বেলপাহাড়ীতে আসার পরে দেখা গেল সেখানে কোন ভাল স্কুল
নেই। তাই আমাকে পাঠান হল ঝাড়গ্রামে, - রাণী বিনোদমঞ্জরী রাষ্ট্রীয় বালিকা
বিদ্যালয়ে। হোস্টেলবাসের সেই শুরু।
ভাই তখন অনেক ছোট। তাই ভাই ভর্তি হল ওখানকার প্রাইমারী স্কুলে। অতি ফর্সা রঙের কারণে ভাইয়ের সহপাঠীদের ধারণা ছিল ও গায়ে চুনকাম করে স্কুলে যায়। ভাষাগত সমস্যাও হচ্ছিল। রোজ মার খেয়ে আসত। শেষমেশ ঠিক হল ভাই বাড়ীতেই পড়বে,
শুধু পরীক্ষা দিতে স্কুলে যাবে। বাড়ীতে ওর সবসময়ের সঙ্গী হল কুটুদা। পরম ভালবাসায় কুটুদা কিভাবে যে ভাইকে জড়িয়ে থাকত,
সে বলে বোঝানোর নয়।
হোষ্টেল আর স্কুলের অনুশাসন ক্রমশঃ আমাকে সমাজজীবনের
উপযোগী করে তুলছিল। আর কিছুতে আমার বেশী অসুবিধা হত না, - শুধু যখন বাইরের
দুনিয়াটার জন্য খুব মন কেমন করত, তখন বারান্দায় এসে দাঁড়াতাম। শালবন চেরা লাল
মাটির রাস্তা ধরে মনে মনে চলে যেতাম সেই দেশে, যেথায় কেউ করে না মানা। যারা শালবন
দেখেছেন, তাঁরা জানেন যে, সকাল, দুপুর, বিকেল, গ্রীষ্ম, বর্ষায় সব রকম বদলেই
শালবনের চেহারা পাল্টে পাল্টে যায়। ফাল্গুনের নরম সবুজের সাথে বর্ষার ঘন সবুজের
ইশারার অনেক পার্থক্য। ওই পথ
দিয়ে চলে যাওয়া লোকেদের সাথে আমিও মনে মনে রওয়ানা দিতাম, - বন্দীত্বের কথা আর মনেই
থাকত না। স্কুলটা ছিল স্বপ্নের মত। পড়া, খেলা, রচনা-বিতর্ক-এক্সটেম্পো
প্রতিযোগিতাগুলোর মধ্যে দিয়ে কত যে নতুন নতুন আকাশ খুলে যাচ্ছিল একে একে!
ভাই এখন ভালই সাঁওতালী ঘেঁষা বাংলা বলতে পারে। বন্ধুও জুটেছে অনেক। হাইস্কুলে ভর্তি হতে অসুবিধা হয় নি আর। একটাই সমস্যা –
দলে মিশে দুষ্টুমি করলেই চেহারার দৌলতে ধরা পড়ে যায়। হোস্টেল থেকে ছুটিতে বাড়ী আসার সময় নিয়ে আসতাম আড়াই বা তিনটাকা দামের সুধীন্দ্রনাথ রাহার বিদেশী গল্পের অনুবাদ। তখনকার দিনে ছোটদের হাতে পয়সা দেবার রেওয়াজ ছিল না। কত কষ্টে যে ওইটুকু জমাতাম তা আমিই জানি। জানতাম বাড়ী ঢুকলেই এক হাসিভরা উজ্জ্বল মুখ জিজ্ঞাসা করবে,
‘দিদি,
এবার আমার জন্যে কি আনলি?’
এইসব ফিরে দেখার মাঝে খুব বেশী করে মনে পড়ে বেলপাহাড়ীতে কাটান প্রথম পুজোর
স্মৃতি। আজও যখন আলো ঝলমলে আসানসোলের বিশাল প্যাণ্ডেলের প্রতিমা দেখে বাড়ী ফিরি,
তখন ঠিক
কোন এক সময়ে ফিকে হয়ে আসে চারিদিকের আলোর রোশনাই, মাইকের আওয়াজ। দূর থেকে কানে ভেসে আসে ফেলে আসা দিনের ঢাকের বাদ্যি – শুক্লপক্ষের অষ্টমীর চাঁদের আলোয় মাখা পথটা বড় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওই পথ ধরে এগিয়ে চলি আমি, ফ্রকপরা এক মেয়ে – ভাইয়ের হাত ধরে, মা-বাবার সাথে। গ্রামের স্কুলের মাঠে প্যাণ্ডেল,
হ্যাজাকের আলোয় চকচকে ঘামতেল মাখা মায়ের মুখ। এই মুখ তৈরী হতে দেখেছি গত বেশ কয়েকদিন ধরে। একটু একটু করে আমাদের চোখের সামনেই তো তৈরী হয়েছে। তখন তো কই এমন জীবন্ত মনে হয়নি আজকের মতো। ধুনোর ধোঁয়া,
ঢাকীর নাচ
– আরতিনৃত্য শুরু হয়ে গেছে। আগের বছরও ডাউহিলে আরতি নাচে অংশ নিয়েছি। কাপটা এখনো ঘরে রাখা আছে। কিন্তু যতই পা দুলুক তালে তালে,
শরীর মাতিয়ে দিক ধুনোর গন্ধ – মা বলে দিয়েছে সাউথ বেঙ্গলে মেয়েরা বারোয়ারী পুজোয় ধুনুচি নাচে না। মেয়ে-জন্মের জন্য, এই প্রথম, কষ্টের অনুভূতি ছড়িয়ে গেল মনের আকাশ জুড়ে। অথচ মাথার উপর শরতের তারাভরা আকাশ,
ঠাকুরদালানের আলোর সীমানা পেরোলেই নরম চাঁদের আলো শাল,
আকাশমণির গা চুঁইয়ে পড়ছে,
ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নাচতে নাচতে চলেছে ঠাকুর দেখতে। ওদের খুশীর হাওয়া মাতিয়ে দিচ্ছে চারিদিক। কই,
আমার দুঃখের ছিটেফোঁটাও তো কোথাও নেই! এভাবেই হাসি-কান্নায়-আনন্দে
–দুঃখে জড়িয়ে গেল আমার অষ্টমীর সন্ধ্যে।
গ্রামের রাত,
আটটা-নটা বাজলেই নিশুতি। কোয়ার্টারে ফিরছি ইউক্যালিপটাসে ঘেরা বনপথ ধরে। তার দুধসাদা গুড়ি এই আবছা আলোতে প্রায় অলৌকিক দেখাচ্ছে।
দিনের বেলাটা কিন্তু অন্যরকম। সক্কালবেলা জলখাবার খেয়ে ভাইবোন বাবার বাইকে সওয়ার। যেখানেই প্যাণ্ডেল,
সেখানেই থামা। দৌড়ে ঠাকুর দেখে আসা,
আর গোনা ক’ নম্বর হল। কোথাও কোথাও প্রসাদও দেয় আবার। দেখতে দেখতে দুপুর নাগাদ ঝাড়গ্রাম। হোটেলে ইচ্ছেমতো খাওয়ার আনন্দ। আবার রাতের জন্য অর্ডার দিয়ে রাখা
– মার সাথে খেতে হবে তো!
ঠাকুর দেখতে দেখতে সন্ধ্যে গড়ায়। আঁধার নির্জন ফিরতি পথের বুক চিরে দেয় বুলেটের তীব্র আলো। দুপাশের এত চেনা ছবি সাদাকালোয় কেমন যেন অচেনা। মার জন্য মন কেমন করছে এবার,
কিন্তু বাইকে তো আর চারজনে......
দশমীতে মায়েদের সিঁদুর খেলা,
আর আমাদের সিংহ অসুরদের মুখে মিষ্টি গুঁজে দিয়ে বলা ‘আবার এসো’। ঠাকুরদের মুখ অবধি হাত পৌঁছায় না যে!
শুক্লা দশমীর আলোয় আবছায়া নদীতীর। ঢাক বলছে,
ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ,
ঠাকুর যাবে বিসর্জন। বিসর্জনের সময় ইঁদুর খুজে পাওয়া যায় না। খোঁজ খোঁজ,
অবশেষে ভাইয়ের পকেট থেকে উদ্ধৃত ইঁদুর নদীর জলে। চিরচারিত নিয়মেই ভাই আর তার বনধুর কান্না বড়দের হাসির তলায় ঢাকা পড়ে যায়। বড়রা কবেই বা এসব ছোটখাট কথা বুঝেছে!
বিসর্জনের পরে বাড়ীতে লোকজনে ভরা সন্ধ্যে। টেবিল ভরা বাড়ীর তৈরী নাড়ু,
মোয়া,
গজা,
নিমকি,
ঘুগনি। আমার হেংলু ভাইটা মাকে বারে বারে প্রণাম করে নাড়ু আদায় করে আনে। এইভাবেই এক পুজো কেটে যায়,
সামনের বছরের পথ চেয়ে। ঠাকুর মশায়ের মত মনে মনে বলি
– পুনরাগমনায় চ।
কিন্তু মনের মাঝে কোথাও বেজে চলে আরেক বিসর্জনের বাজনা, - বুঝতে পারি
দুগ্গাঠাকুরের সাথে আমার বাঁধনহারা শৈশবও চলে যাচ্ছে আমায় ছেড়ে। পুজো ফিরে ফিরে
আসবে, কিন্তু তার আর ফেরা হবে না। শুধু একরাশ শিউলির গন্ধ মেখে মেঘ-কুয়াশার স্পর্শ
নিয়ে মনে তার নিত্য আসা যাওয়া চলতেই থাকবে: সেটা কেউ কোনদিনও আমার কাছ থেকে কেড়ে
নিতে পারবে না। (সমাপ্ত)
No comments:
Post a Comment