়ে
গেছে। কাকুর খুব কষ্ট হতো জানো দিদা? মুখে কিছু বলত না। ক’দিন আসতো না খালি। তারপর
থেকে কাকু এখানেই ওদের সঙ্গে খেলত, কুকুরছানাগুলোকে আদর করত। কিন্তু কখনো বাড়ি
নিয়ে যেত না।
মাথা নাড়লেন দেবী। এই মানুষটির জন্যে তাঁর মায়া হচ্ছে।
একজন সুস্থ শিশু যে জীবনের এক পরম সম্পদ, একথা কেন যে কিছু লোক বুঝতে চায় না!
- কে যে এমন করল?
মনের প্রশ্নটা উচ্চারিত হতেই তড়িত উত্তর এলো – ওমা, দিদা
তুমি জানো না? তপেন গুণ্ডাকে পুলিশ আজ সকালে অ্যারেস্ট করেছে যে?
-
তপেন?
-
বিনুকাকুর বাড়িতে কাজ করত আশাদিদি। তার বর।
বিকেলে সমরের ফোন এলো –
-
মৃত্যুর কারণ ও সময় পাওয়া গেছে। শুক্রবার রাতেই
মারা গেছে প্রগতি। দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু।
-
তপেনকে গ্রেপ্তার করেছেন শুনলাম?
-
লোকটার পাস্ট ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে। কিছুদিন আগে প্রগতির
সঙ্গে একটা দামী ফুলদানী ভাঙা নিয়ে কাজের লোকের খুব বচসা হয়। প্রগতির অভিযোগ – সে
নাকি একটা হারও পাচ্ছে না। অপমানিত আশা কাজ ছেড়ে চলে যায়। পরে তপেন বৌয়ের
অপমানের বদলা নিতে বাড়ি বয়ে এসে হুমকি দিয়ে যায়। প্রগতি দারোয়ান ডেকে ওকে তাড়িয়ে
দেয় বটে, কিন্তু সেই শুক্রবারের বিকেলে সে মদ খেয়ে এসে আবারও শাসিয়ে যায় যে এর
প্রতিকার সে করেই ছাড়বে। ঐদিন সন্ধ্যায় তপেনকে আরও কয়েকজন সমাজবিরোধীদের সঙ্গে বসে
মদ খেতে দেখা গেছে। সেখানেও সে বারবার বদলা নেবার কথা বলেছে। রাতে সে বাড়ি ফেরেনি।
আশার বক্তব্য প্রায়ই নাকি মদ খেয়ে এদিক ওদিক পড়ে থাকে। সারারাত কোথায় ছিল তাও জানা
যাচ্ছে না।
-
কাজের লোকের বর? এটা একটু কষ্টকল্পনা হয়ে যাচ্ছে না?
-
প্রগতি নাকি বিনয় না থাকাকালীন, টুকটাক কাজ করে দেবার
অজুহাতে, প্রায়ই ওকে বাড়িতে ডাকত।। বন্ধুমহলে তপেন এই সুযোগ নেবার ইচ্ছে প্রকাশ
করেছে বহুবার। কিন্তু প্রগতি ঘোড়েল মেয়ে। ওকে নাচিয়ে কার্যসিদ্ধি করত বলেই মনে হয়। তপেন
আজকাল ক্ষেপে উঠেছিল। এ নিয়ে আশা আর তপেনের ঝগড়াও হয়েছে কয়েকবার।
-
তপেন খুনের কথা স্বীকার করেছে?
-
এখনো করে নি। তবে দুটো রুলের গুঁতো খেলে ঠিক
কবুল করবে। ভদ্রমহিলা সেদিন ঘুমের ওষুধ খাওয়ায় ওর কাজ অনেকটাই সোজা হয়ে গিয়েছিল।
-
কিন্তু বাড়ি ঢোকার চাবি পেল কোথায়?
-
আশার কাছে একটা চাবি থাকত নাকি। আশা অবশ্য বলছে ও
চাবিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু সেই
এক্সট্রা চাবিটা আমরা পাইনি।
-
তাহলে?
-
তপেন খুবই হোস্টাইল। চাবিটা ও কুড়িয়ে নিয়েছিল, সেটা
স্বীকার করেছে। প্রগতির ওপর যে ওর একটা অন্যরকম আকর্ষণ ছিল, সেটাও কবুল
করেছে। কিন্তু ওই বাড়িতে সেদিন যাওয়াটা স্বীকার করছে না। তবে সমস্ত সারকামস্টিয়াল
এভিডেন্স ওর বিপক্ষে।
-
আর অমিয়?
-
ওর ওপরেও নজর রাখছি। অ্যালিবাইটা মিথ্যে ছিল। মেয়েটি পরে
স্বীকার করেছে। তবে ওর বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই।
-
গাড়িটার খোঁজ পেলে খুব সুবিধে হতো।
-
হ্যাঁ। কিন্তু সেটাই পাওয়া যাচ্ছে না। বুঝতেই পারছেন,
তপেনের সুযোগটা সবচেয়ে বেশি ছিল।
বুঝলেন বইকি দেবী। সমরের যুক্তিতে ফাঁক নেই। তাঁর
গোয়েন্দাগিরি যে এভাবে মুখ থুবড়ে পড়বে এ আশঙ্কা তিনি করেননি। তবু বাস্তবে যে
এমনটাই ঘটে তা তিনি মানতে বাধ্য। অতএব মৃদু হেসে পয়েন্ট লেখা কাগজটা তিনি কুটি
কুটি করে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলেন। মনে পড়লো আজ তাঁর গাছে জল দেওয়ার দিন।
[৫]
দেবী সেদিন অনাহুত গিয়েছিলেন নীলার বাড়ি। আর আজ, বিজয়ার
পরে নীলা তাঁকে চায়ের নিমন্ত্রণ করছে। তবু
কেন জানিনা তাঁর একটুও যেতে ইচ্ছে করছে না। গতকাল লক্ষ্মীপুজোর উপোস গেছে। দেবী
একটু ক্লান্ত বোধ করছিলেন। কিন্তু যেতে হবে। ভদ্রতার দায়। অবশ্য সব কিছুর মধ্যে
একটাই ভালো খবর এই যে প্রগতির অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে আর কাঁটা ছেড়া হবে না।
নীলার বাড়িতে বসেও সেই কথাই হচ্ছিল। নীলা বলছিল –
-
আশার বর যে
এতোটা বিপজ্জনক তা আগে বুঝিনি।
-
তুমি তো তপেনকে দেখেছ।
-
হ্যাঁ। বেশ রগচটা। তবে খুন করতে পারে
বলে মনে হয়নি।
-
বাইরে থেকে সবসময় লোক চেনা যায় না।
-
ভাবছি আশাকে ছাড়িয়ে দেব। খুনীর বউ ভাবতে কেমন যেন গা
শিরশির করছে।
-
তপেন নাকি এখনো বলছে, খুনটা সে করেনি। অথচ, পুলিশের বক্তব্য সে জাত ক্রিমিনাল।
-
সেই তো। কে জানে কি ব্যাপার। বোনের সঙ্গে এই নিয়ে কথা
হচ্ছিল। সে অমিয়কে চেনে বলল। এই খুনের খবরটা কাগজে বেরিয়েছে তো। তাতে ওর নাম দেখেই
আজ একথা বলছিল।
-
কেমন ছেলে এই অমিয়? জানে কিছু?
-
প্রগতির যোগ্য দোসর। প্রচুর মেয়ের সঙ্গে ঘোরে। চরিত্র
ভালো না। অনেকের সাথে সম্পর্ক আছে নাকি। রাতে ওই আসত কিনা কে জানে?
-
হতেও পারে। আবার একেবারে অন্য কেউও হতে পারে।
-
কোনটা যে সত্যি আর কোনটা যে মিথ্যে কে জানে!
দেবী কথার জবাব দিচ্ছিলেন না। নীলার কথাটা তাঁর মন ভার
করে দিয়েছিল। সত্যি-মিথ্যে চেনা সত্যি বড়ো কঠিন।
হঠাৎ দেবী সোজা হয়ে বসলেন। এই সম্ভাবনার কথা
তাঁর আগে মনে আসেনি কেন? এতো সামনে পড়েছিল বলেই কি তাঁর চোখ এড়িয়ে গেছে? আগ্রহে
ঝুঁকে বসলেন দেবী –
-
একটা কথা বলোতো নীলা? প্রগতির মৃতদেহ দেখতে তুমি
গিয়েছিলে?
-
হ্যাঁ। তোমাকে
তো বলেছি। আরও অনেকেই গিয়েছিল।
-
অস্বাভাবিক কিছু নজরে পড়েছিল? খুব ভেবে চিন্তে বলবে।
নীলা, দেবীর এই উত্তেজনায় অবাক হচ্ছিল –
-
অ স্বা ভা বি ক? আলাদা করে তেমন কিছু তো – আসলে পুরো
ঘটনাটাই তো অস্বাভাবিকের চূড়ান্ত।
দেবী অধৈর্যভাবে হাত নাড়লেন –
-
সে কথা বলছি না। মানে অসঙ্গত কিছু – সেটা যতো ছোটই হোক,
এমন কিছু যা ওখানে থাকা উচিত ছিল না। বা কোন কথার টুকরো – যা তোমার কানে
লেগেছিল....
দেবী কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আসলে ঠিক কী জানতে চাইছেন,
তা তাঁর নিজের কাছেও স্পষ্ট নয় তেমন।
অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে নীলা। একটু পরে খুব
দ্বিধার সঙ্গে বলে –
-
খুবই ছোট ব্যাপার। আসলে সেটা চোখে পড়েছিল বলে নিজেরই পরে
খারাপ লেগেছিল।
একটু গুছিয়ে নেয় নিজেকে। কিভাবে বলবে সেটা সাজিয়ে নেয়
এবার –
-
তোমায় তো বলেছিলাম, প্রগতি ঘর সাজানোর ব্যাপরে অসম্ভব
খুঁতখুঁতে ছিল। ঘরের পর্দা থেকে বেডকভার সবকিছু ওর ম্যাচিং চাই। অথচ মারা যাবার
সময় ওর বিছানার চাদর আর বালিশের ওয়াড় আলাদা সেটের ছিল। নীল চাদরের ওপর কমলা
বুটিদার বালিশ – এতো আনইউজুয়াল ওর পক্ষে....
হয়তো সেদিন ওর শরীর খারাপ ছিল
বলেই... ঠিক জানি না..
সংশয়ে, দ্বিধায় নীলার কথা জড়িয়ে যায়। আর উজ্জ্বল হয়ে ওঠে
দেবীর চোখ। এতোক্ষণে সবটা তাঁর কাছে পরিষ্কার। এলোমেলো পাজলগুলো সব খাঁজে খাঁজে
বসে যাচ্ছে। এবার বাড়িতে গিয়ে শুধু একটা খবর জানতে হবে ফোনে। তারপর...
মুখে বললেন –
-
এবার চলি। সন্ধ্যে গড়িয়ে গেছে অনেকক্ষণ। রথীনেরও তো আসার
সময় হলো। মেয়েটা হোস্টেল থেকে ফিরলে একবার তিনজনে মিলে আমার বাড়িতে এসো, কেমন?
ডিনারের নেমন্তন্নো রইল কিন্তু। ভুলে যেও না।
-
নিশ্চয়ই যাবো মাসী।
-
এসো।
বেরোবার মুখে রথীনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। গাড়িটা লক করে মুখ তুলতেই মুখোমুখি। রথীনকে কোনো কারণে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। সাধারণ কুশল প্রশ্নের জবাব দিয়েই তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে এগোলো। দেবী একটু অবাক হলেন। ছেলেটি এমনিতে খুব আলাপী এবং আন্তরিক। রথীনের গাড়িটার দিকে চোখ পড়ল - লাল রঙের নতুন মারুতি। দেবী নিজের মনেই হাসলেন।
বেরোবার মুখে রথীনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। গাড়িটা লক করে মুখ তুলতেই মুখোমুখি। রথীনকে কোনো কারণে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। সাধারণ কুশল প্রশ্নের জবাব দিয়েই তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে এগোলো। দেবী একটু অবাক হলেন। ছেলেটি এমনিতে খুব আলাপী এবং আন্তরিক। রথীনের গাড়িটার দিকে চোখ পড়ল - লাল রঙের নতুন মারুতি। দেবী নিজের মনেই হাসলেন।
বাড়ি ঢুকেই সমরকে একটা খবর জানাতে বললেন। সমর একটু অবাক
হলেন বটে, কিন্তু বললেন, খোঁজ নিয়ে জানাবেন।
দেবী এখন শান্ত। তিনি যেন জানেন ফোনে কি খবর আসবে। এখন শুধু
পরপর ঘটনাগুলো সাজিয়ে দেখে নেওয়া। কোনো ফাঁক থেকে গেল না তো! দুদিন
পরেই সমরের ফোন এলো। দেবীর অনুমান অভ্রান্ত। লাল গাড়ির খোঁজ মিলেছে। দেবী জানালেন –
লাল গাড়ির মালিককেও তিনি সনাক্ত করতে পেরেছেন। সমর যদি আগামীকাল সন্ধ্যায় ‘এ কাপ
অফ টি’তে আসেন, তাহলে চা আর স্ন্যাকস খেতে খেতে তিনি তাঁর তথ্যগুলো সমরকে জানাতে
পারেন। সমরের আপত্তি করার জো নেই। নেহাত বসের মাসীশাশুড়ি, নয়তো আজকেই সবকিছু বলবার
জন্য জোর করতে পারতেন।
[৬]
সমর কফিশপে একলা দেবীকেই আশা করেছিলেন। কিন্তু পৌঁছে
দেখলেন, দেবী বিনয়ের সঙ্গে গল্প করছেন! বিনয়ও সমরকে দেখে অবাক, খানিকটা বিরক্তও।
এমনিতেই সে এখানে আসতে চায়নি। তার আর প্রগতির অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে।
এখানকার স্ন্যাকস ওর খুব প্রিয় ছিল। নেহাত দেবী প্রগতিকে ছোট থেকে চেনেন, তাই বার
বার তাঁর সনির্বন্ধ অনুরোধ বিনয় এড়াতে পারে নি। সমরও একটু হালকা হেসে বললেন –
-
আমিও কিন্তু আপনাকে একলা আশা করেছিলাম।
দেবী ম্লান হাসলেন –
-
আমার মনে হয়েছিল, সত্যিটা জানার অধিকার বিনয়রই সবচেয়ে
বেশি। তাই ওকে ডেকেছি।
ওয়েটারকে আগে থেকেই বলা ছিল। সে স্ন্যাকস আর কফি
পরিবেশন করে গেল। সমর কাপটা টেনে নিলেও বিনয়ের ভ্রু কুঁচকে উঠল –
-
কোন সত্যি?
-
বলছি।
কফির পেয়ালাটা বিনয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে দেবী জানতে চাইলেন
–
-
জয়নাবের হাতের কাজ কেমন?
-
ক্বে? কোন জয়নাব?
-
আমার এক বন্ধু নতুন গেছে সাঁতরাগাছিতে। ওর গাড়িটা সারাতে
হবে। আমি ভাবলাম, তুমি তো মাঝে মাঝেই সাঁতরাগাছি যাও; হয়তো বলতে পারবে।
-
আমি কোন জয়নাবকে চিনি না। - বিনয় গোঁজ হয়ে বলে।
-
না চিনতেই পারো। তোমায় একটা খবর দিই। প্রগতির কাছে যে
লাল গাড়িটা আসত, সেটা জয়নাবের গ্যারেজ থেকেই ভাড়া করা হতো।
-
ও। তা লোকটার কোনো খোঁজ পেয়েছেন কি?
-
তুমি একটু সাহায্য করলেই পাবো।
দেবী কফিতে হালকা চুমুক দিলেন। এরা কফিটা সত্যিই ভালো
বানায়। বিনয় অস্বস্তিভরে জানতে চাইল – মানে?
দেবী খুব স্বাভাবিকভাবে, মানে বিশেষ কিছু নয়, ভঙ্গিতে
আলগা গলায় বললেন –
-
প্রগতি যেদিন মারা যায়, সেদিন ওর বিছানার চাদর আর বালিশের
ওয়াড় আলাদা সেটের ছিল। দুটো সেটের বাকিগুলোর হদিশ যদি দিতে পারো, তাহলে..
-
কি বাজে কথা বলছেন? দুটোর মধ্যে সম্পর্ক কি? কোনো মানে
হয় এসবের? আমার এসব ফালতু কথা শোনার সময় নেই। চললাম।
সমর একটু ঝুঁকে চেয়ারে বসেছেন। তাঁর চোখ জ্বলজ্বল করছে।
তিনি খুব দ্রুত কিছু হিসাব মিলিয়ে নিচ্ছেন। বিনয় চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াতেই তিনি ওর
কাঁধে একটা শক্ত, দৃঢ় হাত রেখে বললেন –
-
সেট দুটোর বাকি অংশ আমারও যে চাই মিস্টার বিনয়।
বিনয় ঝুপ করে বসে পড়ে দুহাতে মুখ ঢাকল। বেশ কিছুক্ষণ পরে
একজন ভাঙাচোরা, সর্বস্বান্ত মানুষ মুখ তুলল –
-
হ্যাঁ, আমিই খুনটা করেছি। কিন্তু আমার বাড়িতে বসে বাকি
কথা হতে পারে? প্লিজ?
[৭]
সোফায় বসে সমর পকেট থেকে একটা ছোট রেকর্ডার বের করে
টেবিলের ওপর রাখলেন –
-
মিস্টার বিনয়, মনে রাখবেন যা বলছেন, সবটাই অন রেকর্ড।
প্রয়োজনে আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে।
বিনয় ম্লান হাসল। যেন গ্রাহ্যই করল না সমরের কথা। দেবীর
দিকে তাকিয়ে বলল –
-
ফুলপ্রুফ বলে কোনো কথা হয় না, তাই না আন্টি? আর সমরবাবু,
এই দুমাস ধরে অহরহ আমি যে শাস্তি পেয়ে চলেছি, তার থেকে বেশি আর কি হবে? আমি আর এই ভার
টানতে পারছিলাম না। শুধু থানায় যাবার সাহসটা করে উঠতে পারছিলাম না।
-
কিন্তু কেন বিনয়? ঘটনাটা কিভাবে ঘটেছে সেটা বুঝতে পারলেও
কারণটা আন্দাজ করতে পেরেছি মাত্র। তুমিই বলো। আমরা শুনছি।
-
বলছি আন্টি। না বলে তো এখন আর কোনো উপায়ও নেই।
আমার আর রোমির, মানে প্রগতির,
ভালোবাসার বিয়ে। বিয়ের পর আমাদের বড়ো আনন্দের সংসার ছিল। সমস্যাটা শুরু হয় বিয়েটা
একটু পুরোনো হয়ে আসতেই। রোমি সবসময়েই সম্পর্কের মধ্যে নতুন কিছু খুঁজত। এ ব্যাপরে
সে ভারি অ্যাডভেঞ্চারাস ছিল। সেটা দোষের নয়, কিন্তু এটা ক্রমশঃ ওর একটা পাগলামিতে
দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল।
একটু জল খেয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল বিনয়। তারপর যেন একটা
লুকোনো অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে, অন্যদিকে তাকিয়ে, বলতে শুরু করল –
-
বিছানায় রোজ নতুন পদ্ধতি, বাইরে গেলে দুজন অপরিচিত
মানুষের অভিনয় করা, অথবা বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে অবৈধ সম্পর্কের ভান – একবার তো নিষিদ্ধ
পল্লীর মেয়ের ভূমিকাতেও অভিনয় করেছিল।
আমার ভালো লাগতো না। ক্লান্ত,
বিরক্ত লাগত। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল ঘর সাজানোর বাতিক। সবকিছু ওর হিসেবে পারফেক্ট
হওয়া চাই। এমন কি কাপের হ্যান্ডেলটা কোনদিকে থাকবে সেটাও। এই নিয়ে আমার সঙ্গে,
কাজের লোকের সঙ্গে নিত্য অশান্তি। দিন দিন পুরোটা অসহ্য হয়ে উঠছিল। আমি একবার
ডাক্তার দেখানোর প্রস্তাব দেওয়ায়, প্লেট ছুঁড়ে মেরেছিল। আমার হাত কেটে যায়। স্টিচ
করতে হয়েছিল।
বিনয় শার্টের হাতা গুটিয়ে দাগটা দেখায়। সমর আর দেবী
নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে থাকেন। অনেকদিনের জমে থাকা কথারা মুক্তি পাচ্ছে। এই সময়টুকু
ওর প্রাপ্য হয়তো।
-
আন্টি, আমি খুব বাচ্চা ভালোবাসি। ভেবেছিলাম ঘরে একটা
শিশু এলে এসব কেটে যাবে। বইতে তো কতোই এমন পড়ি। কিন্তু সে গুড়ে বালি। রোমি দুচক্ষে
বাচ্চা দেখতে পারত না। বাচ্চা মানেই ঘরদোর অগোছালো, সময়ের কাজ সময়ে না হওয়া,
স্বাধীনতার অন্ত – এমনি আরো অনেক কিছু। কাজেই সবরকম সাবধানতা নিয়ে চলত। আমাদের
ছেলেপুলে হলো না।
ভেবেছিলাম, এখানে থাকলে পুরোনো
লোকজনের সঙ্গে দেখা হবে। তাদের কথায় যদি ওর মন গলে। রোমি সেদিক দিয়ে গেলই না।
পরিচিত জনেদের অনেকেই বাচ্চা নিতে বলতো, সেটা এড়াবার জন্য এখানে পূর্বপরিচিত কারো
সঙ্গেই যোগাযোগ করল না।
আমি মাঝে মাঝে পাখি বা কুকুরছানা
বাড়ি নিয়ে এসে দেখেছি। তারা কিছুদিন বাদে হয় মরে গেছে, কিম্বা হারিয়ে গেছে। ইদানিং
তাই ওসব আনতাম না।
আমি বাইরের শিশুদের সঙ্গে
খেলতাম। ওদের বুকে চেপে পবিত্র গন্ধটা বুকের মধ্যে শুষে নিতাম। সেটাতে অবশ্য রোমি
আপত্তি করত না। বাড়ি এসে স্নান করে নিলেই হলো। তবু আমার চোখ সবসময় ঘরে একটা টলোমলো
পায়ে হাঁটা শিশু দেখতে চাইত। এইভাবেই দিন কাটছিল। আমি ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে
যাচ্ছিলাম। এই সময়ে একটা ঘটনা ঘটল।
বিনয় এবার অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। মাথার উপর ফ্যানের
খসখসে আওয়াজটাই শোনা যাচ্ছে শুধু। দেবী হঠাৎ শিউরে উঠলেন। উঠে ফ্যানটা একঘাট কমিয়ে
দিলেন। আস্তে করে বললেন –
-
আশা বলেছে রোমি নাকি মা হতে চলেছিল। মিসক্যারেজ হয়ে যায়।
-
মিসক্যারেজ নয়। অ্যাবর্শন।
বিনয়ের মুখটা এখন ঘেন্নায় মাখামাখি।
-
নিজের ইচ্ছায় একা একা নার্সিংহোমে গিয়ে বাচ্চা নষ্ট করে
এসেছিল। আমার স্বপ্নের মেয়েটা!
উঠে গিয়ে একটা প্রেসকৃপশন আর বিল নিয়ে এসে টেবিলে রাখল।
-
ইচ্ছে হলে এখানে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। এর পরেই আমি
সিদ্ধান্ত নিই। একজন শিশু হত্যাকারীকে আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না।
-
সেজন্য খুন কেন? ডিভোর্স নেওয়া যেত না?
-
আমি পারতাম না। রোমিকে অন্য কারো সঙ্গে…….
এক অদ্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছিলাম আমরা। একে অপরকে
ঘেন্না করতাম, কিন্তু ছেড়ে যেতেও পারতাম না। ইদানিং আমাকে জ্বালাবার জন্য কয়েকজনের
সঙ্গে ফ্লার্ট করতে শুরু করেছিল।
আর পারলো না বিনয়। টেবিলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। দেবী
বললেন –
-
এবার আমি বলি? ভুল হলে শুধরে দিও কেমন?
রোমির অদ্ভুত খেয়াল মেটাতে বিনয়
অফিস ট্যুরের সময় একদিন অন্য সাজে প্রকাশ বসু নাম নিয়ে বাড়ি আসত।
বসু পদবীটা বোধহয় অমিয়কে একটু জড়িয়ে দেবার জন্য। আমার ধরাণা, বিনয় রোমির সব খবরই
রাখত। পরকীয়ার এমন খেলা ওরা আগেও খেলেছে। বিনয়কে তো অফিসের কাজে সাঁতরাগাছি আসতেই
হতো। গাড়ি থাকলে সাঁতরাগাছি থেকে রাতে এসে আবার রাতে ফিরে যাওয়া সহজ ব্যাপার। আর
নকল দাড়িটা বোধহয় ছদ্মবেশ ধরতেই। আমার ধারণা কোনো
বেয়ারার সাহায্যে সে পিছনের দরজা দিয়ে ছদ্মবেশে বেরোত। তাই জয়নাব পুলিশের কাছে ওই
চেহারাটাই সনাক্ত করেছে। খুব ভুল না করলে এবারের আইডিয়াটা বিনয়ের ছিল। লাল
মারুতি খুব কমন গাড়ি। নকল নাম্বার প্লেটটা বিনয় কোথাও থেকে জোগাড় করেছিল। অন্য
কোনো মডেলের গাড়ির সাথে মেলেনি, সেটা ওর কপালের জোর।
বিনয়ের অসহায়
সমর্পিত ভঙ্গীই বলে দিচ্ছিল, দেবীর অনুমান সঠিক। তবু সমর বাধা দিল –
-
আপনার কথামতো সাঁতরাগাছির গ্যারেজগুলোতে লাল গাড়ির খোঁজ
করতে করতে জয়নাবের সন্ধান পাই। সে প্রকাশের ছবি দেখে সনাক্ত করে। কিন্তু বিনয় ও
প্রকাশ যে একই ব্যক্তি তা আপনি বুঝলেন কি করে?
-
মেয়েদের গসিপ। রোমির অবৈধ সম্পর্ক ও ঘর সাজানোর বাতিক,
আবাসনের মেয়েমহলে চর্চার বিষয়। রোমি নাকি বলত, এসব বাজে কথা। স্বভাবতই সবাই এটাকে
মিথ্যে বলেই ভেবে নেয়। আমিও প্রথমে তাই ভেবেছিলাম। তারপর যখন শুনলাম মৃতা রোমির
খাটে বালিশ ও চাদর মিসম্যাচ, তখনই আমার সন্দেহ হলো।
এটা রোমির পক্ষ স্বাভাবিক নয়। তাহলে
এই বদলটা ওর মরার পরে ঘটেছে। কিন্তু কে বদলাতে পারে? আর কেন?
প্রথমে দেখি কার পক্ষে এটা করা
সম্ভব। তপেনের দ্বারা এ সম্ভব ছিল না। রাতের প্রণয়ীর পক্ষেও বালিশের ওয়াড় কোথায়
থাকে জানা মুসকিল। সেটা একমাত্র জানার কথা বাড়ির লোকের। তখনই
আমার মনে হলো, প্রগতি যদি পরকীয়ার ব্যাপারে সত্যি কথাই বলে থাকে? তাহলে বিনয় ও
প্রকাশ একই ব্যক্তি হবার কথা। এভাবে ভাবতেই সব ঘটনা পরপর ছকে পড়ে গেল।
দেবী হাঁপিয়ে উঠছিলেন। বিনয় মাথা নীচু করে পাথরের মতো
বসে আছে সেই থেকে। কেন জানিনা, ওকে দেখে দেবীর মনে ঘৃণার বদলে মায়া জমছিল। কিন্তু
এখন আর ফেরার পথ নেই। সমর ওঁর দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। সেই দৃষ্টিতে কি আছে দেবী বুঝতে পারলেন না।
তিনি ফের তাঁর বক্তব্যের খেই ধরলেন।
-
এর মধ্যে আশার সঙ্গে রোমির ঝগড়া হলো। আশা কাজ ছেড়ে চলে
গেল। বিনয় দেখল, এই সুযোগ। এখন রোমি মরলে দেহ আবিষ্কার হতে হতে কয়েকটা দিন গড়িয়ে
যাবে। সে হয়তো কোন পানীয়ের সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিল। তারপর রোমি ঘুমিয়ে পড়লে মুখে
বালিশ চাপা দিয়ে –
বালিশে বোধহয় রক্তের দাগ
লেগেছিল। তাই ওয়াড় বদলে দিয়েছিল। রিনির সব জিনিস জায়গামতো থাকতো। তাই সেটা খুঁজে
পেতে দেরি হয়নি। এরপর রোমিকে ঠিক করে শুইয়ে পুরোনো ওয়াড় ব্যাগে পুরে সে বেরিয়ে
গিয়েছিল। সেদিন রাতে প্রকাশ বা বিনয়ের হাতে আমি একটা প্যাকেট দেখেছিলাম। তখন তার
মানে বুঝিনি।
দেবী উঠে পড়লেন। সমরের চোখে চোখ রেখে বললেন –
-
বিনয় এতো বাচ্চা ভালোবাসে, অথচ ওর ঘরে পশুপাখির বাচ্চা
বাঁচে না – এ আমি বস্তির বাচ্চাদের কাছে শুনেছিলাম। তাতেই মোটিভের একটা আবছা ধারণা
হয়েছিল।
বিনয় সারাজীবন বড়ো কষ্ট পেয়েছে।
অসুস্থ দাম্পত্য, সন্তান কামনা, সন্তান হত্যার যন্ত্রণা আমি মা, আমি বুঝি।
আর আমার কথা যদি বলেন, তাহলে
বলব আমি কিচ্ছু দেখিনি, কিচ্ছু জানিনা।
এবার আমি যাব।
দেবী আর কথা বাড়ালেন না। আর কোনোদিকে না তাকিয়ে, ধীর
পায়ে বাইরে এলেন। হেমন্তের সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামছে। রাস্তার আলোগুলো ঘিরে হালকা
কুয়াশা। দেবী আঁচলটা একটু গায়ে জড়িয়ে নিলেন। বাড়ি ফিরতে হবে এবার।
দোলা সেন||
No comments:
Post a Comment