Friday, December 21, 2018

বাঁশি


প্রথম বাঁশি শুনেছিল দশ বছর বয়েসে। তার আগে বইয়ের পাতাতে, ছবির মাধ্যমেই পরিচয়। একটুকরো ফুটোওয়ালা বাঁশ নিয়ে এত আদিখ্যেতার যে কি আছে তা ছোট্ট ইমনের মাথায় ঢোকে না। জিনিসটা গোটা হলেও বা না হয় কিছু মানে ছিল!
গরমের ছুটির দুপুরে চোখে ঘুম নেই। তাই সে বসে বসে স্কুলের ছুটির কাজগুলো শেষ করে ফেলছিল একদমে দিন দশেকের মধ্যে ওগুলো শেষ করে ফেলতে পারলেই বাকি কুড়িটা দুপুর ওর একেবারে নিজস্ব। বইয়ের আলমারির কাঁচের উল্টোপিঠে অনেকগুলো না পড়া নতুন বই জমা হয়ে আছে। তাই সে একমনে ঘাড় গুঁজে লিখে চলেছে। টেবিলের পাশের জানলা পেরিয়ে ফুটপাথ, - ফুটপাথ পেরিয়ে রাস্তা। অনেকক্ষণ বাদে বাদে একটা হর্ণ, ‘বাসন নেবে গো বা--ডাক, আর পুরোনো কাগজের ফেরিওয়ালার হাঁক বাদ দিলে ভরদুপুরে মোটামুটি নিস্তব্ধ পাড়ার এই রাস্তাখানি।
হঠাৎ তার খাতার পাতায় ছায়া পড়ে। মুখ তুলে তাকাতেই ময়লা জামা পরা একটা রোগা হাসিমুখ বলে উঠল, - “দিদিভাই, বড্ড খিদে পেয়েছে। একটা রুটি দিতে পার?”
ভিখিরিদের ভিক্ষে চাইতে এই বয়েসেই অনেক দেখেছে ইমন। কিন্তু এমন হাসিমুখে নিসঙ্কোচে আবদার করতে এই প্রথম দেখল। ছেলেটিকে একটু দাঁড়াতে বলে সে উঠে ভিতরে গেল। এল তো! এবার করে কি? মা ঘুমোচ্ছে। এই কারণে মার কাঁচা ঘুম ভাঙালে কি হবে তা ভালই জানে ইমন। অতএব সে রাস্তায় না গিয়ে ফ্রীজ থেকে কয়েক পিস পাউরুটি আর দুটো মিষ্টি নিয়ে এল। নিজের ড্রয়ারে কয়েকটা লজেন্স ছিল। কি ভেবে সেটাও দিয়ে দিল ইমন। ছেলেটির আনন্দ আর ধরে না! একগাল হেসে বলে,
-       “তুমি আমায় এত কিছু দিলে, আমি তোমায় কি দিই বলোতো? আমার কাছে তো এই বাঁশিটা ছাড়া কিছু নেই। এটা তুমি নাও।“
ইমন রীতিমত ঘাবড়ে যায় – “না. না। আমার কিছু চাই না। তাছাড়া আমি বাঁশি বাজাতে জানিও না।
-       “তাহলে শোন। আমিই বাজিয়ে শোনাই। এটাই হোক আমার তোমাকে দেওয়া উপহার।“
নিঝুম দুপুর সেই বাঁশির সুরে ভেসে যায়। ইমন চুপটি করে শোনে। কোথাও মনের গভীরে এক অস্থিরতা কাজ করে। মনে হয়, এই সুরেলা আওয়াজ সে আগেও শুনেছে। একটু হয়ত অন্য সুর, অন্য টান, - কিন্তু শুনেছে যে, তাতে কোন ভুল নেই। এই সুর, এই বাঁশি তাকে একটা নরম ওড়নায় ঢেকে দিল। সেই ওড়নার উপর  পেঁজা তুলোর মত বরফ ঝিরঝিরিয়ে পড়ছে, পড়তেই থাকছে। সে কেমন যেন তাতে ডুবে যাচ্ছে, তার চারপাশ ক্রমশঃ আবছা হয়ে  আসছেআরও গভীর কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ইমন..............
-       “ইমন, তুমি হোমওয়ার্ক না করে জানলা ধরে দাঁড়িয়ে আছ?”----
মায়ের ডাকে নরম কুয়াশারা ভয় পেয়ে এদিকে ওদিকে সুট সুট লুকিয়ে পড়ে ইমন অবাক হয়ে দেখে তার গাল দুখানি ভিজে সপ্ সপ্। বাঁশিওয়ালা কখন যে চলে গেছে তার বাঁশি নিয়ে, সে জানেও না।
সেই শুরু। এরপর থেকে বাঁশি শুনলেই যেন এক বহুদিন আগের শোনা সুরমনে পড়ে-পড়েনাহয়ে লুকোচুরি খেলত। এই খেলায় কষ্ট পেত ইমন, আবার কিছুদিন বাঁশি না শুনলে ভুলেও যেত ব্যাপারটা। মিনতি দেবী মেয়ের এই ভাবান্তর লক্ষ্য করেছিলেন। বাঁশির সুর থেকে মেয়েকে যথাসম্ভব আড়াল করে রাখতেন তাই।
একটু একটু করে বড় হচ্ছিল ইমন। পড়াশোনা, খেলাধূলা ইত্যাদির ভীড়ে বাঁশির সুর বড়ই ক্ষীণ হয়ে গেছে। সেভাবে মনেও পড়ে না আজকাল। বিশেষতঃ এই গরমের ছুটিতে সে খুব উত্তেজিত। তাদের ইস্কুল থেকে নাইন টেনের মেয়েদের নিয়ে এস্কারশন হবে। ইমন অনেক ঝোলাঝুলি করে মা-বাবার অনুমতি জোগাড় করেছে। এই প্রথম সে বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যাবে, প্রথম দেখবে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর পান্না সবুজ তিস্তা।
হৈ হৈ করে গল্পে গানে ঝলমল করতে করতে একদল কিশোরী পৌঁছে গেল টুং-সোনাদা হয়ে ঘুম-এ। এখানকার লজে তাদের থাকার ব্যবস্থা। লজের কোন ঘরে কে কে থাকবে তা দিদিমণিরাই ঠিক করে দিলেন। চটপট ফ্রশ হয়ে সবাই দল বেঁধে বেড়িয়ে পড়ল আশ পাশটা একটু ঘুরে দেখবার জন্য। আজ তাড়াতাড়ি লজে ফিরে শুয়ে পড়তে হবে। কাল রাত থাকতে উঠে ওরা যাবে টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখতে। তা গেল ওরা। জীবনের এক পরম বিষ্ময়ের সামনে দাঁড়িয়ে চঞ্চল মেয়ের দল একেবারে চুপ। কিছু সৌন্দর্য আজও আছে পৃথিবীতে যা মানুষকে নির্বাক করে দেয়।
ফিরে এসে স্নান, ব্রেকফাস্ট সেরে ঘুম। দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে আবার বেরোনো হবে। তাই সক্কলে চটপট গড়িয়ে পড়ল যার যার বিছানায়, তাদের নাক ডাকতে লাগল ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ। কিন্তু ইমনের যে কি হল কে জানে! তার চোখে আজ ঘুম নেই। কেন কে জানে, তার বারবার মনে হচ্ছে এই অনৈসর্গিক সুন্দর দৃশ্যটা তার অপরিচিত নয়। সোনার কলসের মত সূর্য ওঠার সাথে তার প্রথম রঙ মেখে সামনের ওই বিস্তৃত ধূসর পাহাড়ের সারির গা বেয়ে যেন ভেসে আসছিল এক আধচেনা সুর; - যার আভাস সে বারবার পেয়েছে বাঁশি বাজলেই, - অথচ স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয় নি কখনো।
বিছানায় খানিকক্ষণ ছটফটিয়ে এধার ওধার গড়িয়ে সে বাইরে বেরিয়ে এল। সকালের ঝকঝকে আকাশ এখন মেঘে ঢেকে গেছে। চারপাশ কুয়াশায় ঢাকা। গায়ে একটা সোয়েটার চাপিয়ে লজের পিছনদিকের রাস্তাটায় নেমে এল ইমন।
কুয়াশা ঘেরা পাইন-ধুবির ছায়াভরা পথ। সেই পথ ধরে আনমনে কিছুটা এগিয়ে গেলতখনই ওর চোখে পড়ল পথের পাশে উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাকা  পায়ে চলা পথটাকেকেমন যেন চেনা চেনা মনে হল তার। একটু ইতস্ততঃ করে সেই পথ ধরে এগিয়ে চলে ও। আর কুয়াশারা ক্রমশঃ ঘন হতে হতে যেন তার মনের ভিতরে, বুকের মাঝে ঢুকে যায়। কিন্তু যতই ঘন হয়ে নামুক কুয়াশারা, পথ চিনতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তার। বড় চেনা, বড় পরিচিত এই পথ।  সব কিছু ছাপিয়ে, সবথেকে চেনা বোধহয় হাওয়ায় ভেসে আসা ঐ বাঁশির সুর; - যে সুরের আভাস তার স্বপ্নের, তার স্মৃতির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে।  এই সুর শোনার জন্য এই মায়াময় আবছায়াটুকুর বড় প্রয়োজন ছিল। ইমন জানে, এই চেনা পথের বাঁকে একটা ঢাল আছে। সেখানে যে পাথরটা আছে, তার উপর বসলে নীচের শহরটা দেখা যায়। সেই পাথরের খোঁজে দ্রুতপায়ে এগিয়ে চলে ইমন, আরও দ্রুত পিছিয়ে যায় সময়, আরও তীব্র হয়ে ওঠে বাঁশির সুরেলা আহ্বানসামনের গাছগুলোর আড়াল সরতেই পাথরের উপরে বসা ছেলেটির পিঠ দেখা যায় । তার বাঁশীতেই বাজছে সেই মন-জাগানিয়া সুর। সব ভুলে ও চেঁচিয়ে ওঠে, - “দা-দা-ম-ণি-ইইইইইই” – প্রাণপণ শক্তিতে ছুটতে থাকে, যেন অনেক দেরী হয়ে গেছে আসতে, আর এক সেকেণ্ডও নষ্ট করা চলবে না!
বাঁশি থামিয়ে অবাক চোখে ফিরে তাকায় এক মধ্য তিরিশের যুবক। তার চোখের জমাট বাঁধা বিস্ময় ইমনের দৌড় থামিয়ে দেয়। থমকে দাঁড়ায় ইমন, আর অস্ফুটে উচ্চারিত হতে শোনে, - “ কত, ক-তো বছর পরে এই ডাক শুনলাম! কে তুমি?”
গলা আটকে আসে বেদনায়। খুব ধীরে ধীরে কোনক্রমে বলে, - “আমায় কি একটুও চেনা যায় না?”
আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে যুবকটি – “আমার এক বোন ছিল। সে চলে যাবার পরে আর কেউ আমায় ও নামে ডাকে নি। মিমির কোন বন্ধুও তো....”
ইমন একটা নিঃশ্বাস ফেলে। বলে, “আমারই ভুল হয়ত।” ধীরে ধীরে পিছন ফিরে পুরোনো পথ ধরে এগোয়। মনে পড়ে একবার এই পাথরটার পাশেই দুষ্টুমি করে মিমি লুকিয়ে রেখেছিল দাদামণির বাঁশি। একবার ভাবল ফিরে যায়, বড় পাথরটার পাশের ছোট ছোট পাথরগুলো সরালেই তো বোঝা যাবে,আর বুঝিয়েও দেওয়া যাবে যে, এ সত্যি, নাকি তার অলস কল্পনা! ফিরে তাকাল সে। দেখতে পেল দুটি অবাক অপরিচিত চোখ। নিজের মনেই মাথা নাড়ল ইমনফিরে চলল লজের পথে। সেখানে বন্ধুরা আছে তার অপেক্ষায়। আজকে দুপুরে সবাই মিলে দার্জিলিং যাবার কথা আছে। তাড়াতাড়ি পা চালায় ইমন।

No comments: