চোখ বুজলেই
আজও সেই ছোট্ট মেয়েটাকে দেখতে পাই। দু’ হাতে বাবা মায়ের হাত ধরে ঝুলতে ঝুলতে ঠাকুর
দেখতে যাচ্ছে। ভীড় শুরু হলেই বাবার কাঁধে। বাবার কাঁধটা কত্তো উঁচুতে! এবার সব
দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। তবুও প্যান্ডেল থেকে বেরোলে ঘামে মুখ জবজবে। মা তাড়াতাড়ি আঁচল
দিয়ে মুখটা মুছিয়ে দেয়। নতুন শাড়ি আর সেন্টের গন্ধে আমার নাকমুখ ভরে ওঠে। আবার
নাচতে নাচতে পথ চলি।
আবার গরমের
দুপুরে মায়ের আঁচলটা আঙুলে পাকিয়ে নাকের কাছে নিলেই রাজ্যের ঘুম চোখে নেমে আসে। মায়ের গায়ের গন্ধটা কি মিষ্টি! হাতটা কী নরম আর ঠাণ্ডা!
মাথায় হাত দিলেই সব ছটফটানি শান্ত হয়ে যায়।
একটু বড় হতেই
কিভাবে যেন ছবিগুলো বদলে যেতে লাগলো। ঠিক কবে থেকে মায়ের আঁচলের বদলে বাবার পকেটের
রুমালে ঘাম মোছা শুরু হল আমার? আর কবে থেকেই বা দুপুরে ঘুম আসে না বলে সাদা খাতার
পাতাগুলো অঙ্কে ভরে যেতে লাগলো? একটা টুকটুকে ছোট্ট ভাই বাড়িতে আসার কতদিন পরের
ঘটনা এগুলো?
খুব খারাপ
এরকম মনে হওয়াটা – সেটা আমি জানি। মা হয়তো সংসারের চাপ, একটা শিশুর দেখাশোনা – সব
মিলিয়ে আর সময় ম্যানেজ করতে পারত না। কিন্তু আমার জ্বর হলে মা-ই তো পাশে বসে মাথায়
ঠাণ্ডা হাত বুলিয়ে দিত, রাত জাগত। আর আমার ইচ্ছে করত আরও বেশিদিন থাকুক জ্বর;
কাশির দমকটা আরেকটু বেশি না হয় হলোই বা। তাহলে? হয়তো এত কথা আমার মনেই আসতো না,
যদি সেদিন মা আর জেম্মার কথা আড়াল থেকে শুনে না ফেলতাম! জেম্মা বলছিল,
-
তুই খুব
ভাগ্যবতী রে লীনা, বংশের প্রদীপ জ্বেলেছিস। আর আমায় দেখ। ছেলে ছেলে কর হেদিয়ে আজ
আমার তিন তিনটে মেয়ে!
মা, হ্যাঁ
গলাটা আমার মায়েরই ছিল। আহ্লাদে, খুশিতে, তৃপ্ত গলা।
-
আমারও খুব ভয়
ছিল জানো বড়দি। যদি আবার মেয়ে হয়! অনেক মানত করেছিলাম। ভগবান তাই হয়তো মুখ তুলে
চেয়েছেন।
তাই মা পাশে
বসলে জ্বর গায়েও জোর করে হাসি ফুটিয়ে বলতাম – আর মাথায় হাত বোলাতে হবে না মা। তুমি
এবার কাজ সেরে নাও। আমি ভালো আছি। অথচ মনে মনে প্রচণ্ডভাবে চাইতাম, মা একবার বলুক –
মার সব কাজের চেয়ে আমি বড়! অথচ নিশ্চিন্ত
হয়ে মা কাজে চলে যেত।
পুজোর সময় দু
ভাইবোনেরই নতুন জামা আসত। কিন্তু মা যেদিন এমনি বাজারে দোকানে যেত, তখন? পথে একটা
খেলনা গাড়ি,কিম্বা বেলুন নয়তো একটা চিপসের প্যাকেট চোখে পড়লে কিনে এনে ভাইয়ের হাতে
দিত। মুখে বলত অবশ্য দুজনে ভাগ করে নেবে – কিন্তু কোনদিন আমার হাতে প্রথমে তুলে
দিত না। জানো মা, কতদিন ভেবেছি, মা যদি আমার হাতে আগে দেয়, তাহলে সেই খুশিতে আমি
পুরোটা ভাইকে দিয়ে দেব। তেমন উদার হবাার সুযোগ আর হল কই আমার?
মা খেয়াল না
করলেও বাবা বুঝত। তাই রাতে আমি একলা শুতে চাইলে অনায়াসে বলে উঠত – ওরে বাপরে! আমার
যে আবার একলা শুলে ঘুম আসে না। ভাই তো মায়ের কাছে শোয়। তুই অন্তত আমার কাছে শো।
সে বয়েসটা এত
কিছু বোঝার বয়েস নয়। সেই ন-দশ বছরের ভয়ঙ্কর অভিমানী আর জেদী মেয়েটা তাই বাবাকে ঘুম
পাড়াতে এসে নিজেই বাবার গলা জড়িয়ে বুকে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ত এক নিমেষে।
যতই বড়
হচ্ছিলাম, ততই দূরে সরে যাচ্ছিলাম মায়ের থেকে। কোন ঝগড়া বিবাদ ছাড়াও, নিত্যকার
জীবনে পাশাপাশি থেকেও যে কতদূরে যাওয়া যায়, তা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না!
প্রাণপণে সবটুকু আবেগ আর নির্ভরতা দিয়ে বাবাকে
জড়িয়ে ধরছিলাম। বাবা শুধু আমার মাথার উপরই হাত রাখত না, জীবনের পথে এগিয়ে যাবার
সাহসও জোগাত।
দিন যায় দিনের
নিয়মে। আমি বড় হতে থাকি। ডিগ্রী জমে। চাকরি আসে। তারপর বিয়ে। একে একে জীবনের অনেকগুলো
ধাপ পেরিয়ে যাই। বাইরের জগতের অত্যন্ত সফল এক নারীর মধ্যে সেই ছোট্ট বাবার কোলে
চড়া শিশুটি যে বেঁচে থাকে তার খবর বাইরের কেউ রাখে না। এমন কি আমারও সবসময় মনে পড়ে
না।
মা হলাম একদিন। একটা ছোট্ট ডলপুতুলের
মতো মেয়ের মা ডাকে উত্তাল হলাম। সুখের সপ্তম স্বর্গে চড়ে দিন কাটছিল। কিন্তু চারপাশটা
খুব দ্রুত পালটাতে লাগল।
-
“একে মেয়ে,
তাহে শ্যামলা - ”
-
“ শুধু
লক্ষ্মীকে নিয়ে এলেই চলবে না বৌমা, এর পরের বার যেন ঘরে নারায়ণ আসেন - ”
বহুযুগের ওপার
হতে শব্দগুলো আবার ফিরে এলো একটু রং বদল করে। দুহাতে জড়িয়ে ধরলাম মেয়েকে। কানে কানে বললাম – কেউ আসবে না। শুধু তুই। তুই
যে আমার নাড়িছেঁড়া ধন।
আমার মেয়ে
টিনি যখন বছর তিনের, তখন তিনদিনের জ্বরে হঠাৎ করেই আমার বাবা নেই হয়ে গেলেন!
দেবীপক্ষের পঞ্চমীতে সারা বাংলা যখন উৎসবে রঙিন - আমাদের বাড়িতে
তখন অমাবস্যার অন্ধকার। পৃথিবী নিজের আবর্তনছন্দে ঘুরতে থাকে বলেই দিন যায়, রাত
আসে, আবার সকাল হয়। আমার দিন আটকে থাকে পঞ্চমীতেই।
সেদিনটা ছিল
লক্ষ্মীপুজোর সন্ধ্যা। চারপাশের বাড়িগুলো থেকে শাঁখের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ধূপধুনোর
গন্ধ ভেসে আসছে হাওয়ায়। আমাদের বাড়ির উঠোনটা
কোজাগরী পূর্ণিমার আলোয় থৈ থৈ। স্থলপদ্মরা গাছেই রয়ে গেছে। এ বছর কেউ তোলেনি
তাদের। অন্যবছরের কথা খুব মনে পড়ছে। আজ আমি বলেছি আমি বাবার পড়ার ঘরে শোব। একা।
ঘরটা আমায় আজ বড় টানছে। মা একটু আপত্তি করছিল। আমি শুনিনি। টিনি এ বাড়িতে এলে তার
দাদুদিদার কাছেই শোয়। মানে এখন দিদার কাছে। ওঃ। এই ছোট ছোট বদলগুলো যে কী ভয়ঙ্কর!
অন্যদিনের
চেয়ে একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়লাম দরজা বন্ধ করে।একটু একা থাকতে চাইছিলাম। সামনের
দেওয়ালে বাবার একটা বড় ছবি টাঙানো হয়েছে। শান্ত গম্ভীর মুখ। গভীর দুটি চোখ যেন আমার
দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। আমার দু চোখ বেয়ে অঝোরে জল নামল – তোমায় ছেড়ে থাকতে
পারছি না বাবা। তোমার কাছে যেতে চাই। বাবা.......
লাইট নিভিয়ে
দিয়েছি। জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে বাবার মুখের ওপর। আমি মোহাবিষ্টের মতো
বাবাকে ডেকে যাচ্ছি। মনটাকে দুই ভুরুর মধ্যে একাগ্র করার চেষ্টা করছি। কে এমন করতে
বলছে জানিনা। শুধু মনে হচ্ছে এরকমটাই করতে হবে। দুচোখ বন্ধ হয়ে এল।শুধু মনের মধ্যে
বাবার মুখ জেগে আছে। ধীরে ধীরে চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সারা পৃথিবীতে কোন আওয়াজ
নেই।ঘরটা কেমন যেন হিম হিম। ঠাণ্ডাটা কি ক্রমশঃ বাড়ছে? বাড়ুক। আমি কিছুতেই চোখ
খুলব না। কিন্তু চোখ না খুলেও বুঝতে পারছি শব্দহীন এক অন্ধকার ঘিরে ধরেছে আমায়।
সময় থেমে গেছে। কারণ দেওয়াল-ঘড়িটার টিক টিক আওয়াজটাও আর নেই। এমন সময় –
একটা হালকা পায়ের
আওয়াজ। এ আওয়াজ আমার
খুব চেনা। উঠোন পেরিয়ে,ঘরের দরজা পার হয়ে
এগিয়ে আসছে সেই ধীর নিশ্চিত পদক্ষেপ। আমার বুকের মধ্যে তার প্রতিধ্বনি। আমার দম আটকে আসছে।
আমি কিছুতেই চোখ খুলব না। দরজার পর্যন্ত এসে পায়ের আওয়াজ থেমে গেল। আবার স্তব্ধতা।
অথচ দরজার ওপারে একটা উপস্থিতি আমার সমস্ত রোমকূপ দিয়ে অনুভব করতে পারছি। ঘরের
তাপমাত্রা এখন আরও অনেক কম।
ধীরে ধীরে চোখ
খুললাম। চারপাশ ঘন অন্ধকারে ডুবে আছে। আজ যে পূর্ণিমা, সেটা জানা সত্ত্বেও অবাক
হচ্ছি না। যেন এমনটাই হবার কথা ছিল। আলো জ্বললেই মিলিয়ে যাবে সব। এতক্ষণের আহ্বান
মিথ্যে হয়ে যাবে। আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে নামলাম। দরজাটা খুলতে হবে এবার। আমার
মাথার মধ্যে কেউ বলে দিচ্ছে দুই পৃথিবীর মাঝে শুধু এই দরজাটার ব্যবধান। এগোতে যাব,
এমন সময় চারদিকের নৈশব্দ্য খান খান করে টিনির রিনরিনে গলাটা আছড়ে পড়ল – মা কই, আমি
মায়ের কাছে যাব!
এবার মাথার
ভিতরের স্বর আরও স্পষ্ট আরও শান্ত।
-
সুইচবোর্ডটা দরজার
পাশেই। তোমাকেই ঠিক করে নিতে হবে তুমি কী চাও।
খুব সিরিয়াস কথায় তুই থেকে তুমিতে এই উত্তরণের সঙ্গে আমার
আজন্ম পরিচয়।
আমার দুচোখ
জলে ভেসে যাচ্ছে। কী করব আমি এখন? আলো জ্বেলে চেনা জগতে ফিরব, নাকি দরজা খুলে
বাবার সাথে চলে যাব চিরদিনের মতো?
দরজার ছিটকিনিতে আমার হাত। বহুদূর থেকে টিনির
অস্ফুট স্বর ভেসে এল আবারও। আমার মাথা থেকে পা অবধি যেন বিদ্যুত তরঙ্গ চলে গেল।
আমার জন্য বাবা ছিল সারাজীবন। টিনির জন্য কে রইল? হাত নামিয়ে সুইচ অন করলাম। আলোয়
ভেসে গেল সারা ঘর। কিনতু আমি ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না। চোখের জলে সব ঝাপসা।
ঘরের আবহাওয়া
ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। জানলার বাইরে চাঁদের আলো ফিরে এসেছে আবার। শুধু বাবার
যে উপস্থিতি অনুভব করছিলাম, তা আর কোত্থাও নেই।
সত্যিই নেই?
জলভরা চোখে বাবার ছবির দিকে তাকালাম। মুখের এই হালকা হাসির ভাবটা আগে ছিল কি?
গম্ভীর চোখদুটোতে এত প্রসন্নতা? আমি নিশ্চিত, আগে এটা ছিল না। আমি পরীক্ষায় ভালো
ফল করলে এই প্রসন্ন চোখ দেখেছি কতবার। তুমি চিরকাল আমার পাশেই থাকবে বাবা। আমি
বুঝে গেছি।
No comments:
Post a Comment