ফুলশয্যার রাতে
অভী যখন বৌকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘মধুচন্দ্রিমায় কোথায় যেতে চাও,’ – তখন তার পিছনে
নতুন বৌকে ইম্প্রেস করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন উদ্দেশ্য ছিল না। প্রশ্নটা শুনে অনিরিনার
মুখটি দশটা হাজার ওয়াটের বাতির মত ঝলমলিয়ে উঠল, দেখে অভীর মনও দুলে উঠল। ‘যেখানে
বলব, নিয়ে যাবে আমায় ?’ সুন্দরী নতুন বৌকে জবাব দিতে গিয়ে পুরুষসিংহ হয়ে উঠল অভী –‘শুধু
বলেই দেখ না !’
‘মানে,
নিউজীল্যান্ডে নিয়ে যাবে আমায় ?’
নি উ জী ল্যা ন্ড
! নামটা অভী ম্যাপে দেখেছে। আর দেশটা ক্রিকেট খেলে, এর বাইরে আর কিছু জানা নেই
তার। এটুকু জানা নিয়ে আর যাই হোক, নববিবাহিতা বধুকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমায় যাওয়া যায়
না। তাছাড়া পাসপোর্ট ভিসা এসবও তো জোগাড় করতে হবে – এইসব বলে তখনকার মত মানরক্ষা
করে অভী। ‘তাতে কি আমরা পরেই যাব, তাড়া কিছুই নেই’ – অনিরিনার কথার মধ্যে একটু
জেদও মিশল কি ?
বারান্দায় এসে
একটা সিগারেট ধরায় অভী। যে কথাটা নতুন বৌকে আজকের রাতে অন্তত বলা যায় না,সেটাই উঠল
কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়ার সাথে – অর্থমনর্থম্! নিজেকে আহাম্মক বলে গালিও দিল দশরথের
মত সত্যবদ্ধ হবার জন্য। ছোট থেকে দিদিমার মুখের রামায়ণপাঠ শোনাটা একেবারেই বেকার
গেছে, ভাবল সে।
এরপর আর হনিমুনের
প্রসঙ্গ ওঠেনি। মুখ রাখতে অভী পাসপোর্ট অ্যাপ্লাই করে দিয়েছিল অবশ্য। রান্না-
সিনেমা- খুনসুটির সংসারটা জমে গেল টুকান আসাতে। তিনজনের এই সুখের সংসার পরিবারের
সকলের আনন্দের কারণ।
দুমাস বাদে
টুকানের জন্মদিন। টুকানের দুবছর পূর্তি উপলক্ষ্যে একটা গ্র্যাণ্ড পার্টি দেবার
ইচ্ছে অভীর। প্রথম জন্মদিনের সময় বাবা খুব অসুস্থ ছিলেন বলে সেভাবে পালন করা যায়
নি। তাই এবারের প্ল্যানটা দিয়ে অনিরিনাকে চমকে দেবে ভেবেছিল অভী। কিন্তু চমকটা দিল
অনিরিনাই – ‘টুকানের জন্মদিনে তোমাদের দুজনকে আমি এই ট্যুরটা উপহার দিলাম।’ যাদুকরীদের মতো ঝুলি থেকে একে একে বের করে ভিসা
টিকিট আর ট্যুরপ্রোগ্রাম !
‘আমি ভুলিনি গো,
আমি এই কবছরে টাকা জমিয়েছি, আর বাকী করেছে গুগলভাই। তোমরা শুধু দুটিতে প্লেনে উঠে
পড়বে, ব্যস।’
তারপরের কটা দিন
কেটে গেল বিবিধ ব্যস্ততায়, গোছগাছে আরও নানাবিধ তাণ্ডবে। প্লেনে বসে অভী জিজ্ঞাসা করে,
‘এবার বলতো, এত জায়গা থাকতে নিউজীল্যান্ড কেন ?’ অনেকক্ষণ চুপ করে রইল অনিরিনা।
এই প্রথম সে জবাব দিতে এত সময় নিল – ‘তোমায় মিথ্যে বলব না। আমি সত্যি এর কারণ
জানি না। ছোট থেকেই নিউজীল্যান্ডের ম্যাপটা আমায় ভীষণভাবে টানে। গুগলে যখন ওখানকার
ছবি দেখি, তখন কিছু জায়গা খুব চেনা লাগে, যেন আমায় ডাকে। বললে সবাই হাসে, কিন্তু
কেমন করে যেন আমি জানি, ওদেশে আমায় যেতেই হবে’ – অভী তার বৌয়ের মাথায় হাত রাখে
গভীর মমতায়। তাকিয়ে দেখে, বৌয়ের ওই ছেলেমানুষী-ভরা চোখদুটো ছলছলিয়ে উঠেছে।
পনেরদিনের ট্রিপ।
নিউজীল্যান্ডে নেমে এসব ভাববিলাসের কথা মাথাতেই রইল না কারো। নতুন দেশ তার সবুজ
সৌন্দর্য নিয়ে ওদের তিনজনকেই মাতিয়ে দিল। একবার ঠাট্টাও করল অভী,-‘কোনখানটা তোমার
চেনা লাগছে গো?’ অনিরিনা হেসেই আকুল,- ‘ভাগ্যে ওই ছেলেমানুষি আবেগটা ছিল, নয়ত এত
সুন্দর দেশটা দেখাই হত না আমাদের !’
চমকটা এল
অপ্রত্যাশিতভাবে। ফুলে ঘেরা এক হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলছিল ওদের গাড়ী – পাল্লা দিয়ে
তার পাশ দিয়ে ছুটছে এক নদী। নদীর ওপারে সবুজ ঘাসে ঢাকা এক মাঠের মাঝে একটিমাত্র
বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে একা। হঠাৎ অনিরিনা চেপে ধরল অভীর হাত। ‘থাম, থাম, একটু দেখি।‘
গাড়ী থেকে নেমে কিছুটা সময় মোহগ্রস্থের মত দাঁডিয়ে থাকে অনিরিনা। অস্ফুটে বলে, ‘এই
রাস্তা থেকে নেমে গেলে একটা সরু পথ, সেই পথের শেষে সাঁকো, তারপর...’ অভী আর টুকান
অনিরিনার পিছু পিছু চলে। হাইওয়ে থেকে নীচে নামতেই পথটা চোখে পড়ল। পথটা ডানদিকে
ঘুরে যেতেই ফুলের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সাঁকোটা উঁকি দেয়। সাঁকোটা পেরিয়ে
এবার ছুটতে থাকে অনিরিনা। দুচোখে তার কিসের এক ঘোর। সোজা গিয়ে দাঁড়ায় বন্ধ দরজার
সামনে। বেল বাজায় না কিন্তু। আস্তে করে ডাকে ‘জন, জন!‘ দরজা খুলে বেরিয়ে আসে এক
মধ্যবয়স্ক পুরুষ।
অনিরিনাকে দেখে
সে অবাক হয়, কিন্তু তা দেখার মত ধৈর্য্য কোথায় সে মেয়ের। যে ছিল তার স্বপ্নে, যার
প্রাণের আকুল ডাক তাকে চিরকাল এক অদৃশ্য বাঁধনে বেঁধেছে – আর আজ তাকে টেনে এনেছে
সেই সত্যের মুখোমুখি;- তার সামনে দাঁড়িয়ে
খুব সহজেই সে দেশ, কাল, অতীত, বর্তমানের সীমানা পার হয়ে চলে গেল। জনের দুহাত ধরে
ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সে বলেই চলল, বলেই চলল। আর সেই কথার মায়ায়. ওর উপস্থিতির তীব্রতায় কেমন যেন বদলে
যেতে থাকল পুরুষটির মুখের ভাব। এবার সে অনিরিনাকে একদৃষ্টে অনেকক্ষণ ধরে দেখে।
অনিরিনার হাত ধরে সেও যেন সময়কে অতিক্রম করে যায়। কোন সুদূর অতীত আজ গতজন্মের
পর্দা সরিয়ে বড় স্পষ্ট হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। দুজনের মাঝখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে
থাকে বর্তমান। এবার জন কথা বলে ওঠে এক অজানা ভাষায়। অনিরিনাও উত্তর দিল সেই
ভাষাতেই! আর একবারও পিছন ফিরে তাকায় না অনিরিনা। জনকে জড়িয়ে ধরে সে ভিতরে চলে
যায়।
অভী এতক্ষণ অবাক
হয়ে দেখছিল। একটু দূরে থাকায় সে ওদের কথোপকথন শুনতে পায় নি। কাছে আসল যখন, তখন যে
ভাষা শুনল, তার বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারল না সে। এ ভাষা কোথায়, কবে শিখল অনিরিনা?
বাংলা আর ইংরাজীর বাইরে হিন্দীটুকুও জানে না যে মেয়ে?
টুকান বলে – ‘মা
কোথায় গেল বাপি ?’ চমক ভেঙে ছেলের হাত ধরে দরজায় এসে দাঁড়ায় অভী। দেখে জন এবং
অনিরিনা দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে এক বিচিত্র ভাষায় কথা বলে চলেছে। দেখে মনে হচ্ছে
এই ঘর এই বাড়ি অনিরিনা বড় পরিচিত। একটা টুলে উঠে ওপরের তাক থেকে একটা ছোট কৌটো বার
করে এনে সে জনের হাতে দেয়।
টুকান দৌড়ে এসে
মায়ের হাত ধরে, কিন্তু মার চোখে সেই পরিচিত দৃষ্টি কই ? বরং টুকানকে দেখে সে ভারী
অবাক হয়ে যায়। যেন টুকানকে সে চেনে না, অথবা টুকানের যেন এখানে আসার কথা ছিল না।
আর সহ্য হয় না টুকানের, সে ‘মা,মা’করে কেঁদে ওঠে। জনের চটকা ভেঙে যায়। এতক্ষণ
ধরে যে হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলো মূর্ত হয়েছিলো, তারা ছিঁড়েখুঁড়ে কোথায় মিলিয়ে
যেতে থাকে। তবু তাদের ধরে রাখার এক নিষ্ফলা চেষ্টায় সে অভীর কাছে তার পরিচয় জানতে
চায়। সব শুনে ম্লান হেসে ইংরাজীতেই বলে এবার – ‘সময় ফেরান যায় না।‘ জন টের পায়,
এবারেও তাকে পেয়ে হারাতে আগের বারের মতোই। টুকানের কান্নায় অনিরিনাও যেন ঘুম থেকে জেগে
ওঠে। সে একবার জনের দিকে তাকায়, একবার অভীর দিকে। বিদীর্ণ হতে থাকে দ্বিধায়। এই
জন্ম নাকি আগের জন্ম? কি করবে সে এই দুই
কালের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে? অবশেষে তার দৃষ্টি স্থির হয় টুকানের ওপর। ওর মাথায় হাত
রেখে বলে, ‘অভী আমায় একটু সময় দাও। তারপর আমি ফিরে আসছি।’ অভী গাড়ীতে বসে
অপেক্ষা করে। অনিরিনা এলে ওরা চলে যাবে সামনের পথ ধরে।
No comments:
Post a Comment