ভালোবাসার জন্য কতটা পথ হাঁটা যায়,
পার হওয়া যায় কটা দুস্তর নদী,
আর ডিঙিয়ে যাওয়া যায় উঁচু পাহাড়ের
সারি?
জানা নেই, তবু সেই বিশ্বাসের বীজমন্ত্র
জপতে জপতে মধুজা কাটিয়ে দেয় আরও একটা রাত। এক অসহ শারীরিক, মানসিক যন্ত্রণা ভরা সেই
রাত পার করে একসময় দেখা দেয় পূবের লাল আকাশ। সব যন্ত্রণার অবসান। মধুজা বুঝতে
পারে আরও একটি রাত সে ভালোবাসার নামে
অতিক্রম করে গেল। আর তাই আরও একটি সুন্দর আলোকিত দিন উপহার পেল উদয়ভানুর কাছ থেকে।
সূর্যপ্রণাম সেরে, স্নান করে চিলেকোঠার
ঘর থেকে নীচে নেমে আসে মধুজা। রোহিত এখনো ঘুমোচ্ছে। তার পাশের ঘর থেকে তুলতুলির
আধো আধো স্বর শোনা যাচ্ছে। এক্ষুনি ঘুম জড়ানো চোখে টুকাই বা রূপা কেউ বেরিয়ে এসে
বলবে – এই নাও তোমার নাতনি। কী করে যে টের পায় ওই জানে!
আর অমনি তুলতুলি খিলখিলিয়ে হেসে দুহাত
বাড়িয়ে মধুজার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। দুজনের
আদরের লুটোপুটির মাঝেই তার বাবা বা মা ফিরে যাবে অসমাপ্ত ঘুমটা পুরো করার জন্য।
মধুজা অবশ্য ফিরেও তাকাবে না। ছোট্ট পুতুলটাকে বুকে চেপে বাগানে নেমে আসবে।
এইটুকুর জন্যই তো তার নিজেকে ক্ষয় করে
সারা রাত্রির সাধনা......
*
*
*
এই কাহিনীর শুরু অনেকদিন আগে। গল্পের
নায়ক রোহিত রায়ের বরাবর পাহাড়ে চড়ার নেশা। তা সেবার যাচ্ছিল পিন্ডারি
গ্লেসিয়ার দেখতে। সহজ
ট্রেক। হালকা টানা চড়াই। পাহাড়, ঝরনা,উপত্যকা দেখতে দেখতে পথ চলা। ফুরকিয়া থেকে এক
গিরিশিরা বেয়ে জিরো পয়েন্টের দিকে যাবার সময় দুর্ঘটনাটা ঘটল। পথের বাঁদিকে খাড়া
দেওয়ালের মতো খাদ নেমে গিয়েছে। নীচে কি নদী? বন্ধুর কোন এক রসিকতায় হাসতে হাসতেই
ঝুঁকে দেখতে গেল রোহিত। ভারসাম্য হারিয়ে গড়িয়ে গেল খাদ বেয়ে।
সঙ্গীরা খোঁজ করেছিল। কিছুই খুঁজে
পায়নি। ফিরে এসে সেই খবর দিতে কান্নাকাটির রোল পড়ে গিয়েছিল বাড়িতে।
মরে যাবারই কথা। পাহাড়ে নিখোঁজ
যাত্রীদের লিস্টে আরও একটি নাম জুড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এইসব হিসাব যে
উল্টে দিয়েছিল, তার নাম মধুজা। জ্ঞান ফিরে আসার পরে এক গুহাঘরে এরই মুখ দেখেছে
রোহিত। আর এরই নিঃশব্দ সেবায় দিনে দিনে সুস্থ হয়ে উঠেছে। বনের উদ্ভিদ থেকে ওষুধ
বেছে আনত মধুজা। আনত ফলমূল, ভেড়া বা হরিণের মাংস। বেশ কয়েকমাস লেগেছিল সম্পূর্ণ
সুস্থ হয়ে উঠতে। ততদিনে মধুজা বাংলা শিখে গেছে। আর রোহিতের কৃতজ্ঞতা ও নির্ভরতা
ধীরে ধীরে কখন যে ভালোবাসায় বদলে গেছে তা রোহিত নিজেও জানে না।
শুধু একটা ব্যাপাারই অবাক লাগত
রোহিতের। এই
গুহাঘরের চারপাশে সে আর কোন মানুষের বসতি দেখতে পায়নি। মধুজাকে জিজ্ঞাসা করলে সে
শুধু হাসত। রোহিতের মনে হত কিছু একটা লুকোচ্ছে মধুজা। গোপন করে রাখছে কোন এক অজানা
রহস্য। একদিন বিকেলে কথা বলতে বলতে আবার সেই প্রসঙ্গই ওঠালো রোহিত। মধুজা কেন জানি
আজ আর এড়িয়ে গেল না।
-
বেঁচে উঠেছ, সুস্থ আছ – এটাই ঈশ্বরের আশীর্বাদ
জেনে খুশী থাক। তুমি এখন মোটামুটি ভালো হয়ে গেছ। কয়েকদিন বাদে নিজের লোকজনের কাছে
ফিরে যেও।
-
তবু –
-
সব জানতে নেই।
আর তোমার তো যাবার সময়ও হয়ে এল।
-
না।
-
না মানে?
-
আমি একলা ফিরব
না। তুমিও আমার সঙ্গে যাবে।
বড় ম্লান,
ক্ষীণ শোনাল মধুজার গলা –
-
তা হবার নয়।
-
কেন?
চুপ করে রইল
মধুজা। যেন তার যা বলার ছিল বলা হয়ে গেছে। কিন্তু রোহিত চুপ করল না। তীব্র
উত্তেজনায় মধুজার হাত চেপে ধরল –
-
কেন হবার নয় মধু? আমি কি তবে তোমায় বুঝতে এত ভুল করলাম? তুমি পারবে আমায় ছেড়ে থাকতে?
-
পারব। আমায়
পারতেই হবে।
-
ভালো যদি নাই
বাসো তাহলে এই চোখের জল কেন মধু? বলো আমায়?
-
আমরা কাছে এর
কোন উত্তর নেই। আর কিছুই বলার নেই আমার।
-
তবে আমি বলি।
আমি তোমায় ছেড়ে থাকতে পারব না। হয় তোমাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরব, নয়তো এখানেই থেকে যাব
আজীবন।
স্পষ্টতঃই
শিউরে উঠল মধুজা। ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেল ওর মুখ। নেহাৎ চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে
এসেছে, তাই এই আতঙ্কটা দেখতে পেল না রোহিত। মধুজার শিহরিত হাত তুলে নিয়ে আবেগে
ঠোঁট ছোঁয়াল বরং।
অনেকক্ষণ চুপ
করে বসে রইল দুজনে। তারপর যেন অনেক দূর থেকে মধুজার গলা ভেসে এল –
-
সেদিন তুমি
আমায় গঙ্গা আর শান্তনুর গল্প শুনিয়েছিলে মনে আছে তোমার?
-
হ্যাঁ, কিন্তু
তার সাথে –
-
যদি আমায়
সঙ্গে নিতে হয়, তাহলে তোমাকেও শপথ করতে হবে – আমার অতীতের কোন কথা তুমি জানতে
চাইবে না কখনো। যতই রহস্যময় মনে হোক আমার কিছু আচরণ, তা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবে
না। আজ যদি এই শপথ করো, তাহলে তা কোনদিন কোন লগ্নেই শান্তনুর মতো ভেঙে ফেলবে না।
দুহাতে
মধুজাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে হেসে ওঠে রোহিত –
-
এইমাত্র? আমি
ভাবলাম কি না কি? আরে বাবা, আমি তোমায় ভালবাসি। ইতিহাসকে নয়। পাগল একটা!
এতক্ষণে
রোহিতের বুকের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দিতে দিতে মধুজা বলে –
-
কালকেই রওনা দেব
আমরা। আস্তে আস্তে গেলে লোকালয়ে পৌঁছাতে দু-তিনদিন লাগবে।
সেই শুরু।
তারপর তিরিশ বছর কেটে গেছে। রোহিত, শান্তনু হয়নি। এমনকি পরিবারের অন্যদের প্রশ্নের
হাত থেকেও মধুজাকে আড়াল করেছে সবসময়। মধুজা পূর্ণিমায় কিছু পুজো করত। চতুর্দশী
থেকে তিনরাত সন্ধ্যার পর থেকে চিলেকোঠার ঘরে তার স্বেচ্ছানির্বাসন। সেখানে কারো
প্রবেশাধিকার ছিল না। এমন কি ছাদের দরজাটাও আটকে দিত মধুজা। রোহিত কোন প্রশ্ন করত
না। বরং পুজোর জন্য সাদা ফুলের মালা আর ফলমূল এনে দিত। রোহিতের বাবা মাও পাহাড়ে
জঙ্গলে বেড়ে ওঠা মেয়েটির এই পুজোতে কোনদিন বাধা দেননি। রোহিতকে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে
এনেছে যে মেয়ে, তাকে তাঁরা সম্পূর্ণ মন দিয়েই গ্রহণ করেছিলেন।
তিরিশটা বছর
খুব কম সময় নয়। এর মধ্যে মধুজা আর শান্তনুর ঘর আলো করে টুকাই এসেছে সংসারে। বড় আদরের
ছেলে তাদের। সেও দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল। রূপা এল তার বৌ হয়ে। ভারি লক্ষ্মী মেয়ে।
মধুজার শ্বশুর শাশুড়ি আর বেঁচে নেই। কিন্তু ঘর ভরাতে এসে গেছে পুতুলের মতো তুলতুল।
সারাদিন হৈ চৈ দুষ্টুমিতে ঘর মাতিয়ে রাখে। মধুজার বড় ন্যাওটা।
সুন্দর চলছিল
সংসার। কিন্তু সবকিছু ভালো চলাটা বিধাতাপুরুষের কোনকালেই সহ্য হয় না। এবারেও তার
অন্যথা হল না। বিকেলে মায়ের সঙ্গে পার্কে গিয়েছিল তুতুল। খেলতে খেলতে বলটা একটু দূরের ঝোপের মধ্যে গিয়ে পড়েছিল।
বলটা কুড়িয়ে নিয়ে এসে রূপা দেখে তুলতুল নেই!
নেই তো নেইই।
কতো খুঁজল রূপা আর তার আসেপাশের লোকজন। মেয়েটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে
থানা পুলিশও করা হল। কিছুতেই কিছু হল না। পুলিশ বলছিল, - কোন গাড়ি যখন ঘটনার সময়
পার্কের কাছে উপস্থিত ছিল না এবং এখন যখন কড়া নজরদারি চলছে, তখন তুলতুল এই
এলাকাতেই আছে। খুঁজে পেতে সময় লাগবে না।
সময়? নেহাত
বুড়ো পৃথিবীটা ঘোরা থামায় না। তাই কেটে গেল দু দুটো
দিন। রূপার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। রোহিত আর টুকাই তো সমানে চারদিকে দৌড়োদৌড়ি
করছে। আর মধুজা? সে তো সেদিনের সেই বিকেল থেকে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। একফোঁটা জল
অবধি তাকে খাওয়ানো যায়নি। তার মনের মধ্যে কি ভাবনা চলছে তা সেই জানে।
আজ তুলতুলহীন ঘরের তৃতীয় সন্ধ্যা। মধুজা এই
প্রথম উঠে দাঁড়াল। রোহিতকে ডেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে তার মুখোমুখি দাঁড়াল।
-
এবার আমি আমার
মতো করে চেষ্টা করতে চাই। অনুমতি দাও।
-
অনুমতি! কেন?
-
কারণ তুলতুলকে
যদি খুঁজে পাই, তাহলে আমাকে আলাদা থাকতে হবে। খুঁজে না পেলে অবশ্য ফেরার প্রশ্ন উঠছে না।
চুপ করে থাকল
রোহিত। শূন্য চোখে কোন দৃষ্টি নেই। খুব ধীরে ধীরে বলল –
-
আমি জানি তুমি
ঠিক পারবে। তুলতুলের জীবন আমাদের চেয়ে দামী। ফিরে এস। একসাথে মোকাবিলা করব সবটা।
কী ছিল
রোহিতের গলায় কে জানে। থরথর করে কেঁপে উঠল মধুজা –
-
তুমি জান? কবে
থেকে.....
-
গুহায় থাকার
সময় তোমাকে একদিন শিকার করতে দেখে ফেলেছিলাম। তারও কিছুদিন পরে অ্যাক্সিডেন্টের
সময়ের ঘটনা মনে পড়ে গিয়েছিল। তার উপর প্রতি পূর্ণিমায় তোমার স্বেচ্ছানির্বাসন। লাইব্রেরীতে কিছু বই ঘাঁটাঘাঁটি করে পাজলগুলো ঠিক ঠিক জায়গায় বসাতে পেরেছিলাম। তোমার
ভালোবাসাকে আমি শ্রদ্ধা করি মধু।
দু চোখে অপার বিস্ময়, ভালোবাসা, বিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকল মধুজা। দুচোখ ভরে নতুন করে দেখল ভালোবাসার মানুষটিকে। একবার দৃঢ়ভাবে
চেপে ধরল তার হাতদুটো। পরমুহূর্তে দরজা খুলে বেরিয়ে এল। স্থির গলায় ছেলে বৌকে
নির্দেশ দিল –
- যা পারো খেয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়। আমি প্রার্থনা
করব তুলতুল যেন ফিরে আসে। আমি পুজোয় বসতে যাচ্ছি। সকালের আগে কেউ দরজা খুলবে না। ঈশ্বরের উপর ভরসা রাখো।
- তুমি নির্বিঘ্নে পুজো করো গে যাও। এ আদেশ আমরা সবাই
মানব।
পিছন থেকে রোহিতের দৃঢ়
শান্ত গলা ভেসে এল। আর কোনদিকে না তাকিয়ে মধুজা ধীর পায়ে তার চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে
দরজা বন্ধ করল।
সবার আগে মন
শান্ত করতে হবে। সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা আজ রোহিত ওকে দিয়েছে। সব জেনেও ও.....
******
চোখ বুজলে আজও
মধুজা তিরিশ বছর আগের সেই দৃশ্য পরিষ্কার দেখতে পায়। এক যুবক পাহাড়ের খাদে পড়ে
গিয়েছিল। নীচে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবার কথা। কিন্তু কিভাবে যেন পাথরের খাঁজে
আটকে গিয়েছিল শরীরটা। সন্ধ্যায় শিকার করতে বেরিয়েছিল আর একজন – মানুষের মতো দেখতে
হলেও যার ক্ষিপ্রতা এবং হিংস্রতা নেকড়ের সঙ্গে তুলনীয়।একটা ক্ষীণ
গোঙানির আওয়াজ আর রক্তের গন্ধ পেয়ে অনায়াসে পাহাড়ী ছাগলের মতোই খাদ বেয়ে উঠে
এসেছিল ও। একসঙ্গে
এতখানি মাংসের জোগান দেখে ভারি খুশি হয়েছিল। চাঁদের আলোয় তার শ্বদন্ত ঝিকিয়ে
উঠেছিল। নীচু হয়ে ঘাড়ে দাঁত ফোটাতে যাবে এমন সময়ে –
হঠাৎই বোধহয় একটু সাড়
ফিরেছিল রোহিতের। অস্ফুটে দুবার ‘মা’ ‘মা’ ডেকে নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় শিকারীর বুকেই
মুখ গুঁজে দিয়েছিল!
কী যে হল মধুজার কে
জানে। দাঁত ফোটানো আর হল না। পরিবর্তে রোহিতকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে এল গুহায়। জংলি
পাতার রস বেটে লাগাল ক্ষতস্থানে। পথ্য জোগাড় করল। এজন্য দলের বাকিদের কাছে কম
গঞ্জনা শুনতে হয়নি বেচারিকে। শেষে ওদের হাত থেকে রোহিতকে বাঁচাতেই সবার থেকে দূরে
এক নির্জন গুহায় আস্তানা গেড়েছিল মধুজা। তাই রোহিত যখন থেকে যাবে বলেছিল তখন সব
ছাড়িয়ে নিরাপত্তার প্রশ্নটাই তার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। সে জানত, সে যা করতে
চলেছে, তা প্রকৃতিবিরুদ্ধ। তবু রোহিতের জন্যই তাকে লোকালয়ে ফিরতে হবে। কারণ ততদিনে সে জেনে গেছে একজন ওয়ারউল্ফের অভিধানেও
ভালোবাসা শব্দটা থাকে। তাই সে পূর্ণিমার রাতে নিজেকে আলাদা করে রাখে। কারণ ঐদিন
তার পাশবসত্ত্বা তীব্রতম থাকে। নিজের পরিবারকে নিজের হাত থেকে রক্ষা করতেই তার এই
স্বেচ্ছানির্বাসন। সহজাত প্রবল রক্তপিপাসাকে সে অস্বীকার করেছে। সমূলে বিলীন করতে
চেয়েছে। আত্মক্ষয়কারী এই লড়াইয়ে সে প্রতিবার জয়ী হয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করেছে
সারা শরীরে, মনে। তবু হার মানেনি।
কিন্তু আজ? তুলুতুলকে
উদ্ধার করতে হলে তাকে আজ তার সেই আদিম ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছাতে হবে। তার ফল কী হবে
তা ভাবার সময় এখন নয়। সমস্ত ভাবনা সংহত করে সে ধ্যানে বসল। তীব্রতম করতে চাইল তার
শিকারশক্তি। তারপর রাত নিঝুম হতেই একটা স্কিনটাইট নাইলন ড্রেস পরা অবয়ব লঘু পায়ে
নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে। এই বয়েসেও তার চেহারার বাঁধুনি যে কোন অভিনেত্রীকে লজ্জা দেয়।
নিঃশব্দে খুলে ফেলল দরজা। এসব কাজে তার গতি ও দক্ষতা প্রশ্নাতীত। বাইরে বেরিয়ে এসে
আকাশের দিকে মুখ তুলে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিল। গলায় এসে যাওয়া রণহুঙ্কারটা গিলে
ফেলল কোনক্রমে। এখন তার শিকার ধরার সময়। তার মন বলছে সে যা খুঁজছে, তা আসেপাশেই
আছে। সে পার্কে এসে দাঁড়াল। নাক উঁচু করে গন্ধ শুঁকলো। কিছু পেলো না। অগত্যা সেখান
থেকে একদিকে দ্রুত এগিয়ে গেল। হতাশ হয়ে ফিরে এল। এবার অন্য দিক। তিনবারের বার যখন
সে পূর্বদিকে এগোচ্ছে, তখন কিছুটা এগোতেই তার নাকে একটা হালকা পরিচিত গন্ধ ঝাপটা
মারল। উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার চোখ। আবার দাঁড়াল। দিক ঠিক করে নিয়ে স্থির লক্ষ্যে
এগোল। গন্ধের নিশানা তাকে যে বাড়িটার সামনে এনে দাঁড় করাল, তাতে সে অবাক হয়ে গেল।
এই বাড়িটা?
এই বাড়িতে এক দম্পতি
তাদের অসুস্থ বাচ্ছা নিয়ে ভাড়া এসেছে কিছুদিন হল। মাঝে মাঝেই তাকে প্র্যামে শুইয়ে ওরা
পার্কে বেড়াতে নিয়ে যায়। রূপার সঙ্গে আলাপও হয়েছে মহিলাটির। ওর কাছেই শোনা এসব।
ইনফেকশনের ভয়ে সবসময় মশারিতে ঢেকে রাখে বাচ্চাটাকে। তুলতুল হারানোর দিন ওরাও
পার্কে ছিল। খোঁজাখুজিও করেছিল। তবু ওরা নতুন বলে পুলিশও এ বাড়ি বার দুয়েক
খানাতল্লাশি করে গেছে। তাহলে এখান থেকে কিভাবে তুলতুলের গন্ধ আসছে? তবু সে নিজের
অনুভূতিকেই মান্যতা দিল। কাঠবিড়ালীর মতো পাইপ আর দেওয়াল বেয়ে উঠে গেল ছাদে। ছাদের
দরজার দুর্বল ছিটকিনিটা তার সবল হাতের ধাক্কা সইতে পারল না। বাড়ির লোক ভালো করে
জাগার আগেই সে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নীচে নেমে এল। সেই দম্পতির মুখোমুখি সে এখন।
তুলতুলের গন্ধ এখানে আরও অনেক জোরাল। ওর চোখদুটো ধকধকিয়ে জ্বলে উঠল। এবার শ্বদন্ত বেরিয়ে এসেছে মুখ থেকে। হাতে নখ লম্বা ও ধারলো।
মুখের চেহারাও বদলে গেছে কি? আতঙ্কে বিস্ফারিত মুখদুটো থেকে আওয়াজ বের হবার আগেই
ঝলসে উঠল তার হাত। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল দুজনেই। ওদের টপকে ঘরের মধ্যে পা রাখল
ও। অগাধে
ঘুমোচ্ছে তুলতুল। নীচু হয়ে তুলতে গিয়ে চমকে গেল। এ মুখ তো তুলতুলের নয়! অথচ
গন্ধটা.....
আর একটু খুঁটিয়ে
দেখতেই ধরা পড়ল। তুলতুলের মুখে পাতলা একটা মুখোশ পরানো আছে। সেটাকে টেনে খুলতেই
তুলতুলের চেনা মুখটা বেরিয়ে পড়ল। মুখোশটা ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে খাটের নীচে পড়ে থাকা
একটা প্রমাণ সাইজের পুতুলের দিকে চোখ আটকাল তার।
এবার পুরো ঘটনাটা তার
কাছে দিনের মতো স্বচ্ছ। এই লোকদুটি এই মতলবেই বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল। প্র্যামে করে ওরা
পুতুলটিকে পার্কে নিয়ে যেত। সুযোগ বুঝে তুলতুলকে অজ্ঞান করে সবার চোখের আড়ালে
প্র্যামে ভরে ফেলাটুকুই কাজ শুধু। তারপর সবার চোখের সামনে দিয়ে আরামে প্র্যাম চালিয়ে বাড়ি
ফিরে এসেছে। কারো সন্দেহ হয়নি! চারদিক একটু ঠাণ্ডা হলেই ওকে সরিয়ে নিয়ে যেত
নিশ্চয়ই। তুলতুলের
সারা গা দিয়ে ওষুধের গন্ধ বেরোচ্ছে। ওষুধ খাইয়ে ওকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে! গায়ে
কয়েক জায়গায় কালশিটে! এইটুকু শিশু!
দ্রুতপায়ে বাইরে বেরিয়ে এল । রাগে পাগল পাগল লাগছে তার। চোখে সবুজ আগুন জ্বলছে। মানুষদুটোর জ্ঞান ফিরে আসছে
বোধহয়। তীব্র আক্রোশে টুঁটি কামড়ে ছিঁড়ে নিল ও। দীর্ঘ নখ ঢুকিয়ে ফালা ফালা করে দিল
বুক। উপড়ে নিল দুজনের হৃৎপিণ্ড। নিদারুণ ঘৃণায় ছুঁড়ে ফেলে দিল একপাশে। আজ ও সবকিছু
ভেঙে চুরমার করে দেবে।
জিনিসপত্র আছড়ে ফেলে
ভাঙার আওয়াজে হুঁশ ফিরল তার। খেয়াল হল খুব বেশি সময় আর বাকি নেই ভোর হতে। প্রবল প্রচেষ্টায়
নিজেকে শান্ত করল। ঘরে ঢুকে
তুলতুলকে খুব সাবধানে কোলে তুলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। নিজের বাড়িতে ঢুকে সোফার উপর
যত্ন করে শোওয়ালো মধুজা। মেয়েটাএখনো অকাতরে ঘুমোচ্ছে। সস্নেহে সেদিকে একবার চেয়ে রোহিতের দরজায় কড়া নেড়েই উঠে
গেল চিলেকোঠার ঘরে। স্নান সেরে কাপড় বদলে নীচে এলো যখন, তখন সেখানে আনন্দের কলরোল।
জোড়া খুনের তদন্তে
পুলিশ খুব একটা সুবিধে করতে পারল না। হিংস্র কুকুর জাতীয় কিছুর আক্রমণে এ দশা
হয়েছে, এটুকু বুঝলেও সেরকম কোন প্রাণীর খোঁজ মিলল না কোথাও। একই দিনে তুলতুলের ফিরে আসায় রায়বাড়ির উপর সন্দেহ ঘনীভূত
হলেও তার সপক্ষে কোন প্রমাণ মেলেনি। পাড়ার দু-একজনের সাক্ষ্যে ব্যাপারটা আরও
গুলিয়ে গেল। তারা ভোরের আগের অন্ধকারে পোঁটলাসহ একটা বাঁদর জাতীয় প্রাণীকে চলে যেতে দেখেছে বলে
প্রকাশ।
টুকাই আর রূপার এসব ব্যাপারে কোন মাথাব্যথা নেই।
তারা তাদের বুকের ধন ফিরে পেয়েই খুশি। তাদের ধারণা,
সাত্ত্বিক মায়ের জীবনভর পুজোর জন্য একটি মিরাকল ঘটেছে।
কিন্তু মধুজার শাস্তির
পালা এইবার শুরু হল। নিজে আবাহন
করে অসময়ে পশুশক্তিকে জাগিয়েছে সে। তাই এখন প্রতি রাতে তাকে তার মাশুল চোকাতে হয়।
সারারাত সে নিজের সঙ্গে লড়াই করে – রাতের পশুটাকে হারিয়ে দিনে মানুষ হয়ে ফিরে আসার
জন্য। সে জানে এই যুদ্ধে হেরে গেলে সবাইকে ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে। প্রতি জয়ে তার দ্রুত আয়ুক্ষয় হয়। এটাই নিয়ম। তবু
এজন্য কোন আপশোষ নেই তার। যে কটা দিন সে বাঁচবে ভালোবাসার জনদের নিয়েই বাঁচবে,
ওয়্যারউল্ফ হয়ে নয় – এই তার পণ।
*
*
*
ঠাম্মাম, ঠাম্মাম –
কচি গলার আধো ডাকে চমক ভাঙে মধুজার। বর্তমানে ফিরে আসে। দেখে বেলী ঝোপের আড়াল থেকে
উঁকি দিচ্ছে একটা মিষ্টি হাসিভরা মুখ। মধুজার মুখেও অনাবিল হাসি ফুটে ওঠে। সেদিকে
এগিয়ে যেতে যেতে দোতলার বারান্দা থেকে সে রোহিতের ডাক শুনতে পায় – শুধু নাতনি নিয়ে
পড়ে থাকলে হবে? চা খাবে না?
No comments:
Post a Comment