এমনিতে
কিছুই বোঝা যায়নি বাইরে থেকে। ওর বয়েসী আর পাঁচটা ছেলের মতোই দীপান সকালে স্কুলে
যায়, দুপুরে বোসেদের পুকুরে ঝাঁপাই জোড়ে, বিকেলে ডাংগুলি কিংবা কাবাডি –
সন্ধ্যাবেলায় আধোঘুমে ঢুলতে ঢুলতে ভুল পড়া বলে মার কাছে বকুনিও খায় রোজ। কখনো কখনো
খুব আনমনে বাগানের গাছপালা জড়িয়ে ধরে ধীরে ধীরে কথা বলে বটে, কিন্তু ওটুকু
কল্পনাবিলাস তো সব শিশুরই থাকে। নাঃ, ছেলেটার মধ্যে কোন বিশেষত্ব আছে বলে তো
সুমিতার মনে হয় নি কখনও। বরং তার ছেলে যে কোন অবস্থাতেই মিছে কথা বলেনা – সে
ব্যাপারটায় একটু প্রচ্ছন্ন গর্বই জমে মায়ের বুকে।
প্রথমদিকে
সেভাবে কিছু বোঝা যায় নি। অসুস্থ মামাশ্বশুরকে দেখে ফিরছিলেন সুমিতা। সেরকম কিছু
হয়নি বৃদ্ধের। ঋতুবদলের সাধারণ জ্বর। তবু দেখতে যেতে হয় তাই যাওয়া। ফেরা পথে হঠাৎ
দীপান জিজ্ঞাসা করল – “মা, এই দাদুটা কি মরে যাবে?”
- ‘বালাই ষাট। ওরকম বলতে নেই বাবা। জ্বর হলে
কেউ মরে যায় নাকি? দুদিন ওষুধ খেলেই সেরে যাবে।‘
কিন্তু দুদিনের মধ্যেই ভদ্রলোকের মৃত্যুসংবাদ শুনেছিলেন সুমিতা।
দুঃখের সঙ্গে সেদিনের কথোপকথন মনে পড়লেও সেটা নিয়ে ভাবার দরকার মনে হয় নি তাঁর। কিন্তু
আবার এবং বারবার যখন এই সমাপতন ঘটতেই থাকল, তখন একটু সচেতন হয়ে উঠলেন সুমিতা।
ইদানীং তাই কোন অসুস্থ লোকের বাড়িতে গেলে ছেলেকে বাড়িতে রেখে যেতেই বেশি স্বচ্ছন্দ
বোধ করেন তিনি।
অবশ্য
উলটোটাও যে ঘটে না এমন নয়। এই তো সেবার। বাড়িতেই তো। দীপানের ঠাকুমার খুব শরীর
খারাপ ছিল। আত্মীয় বন্ধুরা সবাই এসে দেখা করে যাচ্ছিলেন। ডাক্তারও আশা ছেড়েই
দিয়েছিলেন বলা চলে। তা সেদিন সন্ধ্যায় সুমিতা আর তাপস একটা ঘরে বসে এইসবই আলোচনা
করতে করতে চোখের জল ফেলছিলেন। দীপান ওর বলটা নিতে ঘরে ঢুকেছিল। বলটা ড্রপ করাতে
করাতে খুব স্বাভাবিকভাবেই বলে বসল – “আচ্ছা, তোমরা সবাই এত কান্নাকাটি করছ কেন
বলোতো? অসুখ তো ওষুধ খেলেই সেরে যায়! নিজেরাই তো বলো। ঠাম্মিকে ওষুধ খাওয়াও, ভালো
হয়ে যাবে। ব্যস!”
সত্যি
সত্যিই কিছুদিন বাদে ভালো হয়ে উঠেছিলেন ভদ্রমহিলা।
সুমিতা
খেয়াল করেছেন,সবসময় এ জাতীয় মন্তব্য করে না দীপান। করে না যখন, তখন জিজ্ঞাসা করে
দেখেছেন, সে উত্তর প্রবাবিলিটির নিয়ম মেনে কখনো ঠিক কখনো ভুল। কিন্তু নিজে থেকে
যখন বলে তখন – নাঃ, সেখানে ভুল হতে দেখেন নি অমিতা।
একজন
বুদ্ধিমতী অভিজ্ঞ মায়ের মতোই এটাকে নিয়ে কোনরকম নাড়াঘাঁটা বা কারো সঙ্গে আলোচনাও
করেন নি সুমিতা। এমন কি খোদ দীপানের সঙ্গেও নয়। নিজস্ব অভিজ্ঞতায় তিনি জানেন অমন
একটু আধটু ESP (extra sensory
perception) অনেকেরই থাকে। সেটা
নিয়ে হৈ চৈ করলে লাভের চেয়ে ক্ষতি হয় বেশি। আর অনেক ক্ষেত্রেই বয়েস বাড়ার সঙ্গে
সঙ্গে এই বোধ আপনি ভোঁতা হয়ে যায়। তাই আর
পাঁচটা বাচ্চার মতোই দীপান ক্লাস ওয়ান, টু, থ্রী টপকাতে টপকাতে স্কুল পার হয়ে
কলেজ, কলেজ পার হয়ে চাকরি – লিটল বক্সেসের খাপে খাপে দিব্বি এঁটে যায়।
বলতে ভুলে গেছি, এর মধ্যে দীপান এই মৃত্যু নিয়ে কথা বলাও ছেড়ে দিয়েছিল।
তাতে সুমিতা আরোই নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না সেই বোধ অন্তঃসলিলা
ফল্গুর মতো ছেলের মননে অনবরত শুধু বয়ে যাচ্ছিল না, আরও শক্তিশালী হচ্ছিল। দীপান প্রথম বিষয়টা টের পায় ক্লাস এইটে। সকালে পড়ার
টেবিলে বসে পড়ছিল। আগের দিন প্রজেক্টের কাজ সারতে গিয়ে অনেকটা রাত জাগতে হয়েছে,
তাই পড়ার চেয়ে ঢুলছিল বেশি। সেই আধোঘুমে তার মনে হল, বড়মামা একটা বিছানায় সাদা
চাদর ঢাকা দিয়ে শুয়ে আছে। কে যেন বলল অ্যাকসিডেন্ট। শব্দটার অভিঘাতেই বোধহয় চটকাটা
ভেঙে যায়। চমকে দেখে স্কুল যেতে হলে আর সময় হাতে নেই। হড়বড়িয়ে কোনমতে নাকেমুখে
কিছু গুঁজে সে দৌড়াল বাস ধরতে। তারপর পড়া, খেলা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা – এসবের
ভীড়ে স্বপ্নটার কথা ও ভুলেই গিয়েছিল।
বাড়ি ফিরতে দরজা খুলেছিল মা নয়,
কাকীমা। দীপানের বড়মামা আজ সকালে একটা স্কুটারের ধাক্কায় ---- মা বাবা সেখানেই
গেছে। কাকীমা এসেছে দীপানকে সঙ্গে করে নিজেদের বাড়ি নিয়ে যেতে। ওর পরীক্ষা আছে বলে ....... দীপানের কানে আর কিছু ঢুকছিল
না।
খুব অবাক হয়েছিল দীপান। আবার সময়ের সঙ্গে ভুলেও গিয়েছিল। দ্বিতীয় চমকটা এলো
আরো বছর তিনেক পর। দীপান তখন হোস্টেলে থাকে। একদিন রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে বন্ধুরা
সবাই আড্ডা দিচ্ছিল জমিয়ে। দীপানের কেন জানি ভালো লাগছিল না কিছু। সে চুপচাপ
বারান্দায় বেরিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরাল। হাতের সিগারেট হাতেই রইল। দীপান দেখতে
থাকল, - ঠাম্মি তার খাটে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল ঠাম্মির। বোধহয়
জলতেষ্টা পেয়েছে। আধোঘুমে চোখ বন্ধ করেই গেলাসটা নেবার জন্য ঝুঁকল একটু। ঘুমচোখে আন্দাজটা
বোধহয় ঠিক হল না। টাল সামলাতে না পেরে উলটে পড়ল মেঝেতে। একটু হাত পা ছটকাল.......
– উঃ! হাতে সিগারেটের ছ্যাঁকা লাগতেই দীপানের ঘোরটা কেটে গেল। ফিরে এল বড়মামার স্মৃতিও। পরদিন ভোর হতে না হতেই বাড়ি
ছুটল দীপান। বাবা শুধু ধরা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন – “তোকে কে খবর দিল? আমি সকালে ফোন
করে শুনলাম তুই নাকি বাড়ি আসার জন্য বেরিয়ে পড়েছিস।“
এরপর আরো বেশ কয়েকবার। সবার
বেলায় হয় না, এমন কি দীপান নিজে চাইলেও নয়। কিন্তু যখন আসে এই স্বপ্ন কিম্বা ভিশন –
যে নামেই ডাকো তাকে তাতে কিচ্ছু এসে যায় না দীপানের – তখন তা অমোঘ হয়েই আসে। কাউকে
বলতেও পারে না দীপান। সে জানে এটা কেউ বিশ্বাস করবে না। উলটে সে সবার হাসির পাত্র
হয়ে যাবে। এই অনুভূতিটা নিয়ে হাসিঠাট্টা সহ্য করতে পারবে না ও।
এভাবেই কাটছিল দিন। যত বড় হয়েছে দীপান কমে এসেছে এই
স্বপ্নদূতের আনাগোনা। গত দুবছরে তো একবারও আসে নি। তাহলে কী ছুটি মিললো এই
অবাঞ্ছিত অনুভূতির হাত থেকে? মনে মনে স্বস্তির শ্বাস ফেলে দীপান। বেশ হালকা লাগে
নিজেকে। খুশির আরেকটা কারণও ঘটেছে সম্প্রতি। তার আর রূপার মেলেমেশায় দু বাড়ির
অভিভাবকদের সম্মতির সীলমোহর পড়ে গেছে। সেটা সেলিব্রেট করতে আজ ওদের সিনেমা আর
‘আবার খাবো’ তে রাতের খাবার কথা। ফুরফুরে মেজাজে দুপুরে বিছানায় শুয়ে পা নাচাতে
নাচাতে এসবই ভাবছিল। ভিশনটা এলো তখনই।
- একটা ছেলে আর
একটা মেয়ে। ঘরটা অন্ধকার বলে দীপান তাদের মুখটা দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু মেয়েটির
পরনের কালো শাড়িটি তার নজর কাড়ল। কথা বলছে তারা। মেয়েটির ভঙ্গিতে বিরক্তির ছাপ
স্পষ্ট। একসময় রেগে উঠে পড়ল। এবার তার মুখ দেখা যাবে কি? নাঃ, ঝোলানো চীনা লণ্ঠনের
আড়ালে মেয়েটার মুখ ঢাকা পড়েছে। বেরিয়ে গেল মেয়েটা। ছেলেটা তাড়াতাড়ি উঠে বাধা দিতে
চাইল, কিন্তু পারল না। হঠাৎ বুক চেপে গড়িয়ে পড়ল টেবিলের ওপর। ছেলেটার মুখ এবারেও
দেখতে পেল না দীপান, কিন্তু এলিয়ে পড়ে থাকা হাতের ঘড়িটা যেন বড্ড চেনা চেনা।
হাঁকপাক করে উঠে বসল দীপান। রীতিমতো ঘামছে ও। কার পালা
এবার? এই প্রথম সে কারো মুখ দেখতে পায়নি। বড্ড অস্থির লাগছে। ঘড়ির দিকে তাকাল।
দেরি হয়ে গেছে অনেকটা। সিনেমা শুরু হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। দেরি করে গেলে রূপা কতোটা
রেগে যায় সেটা মনে পড়তেই দীপান স্বপ্নটাকে এককোণে ঠেলে দিয়ে জামাটা গলাল। দ্রুত
চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতেই উবেরে ফোন করে ট্যাক্সি ডেকে নিল। তাতেও দেরিটা ঠেকানো গেল
না। লাল শাড়িতে রূপাকে আজ দারুণ সুন্দরী লাগছে। রাগে মুখটাও লাল হয়ে আছে। দীপান
মুগ্ধ হয়ে তাই দেখছিল। রূপা ওর অবস্থা দেখে হেসে ফেলল। ধড়ে প্রাণ এলো দীপানের।
চটপট দু ঠোঙা পপকর্ণ কিনে হলে ঢুকে পড়ল।
টুকটাক কথা, পপকর্ণ, মুভি – সবই একসময় শেষ হয়। বেরিয়ে
এসে রূপা মিটিমিটি হাসে – “আজ তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। চলো ‘আবার খাবো’তে
যাই।“
রেস্তোঁরাতে ঢুকতেই ওয়েট্রেস দুজনকে দুটি গোলাপের তোড়া
দিয়ে স্বাগত জানায়। তারপর নিয়ে যায় দোতলার কেবিনে। কেবিনে সুন্দর মোহময় নীল-সবুজ
আলো। প্লেটের উপর রাখা একমুঠো জুঁই। সারা ঘর সুন্দর গন্ধে ভরে গেছে। দেখেই দীপানের
মন খুশিতে ভরে উঠল। হাসিমুখে রূপাকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়েই সে বিস্ময়ে পাথর হয়ে
গেল।রূপার গাঢ় লাল শাড়িটা এই আলোয় কালো দেখাচ্ছে! মাথার ওপরের ঢাকা দেওয়া আলোটা
চিনতে একটুও অসুবিধা হল না দীপানের। স্বয়ংক্রিয়ভাবে নজর চলে গেল নিজের হাতের দিকে।
ঘড়িটা কেন এত চেনা লাগছিল, তা এখন জলের মতো পরিস্কার।
দীপান ছটফটিয়ে উঠল। নিঃসীম একটা আতঙ্ক যেন গ্রাস করতে
চাইছে ওকে। রক্তশূন্য দেখাল মুখখানা। রূপাকে বলল – আর এক মুহূর্ত এখানে নয়। শিগগির
বাইরে চলো প্লীজ।
-
সে কি? এত
কষ্ট করে সাজালাম সব কিছু। তোমার পছন্দের রঙ, পছন্দের ফুল! তোমার ভালো লাগল না?
-
ভালোলাগার কথা
নয়। পরে বুঝিয়ে বলছি। আমি সিম্পলি এই জায়গাটা সহ্য করতে পারছি না!
-
তোমার না ভালো লাগাটা এত রূঢ়ভাবে না বললেও পারতে দীপ।
বিয়ে ঠিক হওয়া মাত্রই তোমার এই বদল আমার অবাক লাগছে।
-
অন্যের কথা শোনার ধৈর্য তোমার আছে?
-
না নেই। খুশি?
রূপা চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ায়। ওর
মুখটা এখন লণ্ঠনের ওপারে। পরমুহূর্তেই ঘর ছেড়ে দুম দুম করে বেরিয়ে যায়। দীপানের দম যেন আটকে আসে।
কষ্টে, আতঙ্কে হিম হয়ে আসে শরীর। তাহলে কি?
না, কিছুতেই নয়। ও এখন মরতে পারেই না!
আন্তরিক এই বিশ্বাসের জোরেই বোধকরি কষ্টটাও হালকা হয়ে আসে। দীপান তাড়াতাড়ি
বেরিয়ে রূপার পিছনে ছুটতে থাকে। কিছুতেই ওকে আজ চলে যেতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু ও
পৌঁছোবার আগেই একটা বাসে লাফ মেরে উঠে পড়ে রূপা।
দীপান দাঁড়িয়ে পড়ল। ওর খুব হতাশ
লাগছিল। মেয়েটা এত যত্ন করে একটা সন্ধ্যা তৈরি করেছিল, আর ও একটা স্বপ্নের জন্য –
স্বপ্নের জন্য? আরে তাই তো? এই প্রথম ও স্বপ্ন মিথ্যে
করে বেঁচে আছে! এই আনন্দে দীপান দু পাক ঘুরে একচক্কর নেচে নিল। শুধু বেঁচে থাকাটাই
যে একটা বিরাট আনন্দ – সেটা সে এতদিনে এইভাবে অনুভব করতে পারে নি। আর ওই হতভাগা
স্বপ্ন? তার থেকেও মুক্তি মিলল তাহলে! হালকা মনে শিস দিতে দিতে সে বাড়ির দিকে
এগোলো। আর তখনই ওর মাথায় অদ্ভুত ভাবনাটা এলো। ও সত্যি সত্যি বেঁচে আছে তো? নাকি ওই
ভূতের গল্পে যেমন বলে তেমনি ও-ও এখন---। গলাটা শুকিয়ে উঠল হঠাৎ। আচ্ছা ও যখন
ফুটপাথে নাচছিল, তখন কি কেউ ওকে খেয়াল করেছে? মানে দেখতে পেয়েছে ওকে? দীপান অনেক
চেষ্টা করেও মনে করতে পারল না। রাস্তায় কারো সঙ্গে কথা বলে দেখবে? কিন্তু যদি কেউ
শুনতে না পায়? দীপান বুঝতে পারল ওর ভিতর থেকে একটা ভয় উঠে এসে ওর আওয়াজ স্তব্ধ করে
দিচ্ছে। একটাই উপায় বাকি আছে তাহলে। ওই কেবিনটায় গিয়ে সরজমিনে দেখে
আসা।
চমকে উঠে দীপান দেখে, কখন যেন সে আনমনে আবার খাবো
রেস্তোঁরার সামনে এসে পড়েছে। কি করবে এখন ও? যাবে ভিতরে? দেখে আসবে নিজের চোখে?
নাকি এসব বোকা বোকা ছেলেমানুষি ভাবনা ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাবে? রূপাকে কল করাটাও তো
জরুরি। মোবাইলটাই বা কোথায় গেল? টেবিলেই পড়ে আছে নিশ্চয়। এইসব ভাবতে ভাবতেই কখন
যেন দরজা পার করে ভিতরে ঢুকে পড়ে দীপান। এগোতে থাকে কেবিনের দিকে।
No comments:
Post a Comment