Friday, December 21, 2018

লাল বলটা


সকালটা দেখে একেবারেই বোঝা যায় নি, দিনটা এইরকম ভাবে শেষ হবে। নেহাতই বড়দিনের ছুটি কাটাতে সিকিমে আসা। পাহাড়ে আবহাওয়াটা এই সময় খুবই সঙ্গ দেয় – আগেও দেখেছে রক্তিম। সিকিমের অর্কিড বা ফার্ণ দেখতে হলে অবশ্য মার্চেই আসা ভালো। কিন্তু ওই সময় ছুটি পাওয়া ঝকমারির ব্যাপার। তাই বরফে মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘাকেই প্রাধান্য দিয়ে চলে এসেছে ওরা দুই বন্ধু – রক্তিম আর প্রীতম।

প্রথমে এসেছিল পেলিংয়ে। সেখানে হাতনাগালে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর তার সঙ্গী সাথীদের আবির খেলার মতো সূর্যোদয় আর পেমিয়াংশি মনাস্ট্রির রহস্যময় সৌন্দর্যে মন ভরে নিয়ে সকালবেলায় ওরা রওয়ানা দিয়েছিল রাবাংলার দিকে। ঘণ্টা দু- আড়াইয়ের পথ। রক্তিম ভালো গাড়ী চালায়। ইচ্ছেমতো ঘুরতে পারবে বলে নিজের গাড়িটাই নিয়ে এসেছে ও। সুন্দর রোদ ঝলমলে দিন। প্রীতম গলা ছেড়ে গান গাইছিল। বড় সুন্দর গানের গলা ওর।  পথে গেজিংয়ের বাজারে নেমে একটু চা আর মোমো খেয়ে নিলআর কিনল গাছ থেকে সদ্য পাড়া কমলালেবু। হৈ হৈ করতে করতে আবার রওয়ানা দিল। বেশ কিছুটা যাবার পরেই ফোনটা এল। প্রীতমের অফিস থেকে জরুরি ডাক এসেছে। আজই ফিরতে হবে। অগত্যা গাড়ি ঘোরাচ্ছিল রক্তিম। প্রীতম হাঁ হাঁ করে উঠল – “ আরে, সমনেই তো লেগশিপ আসছে। ওখান থেকে আমি একটা জীপ নিয়ে নেমে যাব। তুই ছুটিটা নষ্ট করিস না। রাবাংলায় বুকিংও করা আছেমিছিমিছি অনেকগুলো পয়সা নষ্ট হবে।“
কিছুটা তা-না-না-না করার পর সেটাই স্থির হল। লেগশিপে নেমে একটা শিলিগুড়িগামী জীপে উঠে বসল প্রীতম। ওকে বিদায় জানিয়ে রক্তিম নিজের গাড়িটার দিকে এগোলমনটা একটু খারাপ হয়ে আছে। কথা ছিল রাবাংলা পৌঁছে লাঞ্চ করবে। প্রীতম চলে যাওয়ায় খুব তাড়াতাড়ি রাবাংলা পৌঁছানোর তাগিদটা আর খুঁজে পাচ্ছে না এখন। রঙ্গিত নদীর ধারের এই ছোট্ট জনপদটা ওর বেশ ভালো লাগছিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, সাড়ে দশটা বাজে। এই লেগশিপের রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে যাওয়াই যায়। মোটামুটি একটা নাগাদ থেকে ফিরতে শুরু করলে দিনের আলো থাকতে থাকতেই রাবাংলা পৌঁছ যাওয়া যাবে। রক্তিম গাড়িটা ডানদিকে ঘুরিয়ে নিলরাস্তাটা সত্যিই সুন্দর। একদিকে সবুজ পাহাড় আর অপরদিকে পান্নারঙা রঙ্গিত। চলতে চলতেই মন খারাপটা মিলিয়ে আসে, গাড়ির গতিটা বেশ কমিয়ে দেয়। চারপাশ দেখতে দেখতে ধীরে ধীরেই এগিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে ঘোর ভেঙে চমকে ওঠে। আনমনে কখন যেন বড় রাস্তা ছেড়ে পাশের ছোট এক রাস্তায় চলে এসেছে রাস্তাটা অসমান বলেই গাড়ি ঝাঁকিয়েছে। রক্তিম ঘড়ি দেখল – প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। একটু নিশ্চিন্ত হল। সামনে সুবিধেমতো জায়গায় গাড়ি ঘুরিয়ে নিলেই হবে।
কিন্তু সরু পাহাড়ী রাস্তা এঁকেবেঁকে এগিয়েই চলে। কোথাও কোথাও রাস্তা এত সরু, যে উল্টোদিক থেকে গাড়ি এলে পাস দেওয়াই মুস্কিল হত। কপাল ভালো সেরকম গাড়ির দেখা এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। রক্তিম এবার একটু চিন্তায় পড়ে গেল অচেনা জায়গা, কোথায় চলছে জানে না। মোবাইলের টাওয়ারও জবাব দিয়েছে। বিকেল নেমে আসছে পাইনের গা বেয়ে। নদীরও দেখা মিলছে না আর। সন্ধ্যের একটু আগে একটা মাঠে এসে আচমকা শেষ হয়ে গেল রাস্তাটা। গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে রক্তিম স্বস্তির শ্বাস ফেলল অনেকক্ষণ ধরে গাড়ি চালানো হয়েছে। নেমে দাঁড়িয়ে একটু হাত পা ছাড়াল একটা সিগারেট ধরিয়ে চারপাশটা তাকিয়ে দেখল এবার ভারি সুন্দর এই চাতালটা। মাঠটার একদিক দিয়ে গভীর খাদ নেমে গেছে। খাদের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে সূর্য ডুবে যাবার আগে একটু আদর করে দিল। লজ্জায় ওর সাদা রঙ অমনি টুকটুকে লাল হয়ে উঠল! পাখিদের ঘরে ফেরার কাকলিতে বন ভরে উঠছে। একটা নিশ্বাস ফেলে রক্তিম ভাবল, আহা, এখানে যদি আজ থাকা যেত!
ভাগ্যদেবী মনে হয় হেসেছিলেন এই কথা শুনে। কি হল কে জানে গাড়িটার! কিছুতেই আর স্টার্ট নিল না। রক্তিম বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছাড়ল এদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। সকালের আলো না ফোটা অবধি আর কিছুই করার নেই। গ্রামের জনবসতিও পার করে এসেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। হঠাৎ মনে পড়ল সিকিমের নানা ভিউ পয়েন্টে সরকার দু’ একটা ট্রেকার হাট বানিয়ে রাখে। সেরকম কিছু পেলে রাতের মতো সেটাতেই আশ্রয় নেবে রক্তিম। নাহলে গাড়ির সীট ভরসা। গাড়ি থেকে টর্চটা বের করে নিয়ে একটু এগোতেই পাথরের ঢিবির আড়ালে থাকা দোতলা বাড়িটা চোখে পড়ল। সাদা রঙের বাড়িটা সন্ধ্যার শেষ আলোতেও ঝকঝক করছে। রক্তিম দ্রুত সেদিকেই পা চালালবেশ খানিকক্ষণ কড়া নাড়ার পরেও যখন কেউ সাড়া দিল না, তখন একটু ঠেলা দিল বাধ্য হয়েই। দরজা ভেজানোই ছিল। ভিতরে ঢুকে অবাক হয়ে গেল রক্তিম। বোঝাই যাচ্ছে কোন অবস্থাপন্ন মানুষের বাড়ি। চকচকে আসবাব, দেয়াল মেঝে। এককণা ধুলো পড়লেও বুঝি আঙুলের ডগায় তুলে নেওয়া যাবে! মানুষগুলো যেন এখুনি এখানে ছিল। একটু ইতস্ততঃ করে এঘর ওঘর ঘুরেও কাউকে দেখতে পেল না বেচারি। বাসিন্দারা মনে হয় কোথাও বেড়াতে গেছে। সিকিমে চোরের উপদ্রব নেই বলে এরা অনেক সময়েই বাড়িতে তালা দেয় না। রক্তিমের খুব ক্লান্ত লাগছিল। সে ঠিক করল, আজকের রাতটা এখানেই কাটাবে। গৃহস্বামীরা ফিরে এলে তাদের সাথে দেখা ও ক্ষমাপ্রার্থনা করে ও কালকে চলে যাবে। কপাল ভালো থাকলে গাড়ির ব্যাপরেও ওদের সাহায্য পাওয়া যেতে পারে।
সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে রক্তিম একটু হাল্কা বোধ করলটর্চটা নিয়ে গিয়ে গাড়ি থেকে বিস্কুট, জলের বোতল আর কমলালেবু নিয়ে এলআজকের ডিনার এই দিয়েই সেরে নিল সোফায় পা ছড়িয়ে বসল। সিঁড়িটার দিকে তাকাল একবার। খুব ইচ্ছে করছিল, একবার ওপরে যায়। নিজের এই অসভ্যের মতো আগ্রহে নিজেই বিরক্ত হল। গৃহস্বামীর অনুপস্থিতিতে যাওয়া ঠিক নয় বলে মনকে চোখ রাঙাল খুব করেকিন্তু অদম্য এক কৌতূহলের তাড়নায় শেষমেশ দোতলায় উঠেও এল। বারান্দার পাশে টানা পরপর শোবার ঘরসিঁড়ির পাশে একটা লাল বল পড়ে থাকতে দেখে বুঝল এ বাড়িতে একটা বাচ্চাও থাকে। রক্তিম প্রথম যে ঘরটাতে ঢুকল, সেটাতে একটা বিছানা পাতা! ক্লান্তিতে ওর সারা শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে। এখনই এত ঘুম পাচ্ছে কেন, তা ভেবে আবাক হতেও পারা গেল না বেশিক্ষণ। সব শুভবুদ্ধি শিকেয় তুলে, পায়ের কাছে রাখা কম্বলটা মুড়ি দিয়ে ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল।
অগাধে ঘুমোচ্ছিল রক্তিম। হঠাৎ মাঝরাতে চলাফেরার খুটখাট আওয়াজে ওর ঘুম ভেঙে গেল। অভ্যেসমতো ঘড়িটা চোখের কাছে এনে দেখল, সেটা সন্ধ্যার পর থেকেই বন্ধ হয়ে আছে। হাল্কা হাসি আর কথার আওয়াজ কানে আসতে বুঝল ঘরের লোকজনেরা ফিরে এসেছে হয়ত এঘরে কেউ ঢোকেনি বলে তাকে দেখতে পায় নি। রক্তিম তাড়াতাড়ি উঠে গরম জামাটা গায়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলতার পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে বলা প্রয়োজন। কিন্তু বারান্দায় বেরিয়ে সে বেজায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সারা বাড়িতে আলো জ্বলছে। অনেক লোক ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে এদিক ওদিকে ছোটাছুটি করছে। একজন ভদ্রমহিলা – সাজগোজ এবং কথা বলার ধরণে মনে হল এই বাড়ির কর্ত্রী – সবাইকে নির্দেশ দিচ্ছেন। লোকজন সেইমতো সবকিছু সাজিয়ে ফেলছে। ঠিক মনে হচ্ছে কোন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। লোকজন ওঁকে বহুরানী বলে ডাকছে। রক্তিম তাঁর কাছেই এগিয়ে গেল – I am so sorry Ma’am, last night........”
কথাটা অসম্পূর্ণই থেকে গেল। বহুরানী এতটাই ব্যস্ত যে, তাঁর এসব শোনারই সময় নেই তিনি তখন অন্য একজনকে বিশেষ নির্দেশ দিতে ব্যস্ত। চারপাশের এত লোকজনের মাঝে যে একজন নেহাতই অপরিচিত, সেটা তাঁর নজরেই পড়ল না! রক্তিম আরো দু একবার চেষ্টা করে হাল ছাড়ল। অপরিচিত মহিলাকে কতবারই বা ডাকা যায়? তার চেয়ে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গৃহস্বামীর জন্য  অপেক্ষা করাই ভালো মনে হল তার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবার কথা শুনতে শুনতে রক্তিম এটুকুই বুঝল, যে কাল বহুরানীর ছেলের জন্মদিন। তার জিনিসপত্র কিনতেই সবাই মিলে শহরে গিয়েছিলেন। ছেলেটিকেও দেখা গেল বারান্দায় সেই লাল টুকটুকে বলটা নিয়ে খেলতে। দেখে মনে হল বছর দুয়েকের হবে। ওপরটা সাজানো শেষ। বহুরানী এবার দলবল নিয়ে চললেন নীচের তলায়যাবার আগে ছেলেকে আদর করে দিয়ে বলে গেলেন, - “তুম এঁহী খেলো,ম্যায় আভী আ জাউঙ্গী।“ – সম্মতিতে একগাল হাসল ছেলেটা। রক্তিম মুগ্ধ হয়ে দেখছিল, কী সুন্দর দেখতে ছেলেটাকে! সবাই নেমে গেল। পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এল এক পুরুষরক্তিম ভাবল একেই খুলে বলে ওর কথা। কিন্তু আশ্চর্য! ওর পা দুটো যেন দরজার চৌকাঠের সঙ্গে আটকে গেছে! অনেক চেষ্টা করেও একপা এগোতে পারল না। রক্তিম কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু কোন আওয়াজ বের হল না। ও কেমন যেন দরজার ওপর পর্দার মতন, তার উপরের কারুকাজ করা ফ্রেমের মতন শুধু দরজাটার একটা অংশ হয়েই আটকে রইলআর দেখতে থাকল। পুরুষটি নীচু হয়ে, মেঝের একটু ওপর দিয়ে সিঁড়ির মুখে এপার ওপার করে একটা নাইলনের সুতো বেঁধে দিলএবার ফিরে ডাক দিল, - “বাবুয়া!” বাচ্চাটার মুখ হাসিতে ভরে গেল। সে “চাচু চাচু” করে দৌড়ে এল। পুরুষ টি তাকে কোলে নিয়ে একটু আদর করে, ওর হাত থেকে লাল বলটা গড়িয়ে দিল অন্যদিকে। বাবুয়া দৌড়ে গিয়ে বলটা নিয়ে ছুঁড়ে দিল চাচুর দিকে। চাচু এবার বলটা সিঁড়ির একধাপ নীচে রেখে বাবুয়াকে হাত নেড়ে নিজের ঘরে চলে গেল! খিলখিল করে হাসতে হাসতে বাবুয়া বলটা নিতে দৌড়ে এল। রক্তিম দৌড়ে ধরতে চাইল বাচ্চাটাকে, চেঁচিয়ে সাবধান করতে চাইল – কিন্তু তার সব প্রয়াসই হাওয়ার মতোই মিলিয়ে গেল রাতের আকাশে। বাবুয়া এক দৌড়ে বলটা নিতে গিয়ে সুতোতে পা জড়িয়ে গড়াতে গড়াতে------
নিরুপায় রক্তিম দুচোখ বন্ধ করেও বাড়ি খান খান করা আর্তনাদটা শোনা থেকে নিজেকে আটকাতে পারল না। “চাচু” দৌড়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে সুতোটা কেটে দিয়ে হাহাকার করতে করতে নীচে দৌড়ে গেল। এরপর বহুরানীর বুকফাটা চিৎকার, বাচ্চার গোঙানি আর লোকেদের কোলাহল হঠাৎ করে সব স্তব্ধ হয়ে গেলএই নিস্তব্ধতা রক্তিমের স্নায়ু ছিঁড়ে দিচ্ছিল। সে প্রাণপণে শুনতে চাইছিল, শিশুটির কান্না, বা কোনরকম একটু শব্দ – যা জীবনের খবর দেয়! একটু পরে রক্তাক্ত শিশুটিকে বুকে করে টলমল পায়ে ওপরে উঠে এলেন বহুরানী। তাঁর সেই পাথরের মত মুখ দেখে কারো সাহস হয় নি সঙ্গে আসার। ঘরে ঢুকতে যাবেন, দৌড়ে এল গৃহসেবকদের একজন, - “বহুরানী, বুরী খবর হ্যাঁয়। সাবকী গাড়িকো  বুরী তরা অ্যাক্সিডেন্ট হুয়া। সাব আউর নেহী...”
“ইয়ে হো নেহী শকতা! সব ঝুট হ্যায়” – চাচুর হাহাকার এই নিয়ে দ্বিতীয়বার শুনল রক্তিম – কিন্তু সেই সঙ্গে হাসিতে ঝিকিয়ে ওঠা ছুরির মতো ধারাল দুটি চোখে চোখ আটকে গেল তার। পা দিয়ে বরফ-ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল যেনতারপর....আর তার কিছু মনে নেই।
সকালবেলার আলো মুখের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে, কষ্ট করে চোখ খুলল রক্তিম। নিজেকে ঘরের খাটেই পেল শোয়া অবস্থায়। ধড়মড় করে উঠে বসল। মাথাটা খুব ভার হয়ে আছে। কালকের কথা মনে পড়তেই দৌড়ে বাইরে এল। বাড়ি আগের দিনের মতোই জনশূন্য। তেমনই পরিস্কার। গতরাতের নৃশংস ঘটনার চিহ্ন মাত্র কোথাও নেই। তবে কি স্বপ্ন দেখল? অত্যন্ত ভয়াবহ নিষ্ঠুর এক স্বপ্ন? সেই স্মৃতির স্পর্শে রক্তিম আরেকবার শিউরে উঠল। কাল রাতের ভুক্তাবশেষটাও চোখে পড়ছে না। বাইরে ফেলে এসেছিল কি? কিচ্ছু মনে করতে পারছে না ও।
রক্তিম সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। নামবার মুখে নিজের অজান্তেই পা তুলে যেন পার হয়ে গেল এক অদৃশ্য দড়ি। নেমে এসে নিজের মনেই মাথা নাড়ল রক্তিম। কালকের পথ হারান আর খালি বাড়ি দুইয়ে মিলে তাকে একটা স্বপ্নই দেখিয়েছে – আর সেও বোকার মতো------
দরজা খুলে বাইরে বেরোবার মুহূর্তে একটা আওয়াজে রক্তিমের নজর সিঁড়ির দিকে ঘুরে গেল। লাল বলটা গড়িয়ে গড়িয়ে নীচে পড়ছে।
রক্তিম বাইরে এসে দাঁড়াল। একবার ফিরে দেখল বাড়িটার দিকে। তারপর সোজাপায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ড্রাইভারের সীটে বসে চাবি ঘোরাতে একবারেই স্টার্ট নিয়ে বেরিয়ে গেল গাড়িটা।
 ******************************************
রাবাংলায় ট্যুরিস্টের ভীড় এই প্রথম রক্তিমকে স্বস্তি দিল। খেয়েদেয়ে একটু আসপাশটা ঘুরে এসে হোটেলের বিছানায় একটা নিরুদ্বিগ্ন ঘুম দিল। ওঠার পর সন্ধ্যার আবছায়াতে অস্বস্তিটা ফিরে এল আবারসত্যিই স্বপ্ন ছিল? লাল বলটা কি তাহলে হাওয়াতেই গড়িয়ে....রক্তিম সিদ্ধান্তটা নিতে পারছিল না। প্রীতমকে বলবে? ও যাবার পরে আর কথা বলা হয়নি। ডায়াল করতে না করতেই প্রীতমের গলা আছড়ে পড়ল – “কাল থেকে পাত্তা নেই। কতবার চেষ্টা করেছি জানিস? কোথায় থাকিস?”
প্রশ্নের ঝড় সামলাতে সামলাতে রক্তিম দেখল গতকালের পুরো ঘটনাটাই তার বলা হয়ে গেছে।  প্রীতম খুব উত্তেজিত হয়ে উঠল – “তাহলে তো একটু খোঁজ লাগাতে হয়!”
-       “খোঁজ আবার করবি কি করে?”
-        “তুই আমার বড়মেসোর কথা ভুলে যাচ্ছিস। পুলিসমহলে ওঁর অনেক প্রতিপত্তি।“
-       “বেশি বাড়াবাড়ি করিস না প্রীত। এটা কলকাতা নয়!”
-        
-       “ওখানে একবার ফোন করে দেখি। আর তুই যেন একা একা আবার লেগশিপ চলে যাস না!”
রক্তিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ব্যাপারটা ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ও বেড়ানোর দিকে মন দিল। রাবাংলায় অনেক মনাস্ট্রি আছে। পরদিন সকালে তার  কয়েকটায় যাবে ঠিক করল। রালাংয়ের গুম্ফায় লামাদের ছাম নাচের মহড়া চলছে। এই মুখোশ নাচের মহড়া আগে কয়েকবার দেখলেও আসল নাচ দেখা হয় নি। ওখানে জিজ্ঞাসা করে জানল এই শনিবারই মূল অনুষ্ঠান। রক্তিম খুশি হয়ে উঠল। রবিবার অবধি ছুটি আছে। আজ মঙ্গলবার।  দু একদিনের জন্য রিন চেন পো ঘুরে আসবে। তারপর শনিবার নাচ দেখে রবিবার ফেরত যাবে। গুম্ফার পিছন দিকে যেতেই সামনের ফাঁকা উপত্যকা থেকে বরফ-ঠাণ্ডা হাওয়া এসে মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফোনের আওয়াজটা বড় কর্কশ লাগল এই পরিবেশে
-       “প্রীতম বলছি রে। কাল মেসোর সাথে কথা বলেছি। আমার চাপাচাপিতে উনি লেগশিপের ওসিকে একটা চিঠি লিখে দিয়েছেন।“
-       “ পুলিস? প্রীত, তুই কি পাগল হলি? হয়ত স্বপ্ন, হয়ত হ্যালুসিনেশন....”
-       “বাজে বকিস না। শোন, আমার কাজ খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাওয়ায় কোম্পানির বেশ কিছু লাভ হয়েছে। তাই আমার এ সপ্তাহটার ছুটি মঞ্জুর হয়েছে। আমি চিঠি নিয়ে কাল লেগশিপ আসছি। তুইও চলে আয়।“
-       “উন্মাদ কোথাকার! তোকে বলাই আমার ভুল হয়েছে। আমি আসছি না।‘
রক্তিম একাই বকে যাচ্ছিলপ্রীতম যে ওধারের ফোনটা অনেক আগেই কেটে দিয়েছে, সেটা বেশ কিছুটা পরে বুঝল ও।
অগত্যা রিন চেন পোর ভাবনা মুলতুবি রেখে পরদিন আবার লেগশিপ। প্রীতম এসে পৌঁছাল দুপুরবেলায়। এসেই টানতে টানতে ওকে নিয়ে চলল থানায়। এখানে অপরাধ খুবই কম বলে পুলিসও বেশ আরামেই থাকে। ট্যুরিস্টরা মাঝে মাঝে নানা জায়গার যাওয়ার পারমিট নিতে আসে। এদের দেখেও সেরকমই ভেবেছিলেন সুনীল লাচেংপা। চিঠি এবং পুরো কথা শুনে তাঁর মুখ খুব গম্ভীর হয়ে গেল। সহকারীকে ডেকে তিনি কিছু নির্দেশ দিলেন। তিনি একটা প্যাকেট দিতে তা থেকে বেশ কিছু ছবি টেবিলে ছড়িয়ে বললেন – ‘দেখুন তো, কাউকে চেনা মনে হয় কিনা?’ রক্তিম তাদের থেকে একটি ছবি নির্দেশ করল, - “চাচুকে এইরকম দেখতে।“
লাচেংপার ফর্সা মুখ লাল টকটকে – “এটা কার ছবি জানেন? দর্শন ছোগিয়ালের। অনেক জমি আর একটা বিরাট কমলালেবুর বাগানের মালিক। আপনারা এর বিরুদ্ধে....। এই চিঠিটা না থাকলে আপনাদের আমি জেলে পুরতাম।“
রক্তিম আর ঝামেলায় জড়াতে চাইল না। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে আসার সময় লাচেংপাও ওদের সাথে বাইরে এলেন। এখন তাঁর মুখ অনেক নরম। একটু ইতস্ততঃ করে বললেন – “আপনারা আজ সন্ধ্যার পরে হোটেলেই থাকবেন। আমি আসব।“
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ওরা রাস্তায় নেমে এল। এরপরে আর বেড়ানো জমে না। উদ্দেশ্যহীনভাবে একটু হেঁটে দুজনেই হোটেলে গিয়ে ঢুকল। সাড়ে সাতটা নাগাদ লাচেংপা এলেন। চায়ের অর্ডার দিয়ে সেরকমই ভাবলেশহীন মুখে একটা বাচ্চার ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, রক্তিমরা এই বাচ্চাটিকে কোথাও দেখেছে কিনা? রক্তিমের দম বন্ধ হয়ে এল প্রায়, – “এই তো! এ তো সেই বাচ্চাটাই!”
মাথা নাড়লেন লাচেংপা – “ওঙ্কার ছোগিয়ালের ছেলে রন্না। ওঙ্কার আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। এই বাগান,জমি সব ওরই ছিল। দু বছর আগে,বছরখানে রন্না জন্মদিনের আগের দিন সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে মারা যায়। ওঙ্কারও সেদিন একটা কার অ্যাক্সিডেন্টে......। দুটো ঘটনা একসাথে ঘটায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছিল। পুলিস অনেক খুঁজেও অস্বাভাবিক কিছু পায়নি। দর্শন ওঙ্কারের একমাত্র ভাই। এই দুর্ঘটনার পরে বহুরানীও আর বেশিদিন বাঁচেন নি। বছরখানেকের মধ্যেই আত্মহত্যা করেন। দর্শন পুরো ব্যাপারটায় খুব ভেঙে পড়ে। সে আর ও বাড়িতে থাকে নি। বাজারের কাছেই নতুন বাড়ি বানিয়ে বসবাস করতে থাকে। আর এতদিন পরে আপনারা এসে .....।“
প্রীতম মরিয়া হয়ে ওঠে – “দর্শনের সঙ্গে কথা বলা যায় না?”
-       “কি হবে দেখা করে? দর্শন খুব প্রভাবশালী আর বদমেজাজী। তাছাড়া ওর বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নেই।“
-       “তবু..... ওঙ্কার তো আপনার বন্ধু ছিলেন?”
-       ”দেখুন, কাল বিকেলে আমি ওকে ওদের পুরোনো বাড়িতে ডাকব। যদি আসে ভালো, না এলে কিছু করার নেই। আমি চাই আপনারাও আমার সঙ্গে চলুন।“
সকালে স্থানীয় দোকান থেকে রক্তিমরা টুকটাক জিনিস কিনছিল। মেয়ের জন্য একটা কাঠের জীপ কিনল রক্তিম। দোকানদার খুচরো ফেরত দিতে না পেরে  একটা লাল বল গাড়ির সাথে প্যাক করে দিল! রক্তিম আনমনে বলটা পকেটে ঢোকায়। ঘটনাপ্রবাহে তার মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না। প্রীতমের কলকাতা ফিরে যাওয়া থেকে আজকের এই লাল বল সব যেন একটা ছবির কোলাজ। কেউ যেন কোথাও বসে এঁকে যাচ্ছে, তারই তুলির টানে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সবার গতিবিধি।
 দুপুরের পর ওরা লাচেংপার গাড়িতেই সেই বাংলোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। খাদের ধারে মাঠের মধ্যে চেয়ার টেবিল সাজিয়ে রেখেছিল দর্শন ছোগিয়াল। রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে বসতে বেশ ভালো লাগছিল সবারই। আজ বাড়িটিতে লোকের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। দর্শনের ইশারায় তারাই সুদৃশ্য কাপে চা পরিবেশন করে গেল। চা-পর্ব মিটলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল দর্শন – “অব বোলিয়ে সুনীলসাব।“
লাচেংপা খানিকটা আমতা আমতা করেই প্রীতমদের পরিচয় ও রক্তিমের অভিজ্ঞতার কথা বললেন। শুনতে শুনতে দর্শনের মুখের ভাব পাল্টে যাচ্ছিল। অবশেষে হাসিতে ফেটে পড়ল – “অসময়ে আপনাকে আতিথ্য দিতে পেরে বাড়ির মালিক হিসেবে আমি আনন্দ প্রকাশ করছি রক্তিমবাবুকিন্তু এই গল্প আমায় শোনাচ্ছেন কেন? আমার দাদা এখানকার একজন বড় ব্যবসায়ী ছিল। সেই সূত্রে এ খবরটা ছবিসহ অনেক কাগজেই বেরিয়েছিল। আর বাড়ীর দেওয়ালে আমাদের সবারই ছবি আছে। সেসবের প্রভাবেই আপনার অবচেতন মন আপনাকে স্বপ্ন দেখিয়েছে এতদিন বাদে আমাকে ডেকে এনে এ গল্প শোনানোর মানে কী? আমার দাদা বৌদি আর ভাইপোকে আমি কতটা ভালোবাসতাম, সেটা সুনীলভাইয়াও জানে। The case is closed Mr, Raktim.  Do you understand THAT? – দর্শনের গলা ক্রমশঃ চড়ছিল। সেই হাসিখুশি অতিথিপরায়ণ হাসিটা এবার উধাও। সশব্দে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।
রক্তিম তার নামের মতোই টুকটুকে লাল হয়ে উঠল লজ্জায়। হাতজোড় করে মাপ চাইতে গিয়েও থমকে গেল। দর্শনের চোখে ঝিলিক দিয়ে উঠেছে ছুরির মতো ভয়াল সেই হাসিটা! হাত নামিয়ে নিল রক্তিম। মাথা নাড়ল। সবাই যাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছে। পকেট থেকে লাল বলটা বের করে দেখল একবার। মনে মনে বোধহয় বলতে চাইল, সরি রন্না! আর কিছু করার নেই। কোন প্রমাণ নেই। The case is closed!
 দর্শনের শাণিত বিদ্রূপ ঝলসে উঠল – “সেই বলটাই নাকি রক্তিম সাব?” দর্শন হাসছিল বটে, কিন্তু বলটা থেকে চোখ সরাতেও পারছিল না! বলটা ওকে যেন এক অমোঘ আকর্ষণে টেনে রাখছিল। ক্রমশঃ উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল দর্শন
রক্তিম আবারও হতাশায় মাথা নাড়ল। তারপর বলটা ছুঁড়ে দিল খাদের দিকে। কেন কে জানে, দর্শন বলটা ধরার জন্য হাত বাড়াল! পাহাড়ী হাওয়ায় বলটা তার আন্দাজের চাইতে একটু বেশিই বাঁক নিয়েছিল। সেদিকে একটু বেশি ঝুঁকতেই -----
মাঠের ধারের খাদটা অনেক গভীর। দর্শনের আর্তনাদটা শোনা গেলেও পড়ার আওয়াজটা শোনা গেল না।

No comments: