Thursday, January 10, 2019

মুহূর্ত

বাড়ীতে যখন ডলপুতুলের মত একটা ছোট্টো ভাই এল, তখন সব্বার মত রিনিও খুব খুশী হয়েছিল। ছোট ছোট দুবেণী দুলিয়ে ভাইকে কোলে নিতে যেতেই মা বলে উঠলেন, “ওরে এটা বড্ডো ছোট। ওভাবে নিতে নেই। তুই বাবু হয়ে বস দেখি, আমি তোর কোলে দিচ্ছি।

-
কেন রে বাপু? রিনির সংসারে তো কত্তোগুলো ছানাপোনা। তাদের বুঝি সে এতদিন কোলে কাঁখে করে মানুষ করে নি? কই, তখন তো কেউ বলতে আসে নি, - এভাবে নয় ওভাবে ধরতে হয়! আর কোলেই কি ঠিকমত দিচ্ছে ছাই! ভাই-পুতুলটা তো মার হাতের মধ্যেই রয়ে গেল। রিনি কি এতটাই ছেলেমানুষ যে এটুকুও বুঝতে পারবে না? বড্ড অভিমান হয়ে গেল তার। খুশীটা বোধহয় আর অবিমিশ্র থাকছে না।

তারপর এই তো সেদিন। রিনির একটু ইচ্ছে হয়েছিল মায়ের কোলে চড়বার। চড়েওছিল তো। কিন্তু কোথা থেকে কাকীমা দৌড়ে এল দিদি, তোমার না এখন কোন ভারী জিনিস ওঠান বারণ?”

আর মাও অমনি তাড়াতাড়ি রিনিকে কোল থেকে নামিয়ে দিল! সাতদিনেই এত কি বড় আর ভারী হয়ে গেল রিনি? গলাটা ব্যথা ব্যথা, চোকের জল উপছে পড়ার আগেই রিনি একদৌড়ে বাবার কোলে উঠে পড়ল। -, ভাইকে মা যখন কোলে নেয়, তখন বুঝি ভারী হয় না? শুধু তার বেলাতেই.......

বড্ড কাঁদুনে হয়েছে ভাইটা। সারাদিন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদে আর মাও তাকে নিয়েই পড়ে থাকে। রিনিকে চান করাতে, জামা পরাতে, খাওয়াতে তো সেই কাকীমাই। যদিও কাকীমা খুব সুন্দর করে গল্প বলে বলে খাওয়ায়, আর সেটা ভালই লাগে রিনির; তবু মার বকেঝকে খাওয়ানোটা যে কেন এত মিস করে সে নিজেও জানে না। কাকীমা অবশ্য সেদিন বলেছিল ভাই নাকি খুব দুর্বল, তাই মাকে সারাদিন ওর দেখভাল করতে হয়।

কোথায় দুর্বল? দুর্বলরা কি অত জোরে জোরে কাঁদতে পারে? মার কাছে আর কোনদিন যাবে না - বাবার গলা জড়িয়ে ঘুমোবার সময় রোজ রাতে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে রিনি।


ধীরে ধীরে হামা দিতে শিখে গেল ভাই, কথাও ফুটল। আর এখন তো টুক টুক করে হেঁটে বেড়ায়। আজকাল ভাইয়ের সাথে একটু আধটু খেলেও রিনি। তবে ভাইটা বড় দুষ্টু হয়েছে। রিনির কত খেলনা যে রিনিরই খেলাঘরের ছোট্ট হাতুড়িটা দিয়ে ভেঙেছে তার ইয়ত্তা নেই। ভেঙে গেলে আবার ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদাও চাই। তখন ওটাকে ধরে মারতে ইচ্ছে করে রিনির। রিনির প্রাণপ্রিয় বইগুলো একটাও আর আস্ত নেই। ভাই হয় ছিঁড়েছে, নয়ত পেনসিল দিয়ে হিজিবিজি ছবি এঁকে রেখেছে। তবু যখন আধো আধো স্বরে ডিডি, টোর ডোডেনটা (কলম) ডিবি?” – বলে তখন ভালও লাগে আবার!

রিনি সবচাইতে বিরক্ত হয় যখন এই ফ্যাঁচকাদুনে পুঁচকেটা তার পিছু পিছু হাজির হয় খেলার মাঠে। সে যখন বন্ধুদের সাথে দাপিয়ে হা-ডু-ডু বা দাঁড়িয়াবান্ধা কিম্বা এক্কাদোক্কা খেলছে, তখন মোক্ষম সময়ে মাঠে ঢুকে দিদির কাছে চলে এসে ওকে আউট করতে ওর জুড়ি মেলা ভার। এইভাবে বারবার মোর হতে ভাল লাগে না রিনির। মাঝে মাঝে দু এক ঘা লাগিয়েও দেখেছে, কেঁদে কেটে একশা হয়ে লাল লাল চোখমুখ নিয়ে বাড়ী ফেরে যখন, রিনি কপালে বকুনির আর অন্ত থাকে না!
তাই সেবার পুজোর ছুটিতে বেড়াতে এসে মাসী যখন বলল, - “ক্লাস ফাইভ হয়ে গেল, রিনিকে কি এই গ্রামের স্কুলেই রেখে দিবি নাকি তোরা? মেয়েটার একটা ভবিষ্যৎ নেই?” তখন পোঁটলা পুঁটলি দিয়ে রিনিকে ওর বাবা ভর্তি করে দিলেন এক মফস্বলের হোস্টেলে। বাবা-মাকে ছেড়ে থাকার দুঃখটা তেমন গায়ে লাগল না রিনির, চারপাশে এত বন্ধু বান্ধব পেয়ে। খাওয়া দাওয়া নিয়ে তেমন বাছবিচার কোনকালেই ছিল না বলে সে তার নির্বিঘ্ন পড়াশোনা, আস্ত বই এবং নিশ্চিন্ত খেলাধূলা নিয়ে মেতে রইল। বরং পড়ার সময় চোদ্দবার কেউ বিরক্ত না করায় খুব তাড়াতাড়ি হোমওয়ার্ক সেরে প্রিয় গল্পের বইয়ের পাতায় ডুবে যেতে পারছিল রিনি। ফলে দিনদিন হোস্টেলের সাথে এক মায়ায় ভালবাসায় জড়িয়ে যাচ্ছিল সে।

বেশ কেটে যাচ্ছিল সময়। গরমের জন্য মর্ণিং স্কুল শুরু হয়েছে। ভোরবেলায় ঘুম ঘুম চোখে যখন স্কুলে যায় রিনি, পথের পাশের শালবনে তখন ভোরের আলো চুঁইয়ে পড়ে। চড়ুই আর শালিকের কিচিমিচিতে ভেঙে ভেঙে যায় সকালের নিস্তব্ধতা। একটা অলস অথচ ভরা মন নিয়ে রোজ এই যাওয়া। ফেরার সময়টা আবার একেবারে অন্যরকম। দুপুরের রোদে ঝিলিমিলি শালবন, ক্বচিৎ ভেসে আসা পাখীর শিষ, লাল মেঠো পথটি রোদ্দুরে জ্বলে আরো লাল।

ফিরে এসে লিস্টের নাম অনুযায়ী পরপর চান সারা হতেই পড়ে খাবার ঘণ্টা। খেতে খেতেই সবার চোখ ঢুলুঢুলু সোজা ঝাঁপ দেওয়া যে যার বিছানায়। শুধু বড় দিদিদের কেউ কেউ স্টাডি রুমে বসে প্রোজেক্ট বা প্রাকটিক্যাল খাতা লিখতে ব্যস্ত থাকে। এত বড় বাড়ীটা হঠাৎ নিঝুমপুরী হয়ে যায়।

এমনই একদিন। রোজকার মতই শুয়েছে রিনি। কিন্তু আজ কেন যেন ঘুম আসছে না তার। খানিক এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়ল সে। পায়ে পায়ে ঘর গুলো পার করে উঠে এল দোতলায়। গমগমে চেনা হোস্টেলটা কেমন যেন অচেনা। সারি সারি নিঃশব্দ পর্দাঢাকা ঘর তার ঘুমন্ত আবাসিকদের আবছায়া আঁধারে ঢেকে রেখেছে। বারান্দায় স্টাডি টেবিলটায় দু চারটে বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের মধ্যে একটা নাম চোখ টানল রিনির আম আঁটির ভেঁপু। ভারী সুন্দর প্রচ্ছদটি। কার বই কে জানে! হাতে নিয়ে একটু নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়েই চোখ আর মন দুইই আটকে গেল রিনির। অপুর সাথে নীলকুঠি ঘুরে আসার পরে তার খেয়াল হল, সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বেশ কয়েকপাতা পড়ে ফেলেছে।

বইটা হাতে করে পায়ে পায়ে সুস্মিতাদিদির পড়ার টেবিলটায় এসে বসে রিনি। এই জায়গাটার ওপর তার ভারী লোভ। টেবিলের পাশের জানালা দিয়ে দেখা যায় হোস্টেলের মাঠ। তার ওপারে সবুজ ঝোপঝাড়। বেঁটে ঘন সবুজ গাছেরা এক বিস্তীর্ণ আকাশছোঁওয়া প্রান্তর তৈরি করেছে। তাদের মাঝে মাঝে স্পর্ধিত ঘোষণায় মাথা তুলেছে এক আধটা শাল বা খেজুর।

এছাড়া আর কিছু নেই। - না, না, আছে। এই বনজমির একান্তে আছে একা একটি হলুদরঙা বাড়ী। বাড়ীর বারান্দা আর উঠোনের কিছু অংশ দোতলার এই জানালাটা দিয়ে দেখা যায়। মাথার উপর ঘননীল রৌদ্রস্নাত আকাশ, সবুজ মাঠ আর হলুদ বাড়ীটা এই নির্জন দুপুরে নেশার মত পেয়ে বসল রিনিকে। উঠোনটায় খেলা করছে দুটি ছোট ভাইবোন। দেখতে খুব ভাল লাগছিল রিনির। ভেতর থেকে ওদের মা বেরিয়ে এসে উঠোন থেকে একহাতে শুকনো কাপড় আর এক হাতে ছেলেমেয়ে দুটিকে জড়িয়ে ধরে ভিতরে ঢুকে গেলেন। দেখতে দেখতে মনকেমনের কুয়াশায় রিনির ভিতরটা ছেয়ে যেতে থাকল কতদিন এই ছোঁওয়া এই আদর পাওয়া হয় নি তার! কিন্তু কান্নাকাটি তার বিকুল না-পসন্দ। তাই তাড়াতাড়ি মন দিল হাতের বইটার ওপর।

যত পড়ে, তত দূর্গার সাথে একাত্ম হতে হতে নিজেকেই পরতে পরতে খোলে রিনি। অপুর বর্ণনায় নিজের দুবলা পাতলা ছোট ভাইটার চেহারাই ভেসে ওঠে চোখের সামনে। এক দুপুরে দীঘল চোখের পাতা ফেলে সেও তো বলেছিল,- আরো এটটু আমমাখা না, না, আমমাখা তো নয়, - মিল্ক পাউডারের গুঁড়ো দিবি দিদি?

কখন ঠোঁটের কোনে হাসি, কখন একটু চিকচিকে জল, বর্ষা হয়ে নামল রিনির দুচোখের পাতায় আমি তোকে ছেড়ে যাইনি দিদি, ইচ্ছে করে চলেও যাইনি। ওরা আমায় নিয়ে যাচ্ছে

নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইল রিনি। জানালার বাইরে কাল মেঘের ছায়া। মাঠের সবুজও তার রঙ পাল্টে ফেলেছে বৃষ্টিস্নাত হয়ে নতুন রূপে প্রকাশিত হবার অপেক্ষায়।
রিনিরও ভেতরটা ভাঙছে। ভাইয়ের দুষ্টুমি দুরন্তপনা সব ছাপিয়ে দিদির আদর আর মনোযোগের জন্য সঅবকিছু করতে একপায়ে খাড়া - একটা ছোট্ট অবোধ মুখ তার মনের সবটুকু জুড়ে বসে রইল।

সেই মন এক দিদির মন এরপর থেকে যে তার ভাইকে দুহাতে আগলে রাখবে আপ্রাণ। সব ক্ষতি সব দুঃখ থেকে আড়াল করে আকাশের মত ভালবাসায়, মুক্তিতে, বন্ধনে সবখানে।
*
*
অনেক দূরে বসে এক শিল্পী তৃপ্তির হাসি হাসলেন। তিনি জানেন প্রাপ্তি, পরিবেশ, সময় আর মনন এই চারের মেলবন্ধনে এক বিরল মহামুহূর্তের জন্ম হয় তাতে ফুটে ওঠে এক আলোকদ্যুতির ফুল। তিনি ফুলটা নিয়ে রিনির বুকে ছুঁইয়ে দিলেন।

No comments: