Monday, May 6, 2019

সবুজ শৈশবের গল্প (৫) – কলকাতা পর্ব

1970-1971 এই দুবছর কলকাতায় খারাপ কাটে নি। পাড়া আর স্কুলে নতুন নতুন বনধু বান্ধবী জুটে গেল। ওই সময় পড়ি স্বপনবুড়োর কিশের সংকল্প বইটা আমাদের খুব প্রভাবিত করেছিল।
আমরা নিজেরা বই দান করে চাঁদা দিয়ে একটা class library বানিয়েছিলাম। আমরাই লাইব্রেরিয়ান আমরাই পাঠক। বেশ ভাল চলত কিন্তু।


   আরেকটা কাজ করেছিলাম।বাড়ীর সামনের ফুটপাথগুলোয় লোকের ফেলা ময়লা জমে ঢিবি তৈরী হয়েছিল। বনধুরা মিলে এক রবিবারে আমরা নেমে পড়লাম সাফাই অভিযানে। খুব মজা লেগেছিল। মাটি খুঁড়ে ছোট ছোট বালতি করে এক জায়গায় জমা করলাম। আগের দিন কর্পোরেশনের ঝাড়ুকাকুকে বলে রেখেছিলাম। সে দুপুরবেলা এসে সব ময়লা নিয়ে চলে গেল।

  -মা, পরের রবিবার আবার যখন দল বেঁধে বেরিয়েছি, তখন দেখি ঝাড়ুকাকু তার আরো দুজন বনধুকে নিয়ে এসেছে। ব্যস, একদিনেই সব পরিস্কার। পাড়া ঝকঝকে। সবচেয়ে ভাল কথা- আর কেউ রাস্তায় নোংরা ফেলত না তারপর থেকে। কোন প্রচার ছাড়াই স্বচ্ছ পাড়া হয়ে গেল এলাকাটা! এখনো যখন লেকরোডের রাস্তা দিয়ে যাই, সেই স্মৃতি মনে পড়ে

সত্তরের কলকাতার সময় বড় অস্থির। কিছু বোঝার পক্ষে আমি যথেষ্টই ছোট তখন। তবু সেই ছেলেমানুষী দিনের গায়েও কিছুটা আঁচ না লেগে উপায় ছিল না। আমার জঙ্গলে বেড়ে ওঠা শৈশব এই চঞ্চলতার দিনগুলিতে বড় দিশেহারা বোধ করত। দেওয়ালে কারা যেন লিখে দিয়ে যেত, “পুলিশ তুমি যতই বাড়ো, মাইনে তোমার একশ বারো” – দেখে হেসে কুটিপুটি হতাম। যে অঞ্চলে আমার মাসীর বাড়ী, সেদিকে বিশেষ কোন গণ্ডগোল ছিল না। কিন্তু যাদবপুর ঢাকুরিয়ায়  বসবাসকারী আত্মীয়জনেদের কাছ থেকে নানা নৃশংসতার বর্ণনা শোনা যেত। কিছুই না বুঝে সব বন্ধুরা মিলে ঠিক করে নিয়েছিলাম, নকশালরা খুব ভাল, তারা ডাক্তারদের কম ফি তে রোগী দেখতে বাধ্য করে আর কালবাজারী (ভগবান জানেন সেটা কি, কিন্তু খুব খারাপ কিছু সেটা নিশ্চিত জানতাম) – বন্ধ করেছে। আর পুলিশ, সি আর পি এফরা ভারী খারাপ, তারা এদের ধরে ধরে মেরে ফেলে। এসব অতি গম্ভীর রাজনৈতিক মতামত বাড়ীতে বলা মানা ছিল। দেবজিৎ নামে আমাদের এক অতি ইঁচড়ে-পক্ক বন্ধুর ভাষায় তাহলে “কেস খতম” হয়ে যাবার সম্ভাবনা।

এই দেবজিতের কথা একটু বলি। আমাদের তুলনায় একটু বেশি পাকা ছিল। ও নাকি আগে যে পাড়ায় থাকত, সেখানে নকশালদের চিঠি একে ওকে পৌঁছে দিত বলে ওর বাবা মা ওকে নিয়ে এদিকে চলে এসেছেন। লেকরোড তখন মোটামুটি ভাবে শান্তিপূর্ণ ছিল। আমাদের মধ্যে একমাত্র ওই সাঁতার কাটা শিখত। সেখানে  তিনতলা উচ্চতার ডাইভ বোর্ড থেকে ওকে জলে ঝাঁপাতে হত! একটু যদি এদিক ওদিক হয় – আমরা শিউরে শিউরে উঠতাম। তাই রোজ ক্লাস শুরুর আগে আমরা সমবেত প্রার্থনা করতাম সাম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়াবার জন্য! বন্ধু হিসেবে খুবই জনপ্রিয় ছিল। পরে বড় হয়েও এই ঘনাদাটিকে অনেক খুঁজেছি, কিন্তু খুঁজে পাইনি।

এই সবের মধ্যে বৃত্তি পরীক্ষা এসে গেল। তখন ক্লাস ফোরের শেষে এই পরীক্ষা দিতে হত। বোর্ড পরীক্ষার মত। তাতে পাশ করলে তবেই পরের ক্লাসে ওঠা যাবে। ভাল ফল করলে সরকার থেকে বৃত্তিও দেওয়া হত। অবশ্য তা পেতে গেলে বাবার মাইনে যা হতে হত, তাতে সেই টাকা কেউ পেত কিনা সন্দেহ আছে। সেই পরীক্ষার দু-একদিন আগে নকশালরা বড়দিকে একটা সাদা থান পাঠিয়ে হুমকি দিয়েছিল, এই পরীক্ষার জন্য ছাত্র না পাঠাবার জন্য। বড়দি সেই পার্শেলটা সরিয়ে রেখে আমাদের পরীক্ষা দিতে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর এই দৃঢ়তা আমায় বড় প্রভাবিত করেছিল।

পরীক্ষার পরে একদিন স্কুল চলছে, এমন সময় খবর এল, নকশালরা নাকি আমাদের স্কুলে হামলা করতে আসছে। তখন এরকম খবর প্রায়ই হাওয়ায় ভাসত। দল বদলাতে এক সেকেণ্ডও লাগল না। ক্লাস পালিয়ে কিছু বন্ধু নিয়ে স্কুলের ছাদে চলে গেলাম। কিছুদিন আগে রিপেয়ার ওয়ার্ক হওয়ায়, ছাদ ভর্তি পাথর আর কংক্রীটের টুকরো। বেশ জেনারেলের মত হুকুম দিচ্ছি, আর বাকীরা রাস্তার দিকের ছাদের কোণায় পাথরকুচি জমা করছে।মানে মিনি যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে আর কি ! নকশালরা এলেই মাথায় পাথর ফেলা হবে। এতবড় প্রস্তুতির ফলাফল বড় ট্র্যাজিক। আমাদের ক্লাস টিচার আমার গুণ্ডা স্বভাবের সাথে পরিচিত ছিলেন। তিনি আমাদের ক্লাসে না দেখতে পেয়ে সোজা ছাদে এবং কান পাকড়ে – যাক্গে ওসব কথা। বড়রা কবেই বা ছোটদের ভাল ভাল আইডিয়াকে সম্মান করতে পেরেছে ! যাই হোক, নকশালরা শেষ অবধি স্কুল অবধি এসে পৌঁছায় নি। তাদের অন্য কোথাও কোন কাজ পড়ে গিয়েছিল বোধহয়! এহেন নিরামিষ সমাপ্তিতে মনটা ভারী ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল।

কিছুদিনের মধ্যেই সেই অস্থিরতার দিন শেষ হল। অনেক প্রাণ গিয়েছিল। Unaffected family বোধহয় বিশেষ কেউ ছিল না। কিন্তু সেসব আলোচনার জায়গা এটা নয়।

এর কিছুদিন পরেই আরেক ইতিহাস গড়ার সময়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতও জড়িয়ে পড়ল। একটা দেশ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে, চোখের সামনে একটা ইতিহাস তৈরি হচ্ছে – তার একটা উত্তেজনা আমাদের ছোট মনটাকেও ঘিরে রাখত। রেডিওতে, খবরের কাগজে তখন শুধুই যুদ্ধ। ঘরের সব কাঁচের জানলা কাল কাগজ দিয়ে মুড়ে দেওয়া হল। নতুন শব্দ শিখলাম – Black Out ! সাইরেন বাজলেই ঘরের সব আলো নিভিয়ে খাটের তলায় ঢুকতে কী মজাটাই না লাগত ! পাড়ায় ভলেন্টিয়াররা ঘুরে ঘুরে দেখত সবাই আলো বন্ধ করেছে কিনা। বাকি কী কী ড্রিল ছিল মনে নেই। কিছুদিন বাদে অবশ্য সাইরেন বাজলে শুধু আলোটাই নেভান হত – বাকি লোকে স্বাভাবিকভাবেই থাকত।

মজাও যে হত না এমন নয়। একবার শোনা গেল, পাকিস্তানীরা বোমা ফেলে হাওড়া ব্রীজ উড়িয়ে দিয়েছে। দুশ্চিন্তায় সবার মুখ কাল। ওইদিন ট্রেনে  আমার বাবামায়ের কলকাতা আসার কথা। তাঁরা তো আর খবর শোনেন নি! তাই দিব্বি ব্রীজ পার হয়ে বাড়ী চলে এলেন ! খবরের গুজব, গুজবের খবর সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।

No comments: