ছলাৎ
ছল ছলাৎ ছল
গল্প
বলে নদীর জল.....
কেন
কে জানে, আজকাল নদীর ধারে এসে বসলেই তার এই দুটো লাইন মনে পড়ে। বহু চেষ্টা করেও
কিছুতেই মনে করতে পারে না, এটা সে কোথাও পড়েছে না কি তার মনেরই গভীর গহন কোনো কোণ
থেকে উঠে আসছে এই লাইন দুটি? কিছু কি গল্প বলে এই নদী, নাকি এতো জানে বলেই নদী কথা
বলে না.......
আজকাল বড় উজানে যেতে ইচ্ছে করে
দীপশিখার। জীবনের পঞ্চাশটা বছর পার করে আসার পরে আর তা সম্ভব কিনা জানে না
দীপশিখা। আর আজও তাকে বহ্নিশিখা বলে ডাকে যে মানুষটি, তার মায়ার বাঁধন ছাড়িয়ে চলে
যাওয়াটা কি আদৌ প্রার্থনীয়? যতক্ষণ ঘরে থাকে ততক্ষণই এইসব যুক্তির টানাপোড়েন,
ঋত্বিকের জন্য খাবার বানানো, ঘর গোছানো, এমন কি কপালের টিপও – কিন্তু যেই নদীর
ধারে এসে বসে, ওমনি আবছা হয়ে আসে বর্তমান, তীব্র হয়ে ওঠে উজানে যাবার আহ্বান।
যখন ছোট ছিল, বিকেলে বাড়ি ফিরে ‘মা’
‘মা’ ডাক ছিল, রাতে খেতে যাবার আগে বাবা-মা-ভাইয়ের সাথে একদান লুডো খেলা ছিল – তখন
সেই দিনগুলোয় একবার দীঘায় বেড়াতে যাওয়া হয়েছিল। মা সেখানে কুড়িয়ে পেয়েছিল একটা
জলশঙ্খ। ওদের ভাই বোনের হাতে দিয়ে বলেছিল, ‘কানে দিয়ে শোন দেখি।‘ বাড়ি ফিরেও মাঝে
মাঝেই সেটা কানে দিত ভাইবোনে। আর দীঘার সমুদ্রগর্জন ফিরে ফিরে আসত। আর শিখা, একা
শিখাই জানত, জলশঙ্খ কানে দিলে শোনা যায় আরো অনেক কিছু – প্রিয় কথা, প্রিয় স্মৃতি,
প্রিয় শব্দেরা ফিরে ফিরে আসে।
সেই সব শব্দ শুনতে শুনতে, চলতে ফিরতে
কত কত দিন যেন চলে যায় – সাথে নিয়ে চলে যায় দীপশিখার শৈশব, বাবা, মা – আরো কত
কিছু। খুব মন খারাপের মুহূর্তে কানে চেপে ধরে জলশঙ্খটা – হারিয়ে যাওয়া টুকরো কথা,
টুকরো হাসি, সমুদ্রের ডাকের সাথে মিলেমিশে কানের পর্দায় বেজে ওঠে। চোখ বন্ধ করলেই
কিশোরীবেলার লাবডুব লাবডুব, কাশবনের সরসরানি, দু হাত ছড়িয়ে আলপথ দিয়ে দৌড়ে চলার
দোলা, দূর থেকে ভেসে আসা মায়ের ডাক এমনি আরো অনেক কিছু।
বেশ কিছুদিন হল, জলশঙ্খটা খুঁজে পাচ্ছে
না দীপশিখা। নদীর ঢেউয়ের মাথায় মাথায় এখন তার মনকথারা টুকরো টুকরো হয়ে এদিক ওদিক
ছিটিয়ে থাকে।
ছুটি থাকলেই ঋত্বিক দীপশিখাকে নিয়ে
বাইক ছুটিয়ে দেয়। রক্তে গতির মাতন লাগে। শালবনের রোদছায়াতে, পলাশের হোলিখেলায়
কিম্বা পথের ধারে খেজুর রস পাক দেবার গন্ধ মেখে সব ঋতুতেই রাস্তা চিরে উড়ে চলে
দুজনে। তেমনই এক ঘুরনবেলায় ওরা এসেছিল তিলপাড়া ব্যারেজের দিকে। শীতের দুপুরের মিঠে
নরম রোদ মেখে নদীর ধার ধরে হেঁটে যাচ্ছিল দুজনে।
-
‘জানো, আমাদের বাড়ী থেকে এই ব্যারেজের
জল দেখা যেত। আর ছাদে উঠলে তো আরও ভালো করে...’
-
‘হুঁ, তোমাদের বাড়ীটা এখান থেকে ওইদিকে
হবার কথা। এখন কত বাড়ী হয়ে গেছে তার আশেপাশে! সে বাড়ীটায় এখন কারা আছে জান?’
-
-
‘ আরে ঋত্বিক না? তুই এখানে?’
হঠাৎ দেখা বাল্যবন্ধুর আলিঙ্গনে চমকে
ওঠে একঝলক খুশি। দূরে আরেক বন্ধু দাঁড়িয়ে।
-
‘একটু দেখা করে আসছি গো, তুমি এখানেই
থেকো।‘
-
মাথা হেলাতেই সে একদম একলা। সামনে শুধু
নদী – যে কথা বলে না। সত্যিই কি বলে না?
-‘ কি হলো বলতো সেই বাড়িটার?’ –
ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করে শিখা।
-‘গিয়েই দেখো, গিয়েই দেখো’ – ছলাৎ ছল
করে এটাই কি বলল নদী?
-‘কোনদিকে যেন.....’
-‘যেদিক খুশি যেদিক খুশি’.....
ঠিকই তো। পৌঁছানো নিয়ে কথা। দিক ভেবে
কি লাভ? পায়ে পায়ে যতই এগিয়ে যায় দীপশিখা, ততই স্পষ্ট হয়ে ওঠে পথের রেখা। চলতে
চলতে পায়ের জোর বাড়ে। মাঠের পরে মাঠ পার হয়ে যায়। পায়ের তলা ভিজে ওঠে – পা ছপছপ –
হাঁটু ছুঁইমুই জল – ঐ তো উঠোনের পিছনের আমগাছটা। উঠোনের ছোট্ট পাঁচিলটার ওপারে মা
ধোয়া কাপড় মেলছে – শাড়ির আড়ালে বছর পঞ্চান্নর এক রোগা রোগা পানপাতা হাসিমুখ – ‘ এলি?
এতো তাড়াতাড়ি?’
একলাফে কিশোরী শিখা পাঁচিল টপকে
মুখোমুখি – ‘এলামই তো। তাড়াতাড়ি কোথায়? কতদিন বাদে বলোতো?’ অভিমানে ঠোঁট ফুলে ওঠে
বুঝি। এই হৈ চৈয়ের আওয়াজেই বোধকরি ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে এক বড় পরিচিত
হাসিমুখ।
- ‘বাবা?’
-‘আয়’
-
এ ডাকটুকুরই অপেক্ষা ছিল। আহ্লাদে গলে জল হয়ে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিখা।
পরম প্রশ্রয়ে ওর চুলে বিলি কাটতে থাকেন মা। বহুদিনের তপ্ত খরার পরে দেহ-মন-প্রাণ
যেন জলের স্পর্শ পায়! হাঁটু ছাড়িয়ে কোমর, বুক, চুল – সব ভিজে সপসপ। দুচোখ বন্ধ করে আদর খেতে
থাকে শিখা – কত্তোদিন পরে!
No comments:
Post a Comment