Thursday, May 2, 2019

একটি সবুজ শৈশবের গল্প -২ (কালিম্পং পর্ব)

এভাবেই দিন কাটতে কাটতে বাবার বদলির হাত ধরে পৌঁছে যাওয়া লাভা, আলগাড়া পেরিয়ে ছোট পাহাড়ী শহর কালিম্পংয়ে।
যতই জনবসতির ঘনত্ব কম থাক, সেই প্রথম ফরেষ্ট ক্যাম্পাস পার হলে গাছের বদলে বাড়ীঘর, লোকজনবেশ অবাক করা ব্যাপার! সেইখানে পাওয়া গেল একটা জ্যান্ত টুকটুকে পুতুলআমার নিজের ভাই ভাইফোঁটার দিনে এবার থেকে প্রথম ফোঁটাটি আমিই দেব। কত যে কষ্ট হত ওই দিনটাতে সে আমিই জানি। কিন্তু ওরে বাবা! কি কাঁদুনে কি কাঁদুনে! তার ওপর কাঁদলে ওই ছোট্ট সাদা শরীরটা দমবন্ধ হয়ে নীল হয়ে যায়। তার ভয়ে বাড়ীশুদ্ধ লোক তটস্থ।
কালিম্পংয়েই প্রথম ইস্কুল যাওয়া। পাহাড়ী রাস্তার পাকদণ্ডী বেয়ে কাঞ্ছাদাজুর হাত ধরে যাত্রা শুরু হলেও কিন্তু শেষ অবধি যাওয়া কমদিনই হত‌। পথে কেউ না কেউ বলতই এমা, এখনো তো পৌনে নটা বাজেনি! ব্যস, অমনি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ী। ঘড়ি দেখতে শিখিনি তখনো। কাজেই পৌনে নটায় স্কুল যাবার চক্করে অর্ধেক দিন স্কুল অবধি পৌঁছাতে পারতাম না।
 বাড়ীর পিছেনে অনেকখানি জমি। বাবার শখ হল কিচেন গার্ডেনিংয়ের। চিরকালের perfectionist বাবার প্রথম সব্জি বাগানের ফসল যে কোন প্রদর্শনীতে পুরষ্কার পাবার মতই সুন্দর। ফুলকপি, বাঁধাকপি, লংকাকি নেই সেখানে! কুমড়ো গাছের কথা বিশেষভাবে মনে আছে, কেননা কুমড়োর ভারে মাচা ভেঙে গিয়েছিল!
কাঞ্ছাদাজু বাবাকে বলেছিল ওই সময় আমি ছিলাম মাচার তলায় ! নালিশ করার শাস্তি দিতে ওর ঘরের বাসন ফেলে দিয়েছিলাম ঝোরার জলে। অনেক কষ্টে বেচারি তাদের উদ্ধার করেছিল। কিন্তু নালিশ করেনি কাউকে। অনেক পরে মা কিভাবে যেন জানতে পেরে জিজ্ঞাসা করায় বলেছিল, ও বুঝতে পারেনি নানীকে (আমি) কুমড়োর জন্য মার খেতে হবে। ঝোরা থেকে বাসন তুলতে ওর তত কষ্ট হয়নি, যতটা হয়েছিল সেদিন নানী মার খাওয়ায়। বোঝ ব্যাপার!
কলকাতায় যেতাম যখন, তখনকার স্মৃতি আনন্দ বিষাদে মাখামাখি। হাঁ করে দেখা শহরের পথ, কত গাড়ী কত লোক, দোকান, বোতাম টিপলে জ্বলে ওঠা বাতি – টর্চের চেয়ে কত বেশী আলো! হ্যাজাকের চেয়েও বেশী ! নাম নাকি টিউবলাইট ! কাকা- মামারা নানারকম খাবার আনতেন, অধিকাংশই অচেনা। কিন্তু পুরোপুরি আনন্দ বড় দুর্লভ। প্রায় মুংলি শিশুটির না-জানার পরিধি এতটাই বেশী যে প্রায়ই তা কলকাতার ভাইবোনদের, বা কখনো কখনো কাকীমাদেরও হাসাহাসির খোরাকের জন্ম দিত। খুব একটা দোষ দিতে পারিনা এই পরিণত বয়েসে এসে। কেউ যদি কাঁঠাল দেখে কেঁদে গড়াগড়ি খায়, তাকে কেন ছোট্ট লিচু খাওয়ান হয়েছে বলে – তাহলে তারাই বা করে কি ? তবু কোথাও যেন একটা অভিমান, একটা মনখারাপ জন্ম নিত। একবারের কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে। মণিকাকু একবার আমার জন্য আইসক্রিম এনেছিল। আহা! অমৃত কোথায় লাগে ! এরপর একদিন সবাই মিলে পার্কে বেড়াতে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে কোণ আইসক্রিম কেনা হল। আমি বিস্কুটের ফাঁক দিয়ে আইসক্রিম খাবার চেষ্টা করছি, কভারটাও যে খাদ্যবস্তু তা কে জানে বাবা! আমার কীর্তি দেখে দুই কাকীমা এবং ভাইবোনেদের সে কি হাসি! কিছুই বুঝতে না পেরে মুখচোখ লাল করে বোকার মত দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় বাবা আর কাকুর প্রবেশ। একনজরে পরিস্থিতি বুঝে বাবা আইসক্রিমটা আমার হাত থেকে ফেলে দিল। কাকু শুধু বলল বাড়ী ফিরে চল। মনে হল বেঁচে গেলাম। সেদিনের বেড়ানোর সেখানেই ইতি। কাউকে একটি কথাও না বলে শাসন করাটা আমাদের বাড়ীর বড়দের সহজাত। তাই ফেরার পথ ছিল নিঃশব্দ। তারপর থেকে হাসি তামাশাটর মাত্রাটা অনেকটাই কমে গিয়েছিল। পরে অবশ্য একদিন বাবা আমাকে ঐ আইসক্রিম কিভাবে খেতে হয় শিখিয়ে দিয়েছিল আর বলেছিল কিছু না জানাটা লজ্জার নয়। শিখতে না পারাটাই লজ্জার। তুমিও অনেক কিছু জান, সেটা ভুলো না।
না, সেটা আর ভুলিনি জীবনে। ওই সম্বল নিয়েই তো এই পথ চলা আমার। 

No comments: