Friday, April 26, 2019

একটি সবুজ শৈশবের গল্প - (১) - লাভা পর্ব




 লাভা পর্ব

এই মনে পড়া, মনে করার খেলা খেলতে খেলতে কতদূর যাওয়া যায় জানিনা। চোখ বন্ধ করে পিছোতে পিছোতে যেখানে আমার প্রথম চোখ খুলল, সেখানে দেখি একটা ছোট্ট মেয়েএই সবে বছর দুই কি তিনখাটে শুয়ে আছে।
তার অলস চোখে ফায়ারপ্লেসের উপরের দেয়ালের পুরোন চূণকামের আঁকিবুকিগুলো ছোট ছোট পুতুলের চেহারা নেয়। তারা নড়ে চড়ে, ফিসফিসিয়ে কথাও বলে। যদিও সে কথা ওই মেয়ে ছাড়া আর কারো কানে পৌঁছায় না! সেই মেয়ে আমি, আর সেই ফায়ারপ্লেসটা লাভার ফরেষ্ট রেঞ্জ অফিসারের কোয়ার্টারের। জঙ্গলের মাঝে পাহাড়ের এক নির্জন টিলার সেই কোয়ার্টারে বাবা-মা রাণুদিদি আর রত্নবাহাদুরদাজুর সাথে আমার বসবাস। এরা ছাড়া আমার একলা দিনরাতের সঙ্গী - জানলার কাঁচে কুয়াশার প্রলেপ। আঙুল ছোঁয়ালেই তাতে আঁকা যায় ইচ্ছেমতো ছবি। তার ফাঁক দিয়ে লুকোচুরি খেলার মত দেখা যায় আকাশে ওড়া মেঘের সারি। কত পাশ দিয়ে তারা উড়ে যায়। জানলায় বসে মেঘেদের সাথে গল্প করি। প্রশ্ন করি, তারপর ওদের উত্তরটা দি অন্য গলায়। এই খেলা পরেও কতদিন আমার একলা আকাশ ভরিয়ে দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।

আর একটু বড় হতে নতুন এক খেলা শুরু হলপাহাড়ে মাঝে মাঝেই মেঘ ভেসে আসে এ পাহাড় ও পাহাড় ডিঙিয়ে। তাই দেখে ছুটতে ছুটতে মেঘের আগেই বাড়ী ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিই এক লাফ। ই য়া য়া, আমায় ধরতে পারে না!! আরে আমাকে কব্জা করা কি অতই সোজা ! কিন্তু মেঘেরা সব গেল কোথায়? কতদূরে পৌঁছাল, দেখতে গিয়ে যেই জানলা খুলেছি অমনি তারা হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে। ভিজিয়ে দিল রোদ্দুরে গরম করে রাখা বিছানা, তোষক, বালিশ। ধরা পড়ে আমি জবুথবু। মা চেঁচাচ্ছে , সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাণু ভুটিয়া। পাহাড়ী শীতের বিকেলে বিছানা স্যাঁতসেতে করে ছেড়েছি যে।

প্রায়ই করি। মেঘ ভেসে আসছে দেখলেই রেস লাগাই। মেঘ ধরে ফেললে ভিজে ভিজে জামা, গা। আর যেদিন জিতি সেদিন জানলা খুলে দেখতে গেলেই ---। বকতে বকতে রাণুদিদি কড়াই করে কাঠকয়লার আগুন এনে রাখল খাটের তলায়।

শীতের দুপুর গড়াত না গড়াতেই সন্ধ্যে। বিকেলটা কখন ঝুপ করে নেমে পালিয়ে যায়, বোঝা যায় না। দিনে জড়ো করা ধুবি গাছের শুকনো ডালপালা ফায়ার প্লেসে সাজান। রত্নবাহাদুরদাজু  এসে জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। বাবা পেট্রোম্যাক্সে পাম্প করে আলোর তীব্রতা ঠিক করছে।আমার পড়ার ইচ্ছে নেই আদৌ। ফায়ারপ্লেসের সামনে পা ছড়িয়ে বসে আছি। পড়তে বসলেই আমার ভীষণ পা-হাত ব্যথা করতে থাকে। রাণুদিদি প্রায় আমায় কোলে বসিয়ে করুণ মুখে আমার হাত পা টিপে দিচ্ছে। বাবা “পড়তে বসো” না বললেই ওই মুখ উজ্জ্বল হয়ে গল্প বলবে।

‘ সেই কবে যেন এক দুষ্টু পাহাড়ী ছেলে সন্ধের মুখে জঙ্গল পেরিয়ে তার মামাবাড়ী যাচ্ছিল। কি করে যেন পথ ভুল করে সে অন্য অন্য গ্রামে পৌঁছে গেল – কিন্তু কিছুতেই নিজের গাঁয়ে ফিরতে পারল না। এমনি করতে করতে সে যে কোথায় চলে গেল,- আর তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না।‘ 

রাণুদিদির গল্পের ছেলেটি আমার চোখের সামনে ছবি হয়ে ফুটে ওঠে। লাল টুপি নীল সোয়েটার পরে ক্লান্ত মুখে সে শুধুই হেঁটে যায় –  এ জঙ্গল ও জঙ্গল, এই গাঁ ওই গাঁ পেরিয়ে বাড়ীর খোঁজে চলা তার আর শেষ হয় না। হারিকেন জ্বলা ঘরে তার মা পথ চেয়ে থাকে, আমার চোখের জল বাধা মানে না।

এরই মধ্যে রত্নবাহাদুরদাজু রাতের খাবার এনে হাজির করে। রুটি আর মুরগীর ঝোল। বাবার কোল ঘেঁসে বসি। বাবা নিজেও খায় আমাকেও খাওয়ায়। জুলজুলে চোখে মাকে দেখতে দেখতে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, একা একা জঙ্গল পার হবো না কোনদিন। রাতে লেপমুড়ি গুড়িশুড়ি – মা বলল চিনিমামা আসছে। কি মজা, কি মজা।

মামা এল দুদিন বাদে। তার বাক্স থেকে বের হল মিষ্টি। তাতে একরাশ পিঁপড়ে। মামা চটে লাল –‘দিদি, এই যে বললে তোমাদের এখানে পোকা নেই?জামাইবাবুর মুখে মুচকি হাসি – ‘তাকিয়ে দেখ’। এ বাবা, সন্দেশের উপর পিঁপড়ে গুলো পুটপুটিয়ে মরে গেল ঠাণ্ডায়। সেই প্রথম মৃত্যু দেখা – তাও আবার মৃত্যুমিছিল! গলাটা বিনা কাশিতেই ব্যথা করে উঠল। তারপরেই বাক্স থেকে বের হল বেগুন!!!

  মামা কেন যে সব ছেড়ে আমাদের জন্য বেগুন আনতে গেল, জানিনা। হয়ত পাহাড়ে তখন স্কোয়াশ আর আলু ছাড়া কিছু পাওয়া যেত না বলেই। সে কারণ যাই হোক, সেই আমার প্রথম বেগুনপোড়া খাওয়া। আজও মনে আছে গন্ধ শোঁকার জন্য পোড়া বেগুনের বোঁটাগুলো জমিয়ে রেখেছিলাম বেশ কিছুদিন। সেই বেগুনবোঁটার গন্ধওয়ালা শীতকাল আজও আমার মন ছেয়ে আছে।

মাঝে মাঝে যাই কিছু দূরের এক ভূটিয়া পরিবারে। সেখানে কমবয়সী ছেলেমেয়ে ছিল দুয়েকটি। এই জনহীন জঙ্গলে তারা কেন বাসা বেঁধেছিল জানিনা। সেখানে গেলে আম্মা আমায় না খাইয়ে ছাড়ত না।তাই মা আমায় ঘন ঘন সেখানে যেতে দিতে চাইত না। এখন বুঝি একটি অতিরিক্ত পেট ভরান সেই দরিদ্র পরিবারের কাছে সহজ ছিল না। কিন্তু প্রবল স্বাভিমানী আম্মাকে সেকথা বলবে কে! পুজোর ছুটিতে কলকাতা গেলে অবশ্য অনেক মানুষের মুখ দেখতে পাওয়া যেত।     

No comments: