ডাউহিল ছেড়ে বেলপাহাড়ী। পাহাড়ঘেরা কুয়াশায় মোড়া শীত-শীত থেকে দুম করে রুক্ষ লাল মোরামের দেশে। গ্রীষ্মকালে মোরামের মাঠ গরম হয়ে আরো রাঙা হয়ে উঠত – উঁচুনীচু সেই রাঙা মাঠ তপ্ত হাওয়ার দোলায় মনে হত লাল সমুদ্দুর। কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা।
তার আগে কার্তিকের রাতে দিপাবলীর আলোয় সেজে ওঠা। বাবা বাজী কিনে এনে
দিতেন বেশ কিছুদিন আগে থেকে। ভাই আর আমি নিয়ম করে রোদ্দুরে সেঁকে মুচমুচে করে
তুলতাম তাদের। বাবা একটা চেয়ারে বসে আমাদের বাজী পোড়ানো দেখতেন। কখনও মানা করতেন
না। কিন্তু হাতের কাছে সাজানো থাকত বার্ণল আর ফার্স্ট এইডের সরঞ্জাম। সেবার
কালিপটকার প্যাকেট গেলো হাতের মধ্যে ফেটে। বাবা সারা হাতে পুরু করে বার্ণল লাগিয়ে
বললেন, এই হাতটা দিয়ে আর বাজী ফুটিয়ো না। আমিও এক হাতে পটকা ফোটাতে থাকলাম। অত ঠাণ্ডার
জায়গা বলেই বোধহয় বিশেষ কিছু হয় নি। জ্বলুনি ছিল অসম্ভব রকম। কিন্তু ব্যথা পেলে
কান্না বারণ ছিল। তাই দাঁতে দাঁত চেপে পটকা ফোটানোটাই ভালো। এরপরে ভাইফোঁটা। এই
সময় নেপালিরা বাড়ি বাড়ি ধেউসি নাচতে আসত। ওদের সেই “ঝিলিমিলি ঝিলিমিলি ধেউসি রে”
গান এখনও কানে বাজে। পরে বেলপাহাড়িতে দশমীর পরে সাঁওতালদের এসে নাচতে দেখেছি। একইরকম।
শুধু ভাষা আর আঙ্গিকেরই যা তফাত। বিবিধের মাঝে মহান মিলন খুঁজতে আমাদের নোটবইয়ের
পাতা ঘাঁটতে হয় নি।
আমার শান্ত ভাইটাকে চোরবাটোর পিছল পথে চলতে, শুকনো পাহাড়ী ঝর্ণা বেয়ে নামতে
শেখাচ্ছিলাম মহানন্দে। ঝর্ণার বুকে পাথরের ঝলকানি দেখে হীরে ভেবে কতদিন কত কষ্ট করে
দু ভাইবোনে সেখানে নেমেছি আর উঠেছি সে আমারাই জানি। ভুলেই গিয়েছিলাম চারবছর কেটে
গেছে। কাজেই যথানিয়মে আবার বদলির অর্ডার এল। এবারের গন্তব্য মেদিনীপুর
জেলার বেলপাহাড়ী।
নিয়মমতে বাবাদের
চাকরিজীবনের অর্ধেক উত্তরবঙ্গ আর অর্ধেক দক্ষিণবঙ্গে কাটাতে হত। বাবার নর্থবেঙ্গলের
কোটা শেষ। তার মানে এবার যেতে হবে পাহাড়কে বিদায় জানিয়ে সমতলে, তাও আবার সাউথ
বেঙ্গলে! আমাদের মন-মেজাজ খুব খারাপ, একমাত্র খুশী হয়েছেন মা। ছমাস ট্যুরের চক্করে
ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার চোদ্দটা বাজছে, তাছাড়া এই চুড়ান্ত যাযাবরী জীবন তাঁর আর ভাল
লাগছিল না।
আমি ডাউহিল ছেড়ে যাবার
দুঃখে কাতর। বুঝতে পারছি বসবাসের জন্য আর কোনদিন পাহাড়ে ফিরে আসা হবে না। এক অদ্ভুত
কষ্টে ভিতরটা তিরতির করে কেঁপে যাচ্ছে। এই ধুবির বন, মেঘ-কুয়াশা-রোদ্দুরের
লুকোচুরি, কাঞ্চনজঙ্ঘাদের ছেড়ে কেমন করে দিন কাটবে আমার – আদৌ কাটবে তো?
আবার এরই পাশে পাশে নতুন
জায়গায় যাবার উত্তেজনাও নেই বললে ভুল বলা হবে। আসলে জন্ম থেকে তিন-চার বছর পরপর
ঠাঁইনাড়া হওয়াটা রক্তে মিশে গেছে। সময় পার হলেই ভিতর থেকে কেউ বলে ওঠে, আর হেথা
নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।
তা, শুরু হল প্যাকিং।
বদলির এই পর্যায়টা খুব আকর্ষক। ভুলে যাওয়া ফুটস্প্রিং, ভাইবোনের ঝগড়া হবার পরে
লোপাট হয়ে যাওয়া ইয়োইয়োটা, কিংবা মার্বেলের কৌটো, অনেক দিন ধরে খুঁজে না পাওয়া বই
– সব্বাই সার বেঁধে বেরিয়ে পড়ে লক্ষ্মী ছেলেদের মত।
এতদিন ছিল সব মালপত্র
প্যাক করে ট্রাকে তুলে দিয়ে তার সামনে সামনে জীপে চড়ে নতুন জায়গায় চলে যাওয়া।
এবারের ব্যবস্থা অন্যব়কম।একান্ত প্রয়োজনীয় দিন সাতেকের রসদ নিয়ে আমাদের চলে যেতে
হবে ট্রেনে। কার্শিয়ং থেকে ঝাড়গ্রাম, ভায়া নিউ জলপাইগুড়ি, হাওড়া।মালপত্র যাবে
জেনারেল ট্রান্সপোর্টের ট্রাকে চড়ে। প্যাকিংয়ের ওপরে সাদা রং দিয়ে লেখা হল, A. K. Sen, From Dowhill to
Belpahari.
ট্রান্সফারের চাকরির দৌলতে বাবা খুব ভাল প্যাকিং করতে পারতেন। মা নিখুঁত ভাবে
পরপর জিনিসের যোগান দিতেন। বাবা হাত বাড়ালেই আমি আর ভাই প্রয়োজনীয় জিনিসটি এগিয়ে
দিতাম। মুখ ফুটে চাইতে হলে বাবার ভুরুটা হাল্কা কুঁচকে যেত, সেটা খুব লজ্জার বিষয়
ছিল। আর্দালীরাও খুব সাহায্য করত। চলে
যাবার আগের আর পৌঁছাবার পরের দুদিন ক্যাম্পাসের কাকীমাদের বাড়ীতে
খাওয়াদাওয়া হত। যে কেউ বদলি হলেই এই অলিখিত নিয়মটা সবাই মেনে চলতেন। জঙ্গলে তো আর
হোটেল বা দোকান থাকত না!
বাবার ধৈর্য ছিল অপরিসীম। হয়ত কোন দামী বা দরকারি জিনিস প্যাক করছেন, ভাই
তাড়াতাড়ি ওর ছোট্ট চেয়ার আর ট্রাইসাইকেলটা হাজির করল। বাবা সমান যত্নে ও
সতর্কতায় সেটাই আগে প্যাক করে দিলেন। মা কিছু বললে শুধু বলতেন – ওর কাছে এটাই
কিন্তু খুব দরকারি আর দামী।
এই বাবার মেয়ে হয়ে আমি যে কি করে এত অপদার্থ হলাম কে জানে!
লম্বা ট্রেনজার্নির বিকেল শেষ হল ঝাড়গ্রামে। সেখান থেকে একটা ঠনঠনে বাসে চড়ে চল্লাম। যাচ্ছি তো যাচ্ছি - বাকী যাত্রীরা কেমন করে যেন দেখছে। শীতকালের বিকেল, সবাই সোয়েটার চাদরে ঢাকা, একা আমরাই ঘাম মুছছি মাঝে মাঝে। সন্ধে গড়িয়ে আঁধার নামল। দুপাশে ঘন অন্ধকার, নজর চলে না। যেখানেই হারিকেনের আলো, সেখানেই বাস দাঁড়ায়। আমাদের নামা হয় না। বাস আবার চলতে থাকে। চলতে চলতে প্রায় আড়াই-তিন ঘণ্টা পরে বাস দাঁড়াল যেখানে, সেখানে ঘুরঘট্টি আঁধার। সেখানেই নামলাম। অন্ধকার ফুঁড়ে কোত্থেকে খোদায় মালুম, হারিকেন হাতে বের হয়ে এল এক ভুতকালোপানা লোক।ভাই তো তাড়াতাড়ি মায়ের পিছনে, সেখান থেকে উঁকি মারছে। আমারও যে একটু অসোয়াস্তি হচ্ছে না এমন নয়, তবু গুটি গুটি পায়ে তারই পিছু ধরলাম। মালপত্র মাঠেই পড়ে রইল, পরে লোকজন এসে নিয়ে যাবে।
সে এক তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে যাওয়া। চোখে আঁধার সয়ে এসেছে। আবছা তারার আলোয় ন্যাড়া মাঠের একটুকরো দেখা যাচ্ছে। কিছুটা হাঁটার পরে আলোর রেখা চোখে পড়ল। সেদিক লক্ষ্য করেই এগিয়ে চলা। গেটের পাশেই বীটকাকু দাঁড়িয়ে আছেন।বাবার সাথে কথা বলতে বলতেই আমাদের কোয়ার্টার দেখিয়ে দিলেন। সঙ্গী লোকটিরও পরিচয় পাওয়া গেল-নাম কুটু মাহাতো, বাবার আর্দালী। কুটুদার কথা অমৃতসমান। সে মহাভারতের গল্প পরে।
মার ব্যাগে সাবান তোয়ালে থাকেই।বাথরুমেও জল রাখা। চটপট পরিষ্কার হয়ে বেরোতেই বীটকাকুর বাড়ী থেকে এল চা-বিস্কুট, আমাদের জন্য হরলিক্স। এবার ঘর আবিষ্কারের পালা। বাবা-মা কাকু কাকিমার সাথে কথা বলছেন। একটা হারিকেন নিয়ে ভাইবোনে ঘর দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। একটাকে শোবার ঘর বলে মনে হল কেননা সেঘরেই শালকাঠের মস্ত চৌকি পাতা আছে। সেখানে আমাদের জন্য ছিল একটা বড় চমক – ঘরের এককোণে ছোট্ট দুধাপ সিঁড়ি! এমনটি তো আগে কোথাও দেখিনি। তাড়াতাড়ি ভাইবোনে তার উপর টুমটুম হয়ে বসলাম।
সিঁড়ির পিছনে নিশ্চয় আছে এক গুপ্ত দরজা, যেটা খুঁজে পেলে যাওয়া যাবে কোথায় তা নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝামেলা পাকব পাকব করছে, এমন সময় আমাদের খুঁজতে বড়রা হাজির। ভাই বাবাকে উচ্ছ্বসিতভাবে সিঁড়ির গল্প বলছে, বাবা-মাও যথেষ্ট গম্ভীরমুখে তাল দিচ্ছেন – কাকুর উচ্ছ্বসিত হাসিতে সব শেষ। ওটা নাকি আগে যিনি ছিলেন, তিনি ঠাকুরের আসন বানিয়েছিলেন! সত্যি! বড়রা যে কেন এত খারাপ হয় কে জানে!
পরদিন ঘুম ভেঙে দেখি সব নতুন,
সব অচেনা!
চারিদিক সমতল,
পাইনের বদলে শাল,
ইউক্যালিপটাস। উঠোনে আবার একটা আস্ত গোটা কুয়ো!
অনন্তদাদা দড়ি ফেলে কুয়ো থেকে জল তুলছে,
আর দড়িটাও গোল গোল হয়ে কী সুন্দর জমা হচ্ছে ওর পায়ের কাছে। অবাক হয়ে তাই দেখছি,
এর মধ্যে ভাই দৌড়ে ভিতরে গিয়ে একটা সাবান এনে অনন্তদাকে বোঝাতে লেগেছে
– ‘এই সাবানটা মেখে চান করলেই তোমার সব ময়লা পরিষ্কার হয়ে যাবে। তোমার মা তোমাকে সাবান দেয়নি বুঝি?’
সে বেচারী তো মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝছে না;
মা তাড়াতাড়ি ওকে টেনে নিয়ে ঘরে পুরল। কালিম্পংয়ে জন্ম বেচারীর, বড় হয়েছে ডাউহিলে।
চারপাশে শুধু নেপালী আর ভুটিয়া দেখেছে। সাঁওতাল দেখে নি কখনো,
তাই এই বিপত্তি!
উঠোনে নামার সিঁড়ির দুধাপ পরেই মাটি। কিন্তু মাটির এককোণাটায় একটু নিমকি রং না? নিঃশব্দে দুজনে দুটো স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে জায়গাটার পিছনে লাগি। বাবা নতুন অফিস আর মা নতুন সংসার নিয়ে ব্যস্ত,
আমাদের তাই অবাধ স্বাধীনতা। বেশ খানিকক্ষণ খোঁচাখুচি করতেই বেরিয়ে পড়ল সিঁড়িটার শেষ ধাপের টুকরো। মহা উৎসাহে দু-তিনদিনের চেষ্টায় সেই ধাপ ‘আবিষ্কার’ হল। এই আনন্দ কিন্তু কলম্বাসের প্রথম মাটি দেখার আনন্দের চেয়ে কিছু কম নয়!
শীতের দেশে মানুষ হয়েছি,
গরমের উপযুক্ত পোষাক নেই। তাই আমাদের জন্য ফ্রক আর হাফপ্যান্ট হাফসার্ট কিনে আনা হল। গোল বাঁধানোর জন্য আর কি চাই?
আমার সাহেব ভাইয়ের দুচোখে জলের বন্যা
– হেঁট
(হাঁটু)
দেখানো কাপড় সে না নিজে পরবে না আমাকে পরতে দেবে। ও আবার কাঁদলেই দমবন্ধ হয়ে নীল হয়ে যেত। অতএব কোথাও বসা মাত্র একটা চাদর এনে হাজির করত,
আর ভাইবোনে তার তলায় “হেঁট” লুকিয়ে বসে থাকতাম। ফল যা হবার তাই হল। সারা গায়ে ফোঁড়া হয়ে দুজনেই ভুগলাম বেশ কিছুদিন। তারপর নিস্তার পাওয়া গেল।
বেলপাহাড়ীতেই প্রথম গ্রামের হাট দেখা। একটা বিরাট মাঠ জুড়ে কত লোক!
গামছা,
শাড়ী,
বাসন,
সব্জি মায় পাতায় করে লালা পিঁপড়ে আর তার ডিম!
হাঁ করে দেখে যাচ্ছি,
দেখি একদিকে মোরগের লড়াই হচ্ছে
– ভাল লাগল না একটুও। চারপাশের লোকজনের প্রবল উল্লাসে ভিতরটা ছোট হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশঃ।
বাড়ীর পাশেই আদিবাসী মেয়েদের জন্য একটা ছোট আবাসিক স্কুল ছিল। সেখানকার দিদিমণি মানে পিসিদের সাথে ভাব হয়ে গেল খুব। অমিতা পিসি লাইব্রেরীর দায়িত্বে ছিলেন। অজস্র বই পড়েছি ওখান থেকে। ভাল সংগ্রহ ছিল। এখন সেই স্কুল বড় হয়ে তেপান্তরেরে মাঠের অনেকটাই জুড়ে আছে।
No comments:
Post a Comment