মাদারিহাট থেকে বাবার এবার বদলি হলেন ডাউহিলে। Forest
Training School এর শিক্ষক হয়ে। সেই প্রথম নিজের বাড়িতে electricity
দেখা। একটা কথা ডাউহিলে এসে উপলব্ধি করলাম আমার বাড়ি এই পাহাড়েই। কাঞ্চনজঙ্ঘা,
তিস্তা আর জঙ্গল ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।
এই রোদ এই কুয়াশার খেলা,
কাঞ্চনজঙ্ঘার রঙবদল,
ধুবি গাছের সরসরানি আর বাড়ীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ী ঝর্ণা-
সব মিলিয়ে সে এক রূপকথার দেশ। বাড়ীর গা ঘেঁষা ধুবির জঙ্গলে ভোররাতের দিকে ভালুক আসত কুটুস ফল খেতে।অনেকটা কাঠবাদামের মতো এই ফল আমরাও কুড়িয়ে খেয়েছি কত।
আরো একটা প্রিয় খেলা ছিল। ট্রাইসাইকেলে বসে ঢালের দিকে মুখ করে প্যাডেল থেকে পা তুলে নিতাম।ক্রমশ:
গতি বাড়তে থাকত। বাড়ি থেকে বাবার অফিস অবধি গিয়ে ব্রেক। পিছন পিছন ভাই আসত দৌড়ে। তারপর সাইকেল ঠেলে ঠেলে ওপরে নিয়ে যাওয়া। এবার ভাই বসবে আর আমি দৌড়াব।
বাবা ছমাস থাকতেন ডাউহিলে আর বাকি ছয়মাস চল্লিশ জন ছাত্রদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন সারা পশ্চিমবাংলা জুড়ে। জঙ্গল প্রদক্ষিণ আর কি। কোথাও তিনদিন তো কোথাও দশদিন। মূল উদ্দেশ্য পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বনপ্রকৃতির সাথে নতুন বীটঅফিসারদের
পরিচিতি ঘটান। তা, এই ছমাস ট্যুরটা আমাদের কাছে বেশ মজার ছিল। মানে আমাদের
ভাইবোনের কাছে আর কি। যত হ্যাপা তো বাবামায়ের। তিন-চারদিন পরপর বাক্স বিছানা
গুটিয়ে নতুন জায়গার উদ্দেশে চলা। এই যাবার সময় কখনো সখনো অনুমতি মিলত জীপের বদলে
ছাত্রকাকুদের ট্রাকে চড়ে যাবার। কাকুরা ট্রেনিংয়ের জন্য বছরখানেক বাড়িছাড়া। তাই
সেখানে গেলে অপরিমিত আদর আর প্রশ্রয় পাওয়া যেত। আবদার করে একবার ট্রাকের ড্রাইভার কেবিনের
মাথায় বসে জার্নি করেছিলাম মনে আছে। এই ঘোরার মধ্যে বিশেষ করে মনে আছে শুকনা,
রাজাভাতখাওয়া আর সিরকাবাদের কথা। শুকনায় প্রথম লিচুগাছ দেখা আর গাছ থেকে লিচু পেড়ে
খাওয়া। বাকি দুই জায়গায় ছোট নদী ছিল। তার নুড়িজলে পা ডুবিয়ে মাছেদের পিছনে
দৌড়োদৌড়ি - সে এক মস্ত খুশীর আড়ৎ।
আর যত খিচুড়ি সব পেকেছিল বামনপোকড়িতে। ছোট্ট পাহাড়ী জায়গা। এককামরার ঘরে
আমাদের বসবাস। সরু খোলা বারান্দার ওপারে বাথরুম আর রান্নাঘর। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে
ছোট এক নদী। একটু ওপরে উঠে গেলে কিছুটা সমতল জায়গা। সেখানে কাকুদের ক্যাম্প।
সেখানে নদী ঝর্ণা হয়ে লাফিয়ে নীচে পড়ছে। তাই জলের জন্য চেরা বাঁশ দিয়ে অস্থায়ী
জলের লাইন তৈরি করা হয়েছে। এখানের জঙ্গলে নাকি অনেক বৈচিত্র্য। তাই প্রায় দিন
সাত-আট থাকা হবে। বাড়ীর পাশের গাছে অনেক হনুমান। মা তাদের কলা খাওয়াত বলে তারা
আমাদের বেশ ভালবাসত। কাছে গেলেও কোনদিন চাঁটি মারত না।
একদিন সন্ধ্যেবেলায় মা আমাদের জন্য দুধ গরম করে আনতে গিয়ে খোলা বারান্দায়
দাঁড়িয়ে পড়ল। সন্ধ্যের অন্ধকারে নাকি একটা শেয়াল এসে নদী থেকে গুবগুব করে জল
খাচ্ছে তাই দেখতে। মানসিংদাজু নিঃশব্দে এসে পাশে দাঁড়িয়ে রইল। শিয়াল চলে গেলে
জিজ্ঞাসা করল, “মাইজি বাঘ দেখলে?” -
“কীঈঈঈ বাঘ?” – চেঁচিয়ে মেচিয়ে সব দুধ ফেলে দিয়ে মা একছুটে শোবার ঘরে ঢুকে লটপটে
দরজাটা বন্ধ করে দিল। আর আমাদের ওপর হুকুম হল খাটের ওপর পা তুলে বসার। ভাই ভারি
বাধ্য ছেলে। সে তাই করল, কিন্তু আমি চিরকেলে ক-কারান্ত ছানা। তাই বিজ্ঞের মত জানতে
চাইলাম, “বাঘ কি খাটের ওপর উঠতে পারে না ? ” সদ্য বাঘ দেখে আসা মায়ের হাতের চড়টা
বাঘের থাবার মতই গালে পড়ল।
ইতিমধ্যে বাবা তার ছাত্রদের নিয়ে সারাদিনের জঙ্গল পরিক্রমা সেরে ঘরে ফিরে
এসেছে। সব শুনে “ধুৎ” বলে যেই না চায়ের কাপে আরাম করে চুমুক দিয়েছে, আর আমরাও
বাবার প্রশ্রয়ে খাট ছেড়ে নেমে পড়েছি, অমনি দুজন ছাত্র দৌড়ে দৌড়ে এসে খবর দিয়েছে।
কি, না – বাঘে গরু মেরে বাঁশের উপর ফেলেছে, তাই তাঁবুতে জল আসছে না। তাই শুনে বাবা
বন্দুক নিয়ে বেরোচ্ছে, মা তো হাউমাউ কান্না জুড়েছে, তাই দেখাদেখি আমরাও। তাতে লাভ
কিছু হল না, শুধু বাবা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, যদি বা বাঘ থাকত, তোদের হল্লার চোটে
সে এতক্ষণে পগার পার হয়ে গেছে। তাই শুনে আমাদের ভাইবোনের কি হাসি !
সে যাই হোক, গরু সরিয়ে রাতে তো জলের লাইন চালু করা হল। মড়ি সরান হলে বাঘ আর
নাকি সেটা ছোঁয় না ! তাই পরদিন সকালে আমরা সেই গরুকে দেখতে গেলাম। অসহায় মরা
গরুটাকে দেখে বাঘটার উপর রাগ আর গরুর জন্য দুঃখ মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল।
নর্থ বেঙ্গলে কালিঝোরার তীরে ক্যাম্প হত। মাঠের ধারে গভীর খাত ৯০ ডিগ্রীতে
নেমে গেছে। সেখানে উঁকি দিলে নীচে গর্জনশীলা কালিঝোরাকে দেখা যেত। বেশি চওড়া নয়,
কিন্তু কি তার আওয়াজ! রীতিমতো চেঁচিয়ে কথা না বললে ওপরের ক্যাম্পের জমিতে কথা শোনা
যেত না। তাতে আমাদের ভারি সুবিধা হয়েছিল। খেলার সময় মায়ের ডাক মোটেই শুনতে পেতাম
না। গল্প শুনেছিলাম, বাজী ফেলে চারটি ছেলে শীতের দুপুরে সাঁতরে নদী পেরোতে
গিয়েছিল। কিন্তু জল এতো ঠাণ্ডা যে ওপারে পৌঁছোবার আগেই ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে সাঁতরাতে
না পেরে মরে যায়!
এত সুখ কি আর কপালে সয়! আমাদের পড়াশোনা নাকি চৌপাট হচ্ছে! তাই পরের বছর আমাকে পাঠান হল কলকাতায় মাসীর বাড়ীতে। ভাই ছোট বলে থেকে গেল।
No comments:
Post a Comment