Thursday, April 18, 2019

সংঘাত


অনেকদিন মানে প্রায় অর্ধশতাব্দীর ওপারের এক শীতের সকাল। হিমেল হাওয়ায় গাছের পাতাথেকে শিশির ঝরে পড়ছে – টুপ্ টাপ্ টুপ্ টাপ্পাখিরা সব ঘুম থেকে উঠে পোকামাকড়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে। রোদের ওম গায়ে জড়িয়ে আরাম করার জো নেই তাদের। ভোরের লাল রঙ ছেড়ে সুজ্যিঠাকুরের রঙ এখন নরম সোনালি। একটু পরে আলো রূপোলি হয়ে গেলেই সে বনের পাতাদের ফাঁক গলে নেমে এসে মাটিতে সুন্দর আলোছায়ার আলপনা তৈরি করবে। তারপরে এই শিশিরে ভেজা মাটি, ঝরাপাতার দল দিব্বি গা শুকিয়ে খটখটে হয়ে উঠবে। তখন এই পথ দিয়ে কেউ চললেই মচ মচ আওয়াজ উঠবে।


কিন্তু তার আগে তরাইয়ের এই বনভূমি ভারি শান্ত, নিস্তব্ধ এখন শুধুই গাছ থেকে জল পড়ার শব্দ, নদীর ঝিরঝির আওয়াজ আর ঘাসবনের সামান্য সরসরানি – ব্যস, আর কিচ্ছুটি নয়।

এই অঞ্চলের বনও তেমন ঘন নয়। কিছুটা গাছপালা, কিছুটা ঘাসজমি, কিছুটা ডোবা – হাতি, গণ্ডার, বাইসনের দল বেশ আরাম করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করে। চট করে কেউ কারো এলাকায় নাক গলায় না। দু-চারটে বাঘও আসে মাঝে মধ্যে। তখন শুধু একটু বেশি সতর্কতা বজায় রাখতে হয়। তা এই বনের পাখি, খরগোস বনমোরগেরা খুব ভালো। তারা আগেভাগেই হুঁশিয়ারি দিয়ে দেয়। তাই বলে দু-একটা দুর্ঘটনা কি আর ঘটে না? তবে জঙ্গলে থাকতে গেলে ওসব নিয়ে ভাবলে চলে না। আরে বাবা বাঘটাকেও তো খেয়ে পরে বাঁচতে হবে, না কি? মোটের উপর শান্তিতেই আছে সবাই। মাঝে মাঝে কিছু দুপেয়ে এসে হাজির হয়। তারা ওদের জন্য মাটিতে নুন মাখিয়ে ঢিবি বানিয়ে দেয়। তাদের সঙ্গে কিছু হাতিও থাকে অবিশ্যি। তাদের আচার আচরণ জঙ্গলের হাতিদের সঙ্গে মেলে না। তাই বুনো হাতিরাও ওদের এড়িয়ে চলে।

সে যাই হোক, কথা হচ্ছিল আজকের সকালটা নিয়ে। আজ এই সোনালি সকালে বড়কা হেলে দুলে নদীর দিকে চলেছে। ওপারের ঘাসজমিতে অনেকদিন যাওয়া হয়নি। এপারটা তার মুখস্ত হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে এলাকা না বদলালে ওর ভালো লাগে না। নদীর ওপারে বালু পেরোলেই ঘাসজমি। তাতে শিশির পড়ে হীরের ঝিলিক। বড়কার মন প্রসন্ন হয়ে উঠল। নাকের উপরে তার সবেধন নীলমণি খাঁড়াটা সে একবার গাছের গায়ে ঘসে নিল।

তার মোটা চামড়া ভেদ করে শীত কামড় বসাতে পারে না। কিন্তু এই শীতের ভোরে তার নদীর জলে পা ভেজাতেও ইচ্ছে করল না।  একটা বড় গাছ কবে যেন নদীর উপর পড়ে দুই তীরকে জুড়ে দিয়েছে। বড়কা তার উপর দিয়ে পার হতে শুরু করল।

সেতুর উপর দিয়ে দু চার পা এগোতেই বিপত্তি। উলটোদিক দিয়ে একই সময়ে আরেকজন আসছে যে! কিশোর বয়েস, তারই স্বজাতি। হালকা আওয়াজ দিলো বড়কা। সাধারণতঃ এভাবে মুখোমুখি হয় না ওরা। তবু কখনো যদি এমনটা ঘটে তাহলে ছোটরা বড়দের জায়গা ছেড়ে দেবে – এমনটাই রীতি। মৃদু আওয়াজে বড়কা সেটাই মনে করিয়ে দিল। কিন্তু উল্টোদিকের ছোকরার মোটেই এসব আদবকায়দার জ্ঞানগম্যি নেই। জবাবে রাস্তা ছেড়ে দেওয়া দূরস্থান, সেও জবাবে একটা হাঁকাড় পেড়ে বসল! ছোটেটার এ জাতীয় ব্যবহারে অত্যন্ত বিরক্ত হলো বড়কা। আগেকার দিন হলে ওটাকে আচ্ছা করে পিটিয়ে সহবৎ শিখিয়ে ছাড়ত। কিন্তু দিন দিন যেভাবে ওদের সংখ্যাটা কমে যাচ্ছে, তাতে এরকম কিছু করা ঠিক হবে না। তার উপর কে জানে কেন, আজ তার মনটা খুব খুশি আছে। তাই সে গাছ বা সেতু যাই হোক না কেন, তা থেকে নেমে ছোটুকে পথ ছেড়ে দিল।

ছোটুর ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাপারটা আলাদা। ছোটবেলতেই মা হারিয়ে সে একা একাই বড় হয়ে উঠেছে। এমনিতেই গণ্ডাররা সমাজবদ্ধ জীব নয়। তাই যখন চোরাশিকারীর দল ওর মাকে মেরে ফেললো, তখন ওকে সুরক্ষা দেবার মতো কাকু, মাসি, পিসি – কেউ ছিল না। কাজেই বাঁচার লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য সে ভারি আক্রমণাত্মক প্রকৃতির হয়ে উঠেছে। নিজের চারপাশে সে কাউকে ভিড়তে দেয় না।

এহেন ছোটু যখন সেতুর ওপর উঠে পড়েছে, তখন সেতুর অপরদিকে পূর্ণবয়স্ক গণ্ডারটাকে দেখে সে মোটেও খুশি হয় নি। রাস্তা ছেড়ে দেবে, না কচু! কোথায় ছিল এই বড়কার দল, যখন পুঁচকে ছোটু একটু সঙ্গ, একটু সুরক্ষার জন্য ছটফট করত? সে তাই হেঁ বাকে বলে উঠলো –
-       নিজের রাস্তা মাপ বুড়োআমি মোটেই তোকে রাস্তা ছাড়ছি না।

ছোটু দেখল তার হুঙ্কারে ভয় পেয়ে বড়কা সেতু থেকে নেমে একদিকে সরে গেল। সে মনে মনে বেশ খুশি হলো। বীরদর্পে গটগটিয়ে পার হয়ে এপারে এসে গর্বোদ্ধত ভাবে বড়কার দিকে চাইল।

বড়কাও এতক্ষণ ছোটুকেই দেখছিল। কিশোর ছেলেটির ঔদ্ধত্যময় চলাটাকে বেশ সস্নেহ কৌতুকেই দেখছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।এবার সে সেতু পার হবার জন্য তৈরি হল। কিন্তু ছোটুর অভিধানে তো স্নেহ, ভালোবাসা শব্দগুলোই নেই। সে দেখলো বুড়োটা তাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে নিজের রাস্তায় রওনা দিয়েছে। ভয়ানক রাগ হয়ে গেল ছোটুর। দু পা পিছিয়ে এসে মাথা নীচু করে এক দৌড়ে বড়কাকে এক ঢুঁ কষিয়ে দিল। অভিজ্ঞ বড়কার চোখ অনেক তীক্ষ্ণ। ছোটুর আচরণের পরিবর্তন সে আগেই খেয়াল করেছে। কাজেই তার বিশেষ আঘাত লাগলো না। কিন্তু এবার তার ভীষণ রাগ হয়ে গেল। তার মনে হলো এই বাঁদরটাকে একটু শিক্ষা না দিলে আর চলছে না!

অতএব....... শুরু হয়ে গেল মরণপণ লড়াই। ছোটু পালিয়ে গেলে কী হতো বলা যায় না। কিন্তু সেও ভারি গোঁয়ার। গণ্ডারের গোঁ যাকে বলে! কাজেই লড়াই জারি রইলো। দুজনেই অমিত বলশালী। ছোটুর ক্ষিপ্রতা বেশি, আর বড়কার অভিজ্ঞতা।

আসেপাশের গাছেরা কেঁপে উঠলো। থেঁতলে গেল ঘাসের দল। বুনো লতার ঝোপের দুমড়ে মুচড়ে গেল। পায়ের ঘষায় যে ধুলোর ঝড় উঠে দুজনকেই আড়াল করে ফেলল।

খবর চলে গেল বনের অফিসে। একজন গার্ড ঘটনাটা দেখেছিল। সেই ছুটতে ছুটতে এল। রেঞ্জারবাবু খেতে বসেছিলেন সবে। এমন বিচিত্র খবর পেয়ে খাওয়া মাথায় উঠলো। এনডেঞ্জারড স্পিসিস বলে কথা! দু দুটো গণ্ডার! তাদের কিছুতেই এভাবে মরতে দেওয়া যায় না। তিনি বন্দুক ঘাড়ে ছুটলেন। সঙ্গে চলল তাঁর বনকর্মীর দল – টিন আর ক্যানেস্তারা সঙ্গে নিয়ে।

ঘুমপাড়ানী গুলি তখন রেঞ্জারবাবুদের কাছে থাকতো না। এখনকার খবর জানিনা। অবশ্য থেকেও কতোটা লাভ হতো বলা মুশকিল। রণোন্মত্ত গণ্ডারের দুই চোখের ফাঁক দেখা সম্ভব না। আর অন্য জায়গায় লাগলে ওই বর্মের মতো চামড়া গুলিকে ছিটকে বার করে দেবে। অতএব একমাত্র উপায় শব্দব্রহ্ম। বাজাও কাড়ানাকাড়া, শূন্যে গুলি ছোঁড়ো, শুকনো ঘাসে লাগিয়ে দাও আগুন। তাতে যদি ভয পেয়ে দুজন দুদিকে পালিয়ে যায়, তাহলেই শান্তি। এই কাজে বিপদ আছে। অতি গুরুতর বিপদ। ওরা রেগে গিয়ে মানুষ তাড়া করলেই চিত্তির। কিন্তু সেসব ভাবনার সময় এটা নয়।

কিছুতেই কিছু হলো না।বড়কা আর ছোটুর লড়াই চলতেই থাকল। খুব বিরক্ত হলে লড়তে লড়তেই জায়গা বদল করে নিচ্ছিল দুজনে।তা এইভাবে সরতে সরতে এই রেঞ্জারবাবুর সীমানা পার। দিনের শেষ কপালের ঘাম মুছে পরের রেঞ্জে খবর পাঠালেন। এবার বিটিংয়ের দায়িত্ব তাদের।এমনি করে সেই ভয়ংকর লড়াই চলতে থাকল। বনকর্মীদের নাওয়া খাওয়া ঘুম সব উড়ে গেল। গণ্ডারেরা লড়তে লড়তে এর সীমানা থেকে ওর, ওর থেকে আবার এর সীমানায় ঢুকে লড়াই করতেই থাকল। একদিন গেল, দুদিন গেল – দুজনেই আহত হয়েছে ভালোভাবে। কিন্তু লড়াই থামেনি। ততদিনে সবাই বুঝে গিয়েছে একজন না মরা অবধি এ লড়াই থামবে না। তবু এই বিপন্ন প্রজাতির দুজনকে ফেলে আসেই বা কি করে? নিষ্ফল জেনেও বনকর্মীদের লড়াই থামানোর প্রচেষ্টা জারি রইল। লড়াই শেষে বিজয়ীকে অন্ততঃ বাঁচাবার চেষ্টা তো করতে হবে, নাকি?

তিন দিন তিন রাত্রি  ধরে চলল এই নারকীয় লড়াই। ছোটু আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল। চতুর্থ দিন সকালে সে একেবারে নেতিয়ে পড়ল। বড়কা তাকে ঠেলতে ঠেলতে একটা গাছের গোড়ায় এনে রাখল। তারপর কিছুটা পিছিয়ে গেল। কেউ কিছু বোঝার আগেই সে তীরবেগে এসে নাকের খাঁড়াটা ছোটুর পেটে ঢুকিয়ে দিল। পেট চিরে ওপরে উঠে এলো খাঁড়াটা।  বড়কা নিজেও এবার টলতে টলতে ফিরে চলল। তারও এবার বিশ্রামের খুব প্রয়োজন। যাবার আগে একবার ফিরে দেখল ছোটুকে।

ছোটুর ক্লান্ত কিশোর মুখটা দেখে তার কি মনে হলো কে জানে? হঠাৎ সে ফিরে এলো ছোটুর কাছে। ওর মুখের কাছে নাকটা এনে ঘষে দিলো একবার। বোধহয় বলতে চাইল – কেন এমন করলি ছোটু? আমি তো তোকে মারতে চাইনি।

তারপর সে সেখানে মলমূত্র ছড়িয়ে এলাকা দখলের নিশান পুঁতলো। এটাও তার জিনের আদেশ। একে আমান্য করা তার সাধ্যাতীত। তারপর মাথা নীচু করে ধীর, ক্লান্ত পায়ে জঙ্গলের ভিতরে হারিয়ে গেল একটি দুঃখী গণ্ডার।

No comments: