কেন যে ছাই মাথায় অঙ্কটা ঢোকে না কিছুতেই?
প্রায় পৌনে ঘণ্টা ধস্তাধস্তির নেট ফল হলো বাবার চেয়ে ছেলের বয়েস দশ বছর বেশি! রাগের
চোটে মাথার চুলগুলোকে উপড়ে ফেলতে ইচ্ছে
করছে শিবানীর। এই অঙ্কটা বিকেলে ওই গুণধরকে দেখাতে হবে ভেবে রাগটা আরও একমাত্রা বেশি।
নয় নয় করে চোদ্দ বছর বয়েস হলো শিবানীর। ইন্দ্রনাথের দৃষ্টির ওই অপরিসীম
তাচ্ছিল্যটা সে ভালোই বুঝতে পারে। সে জানে অঙ্কটা দেখে চশমার ওপারের ঝকঝকে চোখদুটো
কিছুক্ষণ খাতার পাতায় স্থির থাকবে। তারপর ঠোঁটের কোণে আসি আসি হাসির ভাবটা মুছে
ফেলে ঘটা করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রায়
বিড়বিড় করে বলবে – এই মা কালীর মতো চুলগুলো একটু কম দিয়ে সে জায়গায় একটু ঘিলু যদি
দিতেন ভগবান....
শিবানীর তখন ইচ্ছে করে ওই বিদ্যের জাহাজ ছেলে
মুণ্ডুটা ধরে দেওয়ালে আচ্ছা করে ঠুকে দেয়। কিন্তু সেরকম কিছু করলে নিজের পিঠের
ছালও যে আস্ত থাকবে না, সেটাও ভালোমতো জানে। এই ইন্দ্রনাথ রায় এ পাড়ার, বিশেষ করে
এ বাড়ির নয়নমণি। তার উপর মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করেছে! অঙ্কে একশোয় একশো পেয়ে ধরাকে
সরা ভাবে এখন। এমনকি এই যে ঠাম্মার মতো মানুষ, যে নাকি শিবি জ্বরের ওপর কুলের আচার
চাইলেও মানা করতে পারে না, দিয়ে ফেলে মায়ের কাছে বকুনি খায় – শিবানীর সমস্ত আদর
আবদারের ভাঁড়ার, সে পর্যন্ত ইন্দির বলতে অজ্ঞান! নয়তো সে চেষ্টাই কি আর করেনি
শিবানী? কিন্তু ইন্দ্রদার কাছে পড়বো না বলতে সেই ঠাম্মাও ফোকলা হেসে বললো – অঙ্কে পাস করতে না
পারলে সে যে খুব লজ্জার কথা হবে দিদিভাই? মাধ্যমিকটা পর্যন্তই তো ব্যাপার। আর
ইন্দিরের মতো ছেলে যখন নিজে থেকে...
মনে মনে ভেঙচি কেটে দুদ্দাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে
নেমে এসেছিল শিবানী। নিজে থেকেই বটে! তাও যদি নিজের কানে বাবার সঙ্গে ইন্দ্রদার
কথাবার্তা না শুনত! নাইনের হাফ-ইয়ার্লিতে অঙ্কে মোটে তিরিশ পেয়েছে বলে বাবার
দুশ্চিন্তার কথা শুনে বদমাশটা হাসতে হাসতেই বলেছিল – এতো চিন্তা করো না জেঠু, আমি শিবিকে
দেখিয়ে দেব ‘খন।
বাবা খুশির সাথে সাথে ব্যস্তও হয়েছিল – আরে না,
না। তোমার সামনে বারো ক্লাসের পরীক্ষা। কতো চাপ। না বাবা, আমি বরং দেখি....
মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ওই ছেলে ফরফরিয়ে বলে বসেছিল
– এতো চাপ নিও না তো! আমায় তো সারাদিনই প্রায় বই মুখে করে বসে থাকতে হয়। এটা বরং
একটা কমিক রিলিফের কাজ করবে। তুমি ভেবো না, আমি হপ্তায় তিন-চারদিন বিকেলে ওকে একটু
দেখিয়ে দেব।
কমিক রিলিফ! দাঁত কিড়মিড় করতে করতে শিবানী
ভেবেছিল, বাবা নিশ্চয়ই এবার ওকে ঘাড় ধরে বের করে দেবে। ওমা! –“তুমি দেখালে তো আমি
বেঁচে যাই” – এই কথাটা যে হাসিমুখে বললো, সে কি ওর বাবা!
সেই শুরু। অসহায় রাগে নিজের মাথার চুলগুলোকেই
টানতে থাকে শিবানী। ইন্দ্র না ইন্দির। ইন্দির না পিন্দির। পিন্দির নাকি পিরান্হা!
বাঃ! সোজা হয়ে বসল এবার। বেশ নাম পাওয়া গেছে
তো? একদম লাগসই। যেমন ক্যাটকেটে কথা দিয়ে কামড় বসায়! হেসে ফেললে আর রাগ বা টেনশন
থাকে না। শিবানী ফিকফিকিয়ে হাসতে হাসতে চলল দিদিভাইয়ের সঙ্গে নতুন নামকরণটা শেয়ার
করতে।
দিন সাতেক পর। টু এক্স প্লাস থ্রী ওয়াই ইজ
ইক্যুয়ালটু....... নিয়ে শিবানী যখন নাকের জলে চোখের জলে হচ্ছে, তখন টেবিলের ওপার
থেকে একটা নিরীহ প্রশ্ন ভেসে এল – পিরান্হা মাছ কাকে বলে?
দিদিভাইয়ের বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি কি দেওয়া
যায়, সেটা পরে ভাবলেও চলবে। আপাততঃ এই বিদ্যের জাহাজের মুখ বন্ধ করা জরুরি। শিবানী
তাই সাদাসাপ্টা মুখে পিরান্হা মাছের উপর একটা লেকচার দিয়ে ফেলল। এসবে তার জুড়ি নেই
সেটা এই জাহাজ বাদে সব্বাই জানে। তার কথা শুনতে শুনতে সামনের জনের অভিব্যক্তি একটু
একটু করে বদলে যাচ্ছিল। তাই দেখে মজা পাচ্ছিল শিবানী, আর, আরও ভালো করে গুছিয়ে
বলছিল।
বলা শেষ হতে ইন্দ্রের অবাকভাবটা চোখে পড়ার মতো –
তুই তো অনেক খবর রাখিস শিবি।একদম পারফেক্ট বললি। আমি
ভাবতাম........
এমন সুযোগ ছেড়ে দেবে, এমন পাত্র শিবানী নয়। সহজ
মুখেই জবাব দিল – হাজার একটা বিষয়ের মধ্যে অঙ্ক একটা। দৈনন্দিন জীবনে থ্রী আরের
বেশি লাগে না। তবু এটাকেই একমাত্র যারা ভাবে, তারা......
থেমে গেল। তীরটা ঠিক জায়গাতেই লেগেছে। মুখ লাল
করে উঠে গেল বিশ্বপাকাটা। শিবানী দৌড়ে গিয়ে দিদিভাইকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে তিনপাক
নেচে নিল। উচ্ছ্বাসের প্রথম পর্ব মিটলে একটু সংশয়। এরপর ওই ছেলে যদি পড়াতে না আসে,
তখন কারণ জানাজানি হবেই। আর তখন মায়ের যে রুদ্রমূর্তি দেখা যাবে, সেটা ভেবেই মুখ
শুকিয়ে আমসি।
বাস্তবে কিন্তু সেরকম কিছু ঘটলো না। নিয়মমাফিক
একদিন পরেই পড়াতে এল ইন্দ্র। শিবানী নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল। তবু এরপর থেকে সে যখন
অঙ্ক করত, তখন ওই ছেলের দৃষ্টি যে তার মুখের ওপরেই আটকে আছে – সেটা টের পেত। আগেও
দেখত বটে, কিন্তু এই দুই দৃষ্টির মধ্যে একটা তফাত যেন টের পায় শিবানী। আজকাল অঙ্কটাও
একটু দরদ দিয়ে বোঝায়। এটুকুও বাড়তি পাওনা। বোঝানোর গুণেই হয়তো অঙ্কটা এখন আর অত
বিচ্ছিরি লাগে না।
তবু টেস্ট পরীক্ষার পরে শিবানী একদিন নিজে
থেকেই বলল – ইন্দ্রদা,
তুমি যা শিখিয়েছ, তাতে আমি ঠিক অঙ্কে পাস করে যাব। তোমারও তো সামনে পরীক্ষা। এখানে
সময় নষ্ট করলে তোমার পড়ার ক্ষতি হবে।
-
না এলে আরও বেশি ক্ষতি
হবে। সারাদিন পড়া মাথায় ঢুকবে না।
গম্ভীর মুখের এই জবাব
শুনে শিবানীর হাঁকপাক দশা। কি বলল বুঝতে খানিকটা সময় লাগল। যা শুনল, তার সাদা অর্থ হলো তাকে না
দেখলে আরেকজনের পড়ায় মন বসবে না! বোঝার পরেই নাক কান মুখ
টকটকে লাল। তারিয়ে তারিয়ে দৃশ্যটা দেখছিল ইন্দ্র। তারপর – মাথায় যে গোবর পোরা
বলতাম, নেহাৎ ভুল বলতাম না দেখছি। বলেই মাথায় হালকা একটা চাঁটি মেরে তিন লাফে
সিঁড়ি টপকে পগার পার।
আর এই তিন সেকেন্ডে
শিবানী হঠৎ করে বড় হয়ে গেল।
ফল বের হলে দেখা গেল
দুজনেই দুজনের আশানুরূপ ভালো ফল করেছে। শিবানীর রেজাল্টের পিছনে ইন্দ্রের অবদানের
কথা সবাই জানল। কিন্তু ইন্দ্র যে কার প্রেরণায় নিজেকেও টপকে গেল, সে খবর রইলো শুধু
দুজনের মধ্যে।
দিন কাটতে থাকে।
ছুটিতে ইন্দ্র বাড়ি এলে ওরা একটা নির্জন অবকাশ খুঁজে নেয় নিজেদের একান্ত
নির্জনতাকে ছুটি দিতে। নিজের পছন্দের বিষয় পেয়ে শিবানীও এখন ভারি খুশি। যত জানে তত ভালো লাগে। সেই ভালোলাগাও ভাগ করে নেয়
ইন্দ্রের সঙ্গে। সস্নেহ প্রশ্রয়ে ইন্দ্র শোনে। নিজের কথা বলে। দুজনের কথায়, আদরে
সময় কোনখান দিয়ে পেরিয়ে যায় কারোরই হিসেব থাকে না। বাড়িতেও জানাজানি হয়ে গেছে।
বাড়ির লোকেরও আপত্তি নেই। কথা হয়ে আছে দুজনের পড়াশোনা শেষ হলে চার হাত এক করে
দেওয়া হবে।
সময়ের নদীতে আরও কিছু
নুড়ি গড়িয়ে যায়। মিত্তির বাড়িতে আজ উৎসব। শিবানী আজ ডক্টর শিবানী। তার সামনে এক
নামী কলেজের অধ্যাপনা আর পোস্ট ডক করার অফার রয়েছে। দুই বাড়ির মিলিত আনন্দ আজ আর
বাঁধ মানছে না। সব শেষ হলে শিবানী রাতে ঘরে গিয়ে দরজা দেয়। মুঠোফোনে তখন একটা
প্রিয় নাম। সেই নামধারীর এখন দিন। বেশ কিছু বছর সে উচ্চশিক্ষা আর অভিজ্ঞতা অর্জনের
জন্য পৃথিবীর অন্য প্রান্তের বাসিন্দা। ইচ্ছে করেই সারাদিন কোন খবর দেয়নি। এখন
একসাথে সারাদিনের খবর জানানোর জন্য নেট অন করল। ইন্দ্রের ব্যাকুল মুখ ভেসে উঠল
পর্দায় – কোথায় ছিলি শিবি, এই ক’দিন?
-
হুঁ হুঁ বাবা, কত্তো
খবর জমালাম বলে এই ক’দিনে। অনেকগুলো ভালো খবর আছে।
-
সারপ্রাইজ? বলে ফেল
চটপট।
-
পোসট ডক আর চাকরির
অফার একসাথে পেয়েছি।
-
মানে ডক্টরেট হয়ে
গেছে? আর আমি কিছুই জানিনা?
-
তোমার এই মুখটা দেখব
বলেই তো......
-
..........
-
তাহলে এবার বাড়িতে বলি
তোর জন্য বেনারসী কিনতে?
-
তুমি কবে আসছ?
-
বিয়ের ডেট ঠিক হলেই
চলে আসব। তারপর তোর ভিসা টিকিট সব করে ফেলব। তারপর ভুউউউউম........
-
বাপরে কী তাড়া! তারপর
আমরা ফিরব কবে? মানে সেই বুঝে আমার নেক্সট প্রোগ্রাম....
-
ফেরার কথা আসছে
কোত্থেকে? তুই এক’দিন ফোন ধরছিলি না বলে বলতে পারিনি। একটা দারুণ চাকরির অফার
পেয়েছি। আমার স্বপ্নের কোম্পানীতে। গ্রীন কার্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করেছি। বাড়িতে মা
একটু হল্লা করবে অবশ্য। সেটা একটু
সামলে নিস প্লিজ।
-
......
-
কি রে?
-
.....
-
কিছু বলছিস না কেন?
-
তুমি আর ফিরবে না ইন্দ্র?
-
কি শুনলি এতক্ষণ ধরে?
-
আমার পড়াশোনা? আমার
কেরিয়ার?
-
ওহো! তুই এখনো সেই
ছেলেমানুষই রয়ে গেলি। বুঝতে পারছিস কতো ডলার মাইনে হবে আমার? তোর চাকরি করার
দরকারই পড়বে না। ছুটিতে কতো কতো দেশ ঘুরতে পারবো জানিস? এই চাকরি কেউ ছাড়ে? তুইই
বল?
-
আমায় একটু সময় দেবে?
ফোনটা কেটে অবশ হয়ে
বসে থাকে শিবানী। তার এতো দিনের পরিশ্রমের, এতো ভালোবাসার পড়াশোনা, তিল তিল করে
গড়ে তোলা সাফল্য সব যেন কুয়াশার আড়ালে আবছা হয়ে যেতে থাকে। অপরদিকে ইন্দ্রের
মুখটাই কি খুব উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয়? তাও তো নয়! বুঝতে পারছে শিবানী, আজ তাকে
দুটোর মধ্যে একটা বেছে নিতে হবে। দুটোই তার পরানপ্রিয়। অথচ হঠাৎ করে কোন আগাম
পূর্বাভাস ছাড়াই তারা একশ আশি ডিগ্রী ঘুরে বিপরীতমুখী হয়ে দাঁড়ালো! সে জানে আজ যদি
সে ইন্দ্রের কথায় হ্যাঁ বলতে পারে, তাহলে দুই বাড়িতে উৎসব শুরু হবে। কিন্তু তা হবে
তার সারা জীবনের সাধনার স্বীকৃতির মূল্যে। অথচ এই মূল্য যার পায়ে অঞ্জলি দেবে তার
কাছে তো এর কোনো দামই নেই। তার কাছে তো এ শুধু দিনযাপনের বেলা কাটানোর খেলা। এই
অবমাননা নিয়ে সারাজীবন চলতে পারবে তো ডক্টর শিবানী রায়?
শিবানী জানে কাল এই সময় আবার ফোন বাজবে। কিন্তু
কি বলবে ও? ভাবতেই থাকে শিবানী। একলা ঘরে চোখের জলে ভেসে ভাবতেই থাকে শিবি – ডক্টর
শিবানী রায়।
No comments:
Post a Comment