বাড়িটা জেন দেখতে পায় এক
সান্ধ্যভ্রমণের সময়। রেডমণ্ডের এদিকটা বেশ নির্জন আর
গাছগাছালিতে ভরা। চারপাশের সাজানো গোছানো বাড়িগুলোর মধ্যে এই বাড়িটা অন্যরকম ঠেকল
কেন, সেটা বুঝতেই দাঁড়াল জেন।
একটু দাঁড়াতেই বিষয়টা ধরা পড়ল।এককালের সযত্নচর্চিত লনে এখন অনেক আগাছা। বাড়ির সামনে দাঁড় করানো RV আর নৌকোর ট্রলারটায় ধুলোমাটির আস্তরণ। সেটা এতটাই পুরু যে তা থেকে লতানে গাছ গজিয়ে নৌকোটার কিছু অংশ ঢেকে দিয়েছে।একতলা বাড়িটার ছাদে মেপল পাতার ভীড়। কাঁচের জানালার ফাঁক দিয়ে চুইয়ে আসছে বাল্বের আলো। অথচ বাড়িতে ঢোকার শ্যাওলাঢাকা পথটিতে কারো পায়ের চিহ্নের আভাস অনেক লক্ষ্য করেও চোখে পড়ল না।
একটু দাঁড়াতেই বিষয়টা ধরা পড়ল।এককালের সযত্নচর্চিত লনে এখন অনেক আগাছা। বাড়ির সামনে দাঁড় করানো RV আর নৌকোর ট্রলারটায় ধুলোমাটির আস্তরণ। সেটা এতটাই পুরু যে তা থেকে লতানে গাছ গজিয়ে নৌকোটার কিছু অংশ ঢেকে দিয়েছে।একতলা বাড়িটার ছাদে মেপল পাতার ভীড়। কাঁচের জানালার ফাঁক দিয়ে চুইয়ে আসছে বাল্বের আলো। অথচ বাড়িতে ঢোকার শ্যাওলাঢাকা পথটিতে কারো পায়ের চিহ্নের আভাস অনেক লক্ষ্য করেও চোখে পড়ল না।
বেশিক্ষণ অপরের বাড়ির
সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটা অসভ্যতা, তাই তখনকার মত চলে এল জেন, কিন্তু বাড়িটার কথা তার
মাথাতে থেকে গেল না। এরপর থেকে রোজই হাঁটতে বেরিয়ে বাড়িটা দেখে আসত সে। তার খালি
মনে হত, এই বাড়ির বাসিন্দারা কোনো এক সন্ধ্যেতে ঘরে বসে গল্প করছিল, খুনসুটি করছিল
পরস্পরের সাথে, তারপর.... একটু ঘুরে আসি, বলে বেরিয়ে আর ফেরে নি। কিন্তু কেন?
অনেক ভেবে তার মনে হল
বুড়ি মার্থার কথা। এই এলাকার সব কাহিনী খুনখুনে বুড়িটার নখদর্পণে। একলা থাকে। কেউ
গেলে খুশি হয়ে প্রচুর বকবক করে। কিছু বলতে পারলে ওই পারবে। কৌতূহলটা এতই বেশি
হয়েছিল যে থ্যাংকসগিভিংয়ের আগের দিন কিছু কুকি বানিয়ে জেন পৌছে গেল মার্থার বাড়ি।
একথা ওকথার পর বাড়িটার কথা তুলল জেন। মার্থা কি কিছু জানে এ ব্যাপারে? না জানারই
কথা। কারণ এটা বোধহয় অনেকদিন আগের ঘটনা। মনেও নাই থাকতে পারে.......
দাওয়াইটা মোক্ষম ছিল।
তেড়েফুঁড়ে উঠল বুড়ি। জানেনা মানে? আরে, তখন তো ওপাড়াতেই থাকত মার্থা। বাড়িটা ছিল
অ্যান্ডারসনদের – শার্লট আর লিও অ্যান্ডারসন। কারো সাথেই বিশেষ মিশত না। নাকউঁচু লোকজন সব। ওদের একটা ছেলেও ছিল, তা সে বাইরে
বাইরেই থাকত বলে বিশেষ দেখা যেত না। পেয়িং গেস্ট রাখত ওরা। রবিন ছোকরাকে ভালই চিনত
মার্থা। দিব্বি আলাপী হাসিখুশি ছেলে। লিওদের মত গোমড়ামুখো নয়। বেশ ছিল সবাই। হঠাৎই
মারা যায় লিও। বেশ কিছুদিন ধরেই অবশ্য ভুগছিল বেচারী। ওই রবিনই তখন খুব দৌড়দৌড়ি
করে ডাক্তার ওষুধ জোগাড় করত। ভারি লক্ষ্মী ছেলে। লিও মারা যাবার পর মন ভেঙে যায়
শার্লটের। রবিনকেই বাড়ি বেচে দিয়ে সে চলে যায় অন্য জায়গায়।
এতখানি একদমে বলে
হাঁপাতে থাকে বেচারি। আর সেই ফাঁকে দু কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে আসে জেন। আয়েশ করে কফির
কাপে চুমুক দেয় বুড়ি। চোখদুটো আরামে চকচক করতে থাকে। গল্পের খেই ধরে আবার শুরু করে
তার গল্পের দ্বিতীয় পর্ব।
শার্লট চলে যাবার পর
রবিন কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। সেভাবে আর মিশত না কারো সাথে। কিন্তু বছর
দুয়েক বাদে ওর এক বান্ধবী জোটে। লিণ্ডা কিন্তু বেশ হাসিখুশি মেয়ে। তা প্রেম থেকে
পরিণয়ে যাবার আগে কিছুদিন লিভ-ইন করে নিলেই ভাল। তা সে সময়েই তার আলাপ হয় মার্থার সাথে। রবিন অফিসে বেরিয়ে
গেলেই লিণ্ডা এসে জুটত মার্থার বাড়ি। জমে উঠত দুই অসমবয়েসীর আড্ডা। তবে এই
মাখামাখিটা যে রবিনের পছন্দ নয়, সেকথাও লিণ্ডাই হেসে হেসে জানাত মার্থাকে। তবে
দুটিতে ভাব ছিল খুব। ছুটি পেলেই RV টার সাথে
নৌকার ট্রেলারটা জুড়ে দূরে কোথাও ঘুরতে চলে যেত। লেক এর ধারে নৌকা-বিহার আর রান্না
শোওয়া থাকা সবই তো ওই ‘বাসাগাড়ি’তে!
এরকমই একদিন। রবিন
অফিস থেকে ফিরেছে। খানিক বাদে ওরা একসাথে বের হল। মার্থা নিজের লনে বসে বই পড়ছিল।
যাবার সময় লিণ্ডা হাত নেড়ে বলে গেল, ‘হাই মার্থা, আমরা ডিনার করতে চললাম। ঘণ্টা
দুয়েকের মধ্যেই ফিরব।‘ মার্থা একটু হেসে, ঘাড় নেড়ে আবার বইয়ের পাতায় ডুব দিল। শুধু
ওই দু ঘণ্টার উল্লেখের জন্য একবার হাতঘড়িটার দিকে নজর গেল ওর। মাত্র সাড়ে সাতটা।
নড়েচড়ে বসল বুড়ি। জেন
চুপচাপ বসে শুনছিল। মার্থাকে চুপ হয়ে যেতে দেখে জানতে চাইল, তারপর?
“ সেই যে গেল
দুটিতে,আর ফিরল না কোনদিনও। ভারী অবাক লাগে জান? কেউ ওদের সেভাবে খোঁজও করেনি
কখনো!”
*
*
খোঁজ যে কেউ করবে না, সেটা
নিশ্চিত জানত শুধু একজন। চার্লি। চার্লি ওরফে ডিক অ্যান্ডারসন। লিও আর শার্লটের
একমাত্র সন্তান। থাকে অন্য শহরে। চার্লিকে চেনে না এমন লোকের সংখ্যা অন্ধকার জগতে
খুব কম। পেশাগত কারণে সে নিত্য যোগাযোগ রাখত না বাবা-মায়ের সাথে। মায়ের কাছে সে
শুধুই আদরের ডিক। এইসব ঘটনা যখন ঘটছিল, তখন সে একটা তিন বছরের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে
জাপান পাড়ি দিয়েছিল। ফিরে যখন এল, তখন আর কিছু করার ছিল না। ভাঙা মন নিয়ে বেশিদিন
বাঁচে নি শার্লট। তার কাছে শোনা কথা নিজের অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে যাচাই করে বুঝেছিল
ডিক, লিওর মৃত্যু আর রবিনকে জলের দরে বাড়ি বেচাটা খুব একটা স্বাভাবিক ঘটনা নয়। কিন্তু
রবিনের অপরাধের প্রমাণ জোগাড় করাটা বেশ শক্ত কাজ। লিণ্ডার সাহায্য ছাড়া এতটা করে উঠতে পারত না হয়ত।ছিল এক এক করে লিণ্ডা সব প্রমাণ জড়ো
করেছে, বিভিন্ন
কথাবার্তার ভিডিও রেকর্ডিং
নিয়েছে। মনে মনে হাসল ডিক, বিছানায় শুয়ে পেটে কথা রাখতে খুব কম লোকই পারে। সে সুযোগটার
পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে লিণ্ডা। লিওর মৃত্যু আর শারলটের নার্ভাস ব্রেকডাউনের পিছনে
তার কারিকুরির কথা রবিন বেশ ফলাও করেই বলেছিল তার প্রিয় বান্ধবীকে। চমৎকার বুদ্ধির
জোরেই এই দারুণ জায়গার বাড়িটার মালিকানা এখন তার।
শেষ প্রমাণ হাতে আসার
পর সেদিন রেস্তোরায় ওদের সাথে দেখা করেছে ডিক। রবিনের সামনে সাজিয়ে দিয়েছে
প্রমাণের কাগজ আর ভিডিওর কপি। রবিনকে তিনটে অপশন দিয়েছিল ডিক । এক: পুলিসের কাছে আত্মসমর্পণ; দুই: এখানে বসে মৃত্যুর
প্রতীক্ষা করা – চার্লি কথা দিচ্ছে সেটা দীর্ঘায়িত হবে না; আর তিন: এই মুহূর্তে
চিরদিনের মত শহর ছেড়ে চলে যাওয়া।
প্রত্যাশামতই তৃতীয় অপশনটা
বেছে নিল রবিন। চার্লির নামটা তার অজানা নয়। নিজের যাবতীয় কার্ড,পাসওয়ার্ডসহ মোবাইল নামিয়ে রেখে চার্লির দেওয়া এয়ার টিকিট আর
কিছু টাকা নিয়ে সে চলে গেল দেশ ছেড়ে।
পরদিন। শার্লটের কবরের
পাশে বসে রবিনের যাবতীয় কার্ড আর মোবাইল টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিচ্ছিল ডিক। পাশে
এসে বসল লিণ্ডা। একটু হেসে নিজের ব্যাগ থেকে বের করল রবিনের সার্টিফিকেটের তাড়া।
কুচি কুচি করে ছড়িয়ে দিল কবরের ওপর। তারপর সাদা ফুল দিয়ে ঢেকে দিল সবকিছু।
*
*
অনেক দূরে এক
নির্জন সমুদ্রতটে বসে জীবনের হিসেব মেলানোর চেষ্টা করে যায় একজন। এই জায়গায় আসার
টিকিটটা তাকে ধরিয়ে দিয়েছিল চার্লি। এককালে তার নাম ছিল রবিন। আজ আর সেটা প্রমাণ
করবার কোন পথ তার কাছে নেই। তার সমস্ত ডেটা, মেল,
কনট্যাক্ট, সার্টিফিকেট ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এর জন্যই পাসওয়ার্ডসহ
মোবাইলটা নিয়েছিল চার্লি। প্রেমিকার চরিত্রে লিণ্ডার অভিনয়টাও যে বেশ ভাল, সেটা
মানতে বাধ্য রবিন। লিণ্ডা একহাতে তার
সংসার সামলেছে, বেড়াতে গেছে একসাথে! শেষদিনেও তো লিণ্ডা তো সরল বিশ্বাসে তার
ফিঁয়াসের সাথে ডিনার করতে গিয়েছিল! সেখানে, তার সাথে ব্রেক আপ করে অন্য রাজ্যে চলে
গিয়েছে বিশ্বাসঘাতক এক পুরুষ! ওর আগে থেকে কাটা টিকিট, মার্থার সাক্ষ্য সব কিছু যে
এ কথাই বলবে, তা জানে রবিন। ফিঁয়াসে! তিক্ত একটা হাসি ফুটে ওঠে রবিনের মুখে।
ফিঁয়াসে তো বটেই, তবে ওর নয়, চার্লির। এটা আগে বুঝতে পারলে........
শুধু যেটা ও
এখনো বুঝতে পারছে না, সেটা হল অ্যাণ্ডারসনদের বিষয়ে চার্লির আগ্রহের কারণ। অবশ্য
এখন আর বুঝেই বা কী হবে?
সামনের কালো
জলের ঢেউয়ের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবতে থাকে সেই একদা রবিন নামের লোকটি – কী করবে এবার
ও? জীবনের খাতাটা আবার শূন্য থেকে শুরু করবে এই বয়েসে? অবশ্য ঠিক শূন্য থেকে নয়, -
আরেকটু পিছন থেকে। চার্লি নামের আতঙ্কটা তাকে এ জীবনেও তাড়া করে যাবে। এ থেকে তার
আর কোনদিনও মুক্তি নেই । নাকি এই জলেই .....?
সন্ধ্যা নামে। রাত হয়। জোয়ারের কালো
জল ক্রমশঃ এগিয়ে আসে। ওর পা ভিজে যায়। ও বসেই থাকে.......
No comments:
Post a Comment