Tuesday, May 7, 2019

সবুজ শৈশবের গল্প (৬) – ডাউহিল পর্ব


ক্লাস সিক্সে উঠে 1972 আবার ফিরে এলাম ডাউহিলে। ওখানের স্কুলে ভর্তি হওয়া মানেই পাকদণ্ডী বেয়ে চোরবাটো ধরে স্কুলে যাওয়া। ঢাল ধরে গড়িয়ে গেলে বেশ চটপট নেমে আসা যেত অনেকটা পথ। মাঝে মাঝে ওর ঘাড়ে গড়িয়ে গেলে নামাটা আরো তাড়াতাড়ি হত।
মোমেন্টামের অঙ্ক না জানলেও প্রয়োগ করতে অসুবিধা হত না কিছু। বর্ষাকালে রাস্তায় খুব জোঁক। অনেকেই ভয় পেত। নুন ছাড়াই জোঁক ছাড়াতে পারতাম বলে বন্ধুমহলে আমার ভাল কদর ছিল। বাড়ী ফিরলে মা ঘরে ঢুকতে দিত না। সব জোঁক গা থেকে ফেললে তবে অনুমতি মিলত। উঃ, বড্ডো জোঁক ছিল ওখানে।

ডাউহিলে যাবার পরে পরেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল। কিন্তু সুদূর নির্জন পাহাড়ে তার বিশেষ প্রভাব দেখিনি। বাবা মায়ের আন্তরিক খুশী আর রেডিওতে আমার সোনার বাংলা বারবার শোনা ছাড়া আর বিশেষ কিছু মনে পড়ে না। ওই  সময় রোজ সন্ধ্যায় বোধহয় সলিল চৌধুরীর লেখা একটা সুদীর্ঘ গান শেখান হত, “এই দেশ এই দেশ, আমার এই দেশ”। তখন খুব মন দিয়ে গাইতাম আমার বেসুরো গলায়। তখন পুরোটা মুখস্ত ছিল। আজ প্রথম অনুচ্ছেদটি ছাড়া কিছুই মনে করতে পারি না।

আমাদের বাড়ী থেকে দু-তিন পাক নেমে গেলেই, ভিক্টোরিয়া স্কুলের নীচে প্রিয়বন্ধু আলপনার বাড়ী হারিয়েই তো গিয়েছিল সেই সব দিনেরাহঠাৎ করে তাদের খুঁজে পেলাম এই সেদিন। সেদিন ফেসবুক থেকে আলপনা আমায় খুঁজে বের করেছিল। সেদিনকে লেখা নিয়ে ভাবতে হয় নি, ঝড়ের মত কীবোর্ডে দৌড়াচ্ছিল আঙুলেরা, যেন তাদের এক্খুনি কিছু ছুঁয়ে ফেলতে হবে, পৌঁছে যেতে হবে কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যে। ওকে লেখা সেই দীর্ঘ নোটে ধরা থাকল আমার – আমাদের সোনালী মুহূর্তেরা। তাই তুলে দিলাম কোন এডিট ছাড়াই।

*

মোবাইলের পর্দায় যখন USA- নম্বরটা ভেসে উঠল, তখন ভেবেছিলাম ছেলের কথা। কিন্তু ওপার থেকে, মানে আক্ষরিক অর্থেই বহুযুগের ওপার হতে একটা রিনরিনে গলা আছড়ে পড়ল – “বলতো কে ? জোর গলায় কথা বল, তোর আওয়াজটা ভাল করে শুনি একবার।আমি তো আকাশ পাতাল এক করে প্রাণপণে খুঁজে যাচ্ছি চেনা গলা, USA এর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বন্ধুদের আওয়াজের সাথে মেলাবার আপ্রাণ প্রয়াসে, - তুই কলকলিয়ে হেসে উঠলি, - “আরে আমার গলা কি কখন ফোনে শুনেছিস যে বলবি ? আমার সাথে তোর শেষ কথা হয়েছিল ’72 এ। বাহাত্তুরে তে না ধরলে,,,,”

 1972, তার মানে ক্লাস সিক্স, তার মানে ডাউহিল----- “আলপনা, তুই?????”

 এক ঝটকায় উড়ে গেল অনেকগুলো বছর। হুড়মুড়িয়ে কত খবর আদান প্রদান। শেষে গিয়ে ঘাঁটি গাড়লাম আমাদের স্বপ্নের রাজ্য ডাউহিলে। কার্শিয়ং এর দু একপাক রাস্তার ওপরেই ছিল রাজরাজেশ্বরী স্কুল। ডাউহিল থেকে রোজ স্কুলে যাওয়া আসা বনপথ ধরে – হাসি গল্প খেলার মাঝে টেরই পাওয়া যেত না যে এই চার কিলোমিটার পথ ফুরাল কখন।  স্কুলের নাম বলতেই সাথে সাথে ভেসে এল রচনা, শিল্পী, অমিত, লিপিকার নাম। এদের কথাও তাহলে লুকিয়ে ছিল মনের গহীনে? শিল্পীর মাথার চুলগুলো কোঁকড়া কোঁকড়া ছিল, তাই নারে? অমিত ছিল খুব মুডি, প্রায় ক্ষ্যাপাটে। লিপির কতো গুণ ছিল, মনে আছে তোর? কি সুন্দর আবৃত্তি করত। কবিতাও লিখতে পারত। আমি হাঁ করে শুধু ভাবতাম, কি করে যে লেখে! আর স্কুলের পাশে ঘরের বারান্দাতে ভাউজুর বাদাম / মকাই ভাজার কথা মনে আছে তোর? টিফিনে যতই বাক্স ভরা খাবার ভাগাভাগি করে খাইনা কেন, ভাউজুর বাদাম বা লজেন্স ছাড়া পেটটা ঠিক ভরত না আমাদের। এই লিপিকা এখন বেশ নামকরা কবি, কতো বড়ো বড়ো জায়গায় ওর আবৃত্তি হয়, শুনি আর বেশ গর্ব হয়, জানিস!

আমি একটু দেরীতে ভর্তি হয়েছিলাম। বুকলিস্টের বইগুলো তখন পাওয়া যায় নি বলে বাবা অন্য বই কিনে দিয়েছিলেন। তাই বই মিলিয়ে নিতে, আমার বইয়ে না থাকা অংশটুকু টুকে নিতে প্রায়ই যেতে হত তোদের বাড়িভিক্টোরিয়া স্কুলের নীচে। বি. এফ. স্কুল-ক্যাম্পাস থেকে দশ-বারো মিনিটের ধুবি গাছে ছাওয়া পাহাড়ী রাস্তার হাঁটাপথ।

প্রথম প্রথম বাবা পৌঁছে দিতেন স্কুলে আর নিয়েও আসতেন। তোরা দলবেঁধে চলে যেতি পাহাড়ী চোরবাটো ধরে। তোদের লাল-নীল-হলদে সোয়েটারগুলো পথের বাঁকে মিলিয়ে যাবার অনেক আগেই বাবার বাইক এসে দাঁড়াত। বুলেটের ডিগ ডিগ আওয়াজটা শোনা যেত অনেক দূর থেকে।

একদিন বাবা মনে হয় মিটিংয়ে আটকে গিয়েছিলেন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যখন চারপাশ ফাঁকা হয়ে গেল, তখন একটু ভয় আর অনেকটাই অস্বস্তি নিয়ে নেমে এলাম কার্শিয়ংয়ের মেখলানী আঙ্কেলের দোকানে। বসার জন্য টুল আর খাবার জন্য মিষ্টি দিয়ে মেখলানী আঙ্কল বাবাকে ফোন করলেন যখন, তখন বাবার অবাক গলা শুনতে পেলাম, “সে কি, বাড়ি আসে নি? আচ্ছা আমি আসছি।  তার মানে মিটিংয়ের কথাটা যে আমায় বলতে ভুলেছেন, সেটাও মনে নেই !

কিছুদিন বাদে একই ঘটনা আবার। ওপরে তাকিয়ে দেখি, চোরবাটোর শেষ মোড়ে তোদের রংবেরংয়ের সোয়েটারগুলো দেখা যাচ্ছে। রাস্তা আমার চেনা নয়। কোন দিন যাইনি যে। তবু রাগ আর জেদের ভরেই ব্যাগটা পিঠে ফেলে রওয়ানা হয়ে গেলাম – পায়ে চলা পথের দাগ আর তোদের সোয়েটার লক্ষ্য করে। কিছুটা এগোবার পর একলা বনপথে একটু যে ভয়ভয় করছিল না, সেটা বললে মিথ্যে বলা হবে। কিন্তু তার একটু আগে বেশ কিছুটা ওপর থেকে বাবার বাইকটা দাঁড়াতে ও চলে যেতে দেখেছি অসহায়ের মত। কাজেই সনসনিয়ে ওপরে চড়া ছাড়া আর কোন গতি নেই। দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে যেতে থাকি। কখনো তোদের দেখতে পাই, কখন অনিশ্চয়তার আড়াল। একটাই কথা মাথায় আছে এই রঙিন সোয়েটার গুলোকে হারিয়ে ফেললে চলবে না। সব রাতের মত সব পথেরও শেষ আছে। জেদ, ভয় আর অনিশ্চয়তায় ভরা একঘণ্টার পথ পার করে একসময় পৌঁছে গেলাম তোদের বাড়ীর সামনের রাস্তায়। আর ভয় নেই। মনে যুদ্ধজয়ের আনন্দ। অচেনা বনপথ শেষ। এবার আমার চেনা রাস্তা। একটু বসে নিলাম। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। বোতল থেকে জল খেলাম এতোক্ষণে। পুরো রাস্তায় তোদের হারিয়ে ফেলার ভয়ে নিজেকে ওটুকু সময়ও দিতে পারিনি। কারণ পাহাড়ি বিকেলে সন্ধ্যা নেমে আসে দ্রুত। তোদের হারিয়ে ফেললে আমি কোথায় যে ঘুরে মরবো তার ঠিক নেই। জঙ্গল মাঝে মাঝে বড়ো অকরুণ হয় রে আলপনা! বেশ একটা যুদ্ধজয়ের আমেজ নিয়ে - আর হুড়োহুড়ি নয়, ধীরে ধীরে খোসমেজাজে বাড়ি।
 ওরে বাবা। প্রলয় ঘটে গেল নাকি? বাবা গম্ভীর মুখে বাইকের ঘরের দিকে যাচ্ছে, মা আর রাণুদিদি হাপুস নয়নে কাঁদছে, ছোট ভাইটা বোকার মত তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ব্যাপারখানা।

বাবা তাঁর জেদী দস্যি মেয়েকে বিলক্ষণ চেনেন। নিশ্চিত ছিলেন যে আমি তোদের সাথে চলে এসেছি। তাই রাণুদিদিকে তোদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে নিয়ে আসার জন্য। রাণুদিদি সেখানে আমাকে না পেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ফিরে এসে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসেছে  সে এক হুলুস্থুলু ব্যাপার।

 ভালই হল ফলটা। এবার থেকে তোদের সাথেই রোজ স্কুল আসা যাওয়ার অনুমতি মিলে গেলপথে আরো কয়েকজন জুটত। চোরাবাটো দিয়ে কলকলিয়ে গল্প করতে করতে যাওযার যে কি মজা ! স্কুলের ওপরে একটা অডিটোরিয়াম ছিল। সেখানে একবার ম্যাজিক শো হয়েছিল মনে আছে তোর ? অঞ্জনাদি আমাদের একটা দ্বৈত নাচ শিখিয়েছিল স্কুল ফাংশনের জন্য। আজও নাচটা মনে আছে আমার। তুই খুব ভাল নাচতি আলপনা। দুর্গাপুজোয় আরতি নাচের প্রথম পুরস্কার দুটো আমরাই ভাগ করে নিয়েছিলাম।

প্রাণের ভিতর কিছু নাম কিছু ছবি গাঁথা হয়ে থাকে – স্মৃতির পর্দা সরালেই তারা যে ঝলমলিয়ে ওঠে, তার প্রমাণ কাল হাতে-নাতে পেলাম।“

*
   পুজোর আগে সারা পাহাড় ভরে যেত বনফুলে। নানা রঙে রঙিন মাঠ-জঙ্গলকে কেমন যেন অচেনা মনে হত। পুজো হত একটা বিরাট হলঘরে। অক্টোবরের ঠাণ্ডায় সন্ধ্যাতে বাইরে থাকা সম্ভব ছিল না যে! ঘরোয়া পরিবেশের পুজোর সেই আনন্দ পরবর্তীকালের কোন পুজোতেই আর ফিরে পাই নি। সেই ঘরে মা দুর্গা আর তার সঙ্গীসাথীরাও ঘরের পরিজন হয়েই থাকতেন। ভাই একবার পকেটে করে বোংগিল (বোরোলিন) নিয়ে গিয়েছিল অসুরকে একটু লাগিয়ে দেবে বলে! ডায়াসে উঠেও পড়েছিল বেচারী, কিন্তু ওই যে বলেছি, বড়দের জ্বালায় ছোটদের কোন ভাল কাজ করার উপায় নেই ! হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে এক কাকু কোলে করে নামিয়ে দিলেন! অসুরটার জন্য একটুও ভাবনা না করেই।

   স্কুল থেকে আর একটু পথ নেমে গেলেই কার্শিয়ং। টয়ট্রেন এসে দাঁড়াত সেখানে। কিছু কিনতে হলে আমাদের চার কিলোমিটার নেমে আসতে হত এখানেই। ডাউহিলে তখন একটা দেশলাইয়ের দোকানও ছিল না। তিনটে বড় রেসিডেন্সিয়াল স্কুল ছিল কিন্তু। Gothel’s School, Victoria Boys’ School and Dowhill Convent. আর বাবাদের  West Bengal Forest Training School তো ছিলই।

   তাই পরিবেশটাও ছিল একটু অন্যরকম। দেশী-বিদেশী আবহাওয়ার একটা চমৎকার মিশ্রণ ঘটেছিল। উগ্রতাবিহীন সেই নরম পরিবেশ আজও আমার স্বপ্নে জড়িয়ে আছে।

No comments: