Friday, May 10, 2019

অথ-কুটু-চরিতকথা


কুটু মাহাত ভারী মুস্কিলে পড়েছে। অনেকদিনের সরকারি চাকুরেবেলপাহাড়ীর রেঞ্জ অফিসারের আর্দালী সে। তা কত বড়বাবুই তো আসে যায়; কুটু সবার কাছেই কাজ করে। কিন্তু কই, এমন ফ্যাসাদে তো কেউ ফেলেনি তাকে!
বেচারী পড়াশোনা জানেনা, শেখার ইচ্ছেও নেই। মাস গেলে মাইনে পায়বেশ শান্তিতেই ছিল এযাবৎ। কিন্তু এই নতুন বাবুটা পারমিন্ট হতে হবে বলে একটাফরমতাকে ধরিয়ে দিয়ে বলেছে ভরে আনতে। বাবুকে একটু ভয়ই পায় কুটু, গম্ভীর চোখ তুলে অত্যন্ত নীচু গলায় কথা বলে যখন, বাক্যবাগীশ কুটুর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না মোটে।

 তা গার্ড বিজনদাদার বিদ্যে কেলাস নাইন। ফর্ম নিয়ে তার কাছেই গেল কুটু। নাম, ঠিকানা অবধি ঠিকই চলছিল, গোল বাঁধল বয়েসে এসে। বয়েস কি গোনার জিনিস নাকি? - তুয়াদের দ্বারা কিছুটি হবেক লাই - বলে রেগেমেগে মায়ের কাছে ফরমখানি নিয়ে হাজিরা দিল সে। বাবুকে ভয় পেলে কি হবে, এই দুর্গাঠাকুরের মত মার উপর তার ভারী ভরসা। যাই ঘটুক না কেন, মার কাছে একবার এসে পড়লেই সব ঠিক হয়ে যাবে, -জাতীয় একটা ভাবনা তার আছে। অনেক বড়বাবু-বড়মা পার করেছে কুটু তার চাকরিজীবনে, কিন্তু এমন শুধুই মা পাওয়া হয়নি আগে কখনো শুধু কি তাই? মার যে একটিছুট ছিলাআছে নাসাদা রং, লাল টুকটুকে ঠোঁট, রোগা-পাতলা একটুখানি? তাকে দেখলেই নি:সন্তান লোকটির বুক বাৎসল্যে লাবডুব তাকে ডাকে ভাই বলে আর ভাইটিরও দাদা-অন্ত প্রাণ। তা এই দু তিন মাসেই কুটু এই পরিবারের একজন হয়ে গেল।

  কিন্তু ফরম? সে তো ভরতেই হবে। মা কলম হাতে ফর্ম ভরতে বসলেন,
-        - কবে থেকে চাকরি করছ বলতে পারবে?
-      কেনে পারবক লাই, সেই যখন এত্তটুকুটি থিলি, বাগালি করথি, তখন খিসা সাহেব আমাকে ডাইক্যে বুলল, - কুচু কুচু, চাকরি কইরবি? - তা সেই থিক্যে
 হাত দিয়ে কত্তোটুকুটি ছিল, সে উচ্চতাটাও দেখিয়ে দেয়।

 তা যতই হাসুক মা, ফরমটা ভরে দিল তো! কিন্তু মুস্কিল হল, ভাই গেল খেপে।
-       কুটুদা, তুমি পড়তে জাননা? তোমায় শিখতেই হবে
-       হঁ হঁ শিখবো - বলে পাশ কাটায় কুটু হলে হবে কি, গুরু নাছোড়বান্দা। শ্লেট-পেন্সিল নিয়ে পিছু পিছু ঘোরে, বেচারী পালিয়েই বা যায় কোথায়? কাজের জন্য তাকে যে সারাদিন বড়বাবুর বাড়ী থাকতেই হয়। খেতে বসেও শান্তি নেই, গুরু দেখাচ্ছে -

 - বল  
 - হঁ, হঁ, বর্ণমালার সবকটি অক্ষরই হঁ-তে এসে থামে। তবু কয়েক মাসের চেষ্টায় সে লিখতে শিখলকট মাহাত। -কারটা শেষ অবধি আর হল না। তাতেও কুটুর ভারী অশান্তি। ভাই বলেছে, কেউ যদি দুটো দাগ দিয়ে দেয়, তাহলে ওর নাম কাটা হয়ে যাবে। আর নাম কাটা হলে যে চাকরী থাকে না, তা সে বিলক্ষণ জানে। তবু ভয়ে ভয়ে খাতাতে নাম সই- করে, টিপছাপ দেওয়ার সাহস হয় না। ভাই জানতে পারলে কুরুক্ষেত্র বাঁধাবে।

 ভাইয়ের জন্য অনেক কাজ বেড়ে গেছে কুটুর। স্কুলে যাবার আগে ভাই সামনের মাঠে একটু খেলবেই। সেখান থেকে তাকে কোলপাঁজা করে নিয়ে আসা, দুপুরে কুস্তি, তীর চালানো শেখা বুনও তো আছে একটা, হোটেলে (হোস্টেল) থাকে, তার জন্যও তাকে বাঁশের তীর-ধনুক বানিয়ে রাখতে হয়। ভাই বলেছে তীর চালাতে শিখে গেলে দুজনে মিলে ডাকাতি করতে যাবে। তারই পরিকল্পনায় মেতে থাকে অসমবয়সী দুই বন্ধু। আজকাল তার আর অবসর নেইকো মোটে।

 দিন বেশ ভালই কাটছিল। কিন্তু গোল বাঁধাবার জন্য বাবু আছে না? বলে কিনা ঠিক দশটায় অফিসে চা পৌঁছাতে হবে! আবার মাকে ধরে পড়ে বেচারী – “টুকু ঘড়িটা শিখ্যায়ে দাও কেনে মা বলে, “আচ্ছা, তুমি ঘড়ি দেখে এসে বল কোন কাঁটাটা কোথায় আছে কুটু অনেকক্ষণ ধরে ঠাহর করে ঘড়ি দেখে; এসে রিপোর্ট দেয়, “বড় কাঁটাটা রাগে দৌড়ছে, আর মেজো কাঁটাটা অনেক পরে টুকু টুকু লইড়ছে, আর ছুট কাঁটাটো চান্ মাইরে খাড়ায়ে আছে! এবার কে বলবে বল, কটা বেজেছে! হঁ হঁ বাবা, ‘হামকে সাথে চালাকি?

  নাঃ, তার সাথে চালাকি করে কেউ পার পায় না। সে দোকানীই হোক বা ভাইয়ের মাস্টর (private tutor) মা বলেছে ওমুক জিনিসটার দাম একটাকা চার আনা। পাঁচসিকে বলেছে বলে দোকানীকে সে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। বাড়ীর গার্জেনের পদটা সে নিজেই নিয়ে নিয়েছে। কিছু সমস্যা দেখা দিলেই তাই সমাধানের জন্য তাড়াতাড়ি বুদ্ধি খরচ করতে বসে। তাতে বাড়ীশুদ্ধ লোক চিন্তিত – ‘ কুটু, মাসের প্রথমেই সব বুদ্ধি খরচ করে ফেললে সারা মাস চলবে কি করে? তা বুদ্ধি খরচ করে ভাইয়ের মাস্টর ঠিক করে এল নিজে নিজেই। বিটিছানা হয়ে মা বেচারী আর কত পড়াতে পারে! মাইনেও ঠিক করে এল দরাদরি করেমাসে দশটাকা, কিন্তু চা খেলে আট টাকা। হঁ, হঁ বাবা, হামকে?


 একদিন হন্তদন্ত হয়ে এসে মাকে খবর দিল – “মা, মা, বাবুর ঘরে দুইটা আমেরিকা মা ভ্যাবাচাকা, - কুটু, আমেরিকা তো একটাই জানি, দুটো হল কি করে? ভাই তাড়াতাড়ি এসে টিপ্পনী কাটে, মা, নিশ্চয় উত্তর আর দক্ষিণ আমেরিকার ম্যাপ এনেছে কেউ কুটু এতদিনে ম্যাপ কি বস্তু জানে, সজোরে প্রতিবাদ করে মাপ লয়, মাপ লয়। দুইটা বিটি আমেরিকা বাবুর সামনে বইসে সিকারেট খাইচ্ছে; আমার মোট্টে ভাল জানাইছে না! মা তাড়াতাড়ি কুটুকে চা বানাতে পাঠায়। গজগজ করতে করতে চা বানাতে যায় সে। World Bank এর প্রোজেক্ট পরিদর্শনে এসেছেন দুই শ্বেতাঙ্গিনীআস্ত দুইখান আমেরিকা!


  বুন হোস্টেল থেকে এল টাইফয়েড নিয়ে। পুরো দুমাস বারান্দায় ঘুমালো কুটু। কি জানি কখন কি দরকার পড়ে! কারো সাধ্য হল না তাকে বাড়ী পাঠায়। মা কখনো কোন কাজে বাইরে গেলেও একই রুটিন ছিল তার। বুন ভাল হবার পরে মাঝে মাঝে হোস্টেলে গিয়ে তাকে দেখেও আসত। কড়া শাসনে শাসিত সেই হোস্টেলে একমাত্র তারই ছিল অবাধ গতিবিধি। Visiting day / hour এর কোন পরোয়াই করনেওয়ালা সে নয় দুঁদে মেট্রন তাড়াতাড়ি বুনকে ডেকে দিয়ে নিস্তার পেত।হামকে বলে কথা!


 এভাবেই পাঁচটি প্রাণীর সংসার চলছিল তার আপন ছন্দে। কিন্তু ছয়বছরের মাথায় বদলির হুকুম আসতেই মা-দাদা-ভাইয়ের যৌথ কান্নার বানভাসি।

*****************

বছর কুড়ি পরেকুটু তখন রিটায়ার করে গেছে, খবর পেল মা-বুন-ভাইয়েরা ঝাড়গ্রামে এসেছে। দৌড়ে এল দেখা করতে। ভাই কই, ভাই কই বলে পাড়া মাথায় করলেও ভাইকে দেখে একদম চুপ করে যায় বেচারী। ভাই কোথায়, এ যে বছর তিরিশের এক পূর্ণ যুবক! তার সাথে বলার মতো কোন কথা খুঁজে পায় না কুটু; ভাইয়ের কথার জবাব দিতেও যেন আর ভাল লাগে না শুধু মার সাথে অনেকক্ষণ গল্প করে বসে বসে তবে বুনের বছর দশেকের ছেলেটাকে ভারী ভাল লেগে যায় তার।

 বুন দেখে আর ভাবে, জীবন কি তাহলে আরো একবার কাবুলিওয়ালা লিখে ফেললঅন্য সুরে, অন্য মাত্রায়?

1 comment:

pradipwritenow said...

এইসব লেখা পড়ে কিন্তু আমার ও মইন টা যে ডাকছে দিদেইমনি যে ই রকম একটা পালা আমকেও লিখতে হবেক ই হওঁ। কেনে পাইরব নাই, কতো দিকু আমদের বুলি লিখল আর আমি লাইরব?