শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে.......
গান নয়, রিংটোন। কিছুদিন হল রোজ দুপুরে
একটা অজানা নম্বর থেকে কল আসছে। পুরোনো কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্য মৌমিতা ইদানীং
অজানা নম্বর থেকে কল এলে ধরতে চায় না।
বড় লম্বা গরমের এই দুপুরগুলো। আর বড্ড
একলা। এককালের বড় সংসার কমতে কমতে এখন দুজনায় এসে দাঁড়িয়েছে – সে আর সৈকত। শ্বশুর শাশুড়ি ননদ ছেলে স্বামী নিয়ে একটা গমগমে সংসার ছিল তার। এম এ পাস করার পর পরই
বিয়ে হয়ে যায়,ননদ রিয়া তখন কলেজ পড়ুয়া। বিয়ের পরে মেয়েদের চাকরির রেওয়াজ এ বাড়িতে
ছিল না। অবশ্য চাকরি করার ইচ্ছে যে মৌমিতারও খুব একটা ছিল এমন কথা জোর দিয়ে বলা
যায় না। বরং সবার সাথে হৈ চৈ হাসি মজায় দিন যে কোথা দিয়ে পার হয়ে যেত বুঝতেই পারত
না মৌমিতা।
সকালবেলাটা কেটে যেত ঝড়ের বেগে। খাবার,
টিফিন, পরিবেশন - নটার মধ্যে বাড়ি ফাঁকা। তারপর স্নান আর শাশুড়ির পুজো শেষ হতে যেটুকু
দেরি। বারোটার মধ্যেই খাওয়া দাওয়ার পাট শেষ। সত্যি কথা বলতে কি, দুজনে মিলে হাতে
হাতে করলে কতই বা আর কাজ! আর একটা ব্যাপার খুব ভালো লাগত মৌমিতার, এ বাড়িতে সবাই
স্বাবলম্বী। কাউকে হাতে হাতে জিনিস এগিয়ে দিতে হয় না। মায়ের কথা মনে পড়লে আজকাল ওর
একটু মন খারাপই করে – বেচারি সারা সকাল শুধু দৌড়েই বেড়াতেন। মৌমিতার চিরুণী, দাদার
পেন, বাবার মানিব্যাগ – সব কিছুর খোঁজেই মার ডাক পড়ত। অথচ সৈকত আর রিয়া বেরিয়ে
যাবার পরেও ওদের ঘর গোছানোই থাকে। মনে মনে এবং সরবে শাশুড়ির ট্রেনিংয়ের মুক্ত
প্রশংসা করে থাকে
মৌমিতা।
ফলতঃ,খাওয়া দাওয়ার পরে শাশুড়ি-বৌয়ের
হাতে অখণ্ড অবসর। শ্বশুরমশাই এখন শেয়ার বাজারের ওঠানামা নিয়ে আঁক কষবেন, ল্যাপটপটা
নিয়ে খুটখাট করবেন, তারপরে ঘুমিয়ে পড়বেন। এদিকে এই দুটি প্রাণীর দিবানিদ্রার
অভ্যেস নেই। ফলে দুজনের মুখে গল্প আর হাতে উলকাঁটা বা এমব্রয়ডারি – যত না প্রয়োজনে
তার চেয়ে বেশি শখে। কোন
কোনদিন আবার দুজনে বেরিয়ে পড়ত টুকটাক কেনাকাটা সারতে। ফেরার পথে ফুচকা কিম্বা
চুরমুর খাবার কম্পিটিশন। সন্ধ্যের মুখে মুখে ফিরে আসত। ততক্ষণে রিয়া কলেজ থেকে
ফিরে খাবার গরম করে খেয়ে টিউশন পড়তে বেড়িয়ে গেছে। শ্বশুর মশাই সান্ধ্যভ্রমণ থেকে
ফিরলে চায়ের আসর বসবে। সৈকত ফেরে আরো একটু পরে। তবে রাতের খাবার টেবিলে সবাই
একসাথে। হাসি খুশি গল্পে টেবিল জমজমাট। রাতে সৈকতের বুকের মধ্যে মিশে যেতে যেতে মৌমিতা
বুঝে যেত সুখপাখিটার বাসা ঠিক এইখানে।
এরপর তুতুল হল। টলোমলো পা থেকে কবে যেন
চাকরি করতে চলে গেল ভিন রাজ্যে। রিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে সেই কবে। ইদানীং বছরে দু একবারের বেশি আসার সময়
পায় না। শ্বশুর শাশুড়ি তো কিছুটা অসময়েই চলে গেলেন। এতবড় বাড়ি যেন খাঁ খাঁ করে।
বাইরে বেড়াতে যাওয়াও সমস্যা। তাই কোন একসময় উঠোন-গোলবারান্দা-ছাদের বাগান – সব
কিছুর বিনিময়ে এই কমপ্লেক্সটার বারোতলার ফ্ল্যাটে উঠে এল মৌমিতা আর সৈকত।
আজকাল নিয়মিত জিমে যায় মৌমিতা।
ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শে কর্তাগিন্নি দুজনেরই খাওয়া সীমিত। কাজেই রান্নাবান্নারও
বিশেষ ঝামেলা নেই। এদিকে অফিসে সৈকতের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। সকাল আটটায় বেরিয়ে
ফিরতে ফিরতে সেই রাত দশটা হয়েই যায়। ক্লান্ত শরীরটা টেনে সৈকত যখন ফেরে তখন
স্নানঘরে তোয়ালে আর টেবিলে খাবার এগিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করণীয় থাকে না। বেচারি কোনমতে
খেয়ে বিছানায় শরীরটা ছুঁড়ে দেয় পরদিনের দৌড়ের রিচার্জের জন্য।
কিটি পার্টি বা মহিলা সমিতির পি এন পি
সি তে মৌমিতার হাঁপ ধরে। কাজেই
একা একাই দিন কাটে তার। ফেসবুক,
বই, গান এইসবের পরেও বেঁচে যায় অনেকটা সময়। দুপুরের খোলা জানালা দিয়ে ঢুকে যায়
একাকীত্বের মনখারাপ। হু হু করে ওঠা মনটা মনেই করতে পারে না শেষ কবে ওরা একসাথে বসে
ভোরের পাহাড়ের জেগে ওঠা দেখেছে। সামান্য একটা সিনেমাই দেখাহয় না কতদিন!
সেদিন এমনই এক দুপুর। বারান্দায় রোদের
আলপনা। ঝড়ের মতো হাওয়ায় পর্দাগুলো পাখি হয়ে উড়ে যেতে চাইছে। কিন্তু রডের বাঁধনে
তাদের ছটফটানিই সার। হালকা অলস পায়ে বারান্দায় দাঁড়াল মৌমিতা। এখান থেকে অনেক দূর
অবধি দেখা যায়। আগে একতলা বাড়ির জানালা দিয়ে উপরপানে চাইলে কৃষ্ণচূড়া গাছের ফাঁক
দিয়ে আকাশ দেখা যেত। এখানে জারুল গাছটা জানালার অনেক নীচে। মনটা কেমন যেন ছোট হয়ে
যায়। এখানে চারপাশ থেকে ঘরের মধ্যে আকাশ ঢুকে পড়ে ভেতরটা কিরকম একা, ফাঁকা করে দেয়। মাঝে মাঝে চিৎকার করে
কাঁদতে ইচ্ছে করে। সব জিনিস এলোমেলো করে ছড়িয়ে ফেলে হাঁপাতে থাকে। আবার শান্ত হলে
নিজেই সব গুছিয়ে তোলে। বন্ধুদের কেউ চাকরি, কেউ সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তাদের
ব্যস্ততার কথা শুনতে ওর একটুও ভালো লাগে না। তার চেয়ে শপিং মলে যাওয়া ভালো।
আজ শরীরটাও ভালো ছিল না। বারান্দা থেকে
সরে এসে দোলনা চেয়ারটায় চাদর মুড়ি দিয়ে বসতেই ফোনটা এলো।
আজ কী মনে হল, ফোনটা ধরল মৌমিতা।
-
হ্যালো....
ওপ্রান্ত নীরব। এবার বিরক্ত হল মৌমিতা।
ঝাঁঝিয়ে উঠল – এই কদিন তো রোজ কল করছেন। এখন ধরলাম তো উত্তর নেই?
-
অনেকদিন বাদে তোমার গলা শুনলাম মৌটুসি।
সেটার স্বাদ নিচ্ছিলাম প্রাণভরে।
-
রাজীবদা?
-
চিনেছ তাহলে! আমি তো ভাবলাম –
-
আমার নম্বর পেলে কোথায়?
-
ইচ্ছে থাকলে পঙ্গুও পাহাড় পেরোয়, জানো
না?
-
হুমম..... তা হঠাৎ এতদিন পরে এই
ইচ্ছেটা হল কেন জানতে পারি?
-
প্লীজ মৌটুসি এভাবে বলো না। আমার কথাটা
আগে শোন।
-
প্রথম কথা মৌটুসি বলে এখানে কেউ থাকে
না। এটা সৈকত মল্লিকের স্ত্রী মৌমিতা মল্লিকের ফোন। দ্বিতীয়ত, আজ আর তোমার কোন কথা
শোনার ইচ্ছে আমার নেই।
ফোনটা কেটে দিয়ে বিছানায় ওটাকে ছুঁড়ে
ফেলল মৌমিতা। অস্থির পায়ে পায়চারি করল খানিক। হাতের ঝটকায় কয়েকটা ম্যাগাজিন ছিটিয়ে
পড়ল কার্পেটের এদিকে ওদিকে।
তারপর কেমন যেন ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল খাটের ওপর।
মৌটুসি, মৌটুসকি, মৌমাছি – এইসব
নামাবলীতে জড়িয়ে তাকে ডাকত ওই একজনই – রাজীব রক্ষিত। কিন্তু সে নাম তো কবেই কত
বছরের জমানো পাথরের তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। একান্ত অবসরেও তো মনে পড়ে নি বহুদিন
হল। তবে কী ওটা পাথর ছিল না? ধূলোর স্তর ছিল? একটু হাওয়াতেই উড়ে গিয়ে সেই
দিনগুলোকে ওর চারপাশে ছবির মতো ছিটিয়ে দিয়ে গেল! কলেজ জীবনের সেই সাতরঙা
দিনে......
মাথা নাড়ল মৌমিতা। নাঃ, ভেবে লাভ নেই।
যেদিন গেছে তাকে যেতে দেওয়াই ভালো। কারণ কলেজ পাশ করার পরে রাজীবদার উধাও হয়ে
যাওয়াটাও মনে আছে তার। হাজার চেষ্টাতেও আর যোগাযোগ করা যায়নি। কলেজের কেউ তার খবর জানতো না। অনেক দিন
পরে, তখন মৌমিতা কলেজ পার করে ইউনিভারসিটিতে – খবর পেয়েছিল বিয়ের বদলে চাকরি জোগাড়
করে মুম্বাই চলে গেছে রাজীব! ততদিনে অনেক চোখের জল কঠিন হয়ে দেওয়াল তুলে দিয়েছিল।
এই খবরে সেটা আরো একটু শক্তপোক্ত হল এই যা।
এর পর – এত বছর পরে আবার! স্পর্ধা নাকি
অন্য কিছু? আবারও ছটফটিয়ে উঠল মৌমিতা। বাড়িতে আর ভালো লাগছে না। ড্রাইভারকে ডেকে
গাড়ি বার করাল – কোয়েস্ট মল চল।
এ দোকান ও দোকান ঘুরল খানিক। কিছু
অপ্রোয়োজনীয় জিনিস কিনে হাত বোঝাই করল। তারপর একটা কোকের বোতল খেতে খেতে বাড়ি ফিরে
এল।
আশ্চর্যজনকভাবে মাথাটা একটু ঠাণ্ডা
লাগছে এখন। কেনা জিনিসগুলো গুছিয়ে তুলেও ফেলতে পারল।
কিন্তু পরদিন দুপুরে আবার ফোনটা এল।
-
মৌ, প্লীজ ফোন কেটে দিও না। অনেক খুঁজে
তোমার নম্বরটা পেয়েছি।
-
কেন রাজীবদা? একদিন আমি অনেক খুঁজেও
তোমার নম্বর পাইনি। সেদিন তুমি আমার নম্বর জেনেও....
-
বড় ভুল করেছিলাম মৌটুসি। পরে যখন
বুঝেছি, তখন আর উপায় ছিল না।
-
এখন উপায় আছে ভাবছ?
-
ভাবছি না। চাইছি। একবার শুধু তোমার
সাথে দেখা করতে চাইছি। আমি কলকাতায় ফিরে এসেছি মৌ। একবার শুধু একটিবার দেখা করা
যায় না? আমার যে অনেক কথা তোমায় বলার আছে মৌমাছি!
-
তুমি চাইলেই সব হবে কেমন?
-
না মৌ, তুমি না চাইলে হবে না। কিন্তু
তুমি তো এমন নিষ্ঠুর ছিলে না মৌ। একটা দিনও কি আজ আমায় দেওয়া যায় না?
আবারও ফোনটা কেটে দিল মৌ। কিন্তু ছুঁড়ে
ফেলল না গতকালের মতো। বড় ক্লান্ত লাগছে ওর। খাটের উপর উপুড় হয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল –
এ টান কেন তার মনে এখনও? এতদিন পরেও?
এ ভাবেই কেটে গেল আরও কয়েকটা দুপুর।
অবশেষে এক বিকেলে এক সিসিডিতে হাজির হল মৌমিতা। হালকা হলুদ শাড়িতে এই বিকেলের আলোয়
ওকে বড় বেশি সুন্দর লাগছে আজ। রাজীব মুগ্ধ হয়ে তাই দেখছিল – বিশেষ পালটাও নি
দেখছি। এখনো তেমনই আছ।
-
ঠিক জানো?তবে তুমি কিন্তু অনেক বদলে
গেছ। বেশ আনেকটা মুটিয়েছ। যাক গে। এবার বলো ডেকেছ কেন?
-
তোমায় একবার বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছিল মৌ।
-
হুম। তারপর?
-
তোমাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম। সেই অপরাধে
সারা জীবন শান্তি পাইনি। বিয়ে করেছি বটে, কিন্তু ভালোবাসতে পারিনি একদিনের জন্যেও।
তুমিই চিরকাল...
-
.......................
-
জানো মৌমাছি, তুমি আজ যখন আসতে বললে..
-
ওয়েটার, দুটো কফি। কোন স্ন্যাক্স নেবে
রাজীবদা?
-
এভাবে কথা বলছ কেন মৌ? মৌটুসি, তুমি
আমার কথা শুনবে না?
-
শুনছি তো! কিন্তু এই ক’দিনে আরো কিছু
যে শুনেছি রাজীব রক্ষিত। তোমার স্ত্রী মারা গেছেন বছর তিনেক হল। মেয়ের বিয়ে হয়ে
গেছে। তুমি কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছ।
-
এত খবর পেলে কোথায়?
-
ইচ্ছে থাকলে পঙ্গুও পাহাড় পেরোয়, জানো
না?
-
ব্যঙ্গ করছ?
-
একদম না। প্রথম তোমার ফোন পেয়ে খুব
কষ্ট হচ্ছিল জান? তারপর মনে হল একটু খবর নেওয়া দরকার। তাই....
-
বলতেটা কী চাইছ?
-
তুমি এখন বড় একা রাজীবদা। আর পুরোনো
প্রেমিকার চেয়ে ভালো সঙ্গী আর কে হয়? কিন্তু আমি তো আর একা নই গো। সৈকত মল্লিকের
মতো পুরুষ আমার স্বামী।
আরেকটা
কথা। মৌটুসি মারা গেছে অনেকদিন হল।
No comments:
Post a Comment