Friday, May 3, 2019

সবুজ শৈশবের গল্প (৩) – মাদারীহাট পর্ব


কালিম্পং থেকে মাদারিহাট। সেখানেই পেলাম প্রথম জীবন্ত বন্ধুর দল। তার আগে তো গাছপালা আর কাঞ্চনজঙঘা ছাড়া বন্ধু ছিল না কেউ। মাদারিহাটে এসে প্রথম সমতলভূমি। প্রথম প্রথম একটু থতমত লাগত ঢালু পথে হেঁটে বড় হওয়া পায়ের। গাছপালা ঘেরা ক্যাম্পাসে থাকত ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্টের হাতীরা।
সেই প্রথম আমার হাতী দেখা, হাতী চড়া। ছয় বছরের আমি এসে এসেই পুরোদস্তুর চামচা বনে গেলাম আমাদের আর্দালী বাহাদুরদাজুর ছেলের। সে ভারী গুণী লোক।দুটো বাঁশের রণপা চড়ে অনায়াসে দৌড়ে বেড়াত, গাছ বাইত কাঠবিড়ালির ক্ষিপ্রতায়। তার কাছেই তো শিখলাম কি করে গাছে চড়তে হয়। আমাকে দুটো ছোট রণপাও বানিয়ে দিয়েছিল। আর শিখিয়েছিল ফুলের বৃষ্টি। ভোরে যখন সবাই মিলে ফুল কুড়োতে যেতাম, তখন আমাদের শিউলি গাছের তলায় দাঁড় করিয়ে গাছ ঝাঁকিয়ে দিতআর টুপটাপ করে মুখে মাথায় ঝরে পড়ত শিউলির দল। তারপর হৈ হৈ করে ফুল কুড়ানোর পালা।

জয়া পেকুদের মা পাতলা কাপড়ের ওপর বড়ি দিতেন। বড়ি শুকিয়ে গেলে কাপড়টা একটু ঝেড়ে নিলেই ব্যস! বড়িরা থালার উপর টুক টুক করে জমা হতো। কাপড়টায় কী সুন্দর ভেজা ডালের গন্ধ! টুসকির ঠাকুমা কুলোয় করে গম ঝাড়তেন। হাতের এক টোকায় গমের দল নিজে নিজেই একদিকে, আর খোসারা অন্যদিকে চলে যেতো। ঠকুমার হাত থেকে কুলো নিয়ে কতো চেষ্টা করেছি। কিছুতেই পারতাম না। অথচ টুসকি দিব্বি পারত! তাই একটু একটু সবুজ হিংসে হতো আমার।
 বনবিভাগের হাতীদের সুন্দর সুন্দর নাম জয়মালা, রাজলক্ষ্মী। থাকত আমাদের ক্যাম্পাসেইতারাও আমাদের বন্ধু ছিল। তাদের পিঠে চড়ে বসতাম প্রায়ই। জয়মালা ছিল ভারী রাগী। ওর একটা বাচ্চা হয়ে নাকি মরে গিয়েছিল। তারপর থেকেই ও সওয়ারিকে ফেলে দেবার চেষ্টা করত বিচিত্র কায়দায়। নদীর ঢাল বেয়ে যখন উঠত পিঠ ঝাঁকিয়ে দিত জোরে জোরে। তাই তখন খুব শক্ত করে হাওদা ধরে থাকতে হত। আশ্চর্য এই যে আমায় ঝাঁকাত না কক্ষনো।  এক আধবার বাবার সাথে জঙ্গলেও গেছি হাতীর পিঠে চড়ে। আমরা থাকতে থাকতেই জয়মালার ছেলে হল। আর তারপর থেকেই জয়মালা ডিপার্টমেণ্টের সবচেয়ে লক্ষ্মী হাতী হয়ে গেল!

জয়মালার ছেলে বীরবাহাদুর আমার ভারী বন্ধু ছোট্ট হাতীটার খুব পছন্দের খেলা ছিল পরপর সাজিয়ে রাখা কাঠের গুড়িগুলোকে ধাক্কা মেরে ছড়িয়ে ফেলা। আমরা খুব মজা পেতাম। একবার এই করতে গিয়ে বীর তাল সামলাতে না পেরে পড়ল নতুন কাঁটাতারের বাণ্ডিলের ওপর। বাছার ওজনটি তো আর কম নয়! কাঁটা ফুটলো গভীর হয়ে। সে কি চিল চ্যাঁচানি বেচারার। অতি কষ্টে ছাড়ানো তো হল। কিন্তু ওষুধ লাগাতে দেবে না কিছুতেই। লোকজন তো হয়রান হয়ে গেল। এবার এগিয়ে এল ওর মা আর মাসী। পা দিয়ে চেপে ধরল বাচ্চাটাকে। সবাই মিলে ওষুধ লাগিয়ে দিল তখন। এইভাবে চলল কিছুদিন। সেরে ওঠার পরে বীরবাহাদুর আর গুড়িগুলোকে ফেলত না। গার্ডদাদারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। রোজ রোজ ঐ বড় বড় গুড়িগুলো সাজানো কি মুখের কথা!

এছাড়া আমার আরেকটা প্রিয় খেলা ছিল, হাতীদের খাওয়ানো। মাহুতদাদা কলাপাতায় ধান মুড়ে খড় দিয়ে বেঁধে কাগের দলা বগের দলা বানাত সারা দুপুর ধরে। বিকেল বেলায় সেই দলা একটা একটা করে হাতীদের খাওয়াত। আমার হাতে যখন সেই দলাটা দিত, মনে হত রাজত্ব পেয়ে গেছি। আমার ছোট্ট হাতে ফোঁস করে লাগত শুঁড়ের ভেজা স্পর্শ। তারপর পুটুত করে সেটা মুখের মধ্যে চালান করে শুঁড় বুলিয়ে দিত আমার মাথায়।

আর একটা পর্ব ছিল নখ কাটা। ছেনির মত একটা জিনিস দিয়ে তার মাথায় হাতুড়ি মেরে নখ কাটা হত। বুনো হাতির মতো অত ঘোরাফেরা হয় না বলে পোষা হাতীদের নাকি নখ বেড়ে যেত। কে জানে রে বাবা!
  রাতটা ছিল বুনো হাতীদের জন্য। রাতে ক্যাম্পাসের গেট খোলা রাখতে হত। হাতীরা গেট দিয়ে ঢুকে গেট দিয়ে বেড়িয়ে যেত। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলে গা ঘষে নিত আমাদের লগ হাউসে। বাড়ীটা দোলনা হয়ে যেত তখন।

ফরেস্ট ক্যাম্পাসের পাশেই ছিল রেল স্টেশন। দিনে একটা কি দুটো গাড়ী যেত। আর যেত মালগাড়ী। তখন তাদের তো এত গতি ছিল না। ট্রেনের ধাক্কায় হাতি মরার খবর কানে আসেনি কখনো।

বাবা জানত অনেক কিছু। সাহসও ছিল প্রবাদপ্রতিম। জলদাপাড়ায় তখন একটা বনবাংলো তৈরি হবার কথা। ট্যুরিজমের জন্য। বাবার তত্বাবধানেই কাজ হবে। রোজ বাইক চেপে জায়গা বা স্পট খোঁজা চলত। অবশেষে হলংয়ের জায়গাটা পছন্দ হল। হলংয়ের বাংলোর প্ল্যান, নদীর ধারের সল্টপিট বাবার নিজের হাতে গড়া। তখন এত আউটসোর্সিং এর চল ছিল না। ফরেষ্ট রেস্ট হাউস বা কোয়ার্টারের প্ল্যান ফরেস্ট অফিসারদেরই করতে হত। লাভার বনবাংলোটিও বাবারই হাতে তৈরি।

যাক সে কথা। হলংয়ের কাজের পরিদর্শন সেরে ফিরতে বাবার প্রায়ই রাত হত। পুরো পথই সেসময় জঙ্গলে ঘেরা ছিল। একদিন ফেরার পথে একটা সেতুর ধারে বাবা মটরসাইকেলটা দাঁড় করিয়ে চুপ করে আছে। সঙ্গী গার্ড টিকারামদা বড় কথা বলে - “শম্বর দেখে দাঁড়ান ক্যান?”
হালকা হাতের চাপে হর্ণ বাজাতেই মুখ ঘোরাল – শম্বর নয় বাঘ ! হ্যাঁ, ওই সময়ে ওখানকার জঙ্গলে বাঘের দেখা মিলত মাঝে সাঝে। ফিরে এসে সেই গল্প বলার সময়েও তার মুখের যে অবস্থা – আমরা সবাই হেসে কুটোপাটি।
একবার লাগল দুই গণ্ডারের লড়াই। এক পূর্ণবয়স্ক গণ্ডার একটা সরু সেতু পার হবে, ওপারে একটি কিশোর গণ্ডারসৌজন্যের ধার না ধেরে উদ্ধত কিশোর জায়গা ছাড়ল না। সে আগে পার হবে সেতু। ছোট বলে নাকি বড়জন জায়গাও ছেড়ে দিয়েছিল, কিন্তু বেয়াড়া ক্ষুদে যাবার সময় বড়টাকে দিল এক ঠেলা। ব্যস আর যায় কোথায় ! লেগে যা লেগে যা নারদ নারদ ! গণ্ডারের গোঁ বলে কথা। তিনদিন ধরে লড়াই চলেছিল। বাবাদেরও তিনদিন নাওয়া খাওয়া নেই। কিন্তু তাদের আলাদা করে কার সাধ্য। পটকা আর কাড়ানাকাড়ার আওয়াজে তারা স্থান বদল করে মাত্র। তারা যখন পাশের রেঞ্জে যায়, তখন বাবা বাড়ী আসে, খেয়ে দেয়ে একটু ঘুমিয়ে নেয়। কয়েক ঘণ্টা পরে আবার যেই তারা বাবার রেঞ্জে ঢুকে পড়ে তখন আবার দৌড়ায় সেখানে। এভাবে তিনদিনের পর ছোটটা হার মানল। বড় গণ্ডারটা তাকে ঠেলে ঠেল গাছের গায়ে সেট করল। তারপর একদৌড়ে এসে কয়েক ঢুঁয়ে তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলল। মনে পড়ে ছোটটার জন্য খুব কেঁদেছিলাম। বাবা বুঝিয়েছিল জঙ্গলের এটাই আইন। এখন ভাবি আমাদের আইনও কি---

আমাদের কোয়ার্টারের পাশে বীরসাদাদারর চাষজমি। ধান, আখ এইসব হত। বীরসাদাদার ছোট ছেলেটা যখন হাঁটতে শিখল, তখন আখের সময়। টলমল করে সে প্রায়ই হারিয়ে যেত আখবনে। ওর মা খুঁজে খুঁজে হয়রাণ। অবশেষে বীরসাদাদা ওর কোমরে দুতিনটে ছোট ঘণ্টি বেঁধে দিল। গরুর গলার ঘণ্টার মত টুং টাং বাজনা বাজত। খুঁজে পাওয়া যেত সহজেই। বাড়ীর সামনে আনারসের বাগান। সেখানে সাপ বেজীর লড়াই দেখেছি কয়েকবার। সন্ধ্যাবেলায় হাতীর তোয়াক্কা না করে বীরসাদাদা মদ খেতে যাত! ফিরবার সময় সে “বড়বাবুর ব্যাটা”! বুনো হাতীর সাধ্য কি তাকে ছোঁয়? এইসব বলে চেঁচাতে চেঁচাতে আমাদেরই বাড়ির নীচ দিয়ে বাড়ি যেত। বাবা মিটিমিটি হাসত – এমন একখানা ছেলে থাকলেই হয়েছে আর কি?

ভাই খুব ছিঁচকাঁদুনে হয়ে উঠেছিল সেই সময়। টুকটুকে ফর্সা আর সুন্দর ছিল বলে ওকে অনেকেই কোলে নিতে চাইত। আর সে এতো প্রবল জোরে না না করে চেঁচাতো, যে ওর নামই হয়ে গেল নানাবাবু! তবে আমার সঙ্গে সব জায়গায় খেলতে যেতে আপত্তি করতো না।

মার তাড়নায় বাবা ভর্তি করে দিলেন ইস্কুলে। সেখান এক স্যারের সাথে ভাব হল খুব। তিনি আমায় বানিয়ে দিয়েছিলেন একটা ছোট ছিপ। স্কুল ছুটির পর একসাথে মাছ ধরতে যেতাম। মার আবার ভীষণ জলে ভয়। ফল যা হবার তাই। কানটি ধরে বাড়ী। স্কুলে যাবার ইতি। অন্য একজন স্যার বাড়ী এসে পড়িয়ে যেতেন। বাবার টাস্ক তো ছিলই। আমার মোটেই তাঁকে পছন্দ হত না। অঙ্ক না করলে স্যার বাইরের ঘরে বন্ধ করে রাখতেন। সেদিন খেলা বন্ধ। কিছুদিন পরপর সব কাজ করলে সাইকেলে চাপিয়ে বেড়াতেও নিয়ে যেতেন অবশ্য। তবে আমার স্বভাবগুণে সে সব দিন কমই আসত।এইসব করতে করতেই তিনবছর পার হয়ে গেল।  

No comments: